ফুটপাতের দোকান : ঈদে ৫০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

টাকা যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের লোকজনের পকেটে

ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। তবে এজন্য তাদের প্রতিদিন যে ‘ভাড়া’ বা চাঁদা দিতে হয়, বেড়েছে তার অঙ্কও। ফুটপাতে বসা প্রায় সাড়ে তিন লাখ হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। শুধু ঈদ মৌসুমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হবে।

এই চাঁদার ভাগ যাচ্ছে অসাধু রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের লোকজনের পকেটে। ফুটপাতের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

চাঁদার রেট কম হলেই দোকান ভেঙে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, একজন লাইনম্যানের অধীনে একটি করে ‘ফুট’ থাকে। একটি ‘ফুটে’ সর্বোচ্চ ৩০০ হকার বসতে পারে। তাদের একটি করে চৌকির জায়গা (দুই হাত বাই চার হাত) বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে ফুটপাত ছাড়াও সরাসরি রাস্তায়ও হকারদের বসতে দেয়া হয়। আর আছে ভ্রাম্যমাণ বরাদ্দ।

ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ মৌসুমে শুধু নিউমার্কেট কেন্দ্রিক চাঁদা তোলা হয় দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। গুলিস্তান কেন্দ্রিক তোলা হয় ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। মতিঝিল জোনে তোলা হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া উত্তরা থেকে ১০ লাখ, গাবতলী ১৫ লাখ, মালিবাগ ১০ লাখ ও মিরপুর এলাকায় ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় প্রতিদিন।

হকার্স লীগের সভাপতি আবুল কাসেম জানান, এখন ঢাকা শহরে সাড়ে ৩ লাখ হকার আছে। তাদের কাছ থেকে অন্য সময়ে সর্বনিম্ন প্রতিদিন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা নেয়া হয়। এটা এলাকা এবং দোকানের আকারের ওপর নির্ভর করে। গড়ে কমপক্ষে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় হয় প্রতিদিন প্রতিজন হকারের কাছ থেকে। আর ঈদের আগের এক মাস এই রেট বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘ঈদকে টার্গেট করে চলতি মাসে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা টার্গেট নিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে হকারদের কাছ থেকে।’

এই হকার নেতা জানান, ঢাকার নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকায় মোট ৫ থেকে ৬ হাজার হকার আছে। এখান থেকে প্রতিদিন চাঁদা আসে কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা। তাই এখানে একদিন দোকান বা ফুটপাত বন্ধ থাকলে যারা এই চাঁদা নেন তাদের বিরাট ক্ষতি হয়।

এই চাঁদা কারা নেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কতিপয় পুলিশ, সিটি করপোরেশনের লোক এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ে কিছু রাজনৈতিক নেতা। আর এই টাকা তোলার জন্য লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার আছে। লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার ঠিক করে দেয় পুলিশ। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের পরিবর্তন হয় না। তাদের কাজ সরকারি চাকরির মতো।’

হকার নেতা মুরশিকল ইসলাম বলেন, ‘এর বড় সুবিধাভোগী হলো প্রশাসন। লাভের জন্য তারাই চাঁদার বিনিময়ে এই ফুটপাত ভাড়া দেয়া টিকিয়ে রেখেছে।’ প্রশাসনের কারা এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সবাই জানে। সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই না। বললে হকাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী নেতাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মার্কেটের বিষয়গুলো দেখভাল করলেও বাইরের হকারদের সমিতির নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

কীভাবে চাঁদা তোলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমরা একজন লাইনম্যান নিয়োগ দিয়ে থাকি। প্রতিটা পয়েন্টে লাইনম্যান রয়েছে। ওই লাইম্যানদের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়।’

তিনি জানান, প্রতিটা দোকানে আলাদা আলাদা স্পেস বরাদ্দ দেয়া আছে। কোন কোনটা ৩ ফিট আবার কোনোটা ৬ ফিট। ৩ ফিটের জন্য দৈনিক ৫০০ টাকা। আর ৬ ফিটের জন্য চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার টাকা। এর মধ্যে লাইনম্যানকে আলাদা অর্থ দিতে হয়। বিদ্যুতের লাইন না থাকলেও ‘অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ’।

‘নিউমার্কেট থেকে ঢাকা কলেজ পর্যন্ত প্রতিদিন ২৫ লাখ টাকা তোলা হয়। তবে ঈদ মৌসুমে এই চাঁদা তোলা হয়। ঈদের পর কিছুটা কমে আসবে,’ বলেন ওই ব্যবসায়ী নেতা।

তিনি আরও জানান, ‘প্রতিদিন যে টাকা আদায় করা হয় সেই টাকা আলাদা একটি অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। প্রতি সপ্তাহ বা মাসিক হিসাবে আদায় করা চাঁদার টাকা সমিতির মাধ্যমেই বণ্টন করা হয়। সেই চাঁদার ভাগ পান ভিআইপি নেতা থেকে স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ। সেই চাঁদা থেকে ব্যবসায়ী সমিতি ভাগ বসায়।’

গুলিস্তানে খদ্দের মার্কেটের সামনে ফুটপাতে দোকানদারি করছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন, বললেন, সামনে ঈদ, তবে বেচা-বিক্রি কম। দোকান ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ৮০০ টাকা দিতে হয়। এরপর আছে লাইনম্যান ও বিদ্যুৎ বিল।’

কারা নেন এই চাঁদার টাকা, তাদের কোন সংগঠন বা সমিতি আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কোন সমিতি নাই। শুনছি লাইনম্যানের মাধ্যমে নেতারা ও পুলিশ নিয়া যায় চান্দার টাকা।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই চাঁদার টাকা তোলেন সেখানকার প্রভাবশালী নেতারা। আওয়ামী লীগ অফিসের লাগোয়া বিভিন্ন সংগঠনের নামে ওই চাঁদা তোলা হয়। সেখানে গত সোমবার বিকেলে গেলে এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিদিনের চাঁদার টাকা রাখা হয় কয়েকটি ভাগে। একটি ভাগ পান আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আরেকটি ভাগ পায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। পুলিশের চাঁদার টাকা আওয়ামী লীগ নেতারাই দিয়ে থাকেন।’

রাজধানী সুপার মার্কেট থেকে বেল্টপট্রি এলাকা পর্যন্ত ২০০টি দোকানের লাইনম্যান বাবুল ও বকুল। ওই ফুটপাতের একাধিক দোকানদার জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় আগে লাইনম্যানরা ১০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে যেত। ঈদকে ঘিরে বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। বেঁধে দেয়া রেট অনুযায়ী চাঁদা না দিলে দোকান ভেঙে দেয়া হয়।

জাতীয় হকার্স ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে চাঁদার হার নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ডিএমপির বিভিন্ন থানার এলাকা থেকে রাতের বেলা হকারদের দোকান গাড়িতে তুলে দেয়া হচ্ছে। গাড়ির মধ্যে যাদের সঙ্গে বনিবনা হয়েছে তাদের মাল ফেরত দিয়েছে আর যারা সমঝোতায় আসতে পারেনি তাদের দোকান চলে যায় মালখানায়। এছাড়া কয়েক এলাকায় নতুন নতুন চাঁদাবাজ এসব ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লাইনম্যান জানান, তিনি আগে ফুটপাতে হকারি করতেন। তিনি এখন লাইনম্যান। তার কাজ শুধু হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা। এই টাকার ভাগ স্থানীয় নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের বণ্টন করতে হয়। এদিক সেদিক করলে ধরপাকড় চালানো হয়।

তিনি আরও জানান, গুলিস্তানে রাজধানী মার্কেটের সামনে ফুটপাতের লাইনম্যানের নাম সুলতান মিয়া, মতিঝিল এলাকার লাইনম্যান মধুমতি সিনেমা হলের টিকেট ব্ল্যাকার এক যুবলীগ নেতা, যুবলীগ নেতা সাইদ বঙ্গভবন এলাকার লাইনম্যান, ফকিরাপুলে গফুর, দিলকুশায় নুরু মিয়া আর আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের অংশে চাঁদা তোলে সালাম। যাত্রাবাড়ীর সাতটি ফুটপাতের সর্দার সোনা মিয়া, ফার্মগেট এলাকায় লাইনম্যান শাহ আলম ও আবদুর রাজ্জাক দুলাল। নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট ও ঢাকা কলেজের সামনের অংশে নিয়ন্ত্রণ করছে হোসেন মিয়া। মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করছে জয়নাল ও আয়নাল। বিমানবন্দর এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে আলী।

গুলিস্তানের এক ব্যবসায়ী জানান, গুলিস্তানে গোলাপশাহ মাজার এলাকা থেকে সিদ্দিক বাজার মার্কেট পর্যন্ত ফুটপাতে এমনিতেই ৮০-৯০টি দোকান বসত, সেখানে এবার ঈদকে ঘিরে দোকানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন শতাধিক। এসব ফুটপাতের দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা চাঁদা নেয়া হচ্ছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ২০১৬ সালে ‘দ্য স্টেইট অব সিটিজ ২০১৬ : ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা, সিটি-গভর্নেন্স পারসপেক্টিভ’ শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে । সেই গবেষণায় উঠে আসে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাথের হকারদের কাছ থেকে বছরে এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়, যা ওই সময়ে দুই সিটি করপোরেশনের মোট বাজেটের প্রায় সমান ছিল।

ওই গবেষণায় অনুসারে, ঢাকার রাস্তায় তখন আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করত। আর প্রতি হকারের কাছ থেকে গড়ে তখন প্রতিদিন ১৯২ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। ওই গবেষক দলের প্রধান ছিলেন ড. মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। তিনি এখন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

তিনি গত সপ্তাহে সংবাদকে জানান, ‘হকারদের সংখ্যা আমরা সংবাদমাধ্যম থেকে নিয়ে পরে যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছি। আর চাঁদার পরিমাণ জেনেছি সরেজমিন কাজ করে। হকারদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছি আমরা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ছিল ফুটপাতের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা। দেখলাম এর একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। এই চাঁদা নেয় রাজনৈতিক লোকজন, পুলিশ ও লাইনম্যানরা। লাইনম্যানরা আবার পুলিশের নিয়োগ করা।’

‘আমরা প্রস্তাব করেছিলাম, সিটি করপোরেশন যদি এটা রেগুলারাইজ করে ট্যাক্স হিসেবে নেয় তাহলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে এবং সরকারের আয় হবে।’

ড. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘নতুন করে কোন গবেষণা না হলেও পর্যবেক্ষণ বলছে, এখন হকার বেড়েছে। চাঁদার আকারও বেড়েছে। আর আগের অবস্থাই বহাল আছে।’

তবে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে কোন দোকানদার চাঁদাবাজির অভিযোগ করেনি। যদি পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদা নেয়ার কোন অভিযোগ আসে তাহলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। চাঁদাবাজির বিষয়ে নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ মাহমুদ বলেন, ‘পুলিশের চাঁদাবাজির তথ্য সঠিক নয়। যারা এমন অভিযোগ তুলেছেন, তারা মিথ্যা বলেছেন।’ তার দাবি, ‘সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত হলে আধা ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীর সব ফুটপাতের দোকান সরানো সম্ভব’।

বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

ফুটপাতের দোকান : ঈদে ৫০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

টাকা যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের লোকজনের পকেটে

মাসুদ রানা

image

ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। তবে এজন্য তাদের প্রতিদিন যে ‘ভাড়া’ বা চাঁদা দিতে হয়, বেড়েছে তার অঙ্কও। ফুটপাতে বসা প্রায় সাড়ে তিন লাখ হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। শুধু ঈদ মৌসুমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হবে।

এই চাঁদার ভাগ যাচ্ছে অসাধু রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের লোকজনের পকেটে। ফুটপাতের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

চাঁদার রেট কম হলেই দোকান ভেঙে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, একজন লাইনম্যানের অধীনে একটি করে ‘ফুট’ থাকে। একটি ‘ফুটে’ সর্বোচ্চ ৩০০ হকার বসতে পারে। তাদের একটি করে চৌকির জায়গা (দুই হাত বাই চার হাত) বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে ফুটপাত ছাড়াও সরাসরি রাস্তায়ও হকারদের বসতে দেয়া হয়। আর আছে ভ্রাম্যমাণ বরাদ্দ।

ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ মৌসুমে শুধু নিউমার্কেট কেন্দ্রিক চাঁদা তোলা হয় দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। গুলিস্তান কেন্দ্রিক তোলা হয় ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। মতিঝিল জোনে তোলা হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া উত্তরা থেকে ১০ লাখ, গাবতলী ১৫ লাখ, মালিবাগ ১০ লাখ ও মিরপুর এলাকায় ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয় প্রতিদিন।

হকার্স লীগের সভাপতি আবুল কাসেম জানান, এখন ঢাকা শহরে সাড়ে ৩ লাখ হকার আছে। তাদের কাছ থেকে অন্য সময়ে সর্বনিম্ন প্রতিদিন ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা নেয়া হয়। এটা এলাকা এবং দোকানের আকারের ওপর নির্ভর করে। গড়ে কমপক্ষে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় হয় প্রতিদিন প্রতিজন হকারের কাছ থেকে। আর ঈদের আগের এক মাস এই রেট বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘ঈদকে টার্গেট করে চলতি মাসে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা টার্গেট নিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে হকারদের কাছ থেকে।’

এই হকার নেতা জানান, ঢাকার নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকায় মোট ৫ থেকে ৬ হাজার হকার আছে। এখান থেকে প্রতিদিন চাঁদা আসে কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা। তাই এখানে একদিন দোকান বা ফুটপাত বন্ধ থাকলে যারা এই চাঁদা নেন তাদের বিরাট ক্ষতি হয়।

এই চাঁদা কারা নেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কতিপয় পুলিশ, সিটি করপোরেশনের লোক এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ে কিছু রাজনৈতিক নেতা। আর এই টাকা তোলার জন্য লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার আছে। লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার ঠিক করে দেয় পুলিশ। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের পরিবর্তন হয় না। তাদের কাজ সরকারি চাকরির মতো।’

হকার নেতা মুরশিকল ইসলাম বলেন, ‘এর বড় সুবিধাভোগী হলো প্রশাসন। লাভের জন্য তারাই চাঁদার বিনিময়ে এই ফুটপাত ভাড়া দেয়া টিকিয়ে রেখেছে।’ প্রশাসনের কারা এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সবাই জানে। সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই না। বললে হকাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী নেতাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মার্কেটের বিষয়গুলো দেখভাল করলেও বাইরের হকারদের সমিতির নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

কীভাবে চাঁদা তোলা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমরা একজন লাইনম্যান নিয়োগ দিয়ে থাকি। প্রতিটা পয়েন্টে লাইনম্যান রয়েছে। ওই লাইম্যানদের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়।’

তিনি জানান, প্রতিটা দোকানে আলাদা আলাদা স্পেস বরাদ্দ দেয়া আছে। কোন কোনটা ৩ ফিট আবার কোনোটা ৬ ফিট। ৩ ফিটের জন্য দৈনিক ৫০০ টাকা। আর ৬ ফিটের জন্য চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার টাকা। এর মধ্যে লাইনম্যানকে আলাদা অর্থ দিতে হয়। বিদ্যুতের লাইন না থাকলেও ‘অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ’।

‘নিউমার্কেট থেকে ঢাকা কলেজ পর্যন্ত প্রতিদিন ২৫ লাখ টাকা তোলা হয়। তবে ঈদ মৌসুমে এই চাঁদা তোলা হয়। ঈদের পর কিছুটা কমে আসবে,’ বলেন ওই ব্যবসায়ী নেতা।

তিনি আরও জানান, ‘প্রতিদিন যে টাকা আদায় করা হয় সেই টাকা আলাদা একটি অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। প্রতি সপ্তাহ বা মাসিক হিসাবে আদায় করা চাঁদার টাকা সমিতির মাধ্যমেই বণ্টন করা হয়। সেই চাঁদার ভাগ পান ভিআইপি নেতা থেকে স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ। সেই চাঁদা থেকে ব্যবসায়ী সমিতি ভাগ বসায়।’

গুলিস্তানে খদ্দের মার্কেটের সামনে ফুটপাতে দোকানদারি করছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন, বললেন, সামনে ঈদ, তবে বেচা-বিক্রি কম। দোকান ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ৮০০ টাকা দিতে হয়। এরপর আছে লাইনম্যান ও বিদ্যুৎ বিল।’

কারা নেন এই চাঁদার টাকা, তাদের কোন সংগঠন বা সমিতি আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কোন সমিতি নাই। শুনছি লাইনম্যানের মাধ্যমে নেতারা ও পুলিশ নিয়া যায় চান্দার টাকা।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই চাঁদার টাকা তোলেন সেখানকার প্রভাবশালী নেতারা। আওয়ামী লীগ অফিসের লাগোয়া বিভিন্ন সংগঠনের নামে ওই চাঁদা তোলা হয়। সেখানে গত সোমবার বিকেলে গেলে এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিদিনের চাঁদার টাকা রাখা হয় কয়েকটি ভাগে। একটি ভাগ পান আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আরেকটি ভাগ পায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। পুলিশের চাঁদার টাকা আওয়ামী লীগ নেতারাই দিয়ে থাকেন।’

রাজধানী সুপার মার্কেট থেকে বেল্টপট্রি এলাকা পর্যন্ত ২০০টি দোকানের লাইনম্যান বাবুল ও বকুল। ওই ফুটপাতের একাধিক দোকানদার জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় আগে লাইনম্যানরা ১০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে যেত। ঈদকে ঘিরে বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। বেঁধে দেয়া রেট অনুযায়ী চাঁদা না দিলে দোকান ভেঙে দেয়া হয়।

জাতীয় হকার্স ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে চাঁদার হার নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ডিএমপির বিভিন্ন থানার এলাকা থেকে রাতের বেলা হকারদের দোকান গাড়িতে তুলে দেয়া হচ্ছে। গাড়ির মধ্যে যাদের সঙ্গে বনিবনা হয়েছে তাদের মাল ফেরত দিয়েছে আর যারা সমঝোতায় আসতে পারেনি তাদের দোকান চলে যায় মালখানায়। এছাড়া কয়েক এলাকায় নতুন নতুন চাঁদাবাজ এসব ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লাইনম্যান জানান, তিনি আগে ফুটপাতে হকারি করতেন। তিনি এখন লাইনম্যান। তার কাজ শুধু হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা। এই টাকার ভাগ স্থানীয় নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের বণ্টন করতে হয়। এদিক সেদিক করলে ধরপাকড় চালানো হয়।

তিনি আরও জানান, গুলিস্তানে রাজধানী মার্কেটের সামনে ফুটপাতের লাইনম্যানের নাম সুলতান মিয়া, মতিঝিল এলাকার লাইনম্যান মধুমতি সিনেমা হলের টিকেট ব্ল্যাকার এক যুবলীগ নেতা, যুবলীগ নেতা সাইদ বঙ্গভবন এলাকার লাইনম্যান, ফকিরাপুলে গফুর, দিলকুশায় নুরু মিয়া আর আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের অংশে চাঁদা তোলে সালাম। যাত্রাবাড়ীর সাতটি ফুটপাতের সর্দার সোনা মিয়া, ফার্মগেট এলাকায় লাইনম্যান শাহ আলম ও আবদুর রাজ্জাক দুলাল। নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট ও ঢাকা কলেজের সামনের অংশে নিয়ন্ত্রণ করছে হোসেন মিয়া। মিরপুর এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করছে জয়নাল ও আয়নাল। বিমানবন্দর এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে আলী।

গুলিস্তানের এক ব্যবসায়ী জানান, গুলিস্তানে গোলাপশাহ মাজার এলাকা থেকে সিদ্দিক বাজার মার্কেট পর্যন্ত ফুটপাতে এমনিতেই ৮০-৯০টি দোকান বসত, সেখানে এবার ঈদকে ঘিরে দোকানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন শতাধিক। এসব ফুটপাতের দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা চাঁদা নেয়া হচ্ছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ২০১৬ সালে ‘দ্য স্টেইট অব সিটিজ ২০১৬ : ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা, সিটি-গভর্নেন্স পারসপেক্টিভ’ শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে । সেই গবেষণায় উঠে আসে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাথের হকারদের কাছ থেকে বছরে এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়, যা ওই সময়ে দুই সিটি করপোরেশনের মোট বাজেটের প্রায় সমান ছিল।

ওই গবেষণায় অনুসারে, ঢাকার রাস্তায় তখন আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করত। আর প্রতি হকারের কাছ থেকে গড়ে তখন প্রতিদিন ১৯২ টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। ওই গবেষক দলের প্রধান ছিলেন ড. মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। তিনি এখন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

তিনি গত সপ্তাহে সংবাদকে জানান, ‘হকারদের সংখ্যা আমরা সংবাদমাধ্যম থেকে নিয়ে পরে যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছি। আর চাঁদার পরিমাণ জেনেছি সরেজমিন কাজ করে। হকারদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছি আমরা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ছিল ফুটপাতের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা। দেখলাম এর একটি রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। এই চাঁদা নেয় রাজনৈতিক লোকজন, পুলিশ ও লাইনম্যানরা। লাইনম্যানরা আবার পুলিশের নিয়োগ করা।’

‘আমরা প্রস্তাব করেছিলাম, সিটি করপোরেশন যদি এটা রেগুলারাইজ করে ট্যাক্স হিসেবে নেয় তাহলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে এবং সরকারের আয় হবে।’

ড. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘নতুন করে কোন গবেষণা না হলেও পর্যবেক্ষণ বলছে, এখন হকার বেড়েছে। চাঁদার আকারও বেড়েছে। আর আগের অবস্থাই বহাল আছে।’

তবে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে কোন দোকানদার চাঁদাবাজির অভিযোগ করেনি। যদি পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদা নেয়ার কোন অভিযোগ আসে তাহলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। চাঁদাবাজির বিষয়ে নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ মাহমুদ বলেন, ‘পুলিশের চাঁদাবাজির তথ্য সঠিক নয়। যারা এমন অভিযোগ তুলেছেন, তারা মিথ্যা বলেছেন।’ তার দাবি, ‘সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত হলে আধা ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীর সব ফুটপাতের দোকান সরানো সম্ভব’।