মনের ময়লা

শাহ্নাজ মুন্নী

‘নতুন একটা ক্লিনিং সার্ভিস চালু হয়েছে জানো, খুব ইন্টারেস্টিং! ঘর বাড়ির ধুলা বালি ময়লা সব পরিষ্কার করে দেয়, ওদের প্রফেশনাল লোক আছে, তুমি ফোন করলেই চলে আসবে, একটা সার্ভিস চার্জ নেবে কিন্তু সেটা খুব বেশি না, উন্নতমানের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আছে, মিহি ধুলাও টেনে নেবে, আরো কী সব কেমিক্যাল দিয়ে মেঝের ময়লা দাগটাগ সব তুলে দেয়। চার তলার সাবেরদের বাসা নাকি এমন সাফ করে গেছে যে আয়নার মতো ঝকঝক করছে, রীতিমতো সেখানে মুখ দেখা যায়...’

মাসুদ মনযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছিলো, রাফিয়ার কথায় পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ঘরের ধুলা বালি না, আসলে মনের ধুলা বালি পরিষ্কার করতে হবে। মন পরিষ্কারের কোনো সার্ভিস জানা থাকলে বলো, যারা আমাদের মনের ময়লা ধুয়ে দিয়ে যাবে...’

মাসুদের কথা শুনে রাফিয়ার হাত থেমে যায়। এতক্ষণ ধরে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়া নিয়ে চেপে চেপে ফার্নিচারের কোনায় জমে থাকা ধুলোময়লা মুছছিল সে। এবার কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে জানতে চায়,

‘মনের ময়লা ব্যাপারটা কী? ঠাট্টা করছো নাকি?’

‘উহু, আমি সিরিয়াস। মনের ময়লা মানে মনের মধ্যে জমে থাকা যত ক্লেদ, গ্লানি, অপমান আর কষ্টের দাগ, মনের মধ্যে পুষে রাখা যতো ঘৃণা বিদ্বেষ রাগ ক্রোধ হিংসা লোভ...’

‘আরে দূর! এর জন্য ক্লিনিং সার্ভিস লাগে নাকি? ঘরদোরের ময়লা সাফ করতে করতেই মনের ময়লা সাফ হয়ে যাবে। আসলে ঘর পরিষ্কার করে আমি মনে যত শান্তি পাই তা আর কিছুতেই পাই না।’

রাফিয়া আবার নিজের কাজে ফিরে যায়। মাসুদ হাতের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে একটু ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,

‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি আসলে শান্তির কথা বলছি না রাফিয়া, বলছি, শুদ্ধতার কথা, আমাদের মনে প্রতিদিন একটু একটু করে দিন যাপনের যেসব কালিমা জমেছে, সেসব দূর করার কথা।’

‘সবই তো বিমূর্ত ব্যাপার। মন, শুদ্ধতা, কালিমা, যাই বলো কোনটাই আদতে হাত দিয়ে ধরা যায় না, চোখ দিয়ে দেখা যায় না। যার অস্তিত্বই বায়বীয়, অদৃশ্য, তাকে তুমি পরিষ্কার করবে কীভাবে?... কিন্তু হঠাৎ করে কেন তোমার এসব মনে হচ্ছে বলো তো, কী হয়েছে?’

রাফিয়া এবার নরম গলায় জানতে চায়।

‘হঠাৎ করে না, আসলে অনেক দিন ধরেই ভাবছি নিজের মনে মনে, তোমাকে আগে বলি নাই...’

আজ বুদ্ধ পূর্ণিমার ছুটি বলে মাসুদের অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে দুজন। সকালের চা পান শেষে দিন ছুটছে দুপুরের দিকে। রাফিয়া রান্না ঘরে ঢুকেছে দৈনন্দিন রান্নার বাইরে স্পেশাল কিছু রাঁধতে, এই যেমন ছোট মাছের চচ্চড়ি, সজনে ডাটার ডাল, কাঁচা আমের টক।

ছুটির দিনে মাসুদ আহমেদেরও বাধাধরা কিছু কাজ থাকে, এই যেমন বাজারে যাওয়া, ব্যাগ ভর্তি করে পছন্দের মাছ মাংস, সবজি কেনা, মাথার চুলে কলপ দেওয়া, শার্ট প্যান্ট ইস্ত্রি করানো, কিন্তু আজ তার কিছুই করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মাথার মধ্যে, মগজের কোষে কোষে ছোটবেলায় শোনা একটা গানের লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে। সুরটা মনে নাই, কথাগুলোও না, শুধু একটা লাইন মনে আছে, ‘গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে?’

আজকাল ইউটিউবে সার্চ দিলে সব গানই খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘরে বিভিন্ন শিল্পির কণ্ঠে এই গানটাই ঘুরেফিরে বাজতে থাকলো, কাঙালিনী সুফিয়া থেকে শুরু করে হালের মনির খান পর্যন্ত সবাই প্রায় একই সুরে কথা একটু এদিক সেদিক করে অনন্ত গোঁসাইয়ের গানটি নিজেস্ব ঘরানায় গেয়েছেন-

‘ওরে বাবলা পাতার কষ লেগেছে

উঠবে না রং সাবানে

গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে...’

রাফিয়া এক ফাঁকে রান্নাঘর থেকে এসে কিছুক্ষণ স্বামীর পাশে বসে গান শুনে মাথা দুলিয়ে বললো,

‘গান শুনছো? বেশ বেশ শোনো, গান কিন্তু মন ভাল রাখার চমৎকার ওষুধ... আর এই গানটা তো দেখি তোমার মনের কথাই বলছে...’

‘যদি সে কয়লার কালি হয়

সে কালি জলে ধুইলে যায়

মনের কালি ভীষণ কালি

গুরু গো ধোয়া নাহি যায়’

কিন্তু এই গান শুনেও মাসুদের বিক্ষিপ্ত মন আসলে শান্ত হয় না। গোঁসাই বলছেন, কয়লার কালি পানি দিয়ে ধুয়ে হয়তো পরিষ্কার করা যেতে পারে কিন্তু মনের কালি এমনই অমোচনীয় যে, কোনো সাবানেই তা পরিষ্কার হয় না। এই গানে শিষ্য তার গুরুর কাছে বার বার জানতে চাইছে, তার মনের ময়লা দূর করার উপায় কী? কিন্তু মাসুদ কার কাছে জানতে চাইবে এই প্রশ্নের উত্তর? কে জবাব দেবে তাকে?

রাফিয়া তুড়ি দিয়ে বলে, ‘আরে, এই যুগে আমাদের গুরু তো ফেসবুক। তাকেই জিজ্ঞেস করো না কেনো।’

মাসুদ একটু দোনামোনা করেও শেষ পর্যন্ত কমলা রঙের ফুল পাতার ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রশ্নের আকারে ফেসবুকে একটা সংক্ষিপ্ত পোস্ট দিলো, ‘বন্ধুরা, বলেন তো মন পরিষ্কারের ফর্মুলা কী?’

মুহূর্তে পাঁচ ছয়টা লাইক পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নানাজন নানা রকম ফর্মুলা দিতে থাকেন। তাদের কেউ পরিচিত, কেউ আবার অপরিচিত। একজন লেখেন, ‘নিজেকে ও অন্যকে ভালবাসতে হবে শ্রদ্ধা করতে হবে, ভালবাসা সব রোগের ওষুধ। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটাই এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। ফলে মানুষের মনের ময়লা দূর হচ্ছে না।’

‘এমন একজন বন্ধুর সাথে নিয়ম করে কথা বলেন যার সাথে উইদআউট সেলফ এডিটিং কথা বলতে পারবেন। পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার দরকার নাই, মুখে যা আসবে তাই বলবেন, গালাগালি হইলেও করবেন, এমন বন্ধু...’

‘মন খুলে হাসি দেও মনের সব ময়লা এক নিমেষে উড়ে যাবে’

‘সবার জন্য এক ফর্মুলা কাজ করবে কিনা জানি না। একেকজনের জন্য একেকটা পথ, আমার কাছে প্রার্থনা। সৃষ্টি কর্তার ধ্যান করেন পরিশুদ্ধ হয়ে যাবেন।’

‘প্রতিদিন স্ত্রীকে হাগ দিবেন, মা বাবা সন্তানের সঙ্গে কনটাক্ট রাখবেন, ফলফলাদি খাবেন, দেখবেন মন পরিষ্কার হয়ে গেছে।’

‘গার্ডেনিং করতে পারেন। গাছপালা ফুল পাখির সাথে থাকলে মন পরিষ্কার হয়।’

মাসুদ আর রাফিয়া দুজন মিলে পোস্টের নিচের মন্তব্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ‘দেখো, মানুষের কত বুদ্ধি! কত সুন্দর সব সাজেশন দিয়েছে- এগুলো কিন্তু আসলেই কাজের...’ রাফিয়া বলে।

‘হুম ! খুব সহজ সব উপায়! কিন্তু তারপরেও চারিদিকে পরিচ্ছন্ন সুন্দর মন পাওয়া কত কঠিন বলো !’

ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঘরে বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠেছে। বিকেলের নাস্তায় রাফিয়া গরম গরম সবজি পাকোড়া বানিয়েছিল, সঙ্গে দুধ চা। ওদের সন্তানেরা এখন বড় হয়ে গেছে। মেয়ে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় সংসার পেতেছে। ছেলে পড়তে গেছে আমেরিকায়। আবার সেই বিয়ের প্রথম দিককার মতো দুইজনের ছোট্ট ছিমছাম সংসার, যেন টোনাটুনির ঘর। মাসুদের রিটায়ারমেন্টের সময় ঘনিয়ে এসেছে আর মাস দুয়েক পড়েই এলপিআরে যাবেন। রাফিয়া একটা ইংরেজি স্কুলে পড়াতো এখন সেই চাকরিটাও আর করছে না।

চা-পর্ব শেষে মাসুদ চোখে চশমা লাগিয়ে বসেছে টেলিভিশনের সংবাদ দেখতে, দেখছে আর আহা উহু করছে,

‘দেখো রাফিয়া দেখো, দেশ থেকে বছরে চৌষট্টি কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার। মানুষ কীভাবে এমন অপরাধ করে? এদের মনে কি একটুও দেশপ্রেম নেই? কোনো ভয়ডর নেই?’

রাফিয়া উত্তরে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু হঠাৎ বাঁশির সুরের মত তীব্র ঝংকার তুলে ফোনের রিং টোন বেজে উঠলে সে প্রায় দৌড়ে গিয়ে পাশের ঘর থেকে ফোনটা ধরে। হয়তো ছেলে মেয়েরা কেউ একজন বিদেশ থেকে ফোন করেছে। দূরদেশ থেকে ওদের চেনা গলার আওয়াজ শুনলে রাফিয়ার তৃষ্ণার্ত মনটা এক গ্লাস শীতল পানি পান করার মতো শান্তি পায়। তবে আজ ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অদ্ভুত ফোন নম্বর দেখে কেমন একটু খটকা লাগে রাফিয়ার। এটা আবার কেমন নাম্বার শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য, অসংখ্য শূন্য। বিদেশি নাম্বারগুলো এত আজব হয় কেন! ওরা কেউ কি তাহলে ফোন নম্বর চেঞ্জ করেছে?

‘হ্যালো ম্যাডাম, আমি আত্মা ক্লিনিং সার্ভিস থেকে বলছি...’

একটা মিষ্টি কণ্ঠের মেয়ে ওপাশ থেকে কানের কাছে কথা বলে উঠলে রাফিয়া বেশ ঘাবড়ে যায়। সে কাঁপা কণ্ঠে জানতে চায়, ‘হ্যালো, হ্যালো, কে বলছেন?’

‘ম্যাডাম, আমি আত্মা ক্লিনিং সার্ভিস থেকে বলছি। আমাদের মন পরিষ্কারের প্যাকেজ বিষয়ে আপনাকে জানাতে চাই। আসলে আপনার হাজবেন্ডের সাথে কথা বললে ভাল হতো। কিন্তু উনার ফোনটা বন্ধ পাচ্ছি। উনি কি আছেন? তাহলে উনার সঙ্গেও কথা বলতে পারি।’

টেলিভিশনের নিউজে তখন হবিগঞ্জে মা-মেয়ে খুনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনানো হচ্ছে। এরই মধ্যে রাফিয়া ফোনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি মাসুদের হাতে ধরিয়ে দেন। মাসুদ খবর দেখায় বাধা পড়ায় প্রথমে ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করে, তারপর সম্ভবত ওই পাশের কথা ভালভাবে শোনার জন্য রিমোট টিপে টিভিটা মিউট করে দেয়।

‘জি¦ স্যার। আমাদের বিভিন্ন রকম প্যাকেজ আছে। ডিপ ক্লিন, মিডিয়াম ক্লিন যেরকম আপনি চান। কাজটা কিন্তু বুঝতেই পারছেন সহজ নয় মোটেই। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিত কর্মী আছেন, যারা খুব সুচারুভাবে মনের ময়লা পরিষ্কার করতে পারেন।’

ওপাশ থেকে সুমধুর নারী কণ্ঠ বলে যায়।

মাসুদের চোখেমুখে তখন অপার বিস্ময়, তাকে খানিকটা হতভম্বও দেখায়। ফলে সে তোতলাতে থাকে,

‘আ-আ-আপনারা মানে আমাকে খুঁজে পেলেন কীভাবে?... মানে আমাদের ফোন নম্বর, আমাদের মনোবাসনা এসব কীভাবে জানলেন?’

‘আমাদের জানতে হয় স্যার, কারণ আমরা স্পেশাল ক্লায়েন্ট খুঁজে বেড়াই। সবাই তো আপনার মতো না, তারা মনের মধ্যে শত শত টন ময়লা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং সর্বত্র সেই ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে দেয়, অন্যকে নোংরা করে, চারপাশ কলুষিত করে কিন্তু একবারো তাদের মধ্যে পরিচ্ছন্ন হওয়ার আকাক্সক্ষা জাগে না। আপনার মধ্যে মন পরিষ্কার করার অভিপ্রায় আমরা দেখতে পেয়েছি, তাই যোগাযোগ করলাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছা। সার্ভিস নিতে পারেন, আবার নাও নিতে পারেন। অভিমত একান্তই আপনার।’

‘আচ্ছা, এটা কি সত্যি সম্ভব? আপনারা কীভাবে কাজটা করেন? মানে কী উপায়ে?’

‘কিছুই অসম্ভব নয় স্যার। প্রথমে পরিমাপক যন্ত্রে আমরা দেখি মনে কতখানি ময়লা জমেছে, মানে কয় স্তরে ময়লা জমেছে, তারপর পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নেই। আমাদের বিশেষ প্রক্রিয়া আছে, আপনি যদি সার্ভিসটা নেন তাহলেই দেখতে পারবেন।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে. পরে জানাচ্ছি আপনাকে।’ বলে ফোন রেখে দেয় মাসুদ। তার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায় না। টিভি বন্ধ করে ঘর জুড়ে অস্থির ভাবে পায়চারি করে সে।

‘বিষয়টা কী হলো বলো তো রাফিয়া, আমি যেটা চাইলাম, সেটা নিজে থেকেই আমার কাছে কীভাবে এসে হাজির হলো, আশ্চর্য না? এরকম সার্ভিস যে সত্যিই আছে সেটা ভেবেই অবাক লাগছে আমার।’

‘আচ্ছা, এরা কি জেনুইন? তুমি যে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলে সেটা দেখে কেউ আবার দুষ্টুমী করছে না তো? চারিদিকে দুই নম্বর মানুষ! প্রতারকে ভর্তি! আমার তো বিশ^াস হচ্ছে না!’ রাফিয়ার গলায় প্রবল সন্দেহ।

‘উহু, আমার সেরকম মনে হয় না।’ মাসুদ নিশ্চিত।

আকাশ আলো করে বৈশাখি পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। শহরের ঝলমলে কৃত্রিম আলো ছাপিয়ে ¯িœগ্ধ জো¯œায় প্লাবিত হচ্ছে চরাচর। রাতের খাওয়া শেষে ঘরের লাইট নিভিয়ে রাফিয়া আর মাসুদ ঝিরিঝিরি বাতাসে চেয়ার গা এলিয়ে বসেছে নিজেদের একচিলতে ব্যালকনিতে। ডানদিকে একটা টবে শখ করে হাসনাহেনার চারা লাগানো হয়েছিল, সেই গাছে সাদা তারার মতো এক ঝাঁক ফুল তীব্র সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।

‘ওদের ক্লিনিং সার্ভিসে বুকিংটা দিয়ে দেই, কী বলো?

মাসুদ হাল্কা ভঙ্গীতে যেন রাফিয়ার অনুমোদন চায়। মাথার এলিয়ে পড়া চুলগুলো পেছনে টেনে দুহাতে খোপা বাঁধতে বাঁধতে রাফিয়া একটু ঝাঁঝালো গলায় জানতে চায়,

‘আচ্ছা, তোমার মনে কি ময়লা আছে বলো তো! আমি তো খালি চোখে তেমন কিছু দেখতে পাই না। বড় লোকেরা অন্যের টাকা মেরে খায়, মানুষ ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, আমরা ছা পোষা মধ্যবিত্ত মানুষ, আমাদের সাদামাটা জীবন, সেখানে কী-ইবা কালিমা থাকতে পারে? ’

মাসুদ সোজা হয়ে বসে খামাকাই পরনের লুঙ্গিটা দুই হাত দিয়ে টেনেটুনে পরিপাটি করে। একটা লম্বা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে, ‘অনেক কিছুই তো তোমাকে বলা হয় না, রাফিয়া, নিজের লজ্জার কথা, নিজের পাপের কথা তোমাকে কী করে বলবো?’

মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ নীরবে বসে থাকে সে। তারপর, যেন বহুকালের ওপার থেকে সে তার ভেজা ভারি মাথাটি তোলে।

‘আমি যখন পারচেজ সেকশনে ছিলাম, চার বছর আগে, মনে আছে তোমার? তখন প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার জিনিসপত্র কেনা হইছিল। ব্যাপক অনিয়ম হইছিল ওইখানে, টেন্ডার জালিয়াতি হইছিল, তথ্য গোপন করা হইছিল, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারি নাই, কারণ এইটার সঙ্গে আমার বসের যোগসাজশ ছিলো। আমি না চাইলেও ওই দুর্নীতির অংশ হয়ে গেছি, কারণ প্রতিবাদ করলে চাকরি থাকতো না। চাকরির লোভে চোখ বুজে সমস্ত অন্যায় মেনে নিয়েছিলাম।’

‘আহা, এছাড়া তখন তোমার কী করার ছিল বলো, এখানে তোমার দোষটা কোথায়? চাকরিটা হারালে ছেলে মেয়ে নিয়ে আমরা পথে বসতাম, না খেয়ে মরতাম। কেউ এসে দাঁড়াতো পাশে?’

রাফিয়া সান্ত¡নার সুরে বলে।

‘ছোটবেলায় না বুঝে বন্ধুদের সাথে কুকুরের লেজে পটকা বেঁধে দিয়েছি, আহা কত ভয় পেয়েছে কুকুরটা, আহত হয়েছে! রিকশাওয়ালার সাথে সামান্য টাকার জন্য খারাপ ব্যবহার করেছি, মাত্র দশটা টাকা বেশি চেয়েছিল সে! দুহাতের আঙ্গুলে কত শত পিঁপড়া পিষে মেরেছি, না মারলেও তো পারতাম! বন্ধুর অগোচরে তার দুর্নাম করেছি, অথচ সামনে দেখা হলে দাঁত কেলিয়ে হেসেছি। অপ্রয়োজনে কত মিথ্যা বলেছি, কোন দরকার ছিল না সেসবের। রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষের দিকে না তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছি, একটু থামলে কী এমন হতো? বেতন বাড়িয়ে দিতে বলায় কাজের লোককে গালি গালাজ করেছি। অন্যের উন্নতি দেখে জ¦লেপুড়ে মরেছি হিংসায়। কত আর বলব রাফিয়া! তোমাকে ভালবাসি তবু তো বহুবার চোখ গেছে পরস্ত্রীর দিকে। মনের মধ্যে অনেক পাপ জমেছে। সেসবের ভার আর নিতে পারছি না,’

মাসুদের গলা কেমন বুজে আসে। মেঘের আড়ালে এরই মধ্যে চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে। দূরের রাস্তায় একটা এম্বুলেন্সের সাইরেনের করুণ শব্দ বাজতে বাজতে মিলিয়ে যাচ্ছে।

‘দেখো, জীবনে চলতে গেলে এরকম শত শত ছোট বড় পাপের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই যাই। এগুলির জন্য তুমি আমি দায়ী না, সিস্টেমটাই এমন। তুমি চাইলেও অনেক কিছু এড়াতে পারবা না। আর এসবের জন্য অপরাধ বোধে ভোগারও কিছু নাই। এমন না যে তুমি কোনো চুরিডাকাতি বা খুনখারাবি করছো। যা বললা, এসব খুচরা পাপ। এগুলো মনে রাখতে নাই।’

রাফিয়া তার দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার চর্চা থেকে আয়ত্ব করা কাউন্সিলিংয়ের ভঙ্গিতে স্বামীকে বোঝাতে চায়।

‘দেখো পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে তোমার মনে ধুলা কাদা লাগবেই। যুধিষ্ঠির যে যুধিষ্ঠির, এত বড় সত্যবাদী সেও তো যুদ্ধ ক্ষেত্রে জেতার জন্য মিথ্যা বলেছে। কে আর এই মলিন পৃথিবীতে সাদা ঝকঝকে থাকতে পারে বলো!

‘না না, রাফিয়া তুমি বুঝতে পারছো না। এই বয়সে এসে আমার আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে।

‘সে জন্যই তো বলছি, তোমার রিটায়ারমেন্টের পর চলো হজ্ব করে আসি। আল্লার ঘরে গিয়ে সব পাপের মাফ চেয়ে একেবারে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো পবিত্র হয়ে আসবো।’

‘সে তো করবোই। কিন্তু তার আগে আমি ওদের সার্ভিসটা নিতে চাই। তুমি এতে আপত্তি করছো কেনো?’

‘দেখো আমার মনে হচ্ছে ওটা ভুয়া। ধোঁকা দিয়ে টাকাপয়সা আদায়ের ফন্দি। কত রকম জোচ্চোরে ভরে গেছে দেশ! তোমাকে সরল সহজ পেয়ে টাকা মারার ধান্দা করছে!’

রাফিয়া জোর গলায় বলে। মাসুদ এবার বিরক্ত হয় আর স্ত্রীর উপর বেশ রেগেই যায়।

‘আহ রাফিয়া, না জেনে-শুনে কেন এসব বলছো? যাও না, ঘর থেকে ফোনটা নিয়া আসো। আমি ওদের সাথে কথা বলবো। দেখতে চাই ওরা কী করে...’

রাফিয়া এবার আর কথা বাড়ায় না। স্বামীর নির্বুদ্ধিতায় হয়তো আপনমনে একটুখানি গজগজ করে। তারপর ফোনটা এনে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দেয়। মাসুদ ফোন খুলে নম্বরটা খুঁজে না পেয়ে একটু বিভ্রান্ত হয়।

‘আচ্ছা, কোন নম্বর থেকে যেন ফোনটা এসেছিল? একটু দেখাও না...’

‘ওই তো শূন্য, শূন্য, শূন্য, শূন্য, অনেকগুলি শূন্য ছিল... স্ক্রল করো পেয়ে যাবে... নয়তো শূন্য শূন্য শূন্য ডায়াল করো...’

মাসুদ ফোনের বাটন টিপে শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য লিখে ডায়াল করে। স্ক্রীনে নোট আসে ‘ইনকারেক্ট নাম্বার ফরমেট। দ্যা নাম্বার ইউ ডায়ালড ইজ ইনকমপ্লিট।’

বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

মনের ময়লা

শাহ্নাজ মুন্নী

image

‘নতুন একটা ক্লিনিং সার্ভিস চালু হয়েছে জানো, খুব ইন্টারেস্টিং! ঘর বাড়ির ধুলা বালি ময়লা সব পরিষ্কার করে দেয়, ওদের প্রফেশনাল লোক আছে, তুমি ফোন করলেই চলে আসবে, একটা সার্ভিস চার্জ নেবে কিন্তু সেটা খুব বেশি না, উন্নতমানের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আছে, মিহি ধুলাও টেনে নেবে, আরো কী সব কেমিক্যাল দিয়ে মেঝের ময়লা দাগটাগ সব তুলে দেয়। চার তলার সাবেরদের বাসা নাকি এমন সাফ করে গেছে যে আয়নার মতো ঝকঝক করছে, রীতিমতো সেখানে মুখ দেখা যায়...’

মাসুদ মনযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছিলো, রাফিয়ার কথায় পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ঘরের ধুলা বালি না, আসলে মনের ধুলা বালি পরিষ্কার করতে হবে। মন পরিষ্কারের কোনো সার্ভিস জানা থাকলে বলো, যারা আমাদের মনের ময়লা ধুয়ে দিয়ে যাবে...’

মাসুদের কথা শুনে রাফিয়ার হাত থেমে যায়। এতক্ষণ ধরে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়া নিয়ে চেপে চেপে ফার্নিচারের কোনায় জমে থাকা ধুলোময়লা মুছছিল সে। এবার কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে জানতে চায়,

‘মনের ময়লা ব্যাপারটা কী? ঠাট্টা করছো নাকি?’

‘উহু, আমি সিরিয়াস। মনের ময়লা মানে মনের মধ্যে জমে থাকা যত ক্লেদ, গ্লানি, অপমান আর কষ্টের দাগ, মনের মধ্যে পুষে রাখা যতো ঘৃণা বিদ্বেষ রাগ ক্রোধ হিংসা লোভ...’

‘আরে দূর! এর জন্য ক্লিনিং সার্ভিস লাগে নাকি? ঘরদোরের ময়লা সাফ করতে করতেই মনের ময়লা সাফ হয়ে যাবে। আসলে ঘর পরিষ্কার করে আমি মনে যত শান্তি পাই তা আর কিছুতেই পাই না।’

রাফিয়া আবার নিজের কাজে ফিরে যায়। মাসুদ হাতের কাগজটা ভাঁজ করে রেখে একটু ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,

‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি আসলে শান্তির কথা বলছি না রাফিয়া, বলছি, শুদ্ধতার কথা, আমাদের মনে প্রতিদিন একটু একটু করে দিন যাপনের যেসব কালিমা জমেছে, সেসব দূর করার কথা।’

‘সবই তো বিমূর্ত ব্যাপার। মন, শুদ্ধতা, কালিমা, যাই বলো কোনটাই আদতে হাত দিয়ে ধরা যায় না, চোখ দিয়ে দেখা যায় না। যার অস্তিত্বই বায়বীয়, অদৃশ্য, তাকে তুমি পরিষ্কার করবে কীভাবে?... কিন্তু হঠাৎ করে কেন তোমার এসব মনে হচ্ছে বলো তো, কী হয়েছে?’

রাফিয়া এবার নরম গলায় জানতে চায়।

‘হঠাৎ করে না, আসলে অনেক দিন ধরেই ভাবছি নিজের মনে মনে, তোমাকে আগে বলি নাই...’

আজ বুদ্ধ পূর্ণিমার ছুটি বলে মাসুদের অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে দুজন। সকালের চা পান শেষে দিন ছুটছে দুপুরের দিকে। রাফিয়া রান্না ঘরে ঢুকেছে দৈনন্দিন রান্নার বাইরে স্পেশাল কিছু রাঁধতে, এই যেমন ছোট মাছের চচ্চড়ি, সজনে ডাটার ডাল, কাঁচা আমের টক।

ছুটির দিনে মাসুদ আহমেদেরও বাধাধরা কিছু কাজ থাকে, এই যেমন বাজারে যাওয়া, ব্যাগ ভর্তি করে পছন্দের মাছ মাংস, সবজি কেনা, মাথার চুলে কলপ দেওয়া, শার্ট প্যান্ট ইস্ত্রি করানো, কিন্তু আজ তার কিছুই করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মাথার মধ্যে, মগজের কোষে কোষে ছোটবেলায় শোনা একটা গানের লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে। সুরটা মনে নাই, কথাগুলোও না, শুধু একটা লাইন মনে আছে, ‘গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে?’

আজকাল ইউটিউবে সার্চ দিলে সব গানই খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘরে বিভিন্ন শিল্পির কণ্ঠে এই গানটাই ঘুরেফিরে বাজতে থাকলো, কাঙালিনী সুফিয়া থেকে শুরু করে হালের মনির খান পর্যন্ত সবাই প্রায় একই সুরে কথা একটু এদিক সেদিক করে অনন্ত গোঁসাইয়ের গানটি নিজেস্ব ঘরানায় গেয়েছেন-

‘ওরে বাবলা পাতার কষ লেগেছে

উঠবে না রং সাবানে

গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে...’

রাফিয়া এক ফাঁকে রান্নাঘর থেকে এসে কিছুক্ষণ স্বামীর পাশে বসে গান শুনে মাথা দুলিয়ে বললো,

‘গান শুনছো? বেশ বেশ শোনো, গান কিন্তু মন ভাল রাখার চমৎকার ওষুধ... আর এই গানটা তো দেখি তোমার মনের কথাই বলছে...’

‘যদি সে কয়লার কালি হয়

সে কালি জলে ধুইলে যায়

মনের কালি ভীষণ কালি

গুরু গো ধোয়া নাহি যায়’

কিন্তু এই গান শুনেও মাসুদের বিক্ষিপ্ত মন আসলে শান্ত হয় না। গোঁসাই বলছেন, কয়লার কালি পানি দিয়ে ধুয়ে হয়তো পরিষ্কার করা যেতে পারে কিন্তু মনের কালি এমনই অমোচনীয় যে, কোনো সাবানেই তা পরিষ্কার হয় না। এই গানে শিষ্য তার গুরুর কাছে বার বার জানতে চাইছে, তার মনের ময়লা দূর করার উপায় কী? কিন্তু মাসুদ কার কাছে জানতে চাইবে এই প্রশ্নের উত্তর? কে জবাব দেবে তাকে?

রাফিয়া তুড়ি দিয়ে বলে, ‘আরে, এই যুগে আমাদের গুরু তো ফেসবুক। তাকেই জিজ্ঞেস করো না কেনো।’

মাসুদ একটু দোনামোনা করেও শেষ পর্যন্ত কমলা রঙের ফুল পাতার ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রশ্নের আকারে ফেসবুকে একটা সংক্ষিপ্ত পোস্ট দিলো, ‘বন্ধুরা, বলেন তো মন পরিষ্কারের ফর্মুলা কী?’

মুহূর্তে পাঁচ ছয়টা লাইক পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নানাজন নানা রকম ফর্মুলা দিতে থাকেন। তাদের কেউ পরিচিত, কেউ আবার অপরিচিত। একজন লেখেন, ‘নিজেকে ও অন্যকে ভালবাসতে হবে শ্রদ্ধা করতে হবে, ভালবাসা সব রোগের ওষুধ। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটাই এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। ফলে মানুষের মনের ময়লা দূর হচ্ছে না।’

‘এমন একজন বন্ধুর সাথে নিয়ম করে কথা বলেন যার সাথে উইদআউট সেলফ এডিটিং কথা বলতে পারবেন। পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার দরকার নাই, মুখে যা আসবে তাই বলবেন, গালাগালি হইলেও করবেন, এমন বন্ধু...’

‘মন খুলে হাসি দেও মনের সব ময়লা এক নিমেষে উড়ে যাবে’

‘সবার জন্য এক ফর্মুলা কাজ করবে কিনা জানি না। একেকজনের জন্য একেকটা পথ, আমার কাছে প্রার্থনা। সৃষ্টি কর্তার ধ্যান করেন পরিশুদ্ধ হয়ে যাবেন।’

‘প্রতিদিন স্ত্রীকে হাগ দিবেন, মা বাবা সন্তানের সঙ্গে কনটাক্ট রাখবেন, ফলফলাদি খাবেন, দেখবেন মন পরিষ্কার হয়ে গেছে।’

‘গার্ডেনিং করতে পারেন। গাছপালা ফুল পাখির সাথে থাকলে মন পরিষ্কার হয়।’

মাসুদ আর রাফিয়া দুজন মিলে পোস্টের নিচের মন্তব্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ‘দেখো, মানুষের কত বুদ্ধি! কত সুন্দর সব সাজেশন দিয়েছে- এগুলো কিন্তু আসলেই কাজের...’ রাফিয়া বলে।

‘হুম ! খুব সহজ সব উপায়! কিন্তু তারপরেও চারিদিকে পরিচ্ছন্ন সুন্দর মন পাওয়া কত কঠিন বলো !’

ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঘরে বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠেছে। বিকেলের নাস্তায় রাফিয়া গরম গরম সবজি পাকোড়া বানিয়েছিল, সঙ্গে দুধ চা। ওদের সন্তানেরা এখন বড় হয়ে গেছে। মেয়ে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় সংসার পেতেছে। ছেলে পড়তে গেছে আমেরিকায়। আবার সেই বিয়ের প্রথম দিককার মতো দুইজনের ছোট্ট ছিমছাম সংসার, যেন টোনাটুনির ঘর। মাসুদের রিটায়ারমেন্টের সময় ঘনিয়ে এসেছে আর মাস দুয়েক পড়েই এলপিআরে যাবেন। রাফিয়া একটা ইংরেজি স্কুলে পড়াতো এখন সেই চাকরিটাও আর করছে না।

চা-পর্ব শেষে মাসুদ চোখে চশমা লাগিয়ে বসেছে টেলিভিশনের সংবাদ দেখতে, দেখছে আর আহা উহু করছে,

‘দেখো রাফিয়া দেখো, দেশ থেকে বছরে চৌষট্টি কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার। মানুষ কীভাবে এমন অপরাধ করে? এদের মনে কি একটুও দেশপ্রেম নেই? কোনো ভয়ডর নেই?’

রাফিয়া উত্তরে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু হঠাৎ বাঁশির সুরের মত তীব্র ঝংকার তুলে ফোনের রিং টোন বেজে উঠলে সে প্রায় দৌড়ে গিয়ে পাশের ঘর থেকে ফোনটা ধরে। হয়তো ছেলে মেয়েরা কেউ একজন বিদেশ থেকে ফোন করেছে। দূরদেশ থেকে ওদের চেনা গলার আওয়াজ শুনলে রাফিয়ার তৃষ্ণার্ত মনটা এক গ্লাস শীতল পানি পান করার মতো শান্তি পায়। তবে আজ ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অদ্ভুত ফোন নম্বর দেখে কেমন একটু খটকা লাগে রাফিয়ার। এটা আবার কেমন নাম্বার শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য, অসংখ্য শূন্য। বিদেশি নাম্বারগুলো এত আজব হয় কেন! ওরা কেউ কি তাহলে ফোন নম্বর চেঞ্জ করেছে?

‘হ্যালো ম্যাডাম, আমি আত্মা ক্লিনিং সার্ভিস থেকে বলছি...’

একটা মিষ্টি কণ্ঠের মেয়ে ওপাশ থেকে কানের কাছে কথা বলে উঠলে রাফিয়া বেশ ঘাবড়ে যায়। সে কাঁপা কণ্ঠে জানতে চায়, ‘হ্যালো, হ্যালো, কে বলছেন?’

‘ম্যাডাম, আমি আত্মা ক্লিনিং সার্ভিস থেকে বলছি। আমাদের মন পরিষ্কারের প্যাকেজ বিষয়ে আপনাকে জানাতে চাই। আসলে আপনার হাজবেন্ডের সাথে কথা বললে ভাল হতো। কিন্তু উনার ফোনটা বন্ধ পাচ্ছি। উনি কি আছেন? তাহলে উনার সঙ্গেও কথা বলতে পারি।’

টেলিভিশনের নিউজে তখন হবিগঞ্জে মা-মেয়ে খুনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনানো হচ্ছে। এরই মধ্যে রাফিয়া ফোনটা নিয়ে তাড়াতাড়ি মাসুদের হাতে ধরিয়ে দেন। মাসুদ খবর দেখায় বাধা পড়ায় প্রথমে ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করে, তারপর সম্ভবত ওই পাশের কথা ভালভাবে শোনার জন্য রিমোট টিপে টিভিটা মিউট করে দেয়।

‘জি¦ স্যার। আমাদের বিভিন্ন রকম প্যাকেজ আছে। ডিপ ক্লিন, মিডিয়াম ক্লিন যেরকম আপনি চান। কাজটা কিন্তু বুঝতেই পারছেন সহজ নয় মোটেই। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিত কর্মী আছেন, যারা খুব সুচারুভাবে মনের ময়লা পরিষ্কার করতে পারেন।’

ওপাশ থেকে সুমধুর নারী কণ্ঠ বলে যায়।

মাসুদের চোখেমুখে তখন অপার বিস্ময়, তাকে খানিকটা হতভম্বও দেখায়। ফলে সে তোতলাতে থাকে,

‘আ-আ-আপনারা মানে আমাকে খুঁজে পেলেন কীভাবে?... মানে আমাদের ফোন নম্বর, আমাদের মনোবাসনা এসব কীভাবে জানলেন?’

‘আমাদের জানতে হয় স্যার, কারণ আমরা স্পেশাল ক্লায়েন্ট খুঁজে বেড়াই। সবাই তো আপনার মতো না, তারা মনের মধ্যে শত শত টন ময়লা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং সর্বত্র সেই ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে দেয়, অন্যকে নোংরা করে, চারপাশ কলুষিত করে কিন্তু একবারো তাদের মধ্যে পরিচ্ছন্ন হওয়ার আকাক্সক্ষা জাগে না। আপনার মধ্যে মন পরিষ্কার করার অভিপ্রায় আমরা দেখতে পেয়েছি, তাই যোগাযোগ করলাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছা। সার্ভিস নিতে পারেন, আবার নাও নিতে পারেন। অভিমত একান্তই আপনার।’

‘আচ্ছা, এটা কি সত্যি সম্ভব? আপনারা কীভাবে কাজটা করেন? মানে কী উপায়ে?’

‘কিছুই অসম্ভব নয় স্যার। প্রথমে পরিমাপক যন্ত্রে আমরা দেখি মনে কতখানি ময়লা জমেছে, মানে কয় স্তরে ময়লা জমেছে, তারপর পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নেই। আমাদের বিশেষ প্রক্রিয়া আছে, আপনি যদি সার্ভিসটা নেন তাহলেই দেখতে পারবেন।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে. পরে জানাচ্ছি আপনাকে।’ বলে ফোন রেখে দেয় মাসুদ। তার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায় না। টিভি বন্ধ করে ঘর জুড়ে অস্থির ভাবে পায়চারি করে সে।

‘বিষয়টা কী হলো বলো তো রাফিয়া, আমি যেটা চাইলাম, সেটা নিজে থেকেই আমার কাছে কীভাবে এসে হাজির হলো, আশ্চর্য না? এরকম সার্ভিস যে সত্যিই আছে সেটা ভেবেই অবাক লাগছে আমার।’

‘আচ্ছা, এরা কি জেনুইন? তুমি যে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলে সেটা দেখে কেউ আবার দুষ্টুমী করছে না তো? চারিদিকে দুই নম্বর মানুষ! প্রতারকে ভর্তি! আমার তো বিশ^াস হচ্ছে না!’ রাফিয়ার গলায় প্রবল সন্দেহ।

‘উহু, আমার সেরকম মনে হয় না।’ মাসুদ নিশ্চিত।

আকাশ আলো করে বৈশাখি পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। শহরের ঝলমলে কৃত্রিম আলো ছাপিয়ে ¯িœগ্ধ জো¯œায় প্লাবিত হচ্ছে চরাচর। রাতের খাওয়া শেষে ঘরের লাইট নিভিয়ে রাফিয়া আর মাসুদ ঝিরিঝিরি বাতাসে চেয়ার গা এলিয়ে বসেছে নিজেদের একচিলতে ব্যালকনিতে। ডানদিকে একটা টবে শখ করে হাসনাহেনার চারা লাগানো হয়েছিল, সেই গাছে সাদা তারার মতো এক ঝাঁক ফুল তীব্র সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।

‘ওদের ক্লিনিং সার্ভিসে বুকিংটা দিয়ে দেই, কী বলো?

মাসুদ হাল্কা ভঙ্গীতে যেন রাফিয়ার অনুমোদন চায়। মাথার এলিয়ে পড়া চুলগুলো পেছনে টেনে দুহাতে খোপা বাঁধতে বাঁধতে রাফিয়া একটু ঝাঁঝালো গলায় জানতে চায়,

‘আচ্ছা, তোমার মনে কি ময়লা আছে বলো তো! আমি তো খালি চোখে তেমন কিছু দেখতে পাই না। বড় লোকেরা অন্যের টাকা মেরে খায়, মানুষ ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, আমরা ছা পোষা মধ্যবিত্ত মানুষ, আমাদের সাদামাটা জীবন, সেখানে কী-ইবা কালিমা থাকতে পারে? ’

মাসুদ সোজা হয়ে বসে খামাকাই পরনের লুঙ্গিটা দুই হাত দিয়ে টেনেটুনে পরিপাটি করে। একটা লম্বা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে, ‘অনেক কিছুই তো তোমাকে বলা হয় না, রাফিয়া, নিজের লজ্জার কথা, নিজের পাপের কথা তোমাকে কী করে বলবো?’

মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ নীরবে বসে থাকে সে। তারপর, যেন বহুকালের ওপার থেকে সে তার ভেজা ভারি মাথাটি তোলে।

‘আমি যখন পারচেজ সেকশনে ছিলাম, চার বছর আগে, মনে আছে তোমার? তখন প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার জিনিসপত্র কেনা হইছিল। ব্যাপক অনিয়ম হইছিল ওইখানে, টেন্ডার জালিয়াতি হইছিল, তথ্য গোপন করা হইছিল, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারি নাই, কারণ এইটার সঙ্গে আমার বসের যোগসাজশ ছিলো। আমি না চাইলেও ওই দুর্নীতির অংশ হয়ে গেছি, কারণ প্রতিবাদ করলে চাকরি থাকতো না। চাকরির লোভে চোখ বুজে সমস্ত অন্যায় মেনে নিয়েছিলাম।’

‘আহা, এছাড়া তখন তোমার কী করার ছিল বলো, এখানে তোমার দোষটা কোথায়? চাকরিটা হারালে ছেলে মেয়ে নিয়ে আমরা পথে বসতাম, না খেয়ে মরতাম। কেউ এসে দাঁড়াতো পাশে?’

রাফিয়া সান্ত¡নার সুরে বলে।

‘ছোটবেলায় না বুঝে বন্ধুদের সাথে কুকুরের লেজে পটকা বেঁধে দিয়েছি, আহা কত ভয় পেয়েছে কুকুরটা, আহত হয়েছে! রিকশাওয়ালার সাথে সামান্য টাকার জন্য খারাপ ব্যবহার করেছি, মাত্র দশটা টাকা বেশি চেয়েছিল সে! দুহাতের আঙ্গুলে কত শত পিঁপড়া পিষে মেরেছি, না মারলেও তো পারতাম! বন্ধুর অগোচরে তার দুর্নাম করেছি, অথচ সামনে দেখা হলে দাঁত কেলিয়ে হেসেছি। অপ্রয়োজনে কত মিথ্যা বলেছি, কোন দরকার ছিল না সেসবের। রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষের দিকে না তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছি, একটু থামলে কী এমন হতো? বেতন বাড়িয়ে দিতে বলায় কাজের লোককে গালি গালাজ করেছি। অন্যের উন্নতি দেখে জ¦লেপুড়ে মরেছি হিংসায়। কত আর বলব রাফিয়া! তোমাকে ভালবাসি তবু তো বহুবার চোখ গেছে পরস্ত্রীর দিকে। মনের মধ্যে অনেক পাপ জমেছে। সেসবের ভার আর নিতে পারছি না,’

মাসুদের গলা কেমন বুজে আসে। মেঘের আড়ালে এরই মধ্যে চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে। দূরের রাস্তায় একটা এম্বুলেন্সের সাইরেনের করুণ শব্দ বাজতে বাজতে মিলিয়ে যাচ্ছে।

‘দেখো, জীবনে চলতে গেলে এরকম শত শত ছোট বড় পাপের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই যাই। এগুলির জন্য তুমি আমি দায়ী না, সিস্টেমটাই এমন। তুমি চাইলেও অনেক কিছু এড়াতে পারবা না। আর এসবের জন্য অপরাধ বোধে ভোগারও কিছু নাই। এমন না যে তুমি কোনো চুরিডাকাতি বা খুনখারাবি করছো। যা বললা, এসব খুচরা পাপ। এগুলো মনে রাখতে নাই।’

রাফিয়া তার দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার চর্চা থেকে আয়ত্ব করা কাউন্সিলিংয়ের ভঙ্গিতে স্বামীকে বোঝাতে চায়।

‘দেখো পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে তোমার মনে ধুলা কাদা লাগবেই। যুধিষ্ঠির যে যুধিষ্ঠির, এত বড় সত্যবাদী সেও তো যুদ্ধ ক্ষেত্রে জেতার জন্য মিথ্যা বলেছে। কে আর এই মলিন পৃথিবীতে সাদা ঝকঝকে থাকতে পারে বলো!

‘না না, রাফিয়া তুমি বুঝতে পারছো না। এই বয়সে এসে আমার আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে।

‘সে জন্যই তো বলছি, তোমার রিটায়ারমেন্টের পর চলো হজ্ব করে আসি। আল্লার ঘরে গিয়ে সব পাপের মাফ চেয়ে একেবারে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো পবিত্র হয়ে আসবো।’

‘সে তো করবোই। কিন্তু তার আগে আমি ওদের সার্ভিসটা নিতে চাই। তুমি এতে আপত্তি করছো কেনো?’

‘দেখো আমার মনে হচ্ছে ওটা ভুয়া। ধোঁকা দিয়ে টাকাপয়সা আদায়ের ফন্দি। কত রকম জোচ্চোরে ভরে গেছে দেশ! তোমাকে সরল সহজ পেয়ে টাকা মারার ধান্দা করছে!’

রাফিয়া জোর গলায় বলে। মাসুদ এবার বিরক্ত হয় আর স্ত্রীর উপর বেশ রেগেই যায়।

‘আহ রাফিয়া, না জেনে-শুনে কেন এসব বলছো? যাও না, ঘর থেকে ফোনটা নিয়া আসো। আমি ওদের সাথে কথা বলবো। দেখতে চাই ওরা কী করে...’

রাফিয়া এবার আর কথা বাড়ায় না। স্বামীর নির্বুদ্ধিতায় হয়তো আপনমনে একটুখানি গজগজ করে। তারপর ফোনটা এনে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দেয়। মাসুদ ফোন খুলে নম্বরটা খুঁজে না পেয়ে একটু বিভ্রান্ত হয়।

‘আচ্ছা, কোন নম্বর থেকে যেন ফোনটা এসেছিল? একটু দেখাও না...’

‘ওই তো শূন্য, শূন্য, শূন্য, শূন্য, অনেকগুলি শূন্য ছিল... স্ক্রল করো পেয়ে যাবে... নয়তো শূন্য শূন্য শূন্য ডায়াল করো...’

মাসুদ ফোনের বাটন টিপে শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য শূন্য লিখে ডায়াল করে। স্ক্রীনে নোট আসে ‘ইনকারেক্ট নাম্বার ফরমেট। দ্যা নাম্বার ইউ ডায়ালড ইজ ইনকমপ্লিট।’