ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
গত এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানিকৃত পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনগণের জীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল এবং এলএনজির দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কায় পেট্রোল, এলপিজি এবং ডিজেলের দাম ৮৫ শতাংশ বাড়িয়েও চরম ঘাটতি সংকট এড়ানো সম্ভব হয়নি। এখন জ্বালানি রেশনিং চালু করতে যাচ্ছে তারা। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংঘবদ্ধ মজুতদারি এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অনেকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট মনিটরিং করার জন্য একজন মিলিটারি জেনারেলের নেতৃত্বে ‘কন্ট্রোলার অব সিভিল সাপ্লাইজ’ নামের কঠোর নজরদারি সংস্থা গড়ে তুলেও অবস্থা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। গাড়ি, স্যানিটারি আইটেম ও ইলেকট্রনিকস গেজেটের অনেকগুলোর আমদানি সরাসরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অন্য অনেক আইটেমের আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ব্যর্থতার পর সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সরকার দেশে ‘অর্থনৈতিক ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করেছে, কারণ দেশটি এখন অভূতপূর্ব ‘ফাইনেন্সিয়াল মেল্টডাউনের সম্মুখীন। বেশ কয়েকমাস ধরে ভয়ংকর খাদ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবেলার সামর্থ্য এখন তাদের নেই বললেই চলে। অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার দিনদিন বাড়ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যাদির বেশির ভাগই যেহেতু আমদানি করতে হয় তাই ওগুলোর ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শ্রীলঙ্কান রুপির বৈদেশিক মান কিছুদিন আগেও ছিল এক ডলারে একশত নব্বই রুপি, গত এক মাসে সেটা বেড়ে দু’শ ত্রিশ রুপিতে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২.৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে, অথচ আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করতেই হবে। এর মানে, শ্রীলঙ্কা নিজেকে ‘আর্থিক দেউলিয়া’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া দেশের কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের কারো সঙ্গে শলাপরামর্শ না করেই সম্পূর্ণ নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণেও দাবি করেন যে বিশ্ব থেকে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহারকে নির্মূল করতে নেতৃত্ব দেবে শ্রীলঙ্কা। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি অনুসরণে কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে বিশ্বে ‘পাইওনিয়ার’ হবে শ্রীলঙ্কা। তাঁর সরকার জৈব কম্পোস্ট সার সরবরাহের প্রক্রিয়া গড়ে তুলবে, যাতে রাসায়নিক সারের ‘প্রকৃতিবান্ধব বিকল্প’ ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করা যায়। কিন্তু, মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন অনেক কঠিন আরেকটা প্রক্রিয়া’ এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড়ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। কৃষক ‘অর্গানিক ফার্মিং’ করার প্রয়োজনে জৈব কম্পোস্ট সারের জন্য হাপিত্যেশ করলেও পুরো ফলন-মৌসুমে তার দেখা মেলেনি। ফলে এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে নেমে আসলো এক-চতুর্থাংশে। অন্যদিকে করোনাভাইরাস মহামারি শ্রীলঙ্কায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনলো শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। গত দু’বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এমন বিপর্যয় হয়েছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলঙ্কার রফতানি আয়ের আরো দুটো প্রধান সূত্র এলাচ এবং দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির এই দু’বছরে। ফলে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামলো এমন এক সময়ে, যখন কৃষি খাতের ফলন-বিপর্যয় খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি অবস্থায় টেনে নামিয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে।
বছরখানেক আগেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে বিবেচনা করা হতো। যেখানে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারের বেশি। শ্রীলঙ্কার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গণমুখী। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। একমাত্র ভারতের কেরালার স্বাস্থ্যব্যবস্থা এর চাইতে উন্নততর ও সর্বজনীন। দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনের আকর্ষণের বড় ঠিকানাও ছিল শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কান তামিল টাইগারদের ওপর সরকারি বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিশ্বের কাছে একুশ শতকের সফল অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল হয়ে উঠার সম্ভাবনা ধারণ করছিল দেশটি। কিন্তু ওই গৃহযুদ্ধে একতরফা বিজয় অর্জনের সময় প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০ তামিল সিভিলিয়ান জনগণকে বিচার-বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি অভিযোগ উত্থাপন করলে বিশ্বের কাছে তদানীন্তন ক্ষমতাসীন সরকার প্রবল বিরূপ সমালোচনার পাত্রে পরিণত হয়। সরকার এবং সংখ্যাগুরু সিংহলীরা এ ধরনের কোন হত্যাকা- ঘটেনি দাবি করে কোনরকম আন্তর্জাতিক বিচার তারা চালাতে দেবে না বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ শ্রীলঙ্কাকে একপ্রকার ‘অস্পৃশ্য রাষ্ট্রের’ মতো বৈরী মর্যাদার অবস্থানে নিয়ে যায়। গৃহযুদ্ধে বিজয় এসেছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের (রাজাপক্ষ) শাসনামলে, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের বড়ভাই। মাঝখানে এক মেয়াদের জন্য মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মৈত্রীপালা সিরিসেনার কাছে হেরে যাওয়ায় বিরোধীদলের নেতার আসনে বসেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে শ্রীলঙ্কার ভোটের রাজনীতিকে দলীয় জোর-জবরদস্তির প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত করে রাজাপাকসে পরিবার পরবর্তী নির্বাচনে আবারো জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফিরে আসে। ক্ষমতায় আসীন হয়ে এবার বড়ভাই মাহিন্দা ছোটভাই গোটাবায়াকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী বনে গেলেন। গৃহযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ওপর সিংহলী জাতিসত্তার যে উগ্র-আধিপত্য স্থাপনের খায়েশ বাস্তবরূপ পেয়েছিল সেটাই রাজাপাকসে পরিবারের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়ায় শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে এনেছে মনে হয়।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। মূলত ২০২০ সালে করোনার মহামারির ধাক্কার ফলে বিপর্যয় আরও তীব্র হয়েছে। ওই সময় পশ্চিমা দেশগুলোতে কর্মরত অনেক শ্রীলঙ্কান কর্মী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। দেশের মধ্যেও সংক্রমণ মারাত্মক আকারে পৌঁছায়, বাধ্য হয়ে অনেক গার্মেন্ট কারখানা এবং চা বাগান বন্ধ হয়ে যায়। কাজ হারিয়ে ঘরে বেকার বসে থাকে লাখ লাখ শ্রমিক। বেড়ে যায় বেকারত্বের হার। মহামারিতে সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খায় সরকার। সংক্রমণের ধাক্কায় পর্যটন খাত বন্ধ হয়ে গেলে সংকট আরও তীব্র হয়। সব মিলিয়ে, রফতানি ও রেমিট্যান্সের মতো অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতগুলো একটা বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সংকট মোকাবিলায় আমদানি কমিয়ে ডলার জমা রাখার উদ্যোগেও ব্যাপক অনিয়মের কথাও উঠে এসেছে। সংকট উত্তরণে তখন থেকেই বড় ধরনের কৌশলের অভাব লক্ষ করা যায়। গত বছরে বেশ কিছু সিদ্ধান্তও নেয় মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার। এরমধ্যে হঠাৎ করেই অর্গানিক কৃষি চাষে পরিবর্তন আনা হয়। এটিকে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়। এমন বেশ কিছু অপরিকল্পিত পদক্ষেপ শ্রীলঙ্কার চলমান সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করা হয় শ্রীলঙ্কায়। খাদ্যমূল্যের দাম বাড়ায় ব্যাপক দরপতন ঘটেছে মুদ্রার। আর এ কারণেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। তখন বিবৃতিতে তিনি বলেন, অনুমোদিত কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর মজুত ক্রয় করতে পারবেন। দামে ছাড় দিয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে বিপত্তি আরও বাড়ে। ডলার বাঁচাতে আমদানি বিধিনিষেধের মধ্যে সরকারের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য জরুরি বিধি ঘোষণার ফলে বাজারে ব্যাপক অনিয়ম এবং মজুদের কারসাজির খবর পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ জাতীয় ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতার আশঙ্কা দেখা দেয়। কারণ দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ ১৬০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। পাশাপাশি যেসব দেশ থেকে ঋণ নিয়েছে লঙ্কান সরকার, তা পরিশোধের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ঋণ নেওয়া অব্যাহত ছিল। একই সময়ে জরুরি খাদ্য, জ্বালানি, মেশিনারি আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলারের মজুত না থাকার মধ্য দিয়ে ২০২২ সাল শুরু হয়। এতে ঘাটতি আরও বাড়ে এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলোÑ রাজাপাকসে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা চরম এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটে বেসামাল দেশটির অর্থনীতি। চারদিকে শুধুই হাহাকার। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। জ্বালানি তেল ও খাদ্য সংকট তীব্র। বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত দেশটি। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। কাগজের অভাবে দেশটির স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ কাগজ আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে নেই। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনও এতটা দূরবস্থায় পড়েনি দেশটি। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এ চরম সংকটের পেছনে মোটাদাগে ছয়টি কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এগুলো হচ্ছে- অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণ, বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত, ঋণ পরিশোধে বেহাল অবস্থা, কর কমানো, পর্যটন ও প্রবাসী আয়ে টান ও অর্গানিক চাষে বিপর্যয়। এ বিপর্যয়ে সরকার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যেসব নেওয়া হয়েছে সেগুলোতে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে নাগরিকদের মধ্যে। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশকে সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামতে দেখা গেছে। সম্প্রতি বিক্ষুব্ধ জনগণ প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর বাধায় তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ব্যাপক জনরোষ ছড়িয়ে পড়েছে এবং যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। অশান্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে সারা দেশে ৩৬ ঘণ্টার কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারকে আগামী কয়েক মাস কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুখোমুখি হতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমদানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন ডলার সংরক্ষণ করা হবে, নাকি আন্তর্জাতিক বন্ডধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধসে দেশটি এক ভয়াবহ সংকট, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন মহলের বিশ্লেষণ ও আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কার পরিবারতন্ত্রের প্রভাব, স্বেচ্ছাচারী শাসন, অবিবেচকের মতো অতিরিক্ত ঋণের মাধ্যমে বড় বড় একাধিক প্রকল্প গ্রহণ এবং অপরিকল্পিতভাবে হঠাৎ কৃষি খাতে অর্গানিক ফার্মিং চালুকরণ ইত্যাদির প্রভাবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তবে আমার কাছে যেটা প্রতীয়মান হচ্ছে তা হলো- উচ্চাশা ও উচ্চাকাক্সিক্ষত মানের বিভিন্ন অযৌক্তিক ও ঋণদায়গ্রস্ত প্রকল্প গ্রহণেই এ রকম ফলাফলটা এসেছে। কেননা কয়েক বছর পূর্বে দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন সূচকে তারা ছিল খুব অগ্রসরমান। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের এ বিপর্যয় খুবই অবাক হওয়ার মতো বিষয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় অবশ্য বের হবে। সেক্ষেত্রে কোন জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে এ শোচনীয় অবস্থার উত্তরণ ঘটবে না। তবে জাতীয় ঐকমত্য ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ফলাফল শুভ হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল ২০২২ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৭ রমাদ্বান ১৪৪৩
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
গত এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানিকৃত পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনগণের জীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল এবং এলএনজির দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কায় পেট্রোল, এলপিজি এবং ডিজেলের দাম ৮৫ শতাংশ বাড়িয়েও চরম ঘাটতি সংকট এড়ানো সম্ভব হয়নি। এখন জ্বালানি রেশনিং চালু করতে যাচ্ছে তারা। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংঘবদ্ধ মজুতদারি এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অনেকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট মনিটরিং করার জন্য একজন মিলিটারি জেনারেলের নেতৃত্বে ‘কন্ট্রোলার অব সিভিল সাপ্লাইজ’ নামের কঠোর নজরদারি সংস্থা গড়ে তুলেও অবস্থা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। গাড়ি, স্যানিটারি আইটেম ও ইলেকট্রনিকস গেজেটের অনেকগুলোর আমদানি সরাসরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অন্য অনেক আইটেমের আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ব্যর্থতার পর সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সরকার দেশে ‘অর্থনৈতিক ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করেছে, কারণ দেশটি এখন অভূতপূর্ব ‘ফাইনেন্সিয়াল মেল্টডাউনের সম্মুখীন। বেশ কয়েকমাস ধরে ভয়ংকর খাদ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবেলার সামর্থ্য এখন তাদের নেই বললেই চলে। অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার দিনদিন বাড়ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যাদির বেশির ভাগই যেহেতু আমদানি করতে হয় তাই ওগুলোর ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শ্রীলঙ্কান রুপির বৈদেশিক মান কিছুদিন আগেও ছিল এক ডলারে একশত নব্বই রুপি, গত এক মাসে সেটা বেড়ে দু’শ ত্রিশ রুপিতে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২.৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে, অথচ আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করতেই হবে। এর মানে, শ্রীলঙ্কা নিজেকে ‘আর্থিক দেউলিয়া’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া দেশের কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের কারো সঙ্গে শলাপরামর্শ না করেই সম্পূর্ণ নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণেও দাবি করেন যে বিশ্ব থেকে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহারকে নির্মূল করতে নেতৃত্ব দেবে শ্রীলঙ্কা। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি অনুসরণে কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে বিশ্বে ‘পাইওনিয়ার’ হবে শ্রীলঙ্কা। তাঁর সরকার জৈব কম্পোস্ট সার সরবরাহের প্রক্রিয়া গড়ে তুলবে, যাতে রাসায়নিক সারের ‘প্রকৃতিবান্ধব বিকল্প’ ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করা যায়। কিন্তু, মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন অনেক কঠিন আরেকটা প্রক্রিয়া’ এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড়ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। কৃষক ‘অর্গানিক ফার্মিং’ করার প্রয়োজনে জৈব কম্পোস্ট সারের জন্য হাপিত্যেশ করলেও পুরো ফলন-মৌসুমে তার দেখা মেলেনি। ফলে এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে নেমে আসলো এক-চতুর্থাংশে। অন্যদিকে করোনাভাইরাস মহামারি শ্রীলঙ্কায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনলো শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। গত দু’বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এমন বিপর্যয় হয়েছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলঙ্কার রফতানি আয়ের আরো দুটো প্রধান সূত্র এলাচ এবং দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির এই দু’বছরে। ফলে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামলো এমন এক সময়ে, যখন কৃষি খাতের ফলন-বিপর্যয় খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি অবস্থায় টেনে নামিয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে।
বছরখানেক আগেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে বিবেচনা করা হতো। যেখানে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারের বেশি। শ্রীলঙ্কার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গণমুখী। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা। একমাত্র ভারতের কেরালার স্বাস্থ্যব্যবস্থা এর চাইতে উন্নততর ও সর্বজনীন। দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনের আকর্ষণের বড় ঠিকানাও ছিল শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কান তামিল টাইগারদের ওপর সরকারি বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিশ্বের কাছে একুশ শতকের সফল অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল হয়ে উঠার সম্ভাবনা ধারণ করছিল দেশটি। কিন্তু ওই গৃহযুদ্ধে একতরফা বিজয় অর্জনের সময় প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০ তামিল সিভিলিয়ান জনগণকে বিচার-বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি অভিযোগ উত্থাপন করলে বিশ্বের কাছে তদানীন্তন ক্ষমতাসীন সরকার প্রবল বিরূপ সমালোচনার পাত্রে পরিণত হয়। সরকার এবং সংখ্যাগুরু সিংহলীরা এ ধরনের কোন হত্যাকা- ঘটেনি দাবি করে কোনরকম আন্তর্জাতিক বিচার তারা চালাতে দেবে না বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ শ্রীলঙ্কাকে একপ্রকার ‘অস্পৃশ্য রাষ্ট্রের’ মতো বৈরী মর্যাদার অবস্থানে নিয়ে যায়। গৃহযুদ্ধে বিজয় এসেছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের (রাজাপক্ষ) শাসনামলে, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের বড়ভাই। মাঝখানে এক মেয়াদের জন্য মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মৈত্রীপালা সিরিসেনার কাছে হেরে যাওয়ায় বিরোধীদলের নেতার আসনে বসেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে শ্রীলঙ্কার ভোটের রাজনীতিকে দলীয় জোর-জবরদস্তির প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত করে রাজাপাকসে পরিবার পরবর্তী নির্বাচনে আবারো জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফিরে আসে। ক্ষমতায় আসীন হয়ে এবার বড়ভাই মাহিন্দা ছোটভাই গোটাবায়াকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী বনে গেলেন। গৃহযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ওপর সিংহলী জাতিসত্তার যে উগ্র-আধিপত্য স্থাপনের খায়েশ বাস্তবরূপ পেয়েছিল সেটাই রাজাপাকসে পরিবারের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়ায় শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে এনেছে মনে হয়।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। মূলত ২০২০ সালে করোনার মহামারির ধাক্কার ফলে বিপর্যয় আরও তীব্র হয়েছে। ওই সময় পশ্চিমা দেশগুলোতে কর্মরত অনেক শ্রীলঙ্কান কর্মী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। দেশের মধ্যেও সংক্রমণ মারাত্মক আকারে পৌঁছায়, বাধ্য হয়ে অনেক গার্মেন্ট কারখানা এবং চা বাগান বন্ধ হয়ে যায়। কাজ হারিয়ে ঘরে বেকার বসে থাকে লাখ লাখ শ্রমিক। বেড়ে যায় বেকারত্বের হার। মহামারিতে সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খায় সরকার। সংক্রমণের ধাক্কায় পর্যটন খাত বন্ধ হয়ে গেলে সংকট আরও তীব্র হয়। সব মিলিয়ে, রফতানি ও রেমিট্যান্সের মতো অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতগুলো একটা বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সংকট মোকাবিলায় আমদানি কমিয়ে ডলার জমা রাখার উদ্যোগেও ব্যাপক অনিয়মের কথাও উঠে এসেছে। সংকট উত্তরণে তখন থেকেই বড় ধরনের কৌশলের অভাব লক্ষ করা যায়। গত বছরে বেশ কিছু সিদ্ধান্তও নেয় মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার। এরমধ্যে হঠাৎ করেই অর্গানিক কৃষি চাষে পরিবর্তন আনা হয়। এটিকে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়। এমন বেশ কিছু অপরিকল্পিত পদক্ষেপ শ্রীলঙ্কার চলমান সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করা হয় শ্রীলঙ্কায়। খাদ্যমূল্যের দাম বাড়ায় ব্যাপক দরপতন ঘটেছে মুদ্রার। আর এ কারণেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। তখন বিবৃতিতে তিনি বলেন, অনুমোদিত কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর মজুত ক্রয় করতে পারবেন। দামে ছাড় দিয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে বিপত্তি আরও বাড়ে। ডলার বাঁচাতে আমদানি বিধিনিষেধের মধ্যে সরকারের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য জরুরি বিধি ঘোষণার ফলে বাজারে ব্যাপক অনিয়ম এবং মজুদের কারসাজির খবর পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ জাতীয় ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতার আশঙ্কা দেখা দেয়। কারণ দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ ১৬০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। পাশাপাশি যেসব দেশ থেকে ঋণ নিয়েছে লঙ্কান সরকার, তা পরিশোধের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ঋণ নেওয়া অব্যাহত ছিল। একই সময়ে জরুরি খাদ্য, জ্বালানি, মেশিনারি আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলারের মজুত না থাকার মধ্য দিয়ে ২০২২ সাল শুরু হয়। এতে ঘাটতি আরও বাড়ে এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলোÑ রাজাপাকসে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা চরম এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটে বেসামাল দেশটির অর্থনীতি। চারদিকে শুধুই হাহাকার। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। জ্বালানি তেল ও খাদ্য সংকট তীব্র। বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত দেশটি। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। কাগজের অভাবে দেশটির স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ কাগজ আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে নেই। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনও এতটা দূরবস্থায় পড়েনি দেশটি। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এ চরম সংকটের পেছনে মোটাদাগে ছয়টি কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এগুলো হচ্ছে- অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণ, বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত, ঋণ পরিশোধে বেহাল অবস্থা, কর কমানো, পর্যটন ও প্রবাসী আয়ে টান ও অর্গানিক চাষে বিপর্যয়। এ বিপর্যয়ে সরকার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যেসব নেওয়া হয়েছে সেগুলোতে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে নাগরিকদের মধ্যে। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশকে সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামতে দেখা গেছে। সম্প্রতি বিক্ষুব্ধ জনগণ প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর বাধায় তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ব্যাপক জনরোষ ছড়িয়ে পড়েছে এবং যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। অশান্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে সারা দেশে ৩৬ ঘণ্টার কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারকে আগামী কয়েক মাস কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুখোমুখি হতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমদানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন ডলার সংরক্ষণ করা হবে, নাকি আন্তর্জাতিক বন্ডধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধসে দেশটি এক ভয়াবহ সংকট, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন মহলের বিশ্লেষণ ও আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কার পরিবারতন্ত্রের প্রভাব, স্বেচ্ছাচারী শাসন, অবিবেচকের মতো অতিরিক্ত ঋণের মাধ্যমে বড় বড় একাধিক প্রকল্প গ্রহণ এবং অপরিকল্পিতভাবে হঠাৎ কৃষি খাতে অর্গানিক ফার্মিং চালুকরণ ইত্যাদির প্রভাবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তবে আমার কাছে যেটা প্রতীয়মান হচ্ছে তা হলো- উচ্চাশা ও উচ্চাকাক্সিক্ষত মানের বিভিন্ন অযৌক্তিক ও ঋণদায়গ্রস্ত প্রকল্প গ্রহণেই এ রকম ফলাফলটা এসেছে। কেননা কয়েক বছর পূর্বে দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন সূচকে তারা ছিল খুব অগ্রসরমান। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের এ বিপর্যয় খুবই অবাক হওয়ার মতো বিষয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় অবশ্য বের হবে। সেক্ষেত্রে কোন জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে এ শোচনীয় অবস্থার উত্তরণ ঘটবে না। তবে জাতীয় ঐকমত্য ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ফলাফল শুভ হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]