ঈদ সেকালে ও একালে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

ঈদ এখন আমাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে- সময়ে ও ভূগোলে। ক্ষণিকের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলি- চলে যাই সুদূর অতীতে, বাল্যকালে আর শ্যামল নিসর্গের এক ভূখণ্ডে, বাংলাদেশে। ঈদ তো ছিল সেখানে, এখনো আছে।

ঈদ একই সঙ্গে মনকে ভরে দেয় আনন্দে ও বিষাদে। শেকড়হীন এ নতুন দেশে তখন ফিরে যাই শেকড়ে- মনে পড়ে যায় টুকরো টুকরো স্মৃতি- ঘরে ফেরার আনন্দ সবার সাথে হাসির ফোয়ারা, বিশেষ দিনের বিশেষ খাওয়ার তৃপ্তি, শেষে বিদায়ের বিষাদ। ঈদে সবার আগে মনে পড়ে মাকে আর বাবাকে।

কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে- কখনো খুলনার ওপারে পাবনার বাঘাবাড়ীঘাট, কখনো শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান। চাঁটগা-ঢাকার নাগরিক জীবন ছেড়ে যখন সুদূরের এসব কর্মক্ষেত্রে যাত্রা শুরু করি তখন মন খুব খারাপ হয়েছিল। বারবার মনে পড়ছিল ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের পোস্টমাস্টারের কথা। আর বন্ধুরাও মজা করে বলত- ‘যাও, বনবাসে যাও। আবার হয়তো ফিরে আসবে।’

সে বনবাদাড়ে গিয়ে মনে হলো এই সেই বাংলাদেশ যার কথা পড়েছি কবিতার বইতে, গল্পের বইতে। এই সেই বাংলাদেশ- বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, জয়নুলের পরিশ্রমী বাংলা, কামরুলের রঙিন বাংলাদেশ... আর মুজিব-ভাসানীর আমার দেশ। চাঁটগা-ঢাকায় জন-অরণ্যের মধ্যে মাথা গুঁজে থাকতাম, এখন মনে হলো নির্জন-অরণ্যের মাঝে মাথা তুলে আছি- ‘মস্তক তুলিতে দাও উন্মুক্ত আকাশে...।’

বাঘাবাড়ী ঘাটে নদীর পাশেই মিল্কভিটার দুগ্ধ করখানা, সেখানেই ছিল ফ্ল্যাট, একদম নদীর কিনারেই, এত কাছে নদীর কলকল কথা শোনা যেত। আর শোনা যেত পাশে বাঁধা নৌকায় মাঝিদের কথা, মাঝেমধ্যে রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তারা গান গাইত, কখনো বাঁশিও বাজাত। আমি সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে সে কথা, সে গান, সে বাঁশির সুর শুনতাম। এ তো জীবনের অকৃত্রিম কথা, অকৃত্রিম সুর। সকালে জানালা খুললেই চোখে পড়ত সরিষার ক্ষেতের অবারিত হলুদ, আর নাকে আসত তার ঝাঁঝালো ঘ্রাণ।

সে বাঘাবাড়ী থেকে কিছু পথ বাসে, ছয় ঘণ্টার ওপর যমুনা নদীর ওপর দিয়ে ফেরি পার, তারপর ট্রেনে করে চাঁটগা পৌঁছতাম। যমুনা-মেঘনা যেখানে মিশেছে সেটা পার হতাম- দুটি নদীরই স্রোতধারা আলাদা দেখা যেত- তবে নদীর পাড় দেখা যেত না, মনে হতো মহাসমুদ্র। একদিন ফেরিতে বসে শুনলাম বাউল কণ্ঠে গান- ‘তোমার নাম নিয়া গো দিলাম পাড়ি অকুল দরিয়ায়’, আব্দুল আলীমের সেই বিখ্যাত গান। মনে হতো এ গান যেন শেষ না হয়, আর ফেরিও চলতে থাকুক দীর্ঘসময়। তবে ফেরি মাঝে মাঝে চরায় আটকে যেত, বা নদীর পাড় ভেঙে পড়ত- তখন ছয় ঘণ্টার ফেরি ভ্রমণ দশ-বারো-চৌদ্দ ঘণ্টায় উন্নীত হতো।

এরপর শুরু হতো ট্রেন ভ্রমণ- সে আরেক মজার অভিজ্ঞতা। ঈদের ট্রেন দেখা যেত না, দেখা যেত শুধু মানুষ- মানুষের দীর্ঘ এক মিছিল যেন রেলপথ দিয়ে চলছে- উপরে মানুষ, ভেতরে মানুষ। মনে পড়ে একবার ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে বাইরে অর্থাৎ ট্রেনের ছাদে বসে-দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করেছিলাম। প্রথমে ভালোই লাগছিল, মাঝপথে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া একটু বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল।

বাস-ফেরি-ট্রেন-ট্যাক্সিতে যখন চাঁটগায় বাড়িতে পৌঁছতাম তখন সব কাজ ফেলে সবার আগে দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরতেন মা। সে কী মহা আনন্দ আমার এবং মায়ের!

আজ ঈদে সবার মতো মনে পড়ে মাকে। দু দশকের অধিক সময় ধরে মা পৃথিবীর ঈদ ছেড়ে স্বর্গীয় ঈদ উদ্যাপন করছেন- আর নিশ্চয়ই দেখছেন আমাকে, আমার ছেলে-মেয়ে-বউকে। সবাইকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন এ ঈদের দিনে, এবং সব দিনে।

ঈদের পূর্বরাতে জেগে রইলাম- ঈদের আনন্দ নয়, কাজের দুর্ভাবনায়। কাল প্রোগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং তাই ছুটি নেয়া হয়নি। রিপোর্ট লিখা শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙল ছেলে-মেয়ে-বউয়ের ‘ঈদ মোবারক’ ডাক ও নিবিড় আলিঙ্গনে। চকিতে মনে হলো- এই তো ঈদ, এরাই তো ঈদ। তারা আমার জীবনকে জড়িয়ে আছে মাধবিলতার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে আনন্দ ও সৌরভ। তাই ঈদও সুন্দর। জীবনও সার্থক।

বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমাদ্বান ১৪৪৩

ঈদ সেকালে ও একালে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

image

ঈদ এখন আমাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে- সময়ে ও ভূগোলে। ক্ষণিকের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলি- চলে যাই সুদূর অতীতে, বাল্যকালে আর শ্যামল নিসর্গের এক ভূখণ্ডে, বাংলাদেশে। ঈদ তো ছিল সেখানে, এখনো আছে।

ঈদ একই সঙ্গে মনকে ভরে দেয় আনন্দে ও বিষাদে। শেকড়হীন এ নতুন দেশে তখন ফিরে যাই শেকড়ে- মনে পড়ে যায় টুকরো টুকরো স্মৃতি- ঘরে ফেরার আনন্দ সবার সাথে হাসির ফোয়ারা, বিশেষ দিনের বিশেষ খাওয়ার তৃপ্তি, শেষে বিদায়ের বিষাদ। ঈদে সবার আগে মনে পড়ে মাকে আর বাবাকে।

কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে- কখনো খুলনার ওপারে পাবনার বাঘাবাড়ীঘাট, কখনো শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান। চাঁটগা-ঢাকার নাগরিক জীবন ছেড়ে যখন সুদূরের এসব কর্মক্ষেত্রে যাত্রা শুরু করি তখন মন খুব খারাপ হয়েছিল। বারবার মনে পড়ছিল ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের পোস্টমাস্টারের কথা। আর বন্ধুরাও মজা করে বলত- ‘যাও, বনবাসে যাও। আবার হয়তো ফিরে আসবে।’

সে বনবাদাড়ে গিয়ে মনে হলো এই সেই বাংলাদেশ যার কথা পড়েছি কবিতার বইতে, গল্পের বইতে। এই সেই বাংলাদেশ- বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, জয়নুলের পরিশ্রমী বাংলা, কামরুলের রঙিন বাংলাদেশ... আর মুজিব-ভাসানীর আমার দেশ। চাঁটগা-ঢাকায় জন-অরণ্যের মধ্যে মাথা গুঁজে থাকতাম, এখন মনে হলো নির্জন-অরণ্যের মাঝে মাথা তুলে আছি- ‘মস্তক তুলিতে দাও উন্মুক্ত আকাশে...।’

বাঘাবাড়ী ঘাটে নদীর পাশেই মিল্কভিটার দুগ্ধ করখানা, সেখানেই ছিল ফ্ল্যাট, একদম নদীর কিনারেই, এত কাছে নদীর কলকল কথা শোনা যেত। আর শোনা যেত পাশে বাঁধা নৌকায় মাঝিদের কথা, মাঝেমধ্যে রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তারা গান গাইত, কখনো বাঁশিও বাজাত। আমি সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে সে কথা, সে গান, সে বাঁশির সুর শুনতাম। এ তো জীবনের অকৃত্রিম কথা, অকৃত্রিম সুর। সকালে জানালা খুললেই চোখে পড়ত সরিষার ক্ষেতের অবারিত হলুদ, আর নাকে আসত তার ঝাঁঝালো ঘ্রাণ।

সে বাঘাবাড়ী থেকে কিছু পথ বাসে, ছয় ঘণ্টার ওপর যমুনা নদীর ওপর দিয়ে ফেরি পার, তারপর ট্রেনে করে চাঁটগা পৌঁছতাম। যমুনা-মেঘনা যেখানে মিশেছে সেটা পার হতাম- দুটি নদীরই স্রোতধারা আলাদা দেখা যেত- তবে নদীর পাড় দেখা যেত না, মনে হতো মহাসমুদ্র। একদিন ফেরিতে বসে শুনলাম বাউল কণ্ঠে গান- ‘তোমার নাম নিয়া গো দিলাম পাড়ি অকুল দরিয়ায়’, আব্দুল আলীমের সেই বিখ্যাত গান। মনে হতো এ গান যেন শেষ না হয়, আর ফেরিও চলতে থাকুক দীর্ঘসময়। তবে ফেরি মাঝে মাঝে চরায় আটকে যেত, বা নদীর পাড় ভেঙে পড়ত- তখন ছয় ঘণ্টার ফেরি ভ্রমণ দশ-বারো-চৌদ্দ ঘণ্টায় উন্নীত হতো।

এরপর শুরু হতো ট্রেন ভ্রমণ- সে আরেক মজার অভিজ্ঞতা। ঈদের ট্রেন দেখা যেত না, দেখা যেত শুধু মানুষ- মানুষের দীর্ঘ এক মিছিল যেন রেলপথ দিয়ে চলছে- উপরে মানুষ, ভেতরে মানুষ। মনে পড়ে একবার ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে বাইরে অর্থাৎ ট্রেনের ছাদে বসে-দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করেছিলাম। প্রথমে ভালোই লাগছিল, মাঝপথে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া একটু বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল।

বাস-ফেরি-ট্রেন-ট্যাক্সিতে যখন চাঁটগায় বাড়িতে পৌঁছতাম তখন সব কাজ ফেলে সবার আগে দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরতেন মা। সে কী মহা আনন্দ আমার এবং মায়ের!

আজ ঈদে সবার মতো মনে পড়ে মাকে। দু দশকের অধিক সময় ধরে মা পৃথিবীর ঈদ ছেড়ে স্বর্গীয় ঈদ উদ্যাপন করছেন- আর নিশ্চয়ই দেখছেন আমাকে, আমার ছেলে-মেয়ে-বউকে। সবাইকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন এ ঈদের দিনে, এবং সব দিনে।

ঈদের পূর্বরাতে জেগে রইলাম- ঈদের আনন্দ নয়, কাজের দুর্ভাবনায়। কাল প্রোগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং তাই ছুটি নেয়া হয়নি। রিপোর্ট লিখা শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙল ছেলে-মেয়ে-বউয়ের ‘ঈদ মোবারক’ ডাক ও নিবিড় আলিঙ্গনে। চকিতে মনে হলো- এই তো ঈদ, এরাই তো ঈদ। তারা আমার জীবনকে জড়িয়ে আছে মাধবিলতার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে আনন্দ ও সৌরভ। তাই ঈদও সুন্দর। জীবনও সার্থক।