মুনিয়ার মৃত্যু : এক বছরেও ‘ধর্ষণ ও খুনের’ মামলার কোন অগ্রগতি নেই

বিচারের দাবিতে কুমিল্লায় মানববন্ধন

কলেজছাত্রী মোসারাত মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে আদালতে যে মামলা হয়েছিল সে মামলার আসামিদের এক বছরেও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। এমনকি মামলার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করারও প্রয়োজন মনে করেনি। মামলার প্রধান আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরসহ অন্যরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ব্যাপারে কোন পদক্ষেণ নেয়নি।

গত বছরের ২৫ এপ্রিল বসুন্ধরার এমডির ভাড়া করে দেয়া একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়। ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লেখা ডায়েরিসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে গুলশান থানা পুলিশ। পরে আত্মহত্যা করেছে দাবি করে পুলিশ মামলা নিলেও সেই মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী হিসেবে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামি করা হয়। কিন্তু পুলিশ তখন আনভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ বা আটক করেনি। এক মাস পর পুলিশ আনভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অভিযোগ থেকে অব্যহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

এরপর গত ৬ সেপ্টেম্বর কলেজছাত্রী মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এ ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে মুনিয়ার সঙ্গে গুলশান ও বনানীর ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রীর মতো আনভীরের বসবাস ও পরবর্তীতে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ করা হয়।

মামলায় মুনিয়ার প্রেমিক সায়েম সোবহান আনভীরকে প্রধান আসামি করা হয়। এছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম এবং আরও ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তারা হলেনÑ শাহ আলমের স্ত্রী আফরোজা বেগম, আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা সায়েম, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, সাফিয়া রহমান মিম, ইব্রাহিম আহমেদ রিপন ও তার স্ত্রী শারমিন। আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত করার দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে সর্বশেষ তারিখ ছিল গত ২০ এপ্রিল। কিন্তু প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ফের সময় নেয় তদন্তকারী সংস্থা।

পিবিআই মামলার তদন্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর চলতি বছরের গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি সাইফা রহমান মীমকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে তিনি কারগারে আছেন। ঘটনার পর দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন মীম। তিনি নিজেকে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবি করেন। মুনিয়ার সঙ্গে মোবাইল কলে এমন দাবি করতে শোনা গেছে। চট্টগ্রামের হুইপপুত্র শারুনের স্ত্রী ছিলেন এই মীম। এর আগে মুনিয়ার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় আরেক আসামি ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে, যিনি র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে মাদক মামলায় কারাগারে ছিলেন। পিয়াসাকে তিনদিনের রিমান্ডেও নিয়েছিল পিবিআই। সম্প্রতি এই আসামি জামিন পেয়েছেন। তবে মীম ও পিয়াসা ছাড়া মূল আসামি আনভীর ও তার পরিবারের সদস্য আসামিদের গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ পুলিশ নেয়নি।

মামলার বাদী মুনিয়ার বড় বোন নুসরাতের অভিযোগ পুলিশের আন্তরিকতা অভাবের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এই মৃত্যুর রহস্য উšে§াচনে ভিকটিমের প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ আসামিদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। কার দ্বারা ভিকটিম দুই-তিন সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, তা শনাক্ত করতে প্রধান আসামির ডিএনএ টেস্টসহ ফরেনসিক পরীক্ষার উদ্যেগ নেয়নি পুলিশ। আলোচিত মামলার আসামি হয়ে জামিন না নিয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেশির ভাগ আসামি। দীর্ঘ এক বছরেও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না থাকায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এ পর্যন্ত ১১ বার আদালত থেকে সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আনভীরের বিদেশযাত্রার ওপর শুনানির তারিখও বারবার ঘুরছে বলে জানিয়েছেন ভিকটিম মুনিয়ার বড় বোন ও মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া।

তিনি বলছেন, ৮ আসামির মধ্যে শুধু সাইফা মীমকে গ্রেপ্তারেই এক বছর পার করেছে পুলিশ। তদন্তের নামে যেন তামাশা চলছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমার বোন মুনিয়াকে এক বছর আগে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো। এক বছর ধরে পুলিশ তদন্ত করছে। অথচ আনভীরসহ আসামিরা জামিন না নিয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তদন্তের কোন অগ্রগতি নেই। তদন্তের নামে যেন তামাশা হচ্ছে। এত বড় অপরাধ করেও যদি কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকে, তাহলে সেটি নিয়ে সবার মাঝে প্রশ্ন উঠবেই। আমি আমার বোন হত্যার ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি করতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাবো।

তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক গোলাম মোক্তার আশ্রাফ উদ্দিন দাবি করেছেন, মুনিয়া মামলার তদন্ত কার্যক্রম থেমে নেই। অনেক তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফলে তদন্তে অগ্রগতি নেই বলা যাবে না।

মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা পুলিশ সুপার আহসান হাবিব পলাশ জানান, পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। যেসব তথ্য পেয়েছে সেইসব তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চলমান রয়েছে।

বাদী পক্ষের আইনজীবী মো. মাসুদ সালাহউদ্দিন বলছেন, এটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলা। ট্রাইব্যুনালের মামলার তদন্তের জন্য সর্বোচ্চ ১২০ দিন নেয়ার কথা আইনে বলা আছে। এ ক্ষেত্রে বিগত এক বছরে ১১ বার সময় নিয়ে আইনের লঙ্ঘন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছেন মুনিয়া মিরপুরের একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা মৃত শফিকুর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কুমিল্লা সদরের দক্ষিণপাড়া উজির দিঘি এলাকায় তার পৈত্রিক বাড়ি। একটি অনুষ্ঠানে মুনিয়ার ওপর নজর পড়ে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের। এরপর বিয়ের আশ্বাস দিয়ে মুনিয়ার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে শুরু করে তারা। প্রথমে বনানীতে মুনিয়াকে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে দেয় আনভীর। সেই ফ্ল্যাটের ভাড়া আনভীর পরিশোধ করতেন। পরে আনভীরের মা মুনিয়াকে মডেল পিয়াসার মাধ্যমে ডেকে নিয়ে আনভীরে সঙ্গ ত্যাগ করে ঢাকা ছাড়তে বলেন। আনভীরের মায়ের হুমকিতে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর পুনরায় মুনিয়াকে ঢাকায় নিয়ে আসেন আনভীর। গুলশান দুই নম্বর এভিনিউর ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর প্ল­টের বি/৩ ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে মুনিয়াকে সেখানে তোলেন। ওই বাসায় আনভীরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

কুমিল্লায় বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যাকা-ে জড়িতদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কুমিল্ল­ায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়েছে। এ সময় মামলার প্রধান আসামি ও ভিকটিমের প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করার আহ্বান জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বজনরা। দীর্ঘ এক বছরেও মামলার তদন্তে অগ্রগতি না হওয়া ও আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের অনীহায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।

বহুল আলোচিত মুনিয়ার হত্যার এক বছর উপলক্ষে গতকাল সকালে কুমিল্ল­া শহরের ছাতিপট্টিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিসের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে এই দাবি জানানো হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কুমিল্ল­া জেলা ইউনিট আয়োজিত এ কর্মসূচিতে নিহত মুনিয়ার স্বজন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় মানুষ অংশ নেন। পরে ছাতিপট্টি মসজিদে কোরআন খতম ও বাদ জোহর দোয়া পড়ানো হয়। বিকেল ৪টায় পূবালী চত্বরে নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেয়া কুমিল্ল­ার বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, নিহত মুনিয়ার বাবা শফিকুর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। তার কন্যাকে বিয়ের নামে প্রলোভন দেখিয়ে ভোগ করার পর পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বসুন্ধরা গ্রপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর ও তার সহযোগীরা। মুনিয়ার দুই-তিন সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি ময়নাতদন্তসহ ফরেনসিক পরীক্ষায় উঠে এসেছে।

বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অথচ চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও প্রধান আসামি আনভীর, তার পরিবারের সদস্য ও সহযোগী আসামিদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। আসামিপক্ষ আর্থিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের গ্রেপ্তারে আন্তরিক নয় তদন্ত সংস্থা। তদন্তের নামে পুলিশ যেন তামাশা করছে। মুনিয়া হত্যার ন্যায়বিচার বাংলার মাটিতে হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা। এত বড় অপরাধ করেও শুধু টাকার জোরে রেহাই পেলে দেশে আইনের শাসনের জন্য সেটি শুভকর বার্তা বয়ে আনবে না, যোগ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

বুধবার, ২৭ এপ্রিল ২০২২ , ১৪ বৈশাখ ১৪২৮ ২৫ রমাদ্বান ১৪৪৩

মুনিয়ার মৃত্যু : এক বছরেও ‘ধর্ষণ ও খুনের’ মামলার কোন অগ্রগতি নেই

বিচারের দাবিতে কুমিল্লায় মানববন্ধন

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

কুমিল্লা : মুনিয়ার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন -সংবাদ

কলেজছাত্রী মোসারাত মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে আদালতে যে মামলা হয়েছিল সে মামলার আসামিদের এক বছরেও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। এমনকি মামলার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করারও প্রয়োজন মনে করেনি। মামলার প্রধান আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরসহ অন্যরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ব্যাপারে কোন পদক্ষেণ নেয়নি।

গত বছরের ২৫ এপ্রিল বসুন্ধরার এমডির ভাড়া করে দেয়া একটি ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়। ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লেখা ডায়েরিসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে গুলশান থানা পুলিশ। পরে আত্মহত্যা করেছে দাবি করে পুলিশ মামলা নিলেও সেই মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী হিসেবে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামি করা হয়। কিন্তু পুলিশ তখন আনভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ বা আটক করেনি। এক মাস পর পুলিশ আনভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অভিযোগ থেকে অব্যহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

এরপর গত ৬ সেপ্টেম্বর কলেজছাত্রী মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এ ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে মুনিয়ার সঙ্গে গুলশান ও বনানীর ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রীর মতো আনভীরের বসবাস ও পরবর্তীতে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ করা হয়।

মামলায় মুনিয়ার প্রেমিক সায়েম সোবহান আনভীরকে প্রধান আসামি করা হয়। এছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম এবং আরও ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তারা হলেনÑ শাহ আলমের স্ত্রী আফরোজা বেগম, আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা সায়েম, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, সাফিয়া রহমান মিম, ইব্রাহিম আহমেদ রিপন ও তার স্ত্রী শারমিন। আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত করার দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে সর্বশেষ তারিখ ছিল গত ২০ এপ্রিল। কিন্তু প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ফের সময় নেয় তদন্তকারী সংস্থা।

পিবিআই মামলার তদন্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর চলতি বছরের গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি সাইফা রহমান মীমকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে তিনি কারগারে আছেন। ঘটনার পর দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন মীম। তিনি নিজেকে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবি করেন। মুনিয়ার সঙ্গে মোবাইল কলে এমন দাবি করতে শোনা গেছে। চট্টগ্রামের হুইপপুত্র শারুনের স্ত্রী ছিলেন এই মীম। এর আগে মুনিয়ার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় আরেক আসামি ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে, যিনি র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে মাদক মামলায় কারাগারে ছিলেন। পিয়াসাকে তিনদিনের রিমান্ডেও নিয়েছিল পিবিআই। সম্প্রতি এই আসামি জামিন পেয়েছেন। তবে মীম ও পিয়াসা ছাড়া মূল আসামি আনভীর ও তার পরিবারের সদস্য আসামিদের গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ পুলিশ নেয়নি।

মামলার বাদী মুনিয়ার বড় বোন নুসরাতের অভিযোগ পুলিশের আন্তরিকতা অভাবের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এই মৃত্যুর রহস্য উšে§াচনে ভিকটিমের প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ আসামিদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। কার দ্বারা ভিকটিম দুই-তিন সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, তা শনাক্ত করতে প্রধান আসামির ডিএনএ টেস্টসহ ফরেনসিক পরীক্ষার উদ্যেগ নেয়নি পুলিশ। আলোচিত মামলার আসামি হয়ে জামিন না নিয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেশির ভাগ আসামি। দীর্ঘ এক বছরেও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না থাকায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এ পর্যন্ত ১১ বার আদালত থেকে সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আনভীরের বিদেশযাত্রার ওপর শুনানির তারিখও বারবার ঘুরছে বলে জানিয়েছেন ভিকটিম মুনিয়ার বড় বোন ও মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া।

তিনি বলছেন, ৮ আসামির মধ্যে শুধু সাইফা মীমকে গ্রেপ্তারেই এক বছর পার করেছে পুলিশ। তদন্তের নামে যেন তামাশা চলছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমার বোন মুনিয়াকে এক বছর আগে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো। এক বছর ধরে পুলিশ তদন্ত করছে। অথচ আনভীরসহ আসামিরা জামিন না নিয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তদন্তের কোন অগ্রগতি নেই। তদন্তের নামে যেন তামাশা হচ্ছে। এত বড় অপরাধ করেও যদি কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকে, তাহলে সেটি নিয়ে সবার মাঝে প্রশ্ন উঠবেই। আমি আমার বোন হত্যার ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি করতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাবো।

তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক গোলাম মোক্তার আশ্রাফ উদ্দিন দাবি করেছেন, মুনিয়া মামলার তদন্ত কার্যক্রম থেমে নেই। অনেক তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফলে তদন্তে অগ্রগতি নেই বলা যাবে না।

মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা পুলিশ সুপার আহসান হাবিব পলাশ জানান, পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। যেসব তথ্য পেয়েছে সেইসব তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চলমান রয়েছে।

বাদী পক্ষের আইনজীবী মো. মাসুদ সালাহউদ্দিন বলছেন, এটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলা। ট্রাইব্যুনালের মামলার তদন্তের জন্য সর্বোচ্চ ১২০ দিন নেয়ার কথা আইনে বলা আছে। এ ক্ষেত্রে বিগত এক বছরে ১১ বার সময় নিয়ে আইনের লঙ্ঘন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছেন মুনিয়া মিরপুরের একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা মৃত শফিকুর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কুমিল্লা সদরের দক্ষিণপাড়া উজির দিঘি এলাকায় তার পৈত্রিক বাড়ি। একটি অনুষ্ঠানে মুনিয়ার ওপর নজর পড়ে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের। এরপর বিয়ের আশ্বাস দিয়ে মুনিয়ার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে শুরু করে তারা। প্রথমে বনানীতে মুনিয়াকে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে দেয় আনভীর। সেই ফ্ল্যাটের ভাড়া আনভীর পরিশোধ করতেন। পরে আনভীরের মা মুনিয়াকে মডেল পিয়াসার মাধ্যমে ডেকে নিয়ে আনভীরে সঙ্গ ত্যাগ করে ঢাকা ছাড়তে বলেন। আনভীরের মায়ের হুমকিতে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর পুনরায় মুনিয়াকে ঢাকায় নিয়ে আসেন আনভীর। গুলশান দুই নম্বর এভিনিউর ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর প্ল­টের বি/৩ ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে মুনিয়াকে সেখানে তোলেন। ওই বাসায় আনভীরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

কুমিল্লায় বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যাকা-ে জড়িতদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কুমিল্ল­ায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়েছে। এ সময় মামলার প্রধান আসামি ও ভিকটিমের প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করার আহ্বান জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বজনরা। দীর্ঘ এক বছরেও মামলার তদন্তে অগ্রগতি না হওয়া ও আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের অনীহায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।

বহুল আলোচিত মুনিয়ার হত্যার এক বছর উপলক্ষে গতকাল সকালে কুমিল্ল­া শহরের ছাতিপট্টিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অফিসের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে এই দাবি জানানো হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কুমিল্ল­া জেলা ইউনিট আয়োজিত এ কর্মসূচিতে নিহত মুনিয়ার স্বজন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় মানুষ অংশ নেন। পরে ছাতিপট্টি মসজিদে কোরআন খতম ও বাদ জোহর দোয়া পড়ানো হয়। বিকেল ৪টায় পূবালী চত্বরে নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেয়া কুমিল্ল­ার বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, নিহত মুনিয়ার বাবা শফিকুর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। তার কন্যাকে বিয়ের নামে প্রলোভন দেখিয়ে ভোগ করার পর পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বসুন্ধরা গ্রপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর ও তার সহযোগীরা। মুনিয়ার দুই-তিন সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি ময়নাতদন্তসহ ফরেনসিক পরীক্ষায় উঠে এসেছে।

বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অথচ চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও প্রধান আসামি আনভীর, তার পরিবারের সদস্য ও সহযোগী আসামিদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। আসামিপক্ষ আর্থিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের গ্রেপ্তারে আন্তরিক নয় তদন্ত সংস্থা। তদন্তের নামে পুলিশ যেন তামাশা করছে। মুনিয়া হত্যার ন্যায়বিচার বাংলার মাটিতে হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা। এত বড় অপরাধ করেও শুধু টাকার জোরে রেহাই পেলে দেশে আইনের শাসনের জন্য সেটি শুভকর বার্তা বয়ে আনবে না, যোগ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।