ঘরে ফেরা

হায়াৎ মামুদ

মনে হয় সকলেরই জানা আছে, তবু জানা-কথা দিয়েই না-হয় শুরু করা গেল। ঘটনাটি মহাভারতের। অজ্ঞাতবাসে দিন কাটছে পঞ্চপা-রের। তখনকার ঘটনা। বনপর্বে কাহিনীটি বলা আছে। পিপাসার্ত যুধিষ্ঠিরের জন্যে জল আনতে গিয়ে চার ভাইয়ের একজনও যখন ফিরে আসেন না, তখন শঙ্কিত মনে ও অবসন্ন দেহে সেই দিঘির কাছে গিয়ে দেখেন বকরাক্ষস সরোবর পাহারা দিচ্ছে। এক-পায়ে-খাড়া বকের রূপধারী রাক্ষস বলেন যে, দিঘির পানি পান করতে হলে কিছু প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিতে হবে যুধিষ্ঠিরকে, নইলে দিঘির পাড়ে তাঁর চার ভাই যে মরে পড়ে আছেন, সেই দশা হবে তাঁরও। তেষ্টায় প্রাণ যায়, যুধিষ্ঠিরের সম্মত না হয়ে উপায় ছিল না। অতঃপর গুটিকয়েক কঠিন প্রশ্ন করার পর বকরাক্ষস সবশেষে সহজ এক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন : পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী কে? যুধিষ্ঠির বললেন : অপ্রবাসী, সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে সুখী যাকে প্রবাসে জীবন কাটাতে হয় না।

এই সুপ্রাচীন বচনের নিহিতার্থ ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষী নয়। দূরদেশে পড়ে-থাকা যে-কোনো দেশের ব্যক্তিমাত্রেই প্রবাসীর মনোজগতের যাবতীয় অনুভব ও উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু একই সঙ্গে আরেক বিপরীতমুখী সত্যও সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই আমরা দেখে আসছি, তা হলো- মনুষ্য জন্মের বিধিলিপি হচ্ছে ঠাঁইনাড়া হওয়া, সে পরিযায়ী (migratory) পাখির মতো নিজেকে উন্মুল করতে বাধ্য হয়। স্থানান্তরে না গিয়ে তার উপায় নেই, তবে- ভ্রমণ শেষে পক্ষিকুলের ঘরে ফেরা হয়, মানুষের অধিকাংশই হয় না, কখনওসখনও হয়। এর অর্থ দাঁড়াল- বিশ্বের মনুষ্যকুল অপ্রবাসে যত সুখীই হোক, প্রবাসী জীবন তার ললাটলিখন। প্রবাসের দূরত্ব অবশ্য কমবেশি হতেই পারে, মূল কথা হলো জন্মশিকড় ছিঁড়ে চলে যাওয়া। বঙ্গদেশ থেকে উত্তর আমেরিকা কি বিলেত-ইওরোপের মাটি যতখানি দূরতিক্রম্য ব্যবধান ততখানি যদি নাও হয়, তবুও। তিতাসপাড়ের ছেলেটিকে অদ্বৈত মল্লবর্মণ কি ফের তার গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন? মফস্বল শহর কি কোনো গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে পড়াশোনা করতে-আসা যে-ছেলেটি আর তার গ্রামে ফিরে যেতে পারে না, তাকে কি প্রবাসী বলব না? স্মৃতিতে নিজের জন্মবৃত্তান্তের টান কতখানি টনটন করে তার ওপরই তো প্রবাসের অনুভূতি জেগে থাকে, নাকি অন্য আরও কিছু?

প্রবাসে কোনও সংস্কৃতি-সম্মেলনের কথা উঠলেই আমি নানান মিশ্র অনুভূতির গোলকধাঁধায় পড়ে যাই। আমার মনে অবিমিশ্র আনন্দ বা উল্লাস জাগে না। দু’একবার আমাকে এমন অনুষ্ঠানে থাকতে হয়েছে বৈকি, জাপানে কি মার্কিন ভূমিতে। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ক’জনই-বা পায়? আমি তো পেয়েছি, তার জন্যে আত্মতৃপ্তি তৈরি হয়ে ওঠে ভেতরে-ভেতরে, যাঁরা আমন্ত্রক তাঁদের জন্য কৃতজ্ঞতাবোধও জাগে খুবই সঙ্গতভাবে। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রাপ্তির বাইরে যখন ভাবতে চাই প্রবাসভূমিতে সাহিত্য সম্মেলন কি সংস্কৃতি সম্মেলন ইত্যাদির মূল লক্ষ্য কী, তখন স্পষ্ট কোনো উত্তর নিজের ভেতর থেকে কেউ দেয় না। উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে, তবে তা দূরপ্রসারী নয়, এবং শিল্প-সংস্কৃতির মত-পথ নিয়ে প্রয়োগ সম্ভব পরিকল্পনাও নয় বলে আমার ধারণা। কারণ সাহিত্যের সকল শাখাই সর্বাংশে একক ব্যক্তির চর্চাসাপেক্ষ, সংঘশক্তির সঙ্গে সাহিত্য সৃজনের কোনও সম্পর্ক নেই। তাতে সম্মেলন জাতীয় কর্মোদ্যোগের গুরুত্ব কমে, এমন নয়। কারণ আয়োজকবৃন্দের মনে তাদের অজ্ঞাতেই কাজ করে স্বদেশাগত বান্ধব সম্মিলনের আশা ও আনন্দ। তবে এ ক্ষেত্রে আমন্ত্রিতরা দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানান দিক ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত- তফাৎ এটুকুই। মনে হতে পারে যে, আমি আত্ম-পর ভেদাভেদের ন্যায় একটা বিভাজন রেখা টেনে দিতে চাইছি। বিভাজন রেখা অবশ্যই, তবে তা নেহাতই বাস্তব অবস্থানগত কারণের ফলে ঘটছে, এর ভেতরে ‘আমরা’ ও ‘ওরা’ ধরনের কোনো সাংস্কৃতিক মূল্যমান আরোপ করা হচ্ছে না। ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’ আর্তি জীবনভর প্রহত হতে থাকলেও পরবাসেই যাঁদের থেকে যেতেই হয় তাঁদের গোত্রত্যাগী ভাবার কথাও উঠছে না। নিজের দেশের ভূগোল ও সংস্কৃতির মধ্যে না থেকে ভিনদেশে বসে শিল্প সাধনায় স্বনিষ্ঠ থেকেছেন এমন উদাহরণ পৃথিবীতে অজস্র। সেসব মনে রাখলে ধরা পড়বে, বিদেশে বসে যারা ‘আশমানদারি’ নিয়ে মেতে থাকেন স্পষ্টতই তাঁদের দুটো দল : এক দলে ফেলা যাবে তাঁদেরকে যাঁরা বিমূর্ত বা ধনংঃৎধপঃ শিল্প নিয়ে চর্চা করেন, যেমন চিত্রকলা কি সঙ্গীত; আর অন্য দলে রয়েছেন বাণীশিল্পীর দল, যেমন কবি, ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-গাল্পিক প্রমুখ- যাঁদের সাধনার মূল উপাদান শব্দ বা কথা যা অর্থের ঘেরে বন্দি, সর্বজনবোধগম্য, অন্তত বাহ্যিক রূপ ও চরিত্রে বক্তব্য প্রকাশে উন্মুখ। একঝাঁক বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর কথা স্মরণ করা যায়- যেমন পিকাসো কি দালি কিংবা কান্দিন্স্কি কি ককোশ্কা, যাঁরা দেশের বাইরে এসে থেকে গেলেন। এই মুহূর্তে মনে আসছে চিত্রী মনিরুল ইসলাম কি শাহাবুদ্দিনকে, একজন মাদ্রিদে তো অন্যজন পারীতে। প্রতিভার বিকাশ তাতে বিঘিœত হয়নি। অথচ লেখ্য শিল্পের ব্যাপার-স্যাপার, চালচলন একেবারে অন্য রকম। সাঙ্গীতিক ধ্বনি কিংবা ছবির রংয়ে-রেখায় ইন্দ্রিয়ানুভূতির রাজত্ব, অর্থের সীমানা অতিক্রম করে রস-সংবেদনা জাগানোই তাদের ধর্ম; অথচ ভাষাকে আশ্রয় করে ব’লে ভূগোল-ইতিহাস-জনগোষ্ঠী ও সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়াটাই সাহিত্যের ভাগ্য। শিল্পের চারিত্র্যধর্মের এই পার্থক্য শিল্পীর জগত ও সৃজনশক্তিকে অন্য রকমের করে দেয়।

স্বদেশ ও প্রবাস বাণীশিল্পীর জন্য তাই এত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁকে বাঁচতে হয় তাঁর ভাষাকে অবলম্বন করে, সে-ভাষার আশ্রয়ে যে-সমাজ ও জীবনধারা প্রবাহিত তাকে সঙ্গে নিয়ে। তবে এ পরিস্থিতিও চূড়ান্ত নয়। মাতৃভাষায় ও অন্য ভাষায় লিখেছেন এমন দ্বিভাষী লেখক ইওরোপ ভূখ-ে সব সময়েই দেখা গেছে, অন্তত উনিশ শতক থেকে তো বটেই। তার একটা জোরালো কারণ- রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে ফিরে যেতে হয়- ইওরোপ রাজনৈতিকভাবে বহুরাষ্ট্রিক হলেও প্রকৃতপক্ষে একটি দেশ। অস্কার ওয়াইল্ড, স্যামুয়েল বেকেট, ভ্লাদিমির নাবোকভকে তো আমরা জানিই যারা মাতৃভাষায় ছাড়াও অন্য ভাষাতে সৃষ্টিশীল রচনা লিখেছেন। তবে এঁদের চেয়ে দলে ভারি তাঁরা যাঁরা প্রবাসে জীবন অতিবাহিত করলেও প্রবাসভূমির ভাষাকে গ্রহণ করেননি, মাতৃভাষাতেই লিখে গেছেন- রুশ সাহিত্যে এমনটি সবচেয়ে বেশি ঘটেছে, যার শুরু ইভান্ তুর্গিয়েনের থেকে, রুশ ভাষায় তো ‘প্রবাসী সাহিত্য’ নামে এক সাহিত্যধারা বা literary genre-ই গড়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা অমিয় চক্রবর্তীকে কী বলব? বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে? বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, কি বনফুল কিংবা সতীনাথ ভাদুড়ী- এঁদেরকেও কি প্রবাসী সাহিত্যিক বলা যাবে যেহেতু তাঁরা বাংলার বাইরে বসে মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য রচনা করে গেলেন? আর অন্নদাশঙ্কর, যিনি প্রথম জীবনে ওড়িয়া ভাষায় লিখে সাহিত্যিক-খ্যাতি পেয়েছিলেন, তাঁকে কোন কুঠরিতে রাখব? উড়িষ্যাও তো বাংলার বাইরে। অন্য আর-এক ভারি ঝলোমলো ঘর আছে, তাতে মুল্ক্রাজ আনন্দ, শশী খারুর, সালমান রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, অরুদ্ধতী রায়, রোহিন্তন মিস্ত্রিদের বসতি : দেশী-প্রবাসীর ভাঙা উঠোনে তাঁরা কোথাও নেই, বিভাষা ইংরেজিতে লিখে তাঁরা ইংরেজি ভাষার মূল স্রোতে সাঁতরাচ্ছেন।

*

এই গপ্পো ভাষা ও ভাষাশ্রমিকের সম্পর্কের অসরল বুনটের এক খতিয়ান। এহেন চালচিত্র পেছনে টাঙানো, তার সামনে প্রবাসী বাঙালি বাণীশিল্পীদের ইচ্ছা, শ্রম ও সাধনাকে বসিয়ে দেখতে চাওয়ার মূল্য আছে। দেশের বাইরে বসে কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মেলনে উদ্দেশ্য এমন হওয়ার কথা নয় যে কোনো শিল্পধারার বিচার ও রায় ঘোষণা করা হবে; সেই ভার থাকে মহাকালের হাতে, সবাই জানি। সম্মেলনের মূল ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য, আমার বিবেচনায় দুই ভূখ-ে বসবাসরত একই ভাষা ও সংস্কৃতির সৃজনশীল কিছু শিল্পী ও ভাবুকের সম্মিলন: প্রথমত স্বদেশের সহযাত্রীদের সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করানো, মৈত্রীবন্ধনে বাধা, দ্বিতীয়ত স্বদেশ ও প্রবাসের সাহিত্যশিল্পসংস্কৃতি সংক্রান্ত বাস্তবতা পরস্পরকে অবহিত করানো এবং সর্বোপরি যে প্রবাসের দিনানুদিন যাপিত জীবন দেশকে স্মৃতি থেকেও মুছে দিতে চায়, সেই দেশকে স্মৃতিতে ও অস্তিত্বে নবায়ন করে নেওয়া, নিজের সৃজনকল্পনাতে নতুন শক্তি ও বেগ সঞ্চারের আকাক্সক্ষা এবং এ-সবই আমন্ত্রিত অভ্যাগত স্বজনদের হাত ধরে, হাতে হাত রেখে। এর বাইরে মহত্তর অর্জন আর কীই-বা হতে পারে?

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমাজ ও আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার কারণে, আমরা লক্ষ্য করছি, এক যুগেরও অধিক কাল ধরে দেশের মানুষ ঘর ছাড়ছে। বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের মানবসম্পদ ভাড়া খাটানোর কথা হিসেবের বাইরে রেখেও দেখা যাচ্ছে, দেশের শিক্ষিত কৃতবিদ্য মেধাবী মানুষজন অনেকেই হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রবাসজীবন বেছে নিচ্ছেন। ইওরোপ, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, সবখানেই বাংলাদেশী নাগরিক খুঁজে পাওয়া যাবে। এঁদের ভেতরে সংখ্যালঘু একটি অংশ রয়েছে যাঁরা বাংলাদেশের অগ্রণী চিন্তার মানুষ হিসেবে স্বদেশেই গণ্য হয়ছেন; অনেকেরই অবদান সমাজে স্বীকৃত ছিল, অনেক তরুণের প্রতিভা ছিল জায়মান।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যে বলতে পারি, কানাডার টরন্টো শহরে যাঁদের স্থিতি এবং ক্রমবর্ধমান হারে যে-ধরনের সৃজনভাবনাতাড়িত মানুষের আগমন প্রত্যক্ষ করছি তাতে বিষণ্ন না হয়ে আমার উপায় নেই। সৃষ্টিশীল ভাবুক একদল মানুষের দেখা পাচ্ছি যাঁদের কেউ চিত্রকর, কেউ কবি, কেউ নাট্যকার বা মঞ্চশিল্পী, আবার কেউ কথাশিল্পী। প্রবাসের দিন যাপনে অচেনা বিভুঁইয়ের সমাজ ব্যবস্থা সেই অবকাশ দেয় না কিংবা মানসিক শান্তি, অথবা সমচিন্তকদের গোষ্ঠীসংঘ যেখানে নিজের শিল্প সংবেদনার আত্মিক ক্ষুধা নিয়ে কেউ ভাবনাচিন্তা করতে পারেন। নিজের দেশ ও ভাষা-সংস্কৃতির মূল স্রোত থেকে ছিন্ন হওয়াতেই এমন অনিবার্য নিয়তি। এই বাস্তবতা এক বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে দেয়, যা প্রবাসীকে স্বনির্মিত এক অলীক বাস্তবতার মোড়কে ঢেকে ফেলে। এটাই তার বেঁচে থাকবার জিয়নকাঠি। বিদেশে বসেও সে কবিতা কি গান লেখে, গল্প-উপন্যাসের বিষয় নিয়ে ভাবে, নাটক রচনার চিন্তা করে, যন্ত্রে কি যন্ত্রবিহীন কণ্ঠে সুর ভাঁজে, নয়তো মনে মনে মঞ্চ পরিকল্পনা করে চলে কোন নাটকের ইত্যাদি; কিন্তু সে-সবের খবর মূল স্রোতের মানুষেরা পায় না; কেননা অতিদূরে গিয়ে পৌঁছুনোর কোন সম্বন্ধ সূত্র নেই। নিজেদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে এঁরা বেঁচে থাকেন, এক কল্প জগতের অধিবাসী যেন তাঁরা। এই কল্প জগতের বাসিন্দারা অটোয়া-মন্ট্রিয়ল-টরন্টো কি নিউইয়র্ক বা লন্ডন কি কোন বিলেতি শহর সবখানেই রয়েছেন। তাঁদের ভাবনার জগৎ কিংবা শিল্প রচনার মেধা নিজেদের ছোট গ-ির চৌহদ্দিতেই থেকে যায়, বাইরে ছড়াবার সুযোগ পায় না। স্ফুরণ ও বহিঃপ্রকাশের সহজ স্বাভাবিক গতিপথ না থাকায় মননে ও হৃদয়ে বিক্ষেপ ঘটে, অভিমান জন্মায়, মূল স্রোতের অস্তিত্বকে পাশ কাটিয়ে বা ভুলে থেকে নিজস্ব জলাধার তৈরিতে মন দেয়, কিন্তু তা সফল হওয়ার নয় বলেই ব্যর্থ হয়। লেখকবৃত্তির বাঙালি মানুষজন বিদেশের মাটিতে কোথাও নিজেদের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির জগৎ নির্মাণ করে নিতে পেরেছেন বলে আমি অন্তত জানি না।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে শিল্প সাধনার যে অব্যাহত ধারা, আন্দোলন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রচেষ্টা ইত্যাদি সেখানে দেশান্তরী স্বদেশী প্রতিভা নিয়ে তেমন কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, আবেগ-উল্লাস জাগে না। আমরা এই মুহূর্তেই এমন কিছু তরুণ বা নাতিতরুণ কবি-সাহিত্যিককে জানি যাঁরা উত্তর আমেরিকায় বা ইওরোপে-বিলেতে বসে বাংলায় লিখে যাচ্ছেন এবং সুনাম অর্জন করেছেন, তবে তা বাংলাদেশের লেখালেখির মূল প্রবাহের সঙ্গে মিশে গিয়ে। তাঁদের বিদেশে থাকা একান্তই শারীরিক-সাংসারিক অবস্থানগত, তা মনোজাগতিক নয়। তাঁরা বিদেশে থাকলেও চিন্তায় ও মননে নিজের দেশকে নিয়েই থাকেন এবং সেসব চিন্তা ও অনুভবের উৎসারণ ঘটে তাদের লেখাপত্রে।

অথচ এ-সবের পরেও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এক অশুভ লক্ষণ আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে যার ভেতরে কোনো ধরনের ঈর্ষা সক্রিয় বলে আমার ধারণা। মনোভাব যেন অনেকটাই এমন- তুমি বিদেশে বসে বেশ তো আরাম-আয়েসে আছ বাপু, দুধ-রুটি মাখন খুব খাচ্ছ, আর ফেব্রুয়ারি এলেই নিজের পয়সায় প্রকাশককে দিয়ে বই ছাপিয়ে লেখক নাম কুড়োচ্ছ, লেখক হওয়া অত ফুর্তির ব্যাপার নয় হে, বুঝতাম হিম্মত- যদি আমাদের মতো এত্ত জ্বালাযন্ত্রণা দুঃখ-কষ্ট সইতে সইতে লিখতে পারতে। এমন অসূয়াপ্রসূত মনোভাব অহেতুক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দেয়, অপরিচয়ের দেওয়াল। এর প্রত্যক্ষ কারণ সম্ভবত এই যে, দেশের পাঠক ও লেখকদের সামনে প্রবাসী লেখকের আকস্মিক উপস্থিতি, দেশের ভেতরে রচনা প্রকাশের ধারাবাহিকতা না থাকা। নইলে সৃজনক্ষমতার সঙ্গে ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য-বিত্তপ্রতিপত্তি ইত্যাদির দৃশ্যত কোনো স্পষ্ট সম্পর্ক নেই, থাকলে নজরুল-সুকান্ত বা মানিক দস্তইয়েফ্স্কিদের দেখা মিলত না।

আমরা যারা ষাট পেরিয়ে এসেছি তাদের শনাক্ত করা হয় গত শতকের ষাটের প্রজন্মের সাহিত্যব্রতী হিসেবে। সংখ্যায় আমরা বিপুলায়তন ছিলাম না। আমাদের সকলেরই বয়স কমবেশি ছিল বিশ থেকে তিরিশের কোঠায়। সাহিত্য নিয়ে দল-উপদল তর্ক-বিতর্ক থাকলেও ছিল যৎসামান্য, কিন্তু নিজেদের ভেতরে মনের লেনদেন অটুট থেকেছে। লিটল ম্যাগাজিনের সূত্রপাত আমাদের হাত দিয়েই হয়। আর সবই ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। এর ফলে সাহিত্যচর্চার বাইরে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক এড়িয়েও হৃদ্যিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতো, তার উৎসবিন্দুতে রাজনীতি-ভাবনা প্রায় থাকতই না, ছিল মেজাজের সাযুজ্যে বন্ধুতা, আর তা এতখানিই গভীর যে এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহাল রয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশী সাহিত্যের দৃশ্যপট বিশালভাবে পাল্টে গেছে, অনেকটা আমাদের সমাজের ভাঙাগড়ার মতোই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এত কবি-সাহিত্যিক লিখছেন, এত বহুভঙ্গিম চরিত্রের ছোটবড় সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে এবং সেসব কেবল রাজধানী শহর থেকেই নয়, অন্যান্য শহর থেকেও এত দল-মত-পথের পরস্পরবৈরী খাত তৈরি হয়েছে যে আমরা প্রবীণের দল কোনো দিক দিয়েই কুলিয়ে উঠতে পারছি না। জনমনোহারী লেখা যেমন অনেকে লিখছেন, তেমনি নিরীক্ষাধর্মী, মস্তিষ্কপ্রবণ, জিজ্ঞাসু, শৈলীগতভাবে দুরূহ রচনারও প্রচুর চর্চা হচ্ছে। গল্পকার অনেক এসেছেন, শক্তিমন্ত— কথা-সাহিত্যিক ও কবির সংখ্যা বিপজ্জনক হারে স্ফীতকায়, আবৃত্তিতে, নাট্যচর্চায়, গানের জগতে কতই-না নতুন নতুন মুখ- এবং সকলেই অল্পবিস্তর নবীন। এই পরিস্থিতিই সত্যিকার আনন্দ ও আশার কথা। কে কখন কোন কালজয়ী রচনা লিখবেন সে হিসেব দূরভবিষ্যের ঝুলিতে জমা থাকুক। আমরা বুঝি, দেশের সংস্কৃতি নিয়ে এত নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী থাকলে তাদের ভেতর থেকে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার প্রতিভা অনেকেই দেশ ও দশকে আলোকিত করবেন।

কিন্তু অনেক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে যে, এসব প্রতিষ্ঠিত ও সম্ভাবনাময় কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক নানা ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণে দেশান্তরী হচ্ছেন। দৈশিক সংস্কৃতিক পরিম-লে এর ফলে প্রতিকারহীন যে-শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রতিকূল প্রভাব ও অভিঘাত তো হতে বাধ্য। অন্যদিকে এমন ভয়ও অমূলক নয় যে, প্রবাস জীবনে তাঁদের শিল্প সাধনা বিঘিœত হবে, অনুকূল পরিবেশের অভাবে তাঁদের প্রয়াস নিষ্ফলা হবে।

এই মনোজাগতিক ও বাইরের বস্তুগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার এক অব্যর্থ উপায় হতে পারে স্বদেশের সঙ্গে নিত্য সংযোগ রেখে মূল স্রোতের ভেতরে থেকে যাওয়া। বাংলা ভাষায় রচিত বাঙালির সাহিত্য বিদেশে বসে লেখা গেলেও তাকে স্বদেশের পাঠক ও রসভোক্তার কাছে যেতেই হবে। বাঙালি মনের গড়নের বিশেষ এক ছাঁচ আছে। সেই ছাঁচকে বলা যেতে পারে হোমসিকনেস, ঘরের জন্যে মন-কেমন-করা রোগ। কে জানে, আরণ্য-সংস্কৃতিভিত্তিক ভারতবর্ষীয় উপমহাদেশে এটিই আদি ব্যাধি কি না; নইলে যুধিষ্ঠিরের মুখ থেকে অমন আর্যবাক্য নিঃসৃত হয় কেমন করে!

বাঙালি তার নিজের ঘরেই থাকে, হয়তো তা বাংলাদেশ। বাঙালি বহির্বিশ্বের যেখানেই থাকুক তার মনের ভেতরে থেকে যায় বাংলাদেশ, যেন বুকের গভীরে স্বদেশভূমির বনসাই। মূল স্রোতে অবগাহনেই তার শক্তি ও সমৃদ্ধি-শিল্পীসত্তার। বাইরে ছড়ানো বাঙালি তখনই ঐশ্বর্যবান হবে যখন বাইরের মণিমুক্তো নিজের ঘরে আনবে, নিজের ভাষাশিল্পের শরীর প্রয়োজন মতো সাজাবে। তখনই তার বাইরে আসা যে ঘরে ফিরে যাবার জন্যেই, সেই সত্য প্রমাণ হবে। প্রমাণের দায় শিল্পসাহিত্যের হাতে থাকলেই সবদিক রক্ষা হবে।

বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

ঘরে ফেরা

হায়াৎ মামুদ

image

প্রচ্ছদ : মনিরুল ইসলাম

মনে হয় সকলেরই জানা আছে, তবু জানা-কথা দিয়েই না-হয় শুরু করা গেল। ঘটনাটি মহাভারতের। অজ্ঞাতবাসে দিন কাটছে পঞ্চপা-রের। তখনকার ঘটনা। বনপর্বে কাহিনীটি বলা আছে। পিপাসার্ত যুধিষ্ঠিরের জন্যে জল আনতে গিয়ে চার ভাইয়ের একজনও যখন ফিরে আসেন না, তখন শঙ্কিত মনে ও অবসন্ন দেহে সেই দিঘির কাছে গিয়ে দেখেন বকরাক্ষস সরোবর পাহারা দিচ্ছে। এক-পায়ে-খাড়া বকের রূপধারী রাক্ষস বলেন যে, দিঘির পানি পান করতে হলে কিছু প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিতে হবে যুধিষ্ঠিরকে, নইলে দিঘির পাড়ে তাঁর চার ভাই যে মরে পড়ে আছেন, সেই দশা হবে তাঁরও। তেষ্টায় প্রাণ যায়, যুধিষ্ঠিরের সম্মত না হয়ে উপায় ছিল না। অতঃপর গুটিকয়েক কঠিন প্রশ্ন করার পর বকরাক্ষস সবশেষে সহজ এক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন : পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী কে? যুধিষ্ঠির বললেন : অপ্রবাসী, সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে সুখী যাকে প্রবাসে জীবন কাটাতে হয় না।

এই সুপ্রাচীন বচনের নিহিতার্থ ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষী নয়। দূরদেশে পড়ে-থাকা যে-কোনো দেশের ব্যক্তিমাত্রেই প্রবাসীর মনোজগতের যাবতীয় অনুভব ও উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু একই সঙ্গে আরেক বিপরীতমুখী সত্যও সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই আমরা দেখে আসছি, তা হলো- মনুষ্য জন্মের বিধিলিপি হচ্ছে ঠাঁইনাড়া হওয়া, সে পরিযায়ী (migratory) পাখির মতো নিজেকে উন্মুল করতে বাধ্য হয়। স্থানান্তরে না গিয়ে তার উপায় নেই, তবে- ভ্রমণ শেষে পক্ষিকুলের ঘরে ফেরা হয়, মানুষের অধিকাংশই হয় না, কখনওসখনও হয়। এর অর্থ দাঁড়াল- বিশ্বের মনুষ্যকুল অপ্রবাসে যত সুখীই হোক, প্রবাসী জীবন তার ললাটলিখন। প্রবাসের দূরত্ব অবশ্য কমবেশি হতেই পারে, মূল কথা হলো জন্মশিকড় ছিঁড়ে চলে যাওয়া। বঙ্গদেশ থেকে উত্তর আমেরিকা কি বিলেত-ইওরোপের মাটি যতখানি দূরতিক্রম্য ব্যবধান ততখানি যদি নাও হয়, তবুও। তিতাসপাড়ের ছেলেটিকে অদ্বৈত মল্লবর্মণ কি ফের তার গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন? মফস্বল শহর কি কোনো গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে পড়াশোনা করতে-আসা যে-ছেলেটি আর তার গ্রামে ফিরে যেতে পারে না, তাকে কি প্রবাসী বলব না? স্মৃতিতে নিজের জন্মবৃত্তান্তের টান কতখানি টনটন করে তার ওপরই তো প্রবাসের অনুভূতি জেগে থাকে, নাকি অন্য আরও কিছু?

প্রবাসে কোনও সংস্কৃতি-সম্মেলনের কথা উঠলেই আমি নানান মিশ্র অনুভূতির গোলকধাঁধায় পড়ে যাই। আমার মনে অবিমিশ্র আনন্দ বা উল্লাস জাগে না। দু’একবার আমাকে এমন অনুষ্ঠানে থাকতে হয়েছে বৈকি, জাপানে কি মার্কিন ভূমিতে। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ক’জনই-বা পায়? আমি তো পেয়েছি, তার জন্যে আত্মতৃপ্তি তৈরি হয়ে ওঠে ভেতরে-ভেতরে, যাঁরা আমন্ত্রক তাঁদের জন্য কৃতজ্ঞতাবোধও জাগে খুবই সঙ্গতভাবে। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রাপ্তির বাইরে যখন ভাবতে চাই প্রবাসভূমিতে সাহিত্য সম্মেলন কি সংস্কৃতি সম্মেলন ইত্যাদির মূল লক্ষ্য কী, তখন স্পষ্ট কোনো উত্তর নিজের ভেতর থেকে কেউ দেয় না। উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে, তবে তা দূরপ্রসারী নয়, এবং শিল্প-সংস্কৃতির মত-পথ নিয়ে প্রয়োগ সম্ভব পরিকল্পনাও নয় বলে আমার ধারণা। কারণ সাহিত্যের সকল শাখাই সর্বাংশে একক ব্যক্তির চর্চাসাপেক্ষ, সংঘশক্তির সঙ্গে সাহিত্য সৃজনের কোনও সম্পর্ক নেই। তাতে সম্মেলন জাতীয় কর্মোদ্যোগের গুরুত্ব কমে, এমন নয়। কারণ আয়োজকবৃন্দের মনে তাদের অজ্ঞাতেই কাজ করে স্বদেশাগত বান্ধব সম্মিলনের আশা ও আনন্দ। তবে এ ক্ষেত্রে আমন্ত্রিতরা দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানান দিক ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত- তফাৎ এটুকুই। মনে হতে পারে যে, আমি আত্ম-পর ভেদাভেদের ন্যায় একটা বিভাজন রেখা টেনে দিতে চাইছি। বিভাজন রেখা অবশ্যই, তবে তা নেহাতই বাস্তব অবস্থানগত কারণের ফলে ঘটছে, এর ভেতরে ‘আমরা’ ও ‘ওরা’ ধরনের কোনো সাংস্কৃতিক মূল্যমান আরোপ করা হচ্ছে না। ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’ আর্তি জীবনভর প্রহত হতে থাকলেও পরবাসেই যাঁদের থেকে যেতেই হয় তাঁদের গোত্রত্যাগী ভাবার কথাও উঠছে না। নিজের দেশের ভূগোল ও সংস্কৃতির মধ্যে না থেকে ভিনদেশে বসে শিল্প সাধনায় স্বনিষ্ঠ থেকেছেন এমন উদাহরণ পৃথিবীতে অজস্র। সেসব মনে রাখলে ধরা পড়বে, বিদেশে বসে যারা ‘আশমানদারি’ নিয়ে মেতে থাকেন স্পষ্টতই তাঁদের দুটো দল : এক দলে ফেলা যাবে তাঁদেরকে যাঁরা বিমূর্ত বা ধনংঃৎধপঃ শিল্প নিয়ে চর্চা করেন, যেমন চিত্রকলা কি সঙ্গীত; আর অন্য দলে রয়েছেন বাণীশিল্পীর দল, যেমন কবি, ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-গাল্পিক প্রমুখ- যাঁদের সাধনার মূল উপাদান শব্দ বা কথা যা অর্থের ঘেরে বন্দি, সর্বজনবোধগম্য, অন্তত বাহ্যিক রূপ ও চরিত্রে বক্তব্য প্রকাশে উন্মুখ। একঝাঁক বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর কথা স্মরণ করা যায়- যেমন পিকাসো কি দালি কিংবা কান্দিন্স্কি কি ককোশ্কা, যাঁরা দেশের বাইরে এসে থেকে গেলেন। এই মুহূর্তে মনে আসছে চিত্রী মনিরুল ইসলাম কি শাহাবুদ্দিনকে, একজন মাদ্রিদে তো অন্যজন পারীতে। প্রতিভার বিকাশ তাতে বিঘিœত হয়নি। অথচ লেখ্য শিল্পের ব্যাপার-স্যাপার, চালচলন একেবারে অন্য রকম। সাঙ্গীতিক ধ্বনি কিংবা ছবির রংয়ে-রেখায় ইন্দ্রিয়ানুভূতির রাজত্ব, অর্থের সীমানা অতিক্রম করে রস-সংবেদনা জাগানোই তাদের ধর্ম; অথচ ভাষাকে আশ্রয় করে ব’লে ভূগোল-ইতিহাস-জনগোষ্ঠী ও সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়াটাই সাহিত্যের ভাগ্য। শিল্পের চারিত্র্যধর্মের এই পার্থক্য শিল্পীর জগত ও সৃজনশক্তিকে অন্য রকমের করে দেয়।

স্বদেশ ও প্রবাস বাণীশিল্পীর জন্য তাই এত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁকে বাঁচতে হয় তাঁর ভাষাকে অবলম্বন করে, সে-ভাষার আশ্রয়ে যে-সমাজ ও জীবনধারা প্রবাহিত তাকে সঙ্গে নিয়ে। তবে এ পরিস্থিতিও চূড়ান্ত নয়। মাতৃভাষায় ও অন্য ভাষায় লিখেছেন এমন দ্বিভাষী লেখক ইওরোপ ভূখ-ে সব সময়েই দেখা গেছে, অন্তত উনিশ শতক থেকে তো বটেই। তার একটা জোরালো কারণ- রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে ফিরে যেতে হয়- ইওরোপ রাজনৈতিকভাবে বহুরাষ্ট্রিক হলেও প্রকৃতপক্ষে একটি দেশ। অস্কার ওয়াইল্ড, স্যামুয়েল বেকেট, ভ্লাদিমির নাবোকভকে তো আমরা জানিই যারা মাতৃভাষায় ছাড়াও অন্য ভাষাতে সৃষ্টিশীল রচনা লিখেছেন। তবে এঁদের চেয়ে দলে ভারি তাঁরা যাঁরা প্রবাসে জীবন অতিবাহিত করলেও প্রবাসভূমির ভাষাকে গ্রহণ করেননি, মাতৃভাষাতেই লিখে গেছেন- রুশ সাহিত্যে এমনটি সবচেয়ে বেশি ঘটেছে, যার শুরু ইভান্ তুর্গিয়েনের থেকে, রুশ ভাষায় তো ‘প্রবাসী সাহিত্য’ নামে এক সাহিত্যধারা বা literary genre-ই গড়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা অমিয় চক্রবর্তীকে কী বলব? বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে? বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, কি বনফুল কিংবা সতীনাথ ভাদুড়ী- এঁদেরকেও কি প্রবাসী সাহিত্যিক বলা যাবে যেহেতু তাঁরা বাংলার বাইরে বসে মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য রচনা করে গেলেন? আর অন্নদাশঙ্কর, যিনি প্রথম জীবনে ওড়িয়া ভাষায় লিখে সাহিত্যিক-খ্যাতি পেয়েছিলেন, তাঁকে কোন কুঠরিতে রাখব? উড়িষ্যাও তো বাংলার বাইরে। অন্য আর-এক ভারি ঝলোমলো ঘর আছে, তাতে মুল্ক্রাজ আনন্দ, শশী খারুর, সালমান রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, অরুদ্ধতী রায়, রোহিন্তন মিস্ত্রিদের বসতি : দেশী-প্রবাসীর ভাঙা উঠোনে তাঁরা কোথাও নেই, বিভাষা ইংরেজিতে লিখে তাঁরা ইংরেজি ভাষার মূল স্রোতে সাঁতরাচ্ছেন।

*

এই গপ্পো ভাষা ও ভাষাশ্রমিকের সম্পর্কের অসরল বুনটের এক খতিয়ান। এহেন চালচিত্র পেছনে টাঙানো, তার সামনে প্রবাসী বাঙালি বাণীশিল্পীদের ইচ্ছা, শ্রম ও সাধনাকে বসিয়ে দেখতে চাওয়ার মূল্য আছে। দেশের বাইরে বসে কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মেলনে উদ্দেশ্য এমন হওয়ার কথা নয় যে কোনো শিল্পধারার বিচার ও রায় ঘোষণা করা হবে; সেই ভার থাকে মহাকালের হাতে, সবাই জানি। সম্মেলনের মূল ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য, আমার বিবেচনায় দুই ভূখ-ে বসবাসরত একই ভাষা ও সংস্কৃতির সৃজনশীল কিছু শিল্পী ও ভাবুকের সম্মিলন: প্রথমত স্বদেশের সহযাত্রীদের সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করানো, মৈত্রীবন্ধনে বাধা, দ্বিতীয়ত স্বদেশ ও প্রবাসের সাহিত্যশিল্পসংস্কৃতি সংক্রান্ত বাস্তবতা পরস্পরকে অবহিত করানো এবং সর্বোপরি যে প্রবাসের দিনানুদিন যাপিত জীবন দেশকে স্মৃতি থেকেও মুছে দিতে চায়, সেই দেশকে স্মৃতিতে ও অস্তিত্বে নবায়ন করে নেওয়া, নিজের সৃজনকল্পনাতে নতুন শক্তি ও বেগ সঞ্চারের আকাক্সক্ষা এবং এ-সবই আমন্ত্রিত অভ্যাগত স্বজনদের হাত ধরে, হাতে হাত রেখে। এর বাইরে মহত্তর অর্জন আর কীই-বা হতে পারে?

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমাজ ও আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার কারণে, আমরা লক্ষ্য করছি, এক যুগেরও অধিক কাল ধরে দেশের মানুষ ঘর ছাড়ছে। বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের মানবসম্পদ ভাড়া খাটানোর কথা হিসেবের বাইরে রেখেও দেখা যাচ্ছে, দেশের শিক্ষিত কৃতবিদ্য মেধাবী মানুষজন অনেকেই হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রবাসজীবন বেছে নিচ্ছেন। ইওরোপ, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, সবখানেই বাংলাদেশী নাগরিক খুঁজে পাওয়া যাবে। এঁদের ভেতরে সংখ্যালঘু একটি অংশ রয়েছে যাঁরা বাংলাদেশের অগ্রণী চিন্তার মানুষ হিসেবে স্বদেশেই গণ্য হয়ছেন; অনেকেরই অবদান সমাজে স্বীকৃত ছিল, অনেক তরুণের প্রতিভা ছিল জায়মান।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যে বলতে পারি, কানাডার টরন্টো শহরে যাঁদের স্থিতি এবং ক্রমবর্ধমান হারে যে-ধরনের সৃজনভাবনাতাড়িত মানুষের আগমন প্রত্যক্ষ করছি তাতে বিষণ্ন না হয়ে আমার উপায় নেই। সৃষ্টিশীল ভাবুক একদল মানুষের দেখা পাচ্ছি যাঁদের কেউ চিত্রকর, কেউ কবি, কেউ নাট্যকার বা মঞ্চশিল্পী, আবার কেউ কথাশিল্পী। প্রবাসের দিন যাপনে অচেনা বিভুঁইয়ের সমাজ ব্যবস্থা সেই অবকাশ দেয় না কিংবা মানসিক শান্তি, অথবা সমচিন্তকদের গোষ্ঠীসংঘ যেখানে নিজের শিল্প সংবেদনার আত্মিক ক্ষুধা নিয়ে কেউ ভাবনাচিন্তা করতে পারেন। নিজের দেশ ও ভাষা-সংস্কৃতির মূল স্রোত থেকে ছিন্ন হওয়াতেই এমন অনিবার্য নিয়তি। এই বাস্তবতা এক বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে দেয়, যা প্রবাসীকে স্বনির্মিত এক অলীক বাস্তবতার মোড়কে ঢেকে ফেলে। এটাই তার বেঁচে থাকবার জিয়নকাঠি। বিদেশে বসেও সে কবিতা কি গান লেখে, গল্প-উপন্যাসের বিষয় নিয়ে ভাবে, নাটক রচনার চিন্তা করে, যন্ত্রে কি যন্ত্রবিহীন কণ্ঠে সুর ভাঁজে, নয়তো মনে মনে মঞ্চ পরিকল্পনা করে চলে কোন নাটকের ইত্যাদি; কিন্তু সে-সবের খবর মূল স্রোতের মানুষেরা পায় না; কেননা অতিদূরে গিয়ে পৌঁছুনোর কোন সম্বন্ধ সূত্র নেই। নিজেদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে এঁরা বেঁচে থাকেন, এক কল্প জগতের অধিবাসী যেন তাঁরা। এই কল্প জগতের বাসিন্দারা অটোয়া-মন্ট্রিয়ল-টরন্টো কি নিউইয়র্ক বা লন্ডন কি কোন বিলেতি শহর সবখানেই রয়েছেন। তাঁদের ভাবনার জগৎ কিংবা শিল্প রচনার মেধা নিজেদের ছোট গ-ির চৌহদ্দিতেই থেকে যায়, বাইরে ছড়াবার সুযোগ পায় না। স্ফুরণ ও বহিঃপ্রকাশের সহজ স্বাভাবিক গতিপথ না থাকায় মননে ও হৃদয়ে বিক্ষেপ ঘটে, অভিমান জন্মায়, মূল স্রোতের অস্তিত্বকে পাশ কাটিয়ে বা ভুলে থেকে নিজস্ব জলাধার তৈরিতে মন দেয়, কিন্তু তা সফল হওয়ার নয় বলেই ব্যর্থ হয়। লেখকবৃত্তির বাঙালি মানুষজন বিদেশের মাটিতে কোথাও নিজেদের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির জগৎ নির্মাণ করে নিতে পেরেছেন বলে আমি অন্তত জানি না।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে শিল্প সাধনার যে অব্যাহত ধারা, আন্দোলন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রচেষ্টা ইত্যাদি সেখানে দেশান্তরী স্বদেশী প্রতিভা নিয়ে তেমন কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, আবেগ-উল্লাস জাগে না। আমরা এই মুহূর্তেই এমন কিছু তরুণ বা নাতিতরুণ কবি-সাহিত্যিককে জানি যাঁরা উত্তর আমেরিকায় বা ইওরোপে-বিলেতে বসে বাংলায় লিখে যাচ্ছেন এবং সুনাম অর্জন করেছেন, তবে তা বাংলাদেশের লেখালেখির মূল প্রবাহের সঙ্গে মিশে গিয়ে। তাঁদের বিদেশে থাকা একান্তই শারীরিক-সাংসারিক অবস্থানগত, তা মনোজাগতিক নয়। তাঁরা বিদেশে থাকলেও চিন্তায় ও মননে নিজের দেশকে নিয়েই থাকেন এবং সেসব চিন্তা ও অনুভবের উৎসারণ ঘটে তাদের লেখাপত্রে।

অথচ এ-সবের পরেও সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এক অশুভ লক্ষণ আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে যার ভেতরে কোনো ধরনের ঈর্ষা সক্রিয় বলে আমার ধারণা। মনোভাব যেন অনেকটাই এমন- তুমি বিদেশে বসে বেশ তো আরাম-আয়েসে আছ বাপু, দুধ-রুটি মাখন খুব খাচ্ছ, আর ফেব্রুয়ারি এলেই নিজের পয়সায় প্রকাশককে দিয়ে বই ছাপিয়ে লেখক নাম কুড়োচ্ছ, লেখক হওয়া অত ফুর্তির ব্যাপার নয় হে, বুঝতাম হিম্মত- যদি আমাদের মতো এত্ত জ্বালাযন্ত্রণা দুঃখ-কষ্ট সইতে সইতে লিখতে পারতে। এমন অসূয়াপ্রসূত মনোভাব অহেতুক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দেয়, অপরিচয়ের দেওয়াল। এর প্রত্যক্ষ কারণ সম্ভবত এই যে, দেশের পাঠক ও লেখকদের সামনে প্রবাসী লেখকের আকস্মিক উপস্থিতি, দেশের ভেতরে রচনা প্রকাশের ধারাবাহিকতা না থাকা। নইলে সৃজনক্ষমতার সঙ্গে ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য-বিত্তপ্রতিপত্তি ইত্যাদির দৃশ্যত কোনো স্পষ্ট সম্পর্ক নেই, থাকলে নজরুল-সুকান্ত বা মানিক দস্তইয়েফ্স্কিদের দেখা মিলত না।

আমরা যারা ষাট পেরিয়ে এসেছি তাদের শনাক্ত করা হয় গত শতকের ষাটের প্রজন্মের সাহিত্যব্রতী হিসেবে। সংখ্যায় আমরা বিপুলায়তন ছিলাম না। আমাদের সকলেরই বয়স কমবেশি ছিল বিশ থেকে তিরিশের কোঠায়। সাহিত্য নিয়ে দল-উপদল তর্ক-বিতর্ক থাকলেও ছিল যৎসামান্য, কিন্তু নিজেদের ভেতরে মনের লেনদেন অটুট থেকেছে। লিটল ম্যাগাজিনের সূত্রপাত আমাদের হাত দিয়েই হয়। আর সবই ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। এর ফলে সাহিত্যচর্চার বাইরে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক এড়িয়েও হৃদ্যিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতো, তার উৎসবিন্দুতে রাজনীতি-ভাবনা প্রায় থাকতই না, ছিল মেজাজের সাযুজ্যে বন্ধুতা, আর তা এতখানিই গভীর যে এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহাল রয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশী সাহিত্যের দৃশ্যপট বিশালভাবে পাল্টে গেছে, অনেকটা আমাদের সমাজের ভাঙাগড়ার মতোই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এত কবি-সাহিত্যিক লিখছেন, এত বহুভঙ্গিম চরিত্রের ছোটবড় সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে এবং সেসব কেবল রাজধানী শহর থেকেই নয়, অন্যান্য শহর থেকেও এত দল-মত-পথের পরস্পরবৈরী খাত তৈরি হয়েছে যে আমরা প্রবীণের দল কোনো দিক দিয়েই কুলিয়ে উঠতে পারছি না। জনমনোহারী লেখা যেমন অনেকে লিখছেন, তেমনি নিরীক্ষাধর্মী, মস্তিষ্কপ্রবণ, জিজ্ঞাসু, শৈলীগতভাবে দুরূহ রচনারও প্রচুর চর্চা হচ্ছে। গল্পকার অনেক এসেছেন, শক্তিমন্ত— কথা-সাহিত্যিক ও কবির সংখ্যা বিপজ্জনক হারে স্ফীতকায়, আবৃত্তিতে, নাট্যচর্চায়, গানের জগতে কতই-না নতুন নতুন মুখ- এবং সকলেই অল্পবিস্তর নবীন। এই পরিস্থিতিই সত্যিকার আনন্দ ও আশার কথা। কে কখন কোন কালজয়ী রচনা লিখবেন সে হিসেব দূরভবিষ্যের ঝুলিতে জমা থাকুক। আমরা বুঝি, দেশের সংস্কৃতি নিয়ে এত নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী থাকলে তাদের ভেতর থেকে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার প্রতিভা অনেকেই দেশ ও দশকে আলোকিত করবেন।

কিন্তু অনেক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে যে, এসব প্রতিষ্ঠিত ও সম্ভাবনাময় কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক নানা ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণে দেশান্তরী হচ্ছেন। দৈশিক সংস্কৃতিক পরিম-লে এর ফলে প্রতিকারহীন যে-শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রতিকূল প্রভাব ও অভিঘাত তো হতে বাধ্য। অন্যদিকে এমন ভয়ও অমূলক নয় যে, প্রবাস জীবনে তাঁদের শিল্প সাধনা বিঘিœত হবে, অনুকূল পরিবেশের অভাবে তাঁদের প্রয়াস নিষ্ফলা হবে।

এই মনোজাগতিক ও বাইরের বস্তুগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার এক অব্যর্থ উপায় হতে পারে স্বদেশের সঙ্গে নিত্য সংযোগ রেখে মূল স্রোতের ভেতরে থেকে যাওয়া। বাংলা ভাষায় রচিত বাঙালির সাহিত্য বিদেশে বসে লেখা গেলেও তাকে স্বদেশের পাঠক ও রসভোক্তার কাছে যেতেই হবে। বাঙালি মনের গড়নের বিশেষ এক ছাঁচ আছে। সেই ছাঁচকে বলা যেতে পারে হোমসিকনেস, ঘরের জন্যে মন-কেমন-করা রোগ। কে জানে, আরণ্য-সংস্কৃতিভিত্তিক ভারতবর্ষীয় উপমহাদেশে এটিই আদি ব্যাধি কি না; নইলে যুধিষ্ঠিরের মুখ থেকে অমন আর্যবাক্য নিঃসৃত হয় কেমন করে!

বাঙালি তার নিজের ঘরেই থাকে, হয়তো তা বাংলাদেশ। বাঙালি বহির্বিশ্বের যেখানেই থাকুক তার মনের ভেতরে থেকে যায় বাংলাদেশ, যেন বুকের গভীরে স্বদেশভূমির বনসাই। মূল স্রোতে অবগাহনেই তার শক্তি ও সমৃদ্ধি-শিল্পীসত্তার। বাইরে ছড়ানো বাঙালি তখনই ঐশ্বর্যবান হবে যখন বাইরের মণিমুক্তো নিজের ঘরে আনবে, নিজের ভাষাশিল্পের শরীর প্রয়োজন মতো সাজাবে। তখনই তার বাইরে আসা যে ঘরে ফিরে যাবার জন্যেই, সেই সত্য প্রমাণ হবে। প্রমাণের দায় শিল্পসাহিত্যের হাতে থাকলেই সবদিক রক্ষা হবে।