‘পার্বত্য অঞ্চলের দুই জেলায় আনসার নিয়োগে অর্থের লেনদেন’

পার্বত্য অঞ্চলের দুটি জেলায় ৫ ধাপে সাধারণ আনসার নিয়োগে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম ধাপে নিয়োগকে কেন্দ্র করে নিয়োগ কমিটির চেয়াম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। যেখানে প্রতিটি নিয়োগের পরিবর্তে ১ লাখ টাকা করে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে আনসার নিয়োগের বিপরীতে ঘুষের অর্থের লেনদেন নিয়ে দুই আনসার কর্মকর্তার মধ্যে কথপোকথনের একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। অডিও রেকর্ডের কথপোকথনের তথ্য বলছে, একজন আনসার সদস্যকে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করার পরিবর্তে লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে। যারা টাকা দিয়েছেন তারা প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হয়েছেন।

বেশ কয়েকজন আনসারকে চূড়ান্ত করতে টাকার চুক্তি করার অডিও রেকর্ড এসেছে এ প্রতিবেদকের কাছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলায় যেসব ব্যক্তিরা টাকা দিয়েছে জেলা কমান্ডারের জন্য কেবল তাদেরই মনোনীত করা আছে আনসার নিয়োগের জন্য। ঘুষ না দেয়ায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এমন ৩ প্রার্থী অনিয়মের কথা জানিয়ে আনসার ও গ্রাম পতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। তার একটি কপিও হাতে এসেছে সংবাদ অফিসে।

যে অডিও রেকর্ড সংবাদের কাছে রয়েছে সেই অডিও রেকর্ডটি রাউজানের উপজেলা আনসার ভিডিপি মহিলা প্রশিক্ষক প্রিয়া মহাজন এবং একজন আনসার প্লাটুন কর্মকর্তার। প্রিয়া মহাজনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলেও পুরুষ কণ্ঠের প্লাটুন কমান্ডারের নাম জানা যায়নি। ওই দুই কর্মকর্তা চট্টগ্রাম জেলা আনসারের কমান্ড্যান্ডের আওতায় কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। অডিও কথপোকথনের তথ্য অনুযায়ী প্লাটুন কমান্ডার প্রতিটি আনসারের জন্য কত টাকা করে দিতে হবে জানতে চাইলে মহিলা প্রশিক্ষক ৮০ হাজার টাকা দাবি করেন। এর মধ্যে জেলা কমান্ডারকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে দিতে হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। এজন্য তিনি অগ্রিম ব্ল্যাক চেকও দাবি করেন। পাশাপাশি যারা টাকা দিবে তাদের এডমিট কার্ডে নাম ও মোবাইল নম্বর লিখে দেয়ার জন্যও বলেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় আনসার নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া। তিনি বর্তমানে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরের পরিচালক (অর্থ) হিসেবে কর্মরত আছেন। একসময় তিনি বান্দরবনের জেলা কমান্ড্যান্ট ছিলেন। তৃতীয় ধাপে নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ব্যাটালিয়ন আনসারের পরিচালক শাখাওয়াত হোসেন। চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা কমান্ড্যান্ট আশরাফ হোসেন ছিদ্দিক। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে আর্থিক লেনদেন বিষয়টি খুব আলোচনায় আসেনি। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে। অর্থ লেনদেনে একাধিক সিন্ডিকেট দালাল হিসেবে কাজ করেছে। কক্সবাজারের একটি হোটেলে অর্থের লেনদেন হয়েছে। যারা টাকা দিয়েছেন কেবল তাদেরকেই শারীরিক মাপ থেকে শুরু করে সব পরীক্ষায় পাস করিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আর যারা টাকা দিতে পারেননি বা চাহিদা মোতাবেক টাকা দেননি তাদের নানাভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট আশরাফ হোসেন ছিদ্দিক, ৪র্থ ও ৫ম ধাপে যেসব আনসারদের প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়েছে সেই নিয়োগ কমিটির তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন বলে স্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন।

তিনি আরও দাবি করেন ‘আনসার নিয়োগের সময় এক শ্রেণীর দালাল রয়েছে যারা এ কাজগুলো করে থাকে। তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। একজন নারী কর্মকর্তা তার কাছে তদবির করেছিলেন, কিন্তু তিনি টাকার বিষয়টি বলেননি। তবে তদবির তিনি শোনেননি, বলেন কমান্ডান্ট আশরাফ’।

তিনি বলেন, নিয়োগ কমিটির সদস্যদের দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে গেছেন। কক্সবাজারে তিনি কাউকে চিনেন না। অনেক সময় যারা বাদ পড়ে তারা নানা রকম অভিযোগ তোলেন। মূলত শারীরিক যোগ্যতা ঠিক থাকার পর যারা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করেন তাদেরকে প্রশিক্ষণের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। আর সাধারণ আনসার হিসেবে যাদের মনোনীত করা হয় তারা কোন ভাতা পান না। এটি তাদের চাকরিও নয়। শুধু তাদের একটি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই প্রশিক্ষণ থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা ডাক পান। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। বিনিময়ে তখন তারা কাজের হিসাব অনুযায়ী ভাতা পান। তার যুক্তি আগে এসব প্রশিক্ষণের জন্য যাদের মনোনীত করা হতো সেখানে লেনদেন ছিল। কিন্ত বর্তমানে এর কোন সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ২০২১ সালে পার্বত্য অঞ্চলের বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় সাধারণ আনসার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম ধাপে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আনসার নিয়োগ দেয়া হয়। ৪র্থ ও ৫ম ধাপে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় চলতি বছর। বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় দুই ধাপে নিয়োগের জন্য বাছাই ও লিখিত পরীক্ষার কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয় কক্সবাজার জেলার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে।

সূত্র বলছে, ৪র্থ ধাপের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। একইভাবে ২৭ মার্চ আবার ৫ম ধাপের সাধারণ আনসার বাছাইয়ের আবেদন শুরু হয়, যার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ। একই জায়গায় ৫ম ধাপের পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয় ১৬ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে। মূলত দুটি কমিটিতেই সভাপতি ছিলেন আনসারের চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার আশরাফ হোসেন সিদ্দিক।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, কক্সবাজার ও বান্দরবানে সাধারণ আনসার নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। এ সিন্ডিকেটের কারণে যোগ্য প্রার্থীরা আনসারে নিয়োগ হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। সাধারণ আনসার নিয়োগে যেখানে লাখ টাকা লাগে সেখানে ব্যাটালিয়ন আনসারে টাকা ছাড়া নিয়োগ পাওয়া এখন স্বপ্ন।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে, আনসারে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে গত ২০ এপ্রিল ডাকযোগে ভুক্তভোগী ছালামত উল্লাহ ও আবদুল্লাহ আল সামাদ (বাবু) আনসার ও গ্রাাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন। তারা অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, সংঘবদ্ধ নিয়োগ কমিটি একাধিক বার কক্সবাজারে এসেছেন। তাদের সঙ্গে আসা কিছু অসাধু কর্মচারী এ লেনদেন সম্পন্ন করেছেন। জেলাজুড়ে এসব অভিযোগ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। তাদের দাবি, জরুরি ভিত্তিতে চলিত বছরের মার্চ ও এপ্রিল (৪র্থ ও ৫ম ধাপ) সাধারণ আনসারে ভর্তি নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নিয়োগকে কেন্দ্র করে জেলা কমান্ড্যান্ট আশরাফ হোসেন ছিদ্দিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য আবদুল আল মামুন ও ড্রাইভার মাহবুব আলম ব্যাপক আর্থিক লেনদেন করেছেন। এছাড়া এর সঙ্গে পেকুয়া উপজেলা আনসার ভিডিপির টিআই জাহাঙ্গীর আলম, কুতুবদিয়া উপজেলা আনসার ভিডিপির টিআই মোসলেম উদ্দিন ফারুকী, মহেশখালী উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম রাজীব, কক্সবাজার সদর উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা জুয়েল ভূঁইয়া, টেকনাফ উপজেলা আনসার ভিডিপি টিআই আমান উল্লাহসহ একাধিক ব্যক্তির নাম বেরিয়ে এসেছে।

অভিযোগের বিষয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর গণসংযোগ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সহকারী পরিচালক মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে অভিযোগ এখনো মহাপরিচালকের দপ্তরে রয়েছে। অভিযোগের এখনো তদন্ত শুরু হয়নি। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে।

তিনি বলেন, নিয়ম হলো যোকোন অভিযোগ মহাপরিচালকের কাছে আসার পর সেটি অভিযোগ সেলে পাঠানো হয়। অভিযোগ সেল অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দেয়, সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বিভাগীয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর আইসিটি সেল রয়েছে যারা গোয়েন্দা কার্যক্রম করে। এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে গোয়েন্দারাও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে প্রতিবেদন দেয়।

শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল ২০২২ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৭ রমাদ্বান ১৪৪৩

‘পার্বত্য অঞ্চলের দুই জেলায় আনসার নিয়োগে অর্থের লেনদেন’

সাইফ বাবলু

পার্বত্য অঞ্চলের দুটি জেলায় ৫ ধাপে সাধারণ আনসার নিয়োগে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম ধাপে নিয়োগকে কেন্দ্র করে নিয়োগ কমিটির চেয়াম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। যেখানে প্রতিটি নিয়োগের পরিবর্তে ১ লাখ টাকা করে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে আনসার নিয়োগের বিপরীতে ঘুষের অর্থের লেনদেন নিয়ে দুই আনসার কর্মকর্তার মধ্যে কথপোকথনের একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। অডিও রেকর্ডের কথপোকথনের তথ্য বলছে, একজন আনসার সদস্যকে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করার পরিবর্তে লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে। যারা টাকা দিয়েছেন তারা প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হয়েছেন।

বেশ কয়েকজন আনসারকে চূড়ান্ত করতে টাকার চুক্তি করার অডিও রেকর্ড এসেছে এ প্রতিবেদকের কাছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলায় যেসব ব্যক্তিরা টাকা দিয়েছে জেলা কমান্ডারের জন্য কেবল তাদেরই মনোনীত করা আছে আনসার নিয়োগের জন্য। ঘুষ না দেয়ায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এমন ৩ প্রার্থী অনিয়মের কথা জানিয়ে আনসার ও গ্রাম পতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। তার একটি কপিও হাতে এসেছে সংবাদ অফিসে।

যে অডিও রেকর্ড সংবাদের কাছে রয়েছে সেই অডিও রেকর্ডটি রাউজানের উপজেলা আনসার ভিডিপি মহিলা প্রশিক্ষক প্রিয়া মহাজন এবং একজন আনসার প্লাটুন কর্মকর্তার। প্রিয়া মহাজনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলেও পুরুষ কণ্ঠের প্লাটুন কমান্ডারের নাম জানা যায়নি। ওই দুই কর্মকর্তা চট্টগ্রাম জেলা আনসারের কমান্ড্যান্ডের আওতায় কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। অডিও কথপোকথনের তথ্য অনুযায়ী প্লাটুন কমান্ডার প্রতিটি আনসারের জন্য কত টাকা করে দিতে হবে জানতে চাইলে মহিলা প্রশিক্ষক ৮০ হাজার টাকা দাবি করেন। এর মধ্যে জেলা কমান্ডারকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে দিতে হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। এজন্য তিনি অগ্রিম ব্ল্যাক চেকও দাবি করেন। পাশাপাশি যারা টাকা দিবে তাদের এডমিট কার্ডে নাম ও মোবাইল নম্বর লিখে দেয়ার জন্যও বলেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় আনসার নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া। তিনি বর্তমানে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরের পরিচালক (অর্থ) হিসেবে কর্মরত আছেন। একসময় তিনি বান্দরবনের জেলা কমান্ড্যান্ট ছিলেন। তৃতীয় ধাপে নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ব্যাটালিয়ন আনসারের পরিচালক শাখাওয়াত হোসেন। চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা কমান্ড্যান্ট আশরাফ হোসেন ছিদ্দিক। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে আর্থিক লেনদেন বিষয়টি খুব আলোচনায় আসেনি। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে। অর্থ লেনদেনে একাধিক সিন্ডিকেট দালাল হিসেবে কাজ করেছে। কক্সবাজারের একটি হোটেলে অর্থের লেনদেন হয়েছে। যারা টাকা দিয়েছেন কেবল তাদেরকেই শারীরিক মাপ থেকে শুরু করে সব পরীক্ষায় পাস করিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আর যারা টাকা দিতে পারেননি বা চাহিদা মোতাবেক টাকা দেননি তাদের নানাভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট আশরাফ হোসেন ছিদ্দিক, ৪র্থ ও ৫ম ধাপে যেসব আনসারদের প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হয়েছে সেই নিয়োগ কমিটির তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন বলে স্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন।

তিনি আরও দাবি করেন ‘আনসার নিয়োগের সময় এক শ্রেণীর দালাল রয়েছে যারা এ কাজগুলো করে থাকে। তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। একজন নারী কর্মকর্তা তার কাছে তদবির করেছিলেন, কিন্তু তিনি টাকার বিষয়টি বলেননি। তবে তদবির তিনি শোনেননি, বলেন কমান্ডান্ট আশরাফ’।

তিনি বলেন, নিয়োগ কমিটির সদস্যদের দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে গেছেন। কক্সবাজারে তিনি কাউকে চিনেন না। অনেক সময় যারা বাদ পড়ে তারা নানা রকম অভিযোগ তোলেন। মূলত শারীরিক যোগ্যতা ঠিক থাকার পর যারা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করেন তাদেরকে প্রশিক্ষণের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। আর সাধারণ আনসার হিসেবে যাদের মনোনীত করা হয় তারা কোন ভাতা পান না। এটি তাদের চাকরিও নয়। শুধু তাদের একটি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই প্রশিক্ষণ থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা ডাক পান। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। বিনিময়ে তখন তারা কাজের হিসাব অনুযায়ী ভাতা পান। তার যুক্তি আগে এসব প্রশিক্ষণের জন্য যাদের মনোনীত করা হতো সেখানে লেনদেন ছিল। কিন্ত বর্তমানে এর কোন সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ২০২১ সালে পার্বত্য অঞ্চলের বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় সাধারণ আনসার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম ধাপে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আনসার নিয়োগ দেয়া হয়। ৪র্থ ও ৫ম ধাপে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় চলতি বছর। বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় দুই ধাপে নিয়োগের জন্য বাছাই ও লিখিত পরীক্ষার কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয় কক্সবাজার জেলার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে।

সূত্র বলছে, ৪র্থ ধাপের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। একইভাবে ২৭ মার্চ আবার ৫ম ধাপের সাধারণ আনসার বাছাইয়ের আবেদন শুরু হয়, যার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ। একই জায়গায় ৫ম ধাপের পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয় ১৬ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে। মূলত দুটি কমিটিতেই সভাপতি ছিলেন আনসারের চট্টগ্রাম জেলা কমান্ডার আশরাফ হোসেন সিদ্দিক।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, কক্সবাজার ও বান্দরবানে সাধারণ আনসার নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। এ সিন্ডিকেটের কারণে যোগ্য প্রার্থীরা আনসারে নিয়োগ হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। সাধারণ আনসার নিয়োগে যেখানে লাখ টাকা লাগে সেখানে ব্যাটালিয়ন আনসারে টাকা ছাড়া নিয়োগ পাওয়া এখন স্বপ্ন।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে, আনসারে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে গত ২০ এপ্রিল ডাকযোগে ভুক্তভোগী ছালামত উল্লাহ ও আবদুল্লাহ আল সামাদ (বাবু) আনসার ও গ্রাাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন। তারা অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, সংঘবদ্ধ নিয়োগ কমিটি একাধিক বার কক্সবাজারে এসেছেন। তাদের সঙ্গে আসা কিছু অসাধু কর্মচারী এ লেনদেন সম্পন্ন করেছেন। জেলাজুড়ে এসব অভিযোগ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। তাদের দাবি, জরুরি ভিত্তিতে চলিত বছরের মার্চ ও এপ্রিল (৪র্থ ও ৫ম ধাপ) সাধারণ আনসারে ভর্তি নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নিয়োগকে কেন্দ্র করে জেলা কমান্ড্যান্ট আশরাফ হোসেন ছিদ্দিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য আবদুল আল মামুন ও ড্রাইভার মাহবুব আলম ব্যাপক আর্থিক লেনদেন করেছেন। এছাড়া এর সঙ্গে পেকুয়া উপজেলা আনসার ভিডিপির টিআই জাহাঙ্গীর আলম, কুতুবদিয়া উপজেলা আনসার ভিডিপির টিআই মোসলেম উদ্দিন ফারুকী, মহেশখালী উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম রাজীব, কক্সবাজার সদর উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা জুয়েল ভূঁইয়া, টেকনাফ উপজেলা আনসার ভিডিপি টিআই আমান উল্লাহসহ একাধিক ব্যক্তির নাম বেরিয়ে এসেছে।

অভিযোগের বিষয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর গণসংযোগ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সহকারী পরিচালক মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে অভিযোগ এখনো মহাপরিচালকের দপ্তরে রয়েছে। অভিযোগের এখনো তদন্ত শুরু হয়নি। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে।

তিনি বলেন, নিয়ম হলো যোকোন অভিযোগ মহাপরিচালকের কাছে আসার পর সেটি অভিযোগ সেলে পাঠানো হয়। অভিযোগ সেল অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দেয়, সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বিভাগীয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর আইসিটি সেল রয়েছে যারা গোয়েন্দা কার্যক্রম করে। এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে গোয়েন্দারাও তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে প্রতিবেদন দেয়।