আমগাছ

মহসীন হাবিব

আজমল সাহেব লম্বা, একহারা গড়নের মানুষ। মুখে ফ্রেন্সকাট দাড়ি। চোখে ভারি চশমা। পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে তার চোখ-দুটো অনেক বড় দেখা যায়। তাঁর শরীরটা যেমন বাঁশের মতো সোজা, ভেতরের মানুষটাও নাকি তেমন। প্যাঁচগোজ বোঝেন না। কথা বলেন সোজাসুজি। নিজেও দাবি করেন, ‘আমার কাছে সোজা কথা আমি প্যাঁচগোজের মইধ্যে নাই।’

শুক্রবার বিকালবেলা আজমল সাহেব বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে এলাকারই ছোটখাটো এক রাজমিস্ত্রী। সে বলল, ‘নকশা ছাড়া ঘর উঠাবেন কাকা?’

‘হ। পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনি দিয়া দুইটা রুম তুইলা দিবা, তারপর উপরে টিন দিয়া মাথাটা মুইড়া দিবা। এতে আবার নকশা কী?’

‘আমি তুলতে পারব কাকা, কোনো সমস্যা নাই। আজীবন আমরা নকশা দিয়া কাজ করছি নাকি?’

‘আর শুনো মিস্ত্রী, ঘরের সঙ্গে একটা বারান্দা থাকবে, লাল সিমেন্টের বারান্দা।’

পাশের বাড়ির মান্নান এসে কখন পেছনে দাঁড়িয়েছে আজমল সাহেব খেয়াল করেননি। সে বলল, ‘কাকা, ঘর যখন তুলবেনই তখন বড় কইরা তুলেন।’

আজমল সাহেব ঘুরে মোটা চশমার ভেতর দিয়ে মান্নানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উপদেশ দিতেছ ভালো কথা। বড় ঘর তুলতে পারলে তো ভালোই হয়। তয় টাকা দেও।’

‘কী কন কাকা, আপনি ভূমি অফিসে চাকরি করেন। টাকার চিন্তা করেন?’

‘ক্যা, আমার অফিসে কি টাকার মেশিন আছে, টাঁকশাল?’

মান্নান জানে আজমল সাহেব রেগে যেতে পারেন। সরল সোজা মানুষটারে তার মাঝে মাঝে রাগাতে ভালোই লাগে। সে বলল, ‘আছে তো কাকা। শোনা যায় ভূমি অফিসের টেবিল-চেয়ারও ঘুষ খায়।’

আজমল সাহেব ডিপার্টমেন্টের বদনামে খানিকটা রাগলেন, ‘তুমি তো পোস্ট আফিসে চাকরি করো, ঘুষ পাও?’

মান্নান বিরক্তির সুরে বলল, ‘পোস্ট অফিসে ঘুষ আছে নাকি কাকা! সবচে মরা ডিপার্টমেন্ট!’

আজমল সাহেব এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘শুনো, যে খায় সে মরা ডিপার্টমেন্টরেও তাজা কইরা খায়। মাইনসের দরকারি কাগজ আসলে, তারপর সঞ্চয়পত্র ভাঙাইতে গেলে তোমরা হেনস্থা কইরা টাকা রাখো না? সব জানি। ছোট চাকরি করো, তুমি অত বড় বাড়ি বানাইছ কী দিয়া!’

আজমল সাহেবের স্ত্রী রোকেয়া বেগম কাছেই দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এখনই জামিলের আব্বা আরো রেগে যাবেন, শেষে কাজের কথা আর কিচ্ছু হবে না। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘এই মান্নান, বাড়ি যাও, তোমার কাকারে কাজ করতে দেও!’

রোকেয়া বেগম আজমল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোনেন, আবার বারান্দার দরকার কী, তারচেয়ে তিনটা ঘর করলে ভালো হইতো না?’

স্ত্রীর কথায় মনোযোগ দিয়ে তিনি স্বাভাবিক হলেন। বললেন, ‘হইলে ভালোই হয়। কিন্তু বারান্দারও দরকার আছে। জামিল আর আক্তার মাঝেমইধ্যে বসতে পারে। তুমিও বসবা। দক্ষিণ দিক থিকা বাতাস আসবে। ওই কী জানি কয়, বলতে বলতে এক পর্যায়ে আখতারের সেই চাচা বললেন, ‘আখতার, তুমি মামারে বাবা ডাকো কেন! মামা হইলেন মামা। তারে কি বাপ ডাকা যায়! আইজ থিকা তুমি মামা ডাকবা! মামা হইল মানুষের বাপের চেয়েও বড় আবদারের জায়গা। কথায় কয় না, মামা বাড়ির আবদার!’

জামিলের পিতা মাথা নিচু করে বসেছিলেন। আখতার তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আজমল সাহেব বললেন, ‘যা খুশি ডাকতে পারিস। তোর চাচা যখন আপত্তি করতেছেন, মামাই ডাক।’

আখতার আর জামিল একসঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পাস করল। কলেজে ভর্তি হলো। জামিল সরকারি কলেজে চান্স পেলেও আখতারকে ভর্তি হতে হলো বেসরকারি কলেজে। থাকতে হবে ঢাকায়। আজমল সাহেব আর রোকেয়া বেগমের মনে হলো একই পাতার দুটি বৃন্ত যেন ছিন্ন হয়ে গেল। আখতারকে ঢাকায় সব ব্যবস্থা করে দিয়ে আজমল সাহেব বললেন, যত কষ্টই হোক, আমি তোর লেখাপড়ার টাকা জোগাড় করে পাঠাব। তুই কোনো চিন্তা করবি না। তোর কাজ শুধু লেখাপড়া করা, বুঝলি? আমি এখন যাই রে।’

মানব সমাজের জন্য সময়টা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে চলে না। কারো কারো জন্য সময় কখনো মন্থর হয়ে যায়, কারো জন্য আবার দ্রুত হয়ে যায়। পালটে যায় জীবনের দৃশ্যপট।

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আখতার একদিন বাড়ি গেল। একটু চুপচাপ। খেতে বসে আজমল সাহেব জানতে চাইলেন, ‘কি রে, কোনো সমস্যা?’

আখতার মাথা নেড়ে বলল, ‘না, কোনো সমস্যা না। মামা, আমি কানাডায় চান্স পাইছি।’

তারপর থেকেই ঝড়ের মতো পালটে গেল সবকিছু।

জামিল দীর্ঘকাল বেকার। সময় এত পার হয়েছে যে জামিল এখন আর কিছু করবে সে চিন্তা পাড়া প্রতিবেশিও বাদ দিয়েছে, নিজেও বাদ দিয়েছে। সবাই ভেবেছিল জামিলকে আখতার কানাডা নিয়ে যাবে। রোকেয়া বেগম ছেলের বেকারত্ব দেখে অস্থির হয়ে একবার আখতারকে ফোন দিয়েছিলেন। আখতার জানিয়ে দিয়েছে, কানাডা এসে লাভ নেই মামি, এখানে এখন কোনো সুযোগ সুবিধা নেই।

জামিল এসব ভাবতে ভাবতেই শহর আলীর চায়ের দোকানে এসে বসল। স্কুল-বন্ধু মন্টুও সেখানে আসে। দেখা হলে রাজনীতি, ক্রিকেট খেলা, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, মন্টুর বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া সবকিছু নিয়েই আলাপ হয়।

জামিলকে দেখেই মন্টু বলল, ‘কী রে, তোর মন খারাপ নাকি?’

দোকানদার শহর আলীর দিকে তাকিয়ে মন্টু বলল, ‘আমাগো দুই কাপ চা দেও। আর দুইটা সিগারেট।’

জামিলের দিকে তাকিয়ে মন্টু বলল, ‘আচ্ছা, আখতার ভাইয়ের খবর কী রে?’

‘কী জেন, জানি না।’

‘ঢাকায় থাকে, না কানাডায়?’

‘এখন ঢাকাতেই থাকে।’

‘তাই তো, এখন আর কানাডা যাবে কী করতে। ঢাকায় বিরাট বড়লোকের মেয়ে বিয়া করছে। নিজেও অনেক বছর কানাডায় ভালো কামাই করছে। এখন সুখ আর সুখ। বাড়ি করছে কুথায়, ধানমন্ডিতে না?’

‘হুম, শশুর বাড়ি থিকাও তিনটা ফ্ল্যাট পাইছে।’

‘তয় আর কী। কিছুদিন আগে বলে আমাগো মোতালেবের সাথে দেখা হইছিল। আখতার ভাই নাকি এখন সারাদিন নামাজ রোজা নিয়া থাকে?’

‘হুম।’

‘বিশাল লম্বা দাড়ি রাখছে শুনলাম। মোতালেবরে অনেক উপদেশ দিছে। মোতালেবরে বলছে, মোতালেব এই পোশাক ছাড়ো। পায়জামা পরবা। পায়জামা পরবা টাকনুর উপরে। অ্যাঙ্কেল পর্যন্ত পড়ার নিয়ম নাই।’

‘তাই?’

‘হে, বলছে, এই জগতে আর কয়দিন। সব রাইখা চইলা যাইতে হবে। নামাজটা ঠিকঠাক মতো পইড়ো।’

‘ভালো কথাই তো বলছে।’

‘মোতালেব জিজ্ঞেস করছিল, এলাকায় যাবা না?’ আখতার ভাই বলছে, ‘আমার হাতে তো কিছু নাই, সব মালিকের ইচ্ছা। তিনি চাইলে আমি যাব না, এমন সাধ্য আমার আছে?’

জামিল, হেসে দিয়ে বলল, ‘অর্থাৎ আল্লাহ চায় না যে আখতার ভাই বাড়িতে আসুক?’

মন্টু শহর আলীর হাত থেকে চা নিতে নিতে বলল, ‘হইতে পারে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। কানাডা গিয়া প্রথম দুইবার এইখানে আসছিল, তখন আমার সাথে দেখা হইছে। আখতার ভাইরে তারপর আর দেখি নাই। তুই তো ভাই, তোর সাথে তো মজার গল্প করতে পারে না। আমাগো সাথে অনেক মজার গল্প করতো।’

মন্টু তারপর নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলল, ‘আখতার ভাইয়ের কাছেই প্রথম ইরোটিক সব গল্প শুনছি। তার দুই তিনটা বান্ধবি ছিল। তাদের সঙ্গে ডিসকোতে, বার-এ যাইতো।’

চায়ে চুমুক দিয়ে মন্টু আবার বলল, ‘আসলে তোরে যে কানাডায় নেয় নাই, তার কারণ ওইডাই। হারে! কত মানুষ দেশে ভাই বেরাদার নিয়া যাইতেছে সমানে। কানাডায় তো আরো সহজ। উনি যখন গেছেন তখন তো কানাডায় গিয়া নামলেই কাগজপত্র চাকরি-বাকরি রেডি।’

‘হইতে পারে, বাদ দে। আখতার ভাইয়ের গল্প ভালো লাগতেছে না।’

রোকেয়া বেগম দেখলেন জামিল বাড়ি নাই। এই সময় আখতাররে একটা ফোন দেওয়া যায়। আখতার ওপাশ থেকে ফোন না ধরলেই জামিল রাগ হয়!

আখতারের ফোন বাজল। রোকেয়া বেগমের খুব ইচ্ছা করে আখতারকে একটু ভিডিও কলে দেখতে। অনেকদিন দেখেন না। শুনেছেন দাড়ি পেকেছে, পুরো ইসলামিক ড্রেস পরে! কিন্তু আখতারকে একদিন বললেও সে বলেছে- ‘না মামি, ভিডিও করে দেখাটা সহি না।’

ফোন রিসিভ করল আখতারের স্ত্রী, ‘হ্যালো।’

রোকেয়া বেগম বললেন, ‘মা তোমরা ভালো আছো?’

‘না, ভালো আর থাকি কই। নানা ঝামেলা নিয়ে থাকতে হয়। আপনারা ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ মা, আমরা ভালো আছি। আখতার বাসায় নাই?’

‘আছে, ও মসজিদে যাবে তো অজু করতে গেল। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি মামি। পরে কথা হবে।’

ফোন কেটে গেল। রোকেয়া বেগম বলতে চেয়েছিলেন, আখতার ফ্রি হইলে একটু ফোন করতে বইল। কিন্তু বলতে পারলেন না। তিনি বেশ কিছুক্ষণ বারান্দার পাশের আম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে পড়ল, বাজার থেকে মিষ্টি আম এনেছিলেন আজমল সাহেব। তখন ওদের বাসায় বারো-তেরো বছর। দুই ভাই দুটো করে আম তৃপ্তি নিয়ে খেল। আখতার বলল, ‘আমি এই জায়গায় আমের আঁটি লাগাব।’ ওর দেখাদেখি জামিলও অন্যপাশে দুটো আমের আঁটি পুতে দিয়েছিল। কিছুদিন পর দেখা গেল আখতারের পুঁতে দেওয়া আঁটি থেকে একটি চারা বের হয়েছে। আরগুলো হয়নি। রোকেয়া বেগম যত্ন করে গাছটি বড় করে তুলেছেন।

দূর থেকে দেখা গেল জামিল আসছে।

জামিল কাছে আসতেই রোকেয়া বেগম খুবই শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘জামিল, এই আমগাছটা কেটে ফেল।’

তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে চলে গেলেন।

বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

আমগাছ

মহসীন হাবিব

image

আজমল সাহেব লম্বা, একহারা গড়নের মানুষ। মুখে ফ্রেন্সকাট দাড়ি। চোখে ভারি চশমা। পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে তার চোখ-দুটো অনেক বড় দেখা যায়। তাঁর শরীরটা যেমন বাঁশের মতো সোজা, ভেতরের মানুষটাও নাকি তেমন। প্যাঁচগোজ বোঝেন না। কথা বলেন সোজাসুজি। নিজেও দাবি করেন, ‘আমার কাছে সোজা কথা আমি প্যাঁচগোজের মইধ্যে নাই।’

শুক্রবার বিকালবেলা আজমল সাহেব বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে এলাকারই ছোটখাটো এক রাজমিস্ত্রী। সে বলল, ‘নকশা ছাড়া ঘর উঠাবেন কাকা?’

‘হ। পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনি দিয়া দুইটা রুম তুইলা দিবা, তারপর উপরে টিন দিয়া মাথাটা মুইড়া দিবা। এতে আবার নকশা কী?’

‘আমি তুলতে পারব কাকা, কোনো সমস্যা নাই। আজীবন আমরা নকশা দিয়া কাজ করছি নাকি?’

‘আর শুনো মিস্ত্রী, ঘরের সঙ্গে একটা বারান্দা থাকবে, লাল সিমেন্টের বারান্দা।’

পাশের বাড়ির মান্নান এসে কখন পেছনে দাঁড়িয়েছে আজমল সাহেব খেয়াল করেননি। সে বলল, ‘কাকা, ঘর যখন তুলবেনই তখন বড় কইরা তুলেন।’

আজমল সাহেব ঘুরে মোটা চশমার ভেতর দিয়ে মান্নানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উপদেশ দিতেছ ভালো কথা। বড় ঘর তুলতে পারলে তো ভালোই হয়। তয় টাকা দেও।’

‘কী কন কাকা, আপনি ভূমি অফিসে চাকরি করেন। টাকার চিন্তা করেন?’

‘ক্যা, আমার অফিসে কি টাকার মেশিন আছে, টাঁকশাল?’

মান্নান জানে আজমল সাহেব রেগে যেতে পারেন। সরল সোজা মানুষটারে তার মাঝে মাঝে রাগাতে ভালোই লাগে। সে বলল, ‘আছে তো কাকা। শোনা যায় ভূমি অফিসের টেবিল-চেয়ারও ঘুষ খায়।’

আজমল সাহেব ডিপার্টমেন্টের বদনামে খানিকটা রাগলেন, ‘তুমি তো পোস্ট আফিসে চাকরি করো, ঘুষ পাও?’

মান্নান বিরক্তির সুরে বলল, ‘পোস্ট অফিসে ঘুষ আছে নাকি কাকা! সবচে মরা ডিপার্টমেন্ট!’

আজমল সাহেব এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘শুনো, যে খায় সে মরা ডিপার্টমেন্টরেও তাজা কইরা খায়। মাইনসের দরকারি কাগজ আসলে, তারপর সঞ্চয়পত্র ভাঙাইতে গেলে তোমরা হেনস্থা কইরা টাকা রাখো না? সব জানি। ছোট চাকরি করো, তুমি অত বড় বাড়ি বানাইছ কী দিয়া!’

আজমল সাহেবের স্ত্রী রোকেয়া বেগম কাছেই দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এখনই জামিলের আব্বা আরো রেগে যাবেন, শেষে কাজের কথা আর কিচ্ছু হবে না। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘এই মান্নান, বাড়ি যাও, তোমার কাকারে কাজ করতে দেও!’

রোকেয়া বেগম আজমল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোনেন, আবার বারান্দার দরকার কী, তারচেয়ে তিনটা ঘর করলে ভালো হইতো না?’

স্ত্রীর কথায় মনোযোগ দিয়ে তিনি স্বাভাবিক হলেন। বললেন, ‘হইলে ভালোই হয়। কিন্তু বারান্দারও দরকার আছে। জামিল আর আক্তার মাঝেমইধ্যে বসতে পারে। তুমিও বসবা। দক্ষিণ দিক থিকা বাতাস আসবে। ওই কী জানি কয়, বলতে বলতে এক পর্যায়ে আখতারের সেই চাচা বললেন, ‘আখতার, তুমি মামারে বাবা ডাকো কেন! মামা হইলেন মামা। তারে কি বাপ ডাকা যায়! আইজ থিকা তুমি মামা ডাকবা! মামা হইল মানুষের বাপের চেয়েও বড় আবদারের জায়গা। কথায় কয় না, মামা বাড়ির আবদার!’

জামিলের পিতা মাথা নিচু করে বসেছিলেন। আখতার তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আজমল সাহেব বললেন, ‘যা খুশি ডাকতে পারিস। তোর চাচা যখন আপত্তি করতেছেন, মামাই ডাক।’

আখতার আর জামিল একসঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পাস করল। কলেজে ভর্তি হলো। জামিল সরকারি কলেজে চান্স পেলেও আখতারকে ভর্তি হতে হলো বেসরকারি কলেজে। থাকতে হবে ঢাকায়। আজমল সাহেব আর রোকেয়া বেগমের মনে হলো একই পাতার দুটি বৃন্ত যেন ছিন্ন হয়ে গেল। আখতারকে ঢাকায় সব ব্যবস্থা করে দিয়ে আজমল সাহেব বললেন, যত কষ্টই হোক, আমি তোর লেখাপড়ার টাকা জোগাড় করে পাঠাব। তুই কোনো চিন্তা করবি না। তোর কাজ শুধু লেখাপড়া করা, বুঝলি? আমি এখন যাই রে।’

মানব সমাজের জন্য সময়টা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে চলে না। কারো কারো জন্য সময় কখনো মন্থর হয়ে যায়, কারো জন্য আবার দ্রুত হয়ে যায়। পালটে যায় জীবনের দৃশ্যপট।

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আখতার একদিন বাড়ি গেল। একটু চুপচাপ। খেতে বসে আজমল সাহেব জানতে চাইলেন, ‘কি রে, কোনো সমস্যা?’

আখতার মাথা নেড়ে বলল, ‘না, কোনো সমস্যা না। মামা, আমি কানাডায় চান্স পাইছি।’

তারপর থেকেই ঝড়ের মতো পালটে গেল সবকিছু।

জামিল দীর্ঘকাল বেকার। সময় এত পার হয়েছে যে জামিল এখন আর কিছু করবে সে চিন্তা পাড়া প্রতিবেশিও বাদ দিয়েছে, নিজেও বাদ দিয়েছে। সবাই ভেবেছিল জামিলকে আখতার কানাডা নিয়ে যাবে। রোকেয়া বেগম ছেলের বেকারত্ব দেখে অস্থির হয়ে একবার আখতারকে ফোন দিয়েছিলেন। আখতার জানিয়ে দিয়েছে, কানাডা এসে লাভ নেই মামি, এখানে এখন কোনো সুযোগ সুবিধা নেই।

জামিল এসব ভাবতে ভাবতেই শহর আলীর চায়ের দোকানে এসে বসল। স্কুল-বন্ধু মন্টুও সেখানে আসে। দেখা হলে রাজনীতি, ক্রিকেট খেলা, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, মন্টুর বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া সবকিছু নিয়েই আলাপ হয়।

জামিলকে দেখেই মন্টু বলল, ‘কী রে, তোর মন খারাপ নাকি?’

দোকানদার শহর আলীর দিকে তাকিয়ে মন্টু বলল, ‘আমাগো দুই কাপ চা দেও। আর দুইটা সিগারেট।’

জামিলের দিকে তাকিয়ে মন্টু বলল, ‘আচ্ছা, আখতার ভাইয়ের খবর কী রে?’

‘কী জেন, জানি না।’

‘ঢাকায় থাকে, না কানাডায়?’

‘এখন ঢাকাতেই থাকে।’

‘তাই তো, এখন আর কানাডা যাবে কী করতে। ঢাকায় বিরাট বড়লোকের মেয়ে বিয়া করছে। নিজেও অনেক বছর কানাডায় ভালো কামাই করছে। এখন সুখ আর সুখ। বাড়ি করছে কুথায়, ধানমন্ডিতে না?’

‘হুম, শশুর বাড়ি থিকাও তিনটা ফ্ল্যাট পাইছে।’

‘তয় আর কী। কিছুদিন আগে বলে আমাগো মোতালেবের সাথে দেখা হইছিল। আখতার ভাই নাকি এখন সারাদিন নামাজ রোজা নিয়া থাকে?’

‘হুম।’

‘বিশাল লম্বা দাড়ি রাখছে শুনলাম। মোতালেবরে অনেক উপদেশ দিছে। মোতালেবরে বলছে, মোতালেব এই পোশাক ছাড়ো। পায়জামা পরবা। পায়জামা পরবা টাকনুর উপরে। অ্যাঙ্কেল পর্যন্ত পড়ার নিয়ম নাই।’

‘তাই?’

‘হে, বলছে, এই জগতে আর কয়দিন। সব রাইখা চইলা যাইতে হবে। নামাজটা ঠিকঠাক মতো পইড়ো।’

‘ভালো কথাই তো বলছে।’

‘মোতালেব জিজ্ঞেস করছিল, এলাকায় যাবা না?’ আখতার ভাই বলছে, ‘আমার হাতে তো কিছু নাই, সব মালিকের ইচ্ছা। তিনি চাইলে আমি যাব না, এমন সাধ্য আমার আছে?’

জামিল, হেসে দিয়ে বলল, ‘অর্থাৎ আল্লাহ চায় না যে আখতার ভাই বাড়িতে আসুক?’

মন্টু শহর আলীর হাত থেকে চা নিতে নিতে বলল, ‘হইতে পারে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। কানাডা গিয়া প্রথম দুইবার এইখানে আসছিল, তখন আমার সাথে দেখা হইছে। আখতার ভাইরে তারপর আর দেখি নাই। তুই তো ভাই, তোর সাথে তো মজার গল্প করতে পারে না। আমাগো সাথে অনেক মজার গল্প করতো।’

মন্টু তারপর নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলল, ‘আখতার ভাইয়ের কাছেই প্রথম ইরোটিক সব গল্প শুনছি। তার দুই তিনটা বান্ধবি ছিল। তাদের সঙ্গে ডিসকোতে, বার-এ যাইতো।’

চায়ে চুমুক দিয়ে মন্টু আবার বলল, ‘আসলে তোরে যে কানাডায় নেয় নাই, তার কারণ ওইডাই। হারে! কত মানুষ দেশে ভাই বেরাদার নিয়া যাইতেছে সমানে। কানাডায় তো আরো সহজ। উনি যখন গেছেন তখন তো কানাডায় গিয়া নামলেই কাগজপত্র চাকরি-বাকরি রেডি।’

‘হইতে পারে, বাদ দে। আখতার ভাইয়ের গল্প ভালো লাগতেছে না।’

রোকেয়া বেগম দেখলেন জামিল বাড়ি নাই। এই সময় আখতাররে একটা ফোন দেওয়া যায়। আখতার ওপাশ থেকে ফোন না ধরলেই জামিল রাগ হয়!

আখতারের ফোন বাজল। রোকেয়া বেগমের খুব ইচ্ছা করে আখতারকে একটু ভিডিও কলে দেখতে। অনেকদিন দেখেন না। শুনেছেন দাড়ি পেকেছে, পুরো ইসলামিক ড্রেস পরে! কিন্তু আখতারকে একদিন বললেও সে বলেছে- ‘না মামি, ভিডিও করে দেখাটা সহি না।’

ফোন রিসিভ করল আখতারের স্ত্রী, ‘হ্যালো।’

রোকেয়া বেগম বললেন, ‘মা তোমরা ভালো আছো?’

‘না, ভালো আর থাকি কই। নানা ঝামেলা নিয়ে থাকতে হয়। আপনারা ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ মা, আমরা ভালো আছি। আখতার বাসায় নাই?’

‘আছে, ও মসজিদে যাবে তো অজু করতে গেল। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি মামি। পরে কথা হবে।’

ফোন কেটে গেল। রোকেয়া বেগম বলতে চেয়েছিলেন, আখতার ফ্রি হইলে একটু ফোন করতে বইল। কিন্তু বলতে পারলেন না। তিনি বেশ কিছুক্ষণ বারান্দার পাশের আম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে পড়ল, বাজার থেকে মিষ্টি আম এনেছিলেন আজমল সাহেব। তখন ওদের বাসায় বারো-তেরো বছর। দুই ভাই দুটো করে আম তৃপ্তি নিয়ে খেল। আখতার বলল, ‘আমি এই জায়গায় আমের আঁটি লাগাব।’ ওর দেখাদেখি জামিলও অন্যপাশে দুটো আমের আঁটি পুতে দিয়েছিল। কিছুদিন পর দেখা গেল আখতারের পুঁতে দেওয়া আঁটি থেকে একটি চারা বের হয়েছে। আরগুলো হয়নি। রোকেয়া বেগম যত্ন করে গাছটি বড় করে তুলেছেন।

দূর থেকে দেখা গেল জামিল আসছে।

জামিল কাছে আসতেই রোকেয়া বেগম খুবই শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘জামিল, এই আমগাছটা কেটে ফেল।’

তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে চলে গেলেন।