মনের গোল বিষয়ে ভাবপ্রকাশ

মামুন হুসাইন

‘মন পবনের দাঁড়’- রূপকথার এই অংশটুকু মিলিয়ে মন নিয়ে এখন বিস্তর খেলাধুলা করা সম্ভব: হয়ত মনটা হারিয়ে ফেললাম, মনে কথা এলো অথবা জেগে উঠলো, মনে কালি পড়েছে, মনের গোলটা মেটানো দরকার, মন রক্ষা করা চাই, মন দেয়া-নেয়া চলছে, মন যোগানো চলছে, মন-কলা খাওয়া হলো, মনমরা হয়ে মনমাতানো দৃশ্য দেখছি, অথবা মনের মতো মানুষ না পেয়ে, মনে বিষ নিয়ে, মনে আগুন নিয়ে, মনপবনে চড়ে কেবলই মন ছল আর মন রক্ষা।

বড় ঠাকুর বলতেন-... ‘মানুষের মনের যদি নির্দিষ্ট ঋতুভেদ থাকত তাহলে অনেক সুবিধে হতো।... কিন্তু মনের ঋতু আবার ছ’টা নয়, একেবারে বাহান্নটা- এক প্যাকেট তাসের মতো- কখন কোনটা হাতে আসে তার কিছু ঠিক নেই- অন্তরে বসে-বসে কোন খামখেয়ালী খেলোয়াড় যে এই তাস ডীল করে এই খামখেয়ালী খেলা খেলে তার পরিচয় জানিনে।’ আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথ ওঁর মনস্বী চোখ এবং হৃদয় দিয়ে অন্তর্যামীর এক পরিচয়পর্ব অন্যত্র কোথাও তৈরি করেছিলেন; যেমনটি করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ- ‘আগে মনটা শুদ্ধ করবার চেষ্টা কর।... জ্ঞানই বল আর অজ্ঞানই বল সবই মনের অবস্থা... মনই সব। মানুষ মনেই জন্ম, মনেই মৃত, মনেই সাধু, মনেই অসাধু, মনেই পাপী, মনেই পুণ্যবান।’

মনের এই বিবিধ ধারণা নিয়ে, মনের গঠন নিয়ে, মনের ভেতর লুকোনো আমাদের বুদ্ধি, অভিপ্রায়, আবেগ, ধীশক্তি, প্রবণতা, সংবেদন, কল্পনা, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রেষণা, আত্মজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা বিস্তর তত্ত্বকথা লিখে গেছেন। হিপোক্রেটস এবং প্লেটো সেই প্রাচীনকালেই জেনেছিলেন, আমাদের আবেগ উৎপত্তির কেন্দ্রবিন্দু হল মস্তিষ্ক, যখন আরিস্ততল মস্তিষ্কের পরিবর্তে হৃদয়কে বিবেচনা করেছিলেন আবেগ উৎপত্তির প্রধান উৎস। অবশ্য বিজ্ঞানের উন্নয়ন-ডামাডোলে হিপোক্রেটস এবং প্লেটো জয়লাভ করলেও, বহুযুগ পরে শেক্সপিয়ার নিজেও একবার ধন্দে পড়েছিলেন- টেল মি হোয়ার ইজ ফেন্সি ব্রেড / অর ইন দ্যা হার্ট অর ইন দা হেড? যাঁরা জীববিজ্ঞানের সামান্য খবরাখবর রাখেন, তারা স্বীকার করবেন- মানুষের ¯œায়ুতন্ত্র, অন্তঃক্ষরাতন্ত্র এবং রোগ প্রতিরোধতন্ত্র মিলেমিশে আমাদের যাবতীয় ক্রীয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখন চিহ্নিত করতে পেরেছেন- কীভাবে আমরা চারপাশের দৃশ্য, শব্দ, স্পর্শ, স্বাদ এবং গন্ধের খবরাখবর পাই। আমাদের ভাষা, যুক্তি, কারিগরি দক্ষতা, অঙ্ক জ্ঞান, সৃজনশীলতা, আবেগ, কল্পনা, ঘুম, স্বপ্ন, সংগীত, অর্ন্তদৃষ্টি, স্মৃতি, বর্ণমালা তৈরির কৌশল ইত্যাদি এখন অনায়াসে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ এখন মলিকুলার বায়োলজি এবং তার শাখা-প্রশাখা; জল¯্রােতের মতো বাড়তে-বাড়তে তা এখন কোয়ান্টাম বায়োলজি ও মলিকুলার মেডিসিন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এই পর্যায়ে গত শতকের দু’টি সুবিখ্যাত বক্তৃতার কথা স্মরণ করা যায়- ১৯৩২-এ পদার্থবিজ্ঞানী নীলস বো’র’এর ‘লাইফ অ্যান্ড লাইট’ এবং ১৯৪৪’-এ বিজ্ঞানী শ্রয়েডিংগার’-এর ‘হোয়াট ইজ লাইফ’। এই দুই বিজ্ঞানী ভৌতবিজ্ঞানের সূত্রগুলো জীববিজ্ঞানের চৌহদ্দিতে খুঁজে পেতে আবিষ্কার করেন। লক্ষ্য করবো, মনের সঙ্গে মানুষের বংশগতি, জীনের রকমফের, মস্তিষ্কের কর্মকা-, প্রতিবেশ, পারিপার্শ্বের ঘাত-প্রতিঘাত এবং ব্যক্তির বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা- এ-সবের মিথষ্ক্রিয়ায় মানুষের ভালো থাকা-মন্দ থাকা নির্ধারিত হয় বলে, বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকে বলা-কওয়া করছেন।

আমাদের ভাবনার এই পরম্পরায় দেখা যাবে- অসুস্থতার উৎপত্তি, সভ্যতার একেবারে গোড়া থেকে; মানুষের জীবনযাপন, মানুষের বসতিস্থাপন এবং মানুষের বংশ বিস্তারের সাথে-সাথে নানান অসুস্থতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। আর জগতের সর্বত্র রোগবালাইকে ভাবা হয়েছে- ঈশ্বরের ক্রোধ-অভিশাপ, অশরীরী আত্মর প্রভাব, যাদু অথবা গ্রহ-নক্ষত্রের অকল্যাণময় প্রভাব হিসেবে। প্রতিকারের আয়োজনে তাই একেবারে গোড়া থেকে নানান রতœ, ধাতু এবং লতা-পাতা-শেঁকড়-এর পাশাপাশি ছিল বিবিধ সালসা এবং বটিকা যা এখনও আমাদের চারপাশে ধন্বন্তরী চিকিৎসা হয়ে বর্তমান। তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর বাইরে আরেকটি আরোগ্য নিকেতন ছিল কলকাতার বাঁশতলা স্ট্রিটে- গবেষকদের লেখায় দেখা যায়: এখানে চন্দ্রধর রস, সঞ্জীবনী সালসা, সুধাকল্পবটী, কামিনী বিনোদ ঘৃত ইত্যাদি নানান আয়ুর্বেদী ঔষুধপত্র পাওয়া যেত। এরকমকালে দর্জি পাড়ার যদুর মা ‘সোনা জারু’ নামক এক অব্যর্থ ওষুধ আবিষ্কার করেন, যার প্রশস্তি করেছিলেন স্বয়ং কবি ঈশ্বরগুপ্ত- ডাক্তার কবিরাজ রণে যারে হারে / যদুর জননী গিয়া জয় করে তারে।

লোকায়াত চিকিৎসা পদ্ধতির রকমফের এড়িয়ে এবার যদিবা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম শাস্ত্র আয়ুর্বেদ পর্যালোচনা করি, দেখবো এখানে ‘মনোরোগ’ চিহ্নিত হয়েছে ‘ভূতবিদ্যা’ হিসেবে; যার আওতায় রয়েছে চার প্রকারের উন্মাদনা- ভাতোন্মাদ (সম্ভবত সিজোফ্রেনিয়া), পিত্তোন্মাদ (সম্ভবত ম্যানিয়া), কফোন্মাদ (সম্ভবত বিষণ্নতা) এবং ত্রিশোন্মাদ (সম্ভবত তীব্র বিষণ্নতা)। প্লেটোর কাছে উন্মাদনা ছিল- প্রোফেটিক ম্যাডনেস, টেলেস্টিক অর রিচুয়াল ম্যাডনেস, পোয়েটিক ম্যাডনেস ও ইরোটিক ম্যাডনেস হিসেবে। সক্রেটিস ম্যাডনেস’কে বিবেচনা করেছিলেন ‘ডিভাইন গিফট’ হিসেবে। নিৎসের কাছে ম্যাডনেস ছিল- as eruption of arbitrariness in feeling, seeing and hearing, the enjoyment of the maid’s lack of discipline, the joy in human unreason; এই উন্মাদনার উল্লেখ আমরা দেখতে পাব ইতিহাসের নানান সময়ে। উদাহরণস্বরূপ হিব্রু বাইবেলের বুক অফ ডানিয়েল-এর কথা বলা যায়- এখানে নেবুচাদনেজার মন্দির ধ্বংসের পর উন্মাদ হয়ে যান। আমরা হোমারের লেখায় দেখবো- অ্যাজাক্স তীব্র উত্তেজক আচরণ করছেন। আমরা দেখবো, ইহুদীদের রাজা সোল (১ সাম ১৫ : ১-৩, ৮-৯) ঈশ্বরের আদর্শ অমান্য করে বিষণ্নতায় আত্মহত্যার ইচ্ছে প্রকাশ করছেন। আমরা দেখবো, চিন্তা রাজ্যে বিদ্রোহ উসকে দেয়ার অপরাধে জোয়ান অফ আর্ককে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে এবং বিরাট অংশের আপাত অপ্রকৃতস্থ মানুষকে আটক রাখা হচ্ছে এ্যাসাইলামে। এই আটক মানুষদের নিয়ে সে-সময় ছবি এঁকেছেন জর্জ বেলো ‘ডান্স ইন ম্যাডহাউস’ নামে, গয়া এঁকেছেন ‘ম্যাডহাউস’ নামে; আর সেন্ট পল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক রোগীর পোর্টেট করছেন ভ্যানগগ। এই ম্যাড-জেনিয়াস আর্কিটাইপ-এর বিস্তৃতি কিং লিয়ার, দনকিহোতে, রাসকলনিকভ, মি. হাইড, সিলভিয়া প্লাথ-বেলজার হয়ে এমনকি সমসাময়িক চলচ্চিত্র (বিউটিফুল মাইন্ড, দ্য আওয়ার্স, সাইন, ওয়ান ফ্লু ওভার কাক্কুস নেস্ট...) পর্যন্ত অনায়াসে খুঁজে পেতে আবিষ্কার করা সম্ভব। আবার বহু মানুষের কাছে ‘উন্মাদনা এবং ভালবাসা’ যেন বা সমর্থক একটি শব্দ- অ্যাজ ইউ লাইক ইট-এ শেক্সপিয়ারের রোজালিন্ড অর্লেন্ডোকে ঠাট্টা করছেন: Love is merely a madness, and I tell, you deserves as well a dark house and a whip as madman do; and the reason why they are not so punished and cured is, that the lunacy is so ordinary that the whippers are in love too...- দেখবো, শুধু চাবুকের আঘাত নয়, চিন্তায়-আচরণে খাপ খাওয়াতে না পারা এই মানুষগুলোর ওপর একসময় রাষ্ট্রের দ-ধরদের আরো তীব্র নির্যাতন নেমে এসেছিল। ইতিহাসে দেখা যায়- ১৯২৭-এ যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে এদেরকে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করার আইন তৈরি হচ্ছে। এই অসম্মানসূচক ঘটনার সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা গেল জার্মানিতে। হিটলারের প্রণোদোনায় ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯-এর মধ্যে প্রায় ৩-৪ লাখ মনোরোগীকে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করা হয় এবং ইউজেন্কিস-এর নামে কয়েক লক্ষ মনোরোগীকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, যারা ছিলেন হোলোকাস্টের প্রথম বলি। মনোরোগীদের গায়ে লেগে থাকা এই ‘স্টিগমা’ আজ অবধি কোননা কোনভাবে সকল দেশেই বিদ্যমান। এই রোগীদের চিকিৎসায় সরকারের বরাদ্দ সবচেয়ে কম (বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মোট খরচের ০.৪৪%)। এই রোগীদের আবাসন হয় মূল হাসপাতালের বাইরে। অনেকে বলেন, এসব আয়োজন নিছক ‘রাজনৈতিক নিরীক্ষা’ এবং এই তর্কযুদ্ধে মনোরোগের চিকিৎসা বহুদিন পর্যন্ত ‘এ্যান্টি সাইকিয়াট্রিস্ট’ দ্বারা সমালোচিত হয়। মনোরোগ সম্পর্কে ধারণা তাই আমাদের অনেকখানি ভাসা-ভাসা; মিডিয়া, শিল্প এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রভাবে এই জগত সম্পর্কে খানিকটা ভয়, অজ্ঞতা, শ্লেষ, বিরূপতা অথবা নিতান্তই কৌতূহল মেশানো রোমান্টিকতার রেশ এখনও তীব্রভাবে বর্তমান।

কিন্তু বিজ্ঞানের গতিমুখ অন্য কথা বলে। এই খোদ বাংলাদশে ১৬.০৫% পূর্ণবয়স্ক এবং ১৮.৪০% শিশুদের মধ্যে মনোরোগ বিদ্যমান। তাদের সেবাদানকারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র ২১০ জন; ফলে বিরাট অংশের কষ্ট পাওয়া মানুষ শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা আওতার বাইরেই থেকে গেছে। ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ যে মূল স্বাস্থ্য ভাবনার একটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ সে সম্পর্কে ১৯৪৮-এর ৭ই এপ্রিল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম প্রস্তাবনা তৈরি করে-

“Health is a state of complete physical, spiritual, mental, and social wellbeing”

শারীরিক ও মানসিক রোগের সমন্ময় নিয়ে বাংলা ভাষায় ‘আধিব্যাধি’ নামক একটি শব্দ আছে: আধি অর্থ মানসিক রোগ এবং ব্যাধি অর্থ শারীরিক রোগ; আধিব্যাধিতে কষ্ট পাওয়া অথবা আধিব্যাধিতে শেষ হয়ে যাওয়া- বাক্যযুগল এই সমন্বিত রোগের অভিজ্ঞান ও চিন্তা চেতনার সাংকেতিক রূপকেই বাক্সময় করেছে।

‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বর্তমান- এই কথাটি আবারও বিস্তৃত করা হয়েছে: যখন কেউ তার সম্ভাবনার জগতকে বুঝতে পারেন, দৈনন্দিনের বিপদ এবং চাপ মোকাবেলা করতে পারেন, জীবনকে কর্মময় সৃজনশীল করতে পারেন এবং তার প্রতিবেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন, তখন বলা যায়, তিনি মানসিক সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। মানসিক সু-স্বাস্থ্যের এই ধারণাকে আর একটু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মান্যজনেরা বলার চেষ্টা করেছেন; তাঁদের বক্তব্যে নিজেকে আত্মমর্যাদাশীল এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রস্তাবনা আছে। বলা হয়েছে- অন্যের ওপর আস্থা রাখার সামর্থ থাকা চাই; বন্ধুত্ব এবং ভালবাসা পারস্পরিক আদান-প্রদানে সফল হবেন, দীর্ঘমেয়াদী আবেগজনিত সম্পর্ক স্থাপনে সমর্থ হবেন; গভীরতর আবেগজাত অভিজ্ঞতাগুলো ধারণ করতে পারবেন; অন্যকে এবং নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন; নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করে, প্রয়োজনে পরিবর্তিত করতে পারবেন; অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারবেন; অনিশ্চয়তাকে ধারণ করতে পারবেন এবং ঝুঁকি গ্রহণে সমর্থ হবেন; আর থাকবে গভীর ধ্যানমগ্নতা এবং বিস্তৃত এক কল্পলোক।

দেখা যাবে- এই বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমাদের খুব সামান্য মানুষেরই ‘মানসিক সু-স্বাস্থ্য’ বিদ্যমান। কথাটির প্রাসঙ্গিকতা এই যে, অনেকের মনোরোগ নেই, কিন্তু প্রায়োগিক বিদ্যার মাপকাঠিতে তার যে যথেষ্ট মানসিক-সুস্বাস্থ্য আছে তা সব-সময় নাও হতে পারে।

মনোরোগের বিন্যাস নিয়ে সৃষ্ট এই ভূমিকা আড়াল করলে দেখা যাবে, দুটি ধারা তৈরি হয়েছে জগতে- একটি হল যুক্তরাষ্ট্রের ঘরানা (DSM-V) এবং অপরটি হলো ইউরোপের (DSM-V)। যদিওবা এ্যান্টি সাইকিয়েট্রিস্টরা (সাজ, সেফ, গফমেন, কুপার, লেইঙ্গ, বুসাগলিয়া, সুল, ব্রেগিন ইত্যাদি) একসময় ভেবেছিলেন- মন কোন অঙ্গ নয়, অতএব এর রোগ হবে না, এবং পুরোটিই একটি সামাজিক-রাজনৈতিক-বাস্তবতার বিপর্যয় ও অনিয়ম; কিন্তু আধুনিক গবেষণায় এই প্রস্তাবনা শেষ পর্যন্ত একটি ‘ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে মনোরোগের ইতিহাসে। নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আজ প্রমাণিত- ব্যক্তির চিন্তা-আবেগ-ভয় ইত্যাদি তৈরি হওয়ার জন্য মস্তিষ্কের নির্ধারিত অঞ্চল ও তার নিজস্ব শরীরবৃত্তীয় অনিয়ম-বিচ্যুতির সঙ্গে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ এবং সামাজিক প্রতিবেশের দুর্যোগ-দুর্দশা এক বিপুল মিথষ্ক্রিয়ার (Bio-psychosocial model) মাধ্যমে ‘মনোরোগ’ তৈরি হয়। এর প্রধান লক্ষণ মোটা দাগে- চিন্তা এবং আচরণের বৈসাদৃশ্য, অযৌক্তিক ভয়, উদ্বেগ, অনুভূতির বিশৃঙ্খলা, স্মৃতিদুর্বলতা, অচেতন হয়ে যাওয়া এবং সময়-স্থান-ব্যক্তি সম্পর্কে তীব্র অসচেতনতা।

এই প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে মনোরোগকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়- গুরুতর রোগ (সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার, ডিমেনসিয়া ইত্যাদি) এবং লঘুতর রোগ (উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা, মনোদৈহিক রোগ, স্ট্্েরস, ডিজঅর্ডার, ঘুমের সমস্যা, খাদ্য গ্রহণের ভয়, যৌনক্রিয়ার ভয় ইত্যাদি)। তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে সবসময় মানুষ রোগ নিয়ে আসে না, অনেক সময় মানুষ বিস্তর সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হয়। যেমন, নেশাগ্রহণ, আত্মহনন, নিজেকে আঘাত করা, খাপখাওয়াতে না পারা, চাকুরির সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, সংস্কৃতিক পরিচয়ের বৈপরীত্য, আইনী জটিলতা, সম্পর্ক তৈরির জটিলতা, বন্ধুত্ব তৈরির সমস্যা, আত্মপরিচয়ের সমস্যা, লেখাপড়ার সমস্যা, দেশান্তরী হওয়ার সমস্যা, শোকগ্রস্ততা, যৌন হয়রানি, ইত্যাদি। আবার শিশুদের সমস্যাগুলো আরেকটু ভিন্নভাবে আসে- ঘরবাড়িতে খাপখাওয়ানোর সমস্যা, স্কুলের ভয়, স্কুল পলায়ন, উদ্বিগ্নতা, নেশাগ্রহণ, মাতৃহীনতার কষ্ট, লেখাপড়ার সমস্যা, শৈশবের যৌন হয়রানি, আচরণের সমস্যা, সেলফোন-ইন্টারনেট আসক্তি, অমনোযোগিতা, কিশোর অপরাধ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, অটিজম ইত্যাদি।

মনোরোগের এই রকমফের সরিয়ে, ইতিহাসে দেখা যায়- মনোরোগ-এর সঙ্গে আইন এবং অপরাধ (Forensic psychology)-এর বাস্তবতা নিয়েও নানান সময়ে তীব্র বাক-বিতণ্ডা হয়েছে। ১৮৪৩-এর ২০শে জানুয়ারি ড্যানিয়েল ম্যাকনওটন নামক একজন অযৌক্তিক সন্দেহে ভোগা মানুষ (persecutory delusion), ঐ সময়ের টোরি দলের নেতা স্যার রবার্ট পিলকে হত্যা করার ইচ্ছে নিয়েও ভুলক্রমে তার ব্যক্তিগত সচিব ড্রুমোন্ডকে হত্যা করে। আদালত এবং মিডিয়ায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়- ‘not guilty on the ground of insanity’। অনেক পরে আমরা দেখবো- প্রেসিডেন্ট রিগ্যান এবং জন লেননকে যারা হত্যা করার আয়োজন নেয়, তারা ও দু’জনেই (হিঙ্কলে এবং মার্কডেভিড চ্যাপলেন যথাক্রমে) ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ।

বলতে কী, মনোরোগের সুলুক-সন্ধানে এইভাবে আমাদের ভাবনার ডালপালা আরো বহুদূর পর্যন্ত অনায়াসে ছড়িয়ে দেয়া যায়; যেমনটি ভেবেছিলেন এরিক ফ্রম- “Man’s nature, his passions and anxieties are a cultural product;...” মনের গতি-প্রকৃতি তাই কেবল হাসপাতাল-ওষুধ এবং এ্যাসাইলামের নিগড়ে বেঁধে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া সংস্কৃতির বিস্তৃত সড়কে হেঁটে বেড়ানো জ্ঞানদীপ্ত মানুষ, সংবেদনশীল মানুষ কোনো না কোনোভাবে চারপাশের অনিয়ম-অরাজকতায়, খানিকটা-খানিকটা, শেষপর্যন্ত আক্রান্ত হয়েই পড়েন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরীরে ‘মনোরোগ’-এর তকমা ছাড়াই তিনি তখন সদাসন্ত্রস্ত থাকেন, বিষাদময় থাকেন এবং বিবমিশা অনুভব করেন। এবার সকল কালের-পুলিশী রাষ্ট্রে বসবাস করার সুবাদে, আমরা টলস্টয়ের মতো শিখতে থাকি- Government is violence! শিখতে থাকি রাষ্ট্র সার্বিক (টহরাবৎংধষ) এবং আমরা বিশেষ (Particular)। শিখতে থাকি সার্বভৌমত্ব, সন্ত্রাস, বিদ্রোহ এবং ধ্বংসযজ্ঞের নতুন এ্যানাটমি। শিখতে থাকি অজানা শঙ্কা, শিখতে থাকি ধর্ষকামিতা, ক্ষমতাহীনতা, একাকীত্ব এবং আপনসত্তা পরিত্যাগের এক নিষ্করুণ অনুসরণপর্ব। অথবা সব মিলিয়ে তৈরি হয় বিপুল এক ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। লক্ষ্য করি- প্রতিদিন মানুষ ঘরে ফেরার আগেই নিঁখোজ হয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশন জুড়ে বিবিধ সন্ত্রাস, মানব বোমা ও হত্যাযজ্ঞের অপরূপ প্রতিস্থাপন। জগতে শান্তি বরাদ্দের জন্য ঈশ্বরের প্রতিরূপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খড়ি Low Intensity Warfare ছড়িয়ে যাচ্ছে। আবু গারিব-গুয়ানতানামোর মতো কারাগারে গোপন নিবর্তন, নির্যাতন ও গুপ্তহত্যা। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির বাজার ত্বরান্বিত করার জন্য বিশ্বায়ন উদ্যাপন পর্ব চলছে, মিডিয়ার খবর পূর্ব-নির্দিষ্ট ছাঁকুনি দিয়ে বেরিয়ে আমাদের সম্মতি উৎপাদন করে চলেছে নিরন্তর। কালচার ইন্ডাস্ট্রির ফিল্টার হয়ে আমরা টেলিভিশনের সুনন্দা-কাঁচের ভেতর এমবেডেড জার্নালিজম শিখি। আমরা তিন ট্রিলিয়ন ডলারের সংবাদ ও ছবি কেনাবেচার বাণিজ্য দেখি ইরাকের রক্তাক্ত জনপদে। আমরা পেটেন্ট সংস্কৃতির নিগড়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করি। বাণিজ্য বিকাশের জন্য আমরা গরিব-কালোমানুষেরা সেক্স টুরিজম এবং হসপিটালিটি গালর্স-এর বন্দোবস্ত রাখি, উন্নয়নের নামে আমরা ডেভেলপমেন্ট রিফিউজির বিস্তার ঘটাই। আমরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ভেতর হেঁটে বেড়াই এবং বিজ্ঞাপনের ইমেজ পান করতে করতে ওনিওম্যানিক হই অথবা ব্যক্তি-জিহ্বার স্বাদ-গন্ধকে ‘ম্যাগডোনাল্ড’ নামক আপাত নিরীহ রসুই ঘরের কাছে বিসর্জন দিই। আমাদের ভাবনার চৌহদ্দীতে দ্রব্যসামগ্রীর এই সর্বগ্রাসী আগ্রাসন কত আগে রবীন্দ্রনাথ আঁচ করেছিলেন!- ‘...একসময় জিনিসই ছিল বৈশ্যের সম্পত্তি; এখন মানুষ তার সম্পত্তি হইয়াছে।’ [লড়াইয়ের মূল]

মানুষ কেনাবেচার এই রকমফেরকেই হয়ত ভয়েরকাল (The Age of Fear) হিসেবে ভেবেছিলেন আলবেয়ার ক্যামু, আর উদ্বেগেরকাল (The Age of Anxiety) হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন অডেন; অডেনের লেখায় গৃহস্থালীর ‘গেজেট’ আর ‘বাজার’ তাই ঈশ্বরের পংক্তিতে অধিষ্ঠান লাভ করেন অনায়াসে-

... this stupid world where

Gadgets are gods and we go on talking,

Many about much, but remain alone,

Alive but alone, belonging– where?–

Unattached as tumble weed.

... well you will soon

Not bother but acknowledge yourself

As market made, as commodity

Whose value varies, a vendor who has

to obey his buyer...

পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত রোগবালাইয়ের বাইরে এইভাবে লুকোনো অন্য এক ভয় রাজ্যে আমরা যেন অজান্তেই আটকে যাই- আমরা একবার ক্রেতা হই, বিক্রেতা হই, অথবা পুরো আয়োজনই নিরুপায় বিকিকিনির এক কূটকর্ম। ভয় তাড়ানোর জন্য মানুষ নিরুপায় হয়ে হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগে ধন্না দেয়। মানুষ ভয়মুক্ত হয় অথবা অবহেলায়-অবমাননায় চিরদিনের মত গৃহহীন (ঐড়সবষবংং সবহঃধষষু রষষ) হয়ে পড়ে। অথবা সেবাদানকারী আত্মীয়কূলকে ভারগ্রস্ত করে খুঁজে নেয় ইচ্ছে-মৃত্যুর গোপন গলিঘোঁজ। বলতে কী, আমাদের বেঁচে থাকা, যুগপৎ এই ভয় এবং ভয়হীনতার অস্পষ্ট বেড়াজালে। ভয়ের জগত নিশ্চিহ্ন করার জন্য আমরা এই বেলা উদার শস্যক্ষেতের কোনো এক ভেতর-বারান্দায় গড়ে তুলি ব্যক্তিগত কাকতাড়–য়া; হয়ত যৎকিঞ্চিৎ বুদ্ধিমত্তার জন্য নিজেকে কখনো নৈরাশ্যময় মনে হয়েছে, কিন্তু ইচ্ছে শক্তি খুঁজে পেতে আবিষ্কারের লোভে ভীরু খোঁড়া পায়ে হেঁটে-হেঁটে আমরা আবারও আশাবাদী হই অথবা শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন এক ব্যক্তিগত শিল্পকলা, নতুন এক আত্মঅবলোকন, নতুন এক উদ্ধারপুরাণ।

বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

মনের গোল বিষয়ে ভাবপ্রকাশ

মামুন হুসাইন

image

শিল্পী : মনিরুল ইসলাম

‘মন পবনের দাঁড়’- রূপকথার এই অংশটুকু মিলিয়ে মন নিয়ে এখন বিস্তর খেলাধুলা করা সম্ভব: হয়ত মনটা হারিয়ে ফেললাম, মনে কথা এলো অথবা জেগে উঠলো, মনে কালি পড়েছে, মনের গোলটা মেটানো দরকার, মন রক্ষা করা চাই, মন দেয়া-নেয়া চলছে, মন যোগানো চলছে, মন-কলা খাওয়া হলো, মনমরা হয়ে মনমাতানো দৃশ্য দেখছি, অথবা মনের মতো মানুষ না পেয়ে, মনে বিষ নিয়ে, মনে আগুন নিয়ে, মনপবনে চড়ে কেবলই মন ছল আর মন রক্ষা।

বড় ঠাকুর বলতেন-... ‘মানুষের মনের যদি নির্দিষ্ট ঋতুভেদ থাকত তাহলে অনেক সুবিধে হতো।... কিন্তু মনের ঋতু আবার ছ’টা নয়, একেবারে বাহান্নটা- এক প্যাকেট তাসের মতো- কখন কোনটা হাতে আসে তার কিছু ঠিক নেই- অন্তরে বসে-বসে কোন খামখেয়ালী খেলোয়াড় যে এই তাস ডীল করে এই খামখেয়ালী খেলা খেলে তার পরিচয় জানিনে।’ আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথ ওঁর মনস্বী চোখ এবং হৃদয় দিয়ে অন্তর্যামীর এক পরিচয়পর্ব অন্যত্র কোথাও তৈরি করেছিলেন; যেমনটি করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ- ‘আগে মনটা শুদ্ধ করবার চেষ্টা কর।... জ্ঞানই বল আর অজ্ঞানই বল সবই মনের অবস্থা... মনই সব। মানুষ মনেই জন্ম, মনেই মৃত, মনেই সাধু, মনেই অসাধু, মনেই পাপী, মনেই পুণ্যবান।’

মনের এই বিবিধ ধারণা নিয়ে, মনের গঠন নিয়ে, মনের ভেতর লুকোনো আমাদের বুদ্ধি, অভিপ্রায়, আবেগ, ধীশক্তি, প্রবণতা, সংবেদন, কল্পনা, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রেষণা, আত্মজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা বিস্তর তত্ত্বকথা লিখে গেছেন। হিপোক্রেটস এবং প্লেটো সেই প্রাচীনকালেই জেনেছিলেন, আমাদের আবেগ উৎপত্তির কেন্দ্রবিন্দু হল মস্তিষ্ক, যখন আরিস্ততল মস্তিষ্কের পরিবর্তে হৃদয়কে বিবেচনা করেছিলেন আবেগ উৎপত্তির প্রধান উৎস। অবশ্য বিজ্ঞানের উন্নয়ন-ডামাডোলে হিপোক্রেটস এবং প্লেটো জয়লাভ করলেও, বহুযুগ পরে শেক্সপিয়ার নিজেও একবার ধন্দে পড়েছিলেন- টেল মি হোয়ার ইজ ফেন্সি ব্রেড / অর ইন দ্যা হার্ট অর ইন দা হেড? যাঁরা জীববিজ্ঞানের সামান্য খবরাখবর রাখেন, তারা স্বীকার করবেন- মানুষের ¯œায়ুতন্ত্র, অন্তঃক্ষরাতন্ত্র এবং রোগ প্রতিরোধতন্ত্র মিলেমিশে আমাদের যাবতীয় ক্রীয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখন চিহ্নিত করতে পেরেছেন- কীভাবে আমরা চারপাশের দৃশ্য, শব্দ, স্পর্শ, স্বাদ এবং গন্ধের খবরাখবর পাই। আমাদের ভাষা, যুক্তি, কারিগরি দক্ষতা, অঙ্ক জ্ঞান, সৃজনশীলতা, আবেগ, কল্পনা, ঘুম, স্বপ্ন, সংগীত, অর্ন্তদৃষ্টি, স্মৃতি, বর্ণমালা তৈরির কৌশল ইত্যাদি এখন অনায়াসে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ এখন মলিকুলার বায়োলজি এবং তার শাখা-প্রশাখা; জল¯্রােতের মতো বাড়তে-বাড়তে তা এখন কোয়ান্টাম বায়োলজি ও মলিকুলার মেডিসিন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এই পর্যায়ে গত শতকের দু’টি সুবিখ্যাত বক্তৃতার কথা স্মরণ করা যায়- ১৯৩২-এ পদার্থবিজ্ঞানী নীলস বো’র’এর ‘লাইফ অ্যান্ড লাইট’ এবং ১৯৪৪’-এ বিজ্ঞানী শ্রয়েডিংগার’-এর ‘হোয়াট ইজ লাইফ’। এই দুই বিজ্ঞানী ভৌতবিজ্ঞানের সূত্রগুলো জীববিজ্ঞানের চৌহদ্দিতে খুঁজে পেতে আবিষ্কার করেন। লক্ষ্য করবো, মনের সঙ্গে মানুষের বংশগতি, জীনের রকমফের, মস্তিষ্কের কর্মকা-, প্রতিবেশ, পারিপার্শ্বের ঘাত-প্রতিঘাত এবং ব্যক্তির বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা- এ-সবের মিথষ্ক্রিয়ায় মানুষের ভালো থাকা-মন্দ থাকা নির্ধারিত হয় বলে, বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকে বলা-কওয়া করছেন।

আমাদের ভাবনার এই পরম্পরায় দেখা যাবে- অসুস্থতার উৎপত্তি, সভ্যতার একেবারে গোড়া থেকে; মানুষের জীবনযাপন, মানুষের বসতিস্থাপন এবং মানুষের বংশ বিস্তারের সাথে-সাথে নানান অসুস্থতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। আর জগতের সর্বত্র রোগবালাইকে ভাবা হয়েছে- ঈশ্বরের ক্রোধ-অভিশাপ, অশরীরী আত্মর প্রভাব, যাদু অথবা গ্রহ-নক্ষত্রের অকল্যাণময় প্রভাব হিসেবে। প্রতিকারের আয়োজনে তাই একেবারে গোড়া থেকে নানান রতœ, ধাতু এবং লতা-পাতা-শেঁকড়-এর পাশাপাশি ছিল বিবিধ সালসা এবং বটিকা যা এখনও আমাদের চারপাশে ধন্বন্তরী চিকিৎসা হয়ে বর্তমান। তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর বাইরে আরেকটি আরোগ্য নিকেতন ছিল কলকাতার বাঁশতলা স্ট্রিটে- গবেষকদের লেখায় দেখা যায়: এখানে চন্দ্রধর রস, সঞ্জীবনী সালসা, সুধাকল্পবটী, কামিনী বিনোদ ঘৃত ইত্যাদি নানান আয়ুর্বেদী ঔষুধপত্র পাওয়া যেত। এরকমকালে দর্জি পাড়ার যদুর মা ‘সোনা জারু’ নামক এক অব্যর্থ ওষুধ আবিষ্কার করেন, যার প্রশস্তি করেছিলেন স্বয়ং কবি ঈশ্বরগুপ্ত- ডাক্তার কবিরাজ রণে যারে হারে / যদুর জননী গিয়া জয় করে তারে।

লোকায়াত চিকিৎসা পদ্ধতির রকমফের এড়িয়ে এবার যদিবা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম শাস্ত্র আয়ুর্বেদ পর্যালোচনা করি, দেখবো এখানে ‘মনোরোগ’ চিহ্নিত হয়েছে ‘ভূতবিদ্যা’ হিসেবে; যার আওতায় রয়েছে চার প্রকারের উন্মাদনা- ভাতোন্মাদ (সম্ভবত সিজোফ্রেনিয়া), পিত্তোন্মাদ (সম্ভবত ম্যানিয়া), কফোন্মাদ (সম্ভবত বিষণ্নতা) এবং ত্রিশোন্মাদ (সম্ভবত তীব্র বিষণ্নতা)। প্লেটোর কাছে উন্মাদনা ছিল- প্রোফেটিক ম্যাডনেস, টেলেস্টিক অর রিচুয়াল ম্যাডনেস, পোয়েটিক ম্যাডনেস ও ইরোটিক ম্যাডনেস হিসেবে। সক্রেটিস ম্যাডনেস’কে বিবেচনা করেছিলেন ‘ডিভাইন গিফট’ হিসেবে। নিৎসের কাছে ম্যাডনেস ছিল- as eruption of arbitrariness in feeling, seeing and hearing, the enjoyment of the maid’s lack of discipline, the joy in human unreason; এই উন্মাদনার উল্লেখ আমরা দেখতে পাব ইতিহাসের নানান সময়ে। উদাহরণস্বরূপ হিব্রু বাইবেলের বুক অফ ডানিয়েল-এর কথা বলা যায়- এখানে নেবুচাদনেজার মন্দির ধ্বংসের পর উন্মাদ হয়ে যান। আমরা হোমারের লেখায় দেখবো- অ্যাজাক্স তীব্র উত্তেজক আচরণ করছেন। আমরা দেখবো, ইহুদীদের রাজা সোল (১ সাম ১৫ : ১-৩, ৮-৯) ঈশ্বরের আদর্শ অমান্য করে বিষণ্নতায় আত্মহত্যার ইচ্ছে প্রকাশ করছেন। আমরা দেখবো, চিন্তা রাজ্যে বিদ্রোহ উসকে দেয়ার অপরাধে জোয়ান অফ আর্ককে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে এবং বিরাট অংশের আপাত অপ্রকৃতস্থ মানুষকে আটক রাখা হচ্ছে এ্যাসাইলামে। এই আটক মানুষদের নিয়ে সে-সময় ছবি এঁকেছেন জর্জ বেলো ‘ডান্স ইন ম্যাডহাউস’ নামে, গয়া এঁকেছেন ‘ম্যাডহাউস’ নামে; আর সেন্ট পল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক রোগীর পোর্টেট করছেন ভ্যানগগ। এই ম্যাড-জেনিয়াস আর্কিটাইপ-এর বিস্তৃতি কিং লিয়ার, দনকিহোতে, রাসকলনিকভ, মি. হাইড, সিলভিয়া প্লাথ-বেলজার হয়ে এমনকি সমসাময়িক চলচ্চিত্র (বিউটিফুল মাইন্ড, দ্য আওয়ার্স, সাইন, ওয়ান ফ্লু ওভার কাক্কুস নেস্ট...) পর্যন্ত অনায়াসে খুঁজে পেতে আবিষ্কার করা সম্ভব। আবার বহু মানুষের কাছে ‘উন্মাদনা এবং ভালবাসা’ যেন বা সমর্থক একটি শব্দ- অ্যাজ ইউ লাইক ইট-এ শেক্সপিয়ারের রোজালিন্ড অর্লেন্ডোকে ঠাট্টা করছেন: Love is merely a madness, and I tell, you deserves as well a dark house and a whip as madman do; and the reason why they are not so punished and cured is, that the lunacy is so ordinary that the whippers are in love too...- দেখবো, শুধু চাবুকের আঘাত নয়, চিন্তায়-আচরণে খাপ খাওয়াতে না পারা এই মানুষগুলোর ওপর একসময় রাষ্ট্রের দ-ধরদের আরো তীব্র নির্যাতন নেমে এসেছিল। ইতিহাসে দেখা যায়- ১৯২৭-এ যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে এদেরকে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করার আইন তৈরি হচ্ছে। এই অসম্মানসূচক ঘটনার সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা গেল জার্মানিতে। হিটলারের প্রণোদোনায় ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯-এর মধ্যে প্রায় ৩-৪ লাখ মনোরোগীকে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করা হয় এবং ইউজেন্কিস-এর নামে কয়েক লক্ষ মনোরোগীকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, যারা ছিলেন হোলোকাস্টের প্রথম বলি। মনোরোগীদের গায়ে লেগে থাকা এই ‘স্টিগমা’ আজ অবধি কোননা কোনভাবে সকল দেশেই বিদ্যমান। এই রোগীদের চিকিৎসায় সরকারের বরাদ্দ সবচেয়ে কম (বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মোট খরচের ০.৪৪%)। এই রোগীদের আবাসন হয় মূল হাসপাতালের বাইরে। অনেকে বলেন, এসব আয়োজন নিছক ‘রাজনৈতিক নিরীক্ষা’ এবং এই তর্কযুদ্ধে মনোরোগের চিকিৎসা বহুদিন পর্যন্ত ‘এ্যান্টি সাইকিয়াট্রিস্ট’ দ্বারা সমালোচিত হয়। মনোরোগ সম্পর্কে ধারণা তাই আমাদের অনেকখানি ভাসা-ভাসা; মিডিয়া, শিল্প এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রভাবে এই জগত সম্পর্কে খানিকটা ভয়, অজ্ঞতা, শ্লেষ, বিরূপতা অথবা নিতান্তই কৌতূহল মেশানো রোমান্টিকতার রেশ এখনও তীব্রভাবে বর্তমান।

কিন্তু বিজ্ঞানের গতিমুখ অন্য কথা বলে। এই খোদ বাংলাদশে ১৬.০৫% পূর্ণবয়স্ক এবং ১৮.৪০% শিশুদের মধ্যে মনোরোগ বিদ্যমান। তাদের সেবাদানকারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র ২১০ জন; ফলে বিরাট অংশের কষ্ট পাওয়া মানুষ শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা আওতার বাইরেই থেকে গেছে। ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ যে মূল স্বাস্থ্য ভাবনার একটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ সে সম্পর্কে ১৯৪৮-এর ৭ই এপ্রিল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম প্রস্তাবনা তৈরি করে-

“Health is a state of complete physical, spiritual, mental, and social wellbeing”

শারীরিক ও মানসিক রোগের সমন্ময় নিয়ে বাংলা ভাষায় ‘আধিব্যাধি’ নামক একটি শব্দ আছে: আধি অর্থ মানসিক রোগ এবং ব্যাধি অর্থ শারীরিক রোগ; আধিব্যাধিতে কষ্ট পাওয়া অথবা আধিব্যাধিতে শেষ হয়ে যাওয়া- বাক্যযুগল এই সমন্বিত রোগের অভিজ্ঞান ও চিন্তা চেতনার সাংকেতিক রূপকেই বাক্সময় করেছে।

‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বর্তমান- এই কথাটি আবারও বিস্তৃত করা হয়েছে: যখন কেউ তার সম্ভাবনার জগতকে বুঝতে পারেন, দৈনন্দিনের বিপদ এবং চাপ মোকাবেলা করতে পারেন, জীবনকে কর্মময় সৃজনশীল করতে পারেন এবং তার প্রতিবেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন, তখন বলা যায়, তিনি মানসিক সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। মানসিক সু-স্বাস্থ্যের এই ধারণাকে আর একটু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মান্যজনেরা বলার চেষ্টা করেছেন; তাঁদের বক্তব্যে নিজেকে আত্মমর্যাদাশীল এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রস্তাবনা আছে। বলা হয়েছে- অন্যের ওপর আস্থা রাখার সামর্থ থাকা চাই; বন্ধুত্ব এবং ভালবাসা পারস্পরিক আদান-প্রদানে সফল হবেন, দীর্ঘমেয়াদী আবেগজনিত সম্পর্ক স্থাপনে সমর্থ হবেন; গভীরতর আবেগজাত অভিজ্ঞতাগুলো ধারণ করতে পারবেন; অন্যকে এবং নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন; নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করে, প্রয়োজনে পরিবর্তিত করতে পারবেন; অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারবেন; অনিশ্চয়তাকে ধারণ করতে পারবেন এবং ঝুঁকি গ্রহণে সমর্থ হবেন; আর থাকবে গভীর ধ্যানমগ্নতা এবং বিস্তৃত এক কল্পলোক।

দেখা যাবে- এই বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমাদের খুব সামান্য মানুষেরই ‘মানসিক সু-স্বাস্থ্য’ বিদ্যমান। কথাটির প্রাসঙ্গিকতা এই যে, অনেকের মনোরোগ নেই, কিন্তু প্রায়োগিক বিদ্যার মাপকাঠিতে তার যে যথেষ্ট মানসিক-সুস্বাস্থ্য আছে তা সব-সময় নাও হতে পারে।

মনোরোগের বিন্যাস নিয়ে সৃষ্ট এই ভূমিকা আড়াল করলে দেখা যাবে, দুটি ধারা তৈরি হয়েছে জগতে- একটি হল যুক্তরাষ্ট্রের ঘরানা (DSM-V) এবং অপরটি হলো ইউরোপের (DSM-V)। যদিওবা এ্যান্টি সাইকিয়েট্রিস্টরা (সাজ, সেফ, গফমেন, কুপার, লেইঙ্গ, বুসাগলিয়া, সুল, ব্রেগিন ইত্যাদি) একসময় ভেবেছিলেন- মন কোন অঙ্গ নয়, অতএব এর রোগ হবে না, এবং পুরোটিই একটি সামাজিক-রাজনৈতিক-বাস্তবতার বিপর্যয় ও অনিয়ম; কিন্তু আধুনিক গবেষণায় এই প্রস্তাবনা শেষ পর্যন্ত একটি ‘ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে মনোরোগের ইতিহাসে। নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আজ প্রমাণিত- ব্যক্তির চিন্তা-আবেগ-ভয় ইত্যাদি তৈরি হওয়ার জন্য মস্তিষ্কের নির্ধারিত অঞ্চল ও তার নিজস্ব শরীরবৃত্তীয় অনিয়ম-বিচ্যুতির সঙ্গে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ এবং সামাজিক প্রতিবেশের দুর্যোগ-দুর্দশা এক বিপুল মিথষ্ক্রিয়ার (Bio-psychosocial model) মাধ্যমে ‘মনোরোগ’ তৈরি হয়। এর প্রধান লক্ষণ মোটা দাগে- চিন্তা এবং আচরণের বৈসাদৃশ্য, অযৌক্তিক ভয়, উদ্বেগ, অনুভূতির বিশৃঙ্খলা, স্মৃতিদুর্বলতা, অচেতন হয়ে যাওয়া এবং সময়-স্থান-ব্যক্তি সম্পর্কে তীব্র অসচেতনতা।

এই প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে মনোরোগকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়- গুরুতর রোগ (সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার, ডিমেনসিয়া ইত্যাদি) এবং লঘুতর রোগ (উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা, মনোদৈহিক রোগ, স্ট্্েরস, ডিজঅর্ডার, ঘুমের সমস্যা, খাদ্য গ্রহণের ভয়, যৌনক্রিয়ার ভয় ইত্যাদি)। তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে সবসময় মানুষ রোগ নিয়ে আসে না, অনেক সময় মানুষ বিস্তর সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হয়। যেমন, নেশাগ্রহণ, আত্মহনন, নিজেকে আঘাত করা, খাপখাওয়াতে না পারা, চাকুরির সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, সংস্কৃতিক পরিচয়ের বৈপরীত্য, আইনী জটিলতা, সম্পর্ক তৈরির জটিলতা, বন্ধুত্ব তৈরির সমস্যা, আত্মপরিচয়ের সমস্যা, লেখাপড়ার সমস্যা, দেশান্তরী হওয়ার সমস্যা, শোকগ্রস্ততা, যৌন হয়রানি, ইত্যাদি। আবার শিশুদের সমস্যাগুলো আরেকটু ভিন্নভাবে আসে- ঘরবাড়িতে খাপখাওয়ানোর সমস্যা, স্কুলের ভয়, স্কুল পলায়ন, উদ্বিগ্নতা, নেশাগ্রহণ, মাতৃহীনতার কষ্ট, লেখাপড়ার সমস্যা, শৈশবের যৌন হয়রানি, আচরণের সমস্যা, সেলফোন-ইন্টারনেট আসক্তি, অমনোযোগিতা, কিশোর অপরাধ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, অটিজম ইত্যাদি।

মনোরোগের এই রকমফের সরিয়ে, ইতিহাসে দেখা যায়- মনোরোগ-এর সঙ্গে আইন এবং অপরাধ (Forensic psychology)-এর বাস্তবতা নিয়েও নানান সময়ে তীব্র বাক-বিতণ্ডা হয়েছে। ১৮৪৩-এর ২০শে জানুয়ারি ড্যানিয়েল ম্যাকনওটন নামক একজন অযৌক্তিক সন্দেহে ভোগা মানুষ (persecutory delusion), ঐ সময়ের টোরি দলের নেতা স্যার রবার্ট পিলকে হত্যা করার ইচ্ছে নিয়েও ভুলক্রমে তার ব্যক্তিগত সচিব ড্রুমোন্ডকে হত্যা করে। আদালত এবং মিডিয়ায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়- ‘not guilty on the ground of insanity’। অনেক পরে আমরা দেখবো- প্রেসিডেন্ট রিগ্যান এবং জন লেননকে যারা হত্যা করার আয়োজন নেয়, তারা ও দু’জনেই (হিঙ্কলে এবং মার্কডেভিড চ্যাপলেন যথাক্রমে) ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ।

বলতে কী, মনোরোগের সুলুক-সন্ধানে এইভাবে আমাদের ভাবনার ডালপালা আরো বহুদূর পর্যন্ত অনায়াসে ছড়িয়ে দেয়া যায়; যেমনটি ভেবেছিলেন এরিক ফ্রম- “Man’s nature, his passions and anxieties are a cultural product;...” মনের গতি-প্রকৃতি তাই কেবল হাসপাতাল-ওষুধ এবং এ্যাসাইলামের নিগড়ে বেঁধে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া সংস্কৃতির বিস্তৃত সড়কে হেঁটে বেড়ানো জ্ঞানদীপ্ত মানুষ, সংবেদনশীল মানুষ কোনো না কোনোভাবে চারপাশের অনিয়ম-অরাজকতায়, খানিকটা-খানিকটা, শেষপর্যন্ত আক্রান্ত হয়েই পড়েন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শরীরে ‘মনোরোগ’-এর তকমা ছাড়াই তিনি তখন সদাসন্ত্রস্ত থাকেন, বিষাদময় থাকেন এবং বিবমিশা অনুভব করেন। এবার সকল কালের-পুলিশী রাষ্ট্রে বসবাস করার সুবাদে, আমরা টলস্টয়ের মতো শিখতে থাকি- Government is violence! শিখতে থাকি রাষ্ট্র সার্বিক (টহরাবৎংধষ) এবং আমরা বিশেষ (Particular)। শিখতে থাকি সার্বভৌমত্ব, সন্ত্রাস, বিদ্রোহ এবং ধ্বংসযজ্ঞের নতুন এ্যানাটমি। শিখতে থাকি অজানা শঙ্কা, শিখতে থাকি ধর্ষকামিতা, ক্ষমতাহীনতা, একাকীত্ব এবং আপনসত্তা পরিত্যাগের এক নিষ্করুণ অনুসরণপর্ব। অথবা সব মিলিয়ে তৈরি হয় বিপুল এক ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। লক্ষ্য করি- প্রতিদিন মানুষ ঘরে ফেরার আগেই নিঁখোজ হয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশন জুড়ে বিবিধ সন্ত্রাস, মানব বোমা ও হত্যাযজ্ঞের অপরূপ প্রতিস্থাপন। জগতে শান্তি বরাদ্দের জন্য ঈশ্বরের প্রতিরূপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খড়ি Low Intensity Warfare ছড়িয়ে যাচ্ছে। আবু গারিব-গুয়ানতানামোর মতো কারাগারে গোপন নিবর্তন, নির্যাতন ও গুপ্তহত্যা। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির বাজার ত্বরান্বিত করার জন্য বিশ্বায়ন উদ্যাপন পর্ব চলছে, মিডিয়ার খবর পূর্ব-নির্দিষ্ট ছাঁকুনি দিয়ে বেরিয়ে আমাদের সম্মতি উৎপাদন করে চলেছে নিরন্তর। কালচার ইন্ডাস্ট্রির ফিল্টার হয়ে আমরা টেলিভিশনের সুনন্দা-কাঁচের ভেতর এমবেডেড জার্নালিজম শিখি। আমরা তিন ট্রিলিয়ন ডলারের সংবাদ ও ছবি কেনাবেচার বাণিজ্য দেখি ইরাকের রক্তাক্ত জনপদে। আমরা পেটেন্ট সংস্কৃতির নিগড়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করি। বাণিজ্য বিকাশের জন্য আমরা গরিব-কালোমানুষেরা সেক্স টুরিজম এবং হসপিটালিটি গালর্স-এর বন্দোবস্ত রাখি, উন্নয়নের নামে আমরা ডেভেলপমেন্ট রিফিউজির বিস্তার ঘটাই। আমরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ভেতর হেঁটে বেড়াই এবং বিজ্ঞাপনের ইমেজ পান করতে করতে ওনিওম্যানিক হই অথবা ব্যক্তি-জিহ্বার স্বাদ-গন্ধকে ‘ম্যাগডোনাল্ড’ নামক আপাত নিরীহ রসুই ঘরের কাছে বিসর্জন দিই। আমাদের ভাবনার চৌহদ্দীতে দ্রব্যসামগ্রীর এই সর্বগ্রাসী আগ্রাসন কত আগে রবীন্দ্রনাথ আঁচ করেছিলেন!- ‘...একসময় জিনিসই ছিল বৈশ্যের সম্পত্তি; এখন মানুষ তার সম্পত্তি হইয়াছে।’ [লড়াইয়ের মূল]

মানুষ কেনাবেচার এই রকমফেরকেই হয়ত ভয়েরকাল (The Age of Fear) হিসেবে ভেবেছিলেন আলবেয়ার ক্যামু, আর উদ্বেগেরকাল (The Age of Anxiety) হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন অডেন; অডেনের লেখায় গৃহস্থালীর ‘গেজেট’ আর ‘বাজার’ তাই ঈশ্বরের পংক্তিতে অধিষ্ঠান লাভ করেন অনায়াসে-

... this stupid world where

Gadgets are gods and we go on talking,

Many about much, but remain alone,

Alive but alone, belonging– where?–

Unattached as tumble weed.

... well you will soon

Not bother but acknowledge yourself

As market made, as commodity

Whose value varies, a vendor who has

to obey his buyer...

পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত রোগবালাইয়ের বাইরে এইভাবে লুকোনো অন্য এক ভয় রাজ্যে আমরা যেন অজান্তেই আটকে যাই- আমরা একবার ক্রেতা হই, বিক্রেতা হই, অথবা পুরো আয়োজনই নিরুপায় বিকিকিনির এক কূটকর্ম। ভয় তাড়ানোর জন্য মানুষ নিরুপায় হয়ে হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগে ধন্না দেয়। মানুষ ভয়মুক্ত হয় অথবা অবহেলায়-অবমাননায় চিরদিনের মত গৃহহীন (ঐড়সবষবংং সবহঃধষষু রষষ) হয়ে পড়ে। অথবা সেবাদানকারী আত্মীয়কূলকে ভারগ্রস্ত করে খুঁজে নেয় ইচ্ছে-মৃত্যুর গোপন গলিঘোঁজ। বলতে কী, আমাদের বেঁচে থাকা, যুগপৎ এই ভয় এবং ভয়হীনতার অস্পষ্ট বেড়াজালে। ভয়ের জগত নিশ্চিহ্ন করার জন্য আমরা এই বেলা উদার শস্যক্ষেতের কোনো এক ভেতর-বারান্দায় গড়ে তুলি ব্যক্তিগত কাকতাড়–য়া; হয়ত যৎকিঞ্চিৎ বুদ্ধিমত্তার জন্য নিজেকে কখনো নৈরাশ্যময় মনে হয়েছে, কিন্তু ইচ্ছে শক্তি খুঁজে পেতে আবিষ্কারের লোভে ভীরু খোঁড়া পায়ে হেঁটে-হেঁটে আমরা আবারও আশাবাদী হই অথবা শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন এক ব্যক্তিগত শিল্পকলা, নতুন এক আত্মঅবলোকন, নতুন এক উদ্ধারপুরাণ।