নিরাপদ হোক অনলাইনে কেনাকাটা

শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ

অনলাইনে কেনাকাটা বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। করোনা মহামারি একে দ্রুতায়িত করেছে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনকে এখন অপরিহার্য ভাবা হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দোকানপাট আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় স্থান নিচ্ছে অনলাইন। অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে ব্যাপকহারে। ক্রেতা মহলে এর জনপ্রিয়তা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে অনলাইনে কেনাকাটা একদা শখের বশে বা পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হলেও এখন অনলাইন বাজারের পরিধি অনেক বেড়েছে। করোনাকালে এ বাজারই ছিল কেনাকাটার প্রধান মাধ্যম। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হয়Ñ দ্রুত বিকাশশীল এ ব্যবসা খাতটি কিছু প্রতারক প্রতিষ্ঠানের খপ্পরে পড়ে আস্থাহীনতার ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ই-কর্মাস খাতের সংশ্লিষ্টদের ত্বরিত উদ্যোগ ও ব্যবস্থায় ইতোমধ্যে ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা অনেকটাই ফিরেছে। শুধু প্রতারক প্রতিষ্ঠানই নয়, একশ্রেণির ক্রেতার সীমাহীন লোভ কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাটের পথকে সহজ ও মসৃণ করেছে। অস্বাভাবিক মূল্যহ্রাস ও অফারের ফাঁদে পা দিয়ে তারা কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হয়নি, অনলাইন ব্যবসাকেও অনেকখানি ডুবিয়েছে। যাই হোক, প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের কর্মকর্তাদের অনেককে আটক করা হয়েছে। হাতিয়ে নেয়া অর্থেরও একটা অংশ গ্রাহকদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে।

খবর অনুযায়ী, কিউকমের ৫১ কোটি টাকা, আলেশামার্টের ২০ কোটি টাকাসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ (মোট ৭৩ কোটি টাকা) প্রতারিত গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা এ খাতে অস্থিরতা কমাতে ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া অনুকূল পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠায় ই-কর্মাস ব্যবসার নিবন্ধনসহ আরো কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, অনলাইনে ব্যবসা আগামী দিনগুলোতে আরো প্রসার লাভ করবে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে। বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। অনলাইন শপিং, অনলাইন মার্কেটিং ইত্যাদি এরই অংশ। ঝুঁকিহীন, ঝামেলামুক্ত এবং নিরাপদ হওয়ায় অনলাইনে পণ্য কিনাকাটায় মানুষ প্রধান্য দিচ্ছে। প্রযুক্তি ও পদ্ধতির এই আনুকূল্য থেকে আমরা বঞ্চিত থাকতে পারি না। করোনাকালে আমরা দেখেছি, কীভাবে অনলাইন শপ ও অনলাইন বাজার আমাদের উপকারে এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ই-কর্মাস খাতকে ২০২৫ সালে যে জায়গায় চিন্তা করা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতি সেই জায়গায় ৫ বছর আগেই তাকে পৌঁছে দিয়েছে। এখন পাড়ার মুদি দোকান থেকে বড় বড় শপিং মলগুলোও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছে। এ লক্ষণ উৎসাহজনক।

ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের সূত্রমতে, দেশে ওয়েবভিত্তিক অনলাইন শপ আছে প্রায় ১৩শ’র মতো। ফেসবুকভিত্তিক আছে ১০ হাজারের বেশি। এসব শপে কাজ করছে কয়েক লাখ মানুষ এবং অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে বছরে। বলাবাহুল্য, অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার সম্ভাবনা অপার। পণ্য প্রাপ্তি দ্রুত, নিরাপদ, সহজ ও নিশ্চিত করতে পারলে এর বিকাশ অবধারিত। এই সঙ্গে অবশ্য প্রতারণার আশঙ্কা ও ঠকার ভয় দূর করতে হবে। প্রতারণা ও ঠকার শঙ্কা-ভীতি একেবারে রহিত করা সম্ভব নয়। তবে উপযুক্ত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপে কমানো ও দ্রুত প্রতিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতারণারোধ ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় এ খাতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন এবং উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর নিতে হবে। ফেসবুক ব্যবহার করে যারা ব্যবসা করবে, তাদেরও এই আইডি নিতে হবে। গত বছর জুলাইয়ে জাতীয় ডিজিটাল কর্মাস পলিসি ২০২০ নামে একটি নির্দেশিকাও প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে অর্ডার নেয়া, ডেলিভারি নেয়া এবং অর্থ পরিশোধ করার নীতিমালা তুলে ধরা হয়েছে।

আগে অনলাইনে ব্যবসার কোনো প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ নিবন্ধন করার ব্যবস্থা ছিল না। ব্যবসার পদ্ধতি সংক্রান্ত কোনো নীতিমালাও ছিল না। ফলে প্রতারণার সুযোগ ছিল এবং কিছু মানুষ সেই প্রতারণার শিকার হয়েছে। প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা যেহেতু রয়েছে বা থাকবে, সুতরাং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে সর্বদা। কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রতারণা হচ্ছে কিনা, অনিয়ম হচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। নিয়মিত তদারকি ও মনিটারিং বহাল রাখতে হবে। কোথাও কোনো বিচ্যুতি হলে, ব্যতিক্রম হলে, সঙ্গে সঙ্গে তা রুখতে হবে এবং প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

‘ফ্যাক্টরস ডিটারমিনিং স্যাটিসফেকশন অব অনলাইন কাস্টমারস ইন ঢাকা সিটি, বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়Ñ অনলাইনে কেনাকাটায় ৯টি সূচক গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো- প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পণ্য দেওয়া, সশরীরে কেনাকাটার সঙ্গে অনলাইনে দামের সামঞ্জস্য, পণ্যের লিখিত ও দৃশ্যমান বিবরণ, গ্রাহক সেবা ও সমস্যা সমাধান, সময়মতো পৌঁছানো, ডেলিভারি মূল্য, দ্রব্য বা অর্থ ফেরত নীতিমালা, বিক্রেতা ও ডেলিভারি ম্যানের আচরণ এবং পণ্যের ওয়ারেন্টি সেবা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পণ্য দেওয়ার সূচকটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এরপর দামের সামঞ্জস্য এবং পণ্যের দৃশ্যমান ও লিখিত বিবরণী সূচক দুটি ভূমিকা রাখে।

গবেষণায় আরো বলা হয়, ঢাকায় অনলাইন কেনাকাটায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পণ্য পায় ২২.৪৫ শতাংশ, গ্রহণযোগ্য মূল্যে কেনাকাটা করে ১৬ শতাংশ এবং বিবরণ অনুযায়ী পণ্য পায় ১৪ শতাংশ অনলাইন ক্রেতা। এতে উল্লেখ করা হয়, সময়ের স্বল্পতা, অবস্থানগত সুবিধা এবং পণ্যের প্রকরণ ও ভিন্নতা এ তিনটি কারণে মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করে। গত পাঁচ বছরে অনলাইনে কেনাকাটা বহুগুণ বেড়েছে।

দেশে বর্তমানে ৬ হাজারের বেশি ‘সেলার রেটিংসহ’ সক্রিয় অনলাইন সাইট রয়েছে। জানা যায়, বিভিন্ন বয়স, পেশা ও আর্থসামাজিক অবস্হান থেকে উঠে আসা ক্রেতাদের ওপর জরিপ করে গবেষণা নিবন্ধটি পরিচালনা করা হয়। যারা কমপক্ষে এক বছর অনলাইনে কেনাকাটা করেছেন, এমন ১ হাজার ৫৬০ জনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের মধ্যে ৯৩৬ জন পুরুষ ও ৬২৬ জন নারী। তবে গবেষণায় শুধু নন-ফুড পণ্য দ্রব্যকে বিবেচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক এসএম ইখতিয়ার আলম বলেন, বিদেশে অনলাইন ব্যবস্হার সুফল দেখে দেশে একের পর এক অনলাইন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। তবে অনেকে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা করছে।

আমরা চাই, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতটি দ্রুত প্রসার লাভ করুক। তবে এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। একজন উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান কতটা অরিজিনাল বা অথেনটিক তা নিশ্চিত করার বিধান থাকা অবশ্যক। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতাদের সতর্ক থাকতে হবে। অস্বাভাবিক অফার বা অতি দামী জিনিস স্বল্পমূল্যে পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের আগে পণ্য বুঝে পাওয়া পরে দাম পরিশোধ করার নীতি অবলম্বন করতে হবে। আগামী কোরবানি ঈদ উপলক্ষে এরই মধ্যে অনলাইনে গরু বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্রেতাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে তারা প্রতারণার শিকার না হন। আমরা মনে করি, যেসব বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের সতর্ক থাকতে হবে।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট]

শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল ২০২২ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৭ রমাদ্বান ১৪৪৩

নিরাপদ হোক অনলাইনে কেনাকাটা

শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ

অনলাইনে কেনাকাটা বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। করোনা মহামারি একে দ্রুতায়িত করেছে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনকে এখন অপরিহার্য ভাবা হচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দোকানপাট আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় স্থান নিচ্ছে অনলাইন। অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে ব্যাপকহারে। ক্রেতা মহলে এর জনপ্রিয়তা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে অনলাইনে কেনাকাটা একদা শখের বশে বা পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হলেও এখন অনলাইন বাজারের পরিধি অনেক বেড়েছে। করোনাকালে এ বাজারই ছিল কেনাকাটার প্রধান মাধ্যম। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হয়Ñ দ্রুত বিকাশশীল এ ব্যবসা খাতটি কিছু প্রতারক প্রতিষ্ঠানের খপ্পরে পড়ে আস্থাহীনতার ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ই-কর্মাস খাতের সংশ্লিষ্টদের ত্বরিত উদ্যোগ ও ব্যবস্থায় ইতোমধ্যে ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা অনেকটাই ফিরেছে। শুধু প্রতারক প্রতিষ্ঠানই নয়, একশ্রেণির ক্রেতার সীমাহীন লোভ কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাটের পথকে সহজ ও মসৃণ করেছে। অস্বাভাবিক মূল্যহ্রাস ও অফারের ফাঁদে পা দিয়ে তারা কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হয়নি, অনলাইন ব্যবসাকেও অনেকখানি ডুবিয়েছে। যাই হোক, প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের কর্মকর্তাদের অনেককে আটক করা হয়েছে। হাতিয়ে নেয়া অর্থেরও একটা অংশ গ্রাহকদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে।

খবর অনুযায়ী, কিউকমের ৫১ কোটি টাকা, আলেশামার্টের ২০ কোটি টাকাসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ (মোট ৭৩ কোটি টাকা) প্রতারিত গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা এ খাতে অস্থিরতা কমাতে ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া অনুকূল পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠায় ই-কর্মাস ব্যবসার নিবন্ধনসহ আরো কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, অনলাইনে ব্যবসা আগামী দিনগুলোতে আরো প্রসার লাভ করবে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে। বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। অনলাইন শপিং, অনলাইন মার্কেটিং ইত্যাদি এরই অংশ। ঝুঁকিহীন, ঝামেলামুক্ত এবং নিরাপদ হওয়ায় অনলাইনে পণ্য কিনাকাটায় মানুষ প্রধান্য দিচ্ছে। প্রযুক্তি ও পদ্ধতির এই আনুকূল্য থেকে আমরা বঞ্চিত থাকতে পারি না। করোনাকালে আমরা দেখেছি, কীভাবে অনলাইন শপ ও অনলাইন বাজার আমাদের উপকারে এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ই-কর্মাস খাতকে ২০২৫ সালে যে জায়গায় চিন্তা করা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতি সেই জায়গায় ৫ বছর আগেই তাকে পৌঁছে দিয়েছে। এখন পাড়ার মুদি দোকান থেকে বড় বড় শপিং মলগুলোও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছে। এ লক্ষণ উৎসাহজনক।

ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের সূত্রমতে, দেশে ওয়েবভিত্তিক অনলাইন শপ আছে প্রায় ১৩শ’র মতো। ফেসবুকভিত্তিক আছে ১০ হাজারের বেশি। এসব শপে কাজ করছে কয়েক লাখ মানুষ এবং অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে বছরে। বলাবাহুল্য, অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার সম্ভাবনা অপার। পণ্য প্রাপ্তি দ্রুত, নিরাপদ, সহজ ও নিশ্চিত করতে পারলে এর বিকাশ অবধারিত। এই সঙ্গে অবশ্য প্রতারণার আশঙ্কা ও ঠকার ভয় দূর করতে হবে। প্রতারণা ও ঠকার শঙ্কা-ভীতি একেবারে রহিত করা সম্ভব নয়। তবে উপযুক্ত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপে কমানো ও দ্রুত প্রতিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতারণারোধ ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় এ খাতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন এবং উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর নিতে হবে। ফেসবুক ব্যবহার করে যারা ব্যবসা করবে, তাদেরও এই আইডি নিতে হবে। গত বছর জুলাইয়ে জাতীয় ডিজিটাল কর্মাস পলিসি ২০২০ নামে একটি নির্দেশিকাও প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে অর্ডার নেয়া, ডেলিভারি নেয়া এবং অর্থ পরিশোধ করার নীতিমালা তুলে ধরা হয়েছে।

আগে অনলাইনে ব্যবসার কোনো প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ নিবন্ধন করার ব্যবস্থা ছিল না। ব্যবসার পদ্ধতি সংক্রান্ত কোনো নীতিমালাও ছিল না। ফলে প্রতারণার সুযোগ ছিল এবং কিছু মানুষ সেই প্রতারণার শিকার হয়েছে। প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা যেহেতু রয়েছে বা থাকবে, সুতরাং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে সর্বদা। কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রতারণা হচ্ছে কিনা, অনিয়ম হচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। নিয়মিত তদারকি ও মনিটারিং বহাল রাখতে হবে। কোথাও কোনো বিচ্যুতি হলে, ব্যতিক্রম হলে, সঙ্গে সঙ্গে তা রুখতে হবে এবং প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

‘ফ্যাক্টরস ডিটারমিনিং স্যাটিসফেকশন অব অনলাইন কাস্টমারস ইন ঢাকা সিটি, বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়Ñ অনলাইনে কেনাকাটায় ৯টি সূচক গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো- প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পণ্য দেওয়া, সশরীরে কেনাকাটার সঙ্গে অনলাইনে দামের সামঞ্জস্য, পণ্যের লিখিত ও দৃশ্যমান বিবরণ, গ্রাহক সেবা ও সমস্যা সমাধান, সময়মতো পৌঁছানো, ডেলিভারি মূল্য, দ্রব্য বা অর্থ ফেরত নীতিমালা, বিক্রেতা ও ডেলিভারি ম্যানের আচরণ এবং পণ্যের ওয়ারেন্টি সেবা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পণ্য দেওয়ার সূচকটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এরপর দামের সামঞ্জস্য এবং পণ্যের দৃশ্যমান ও লিখিত বিবরণী সূচক দুটি ভূমিকা রাখে।

গবেষণায় আরো বলা হয়, ঢাকায় অনলাইন কেনাকাটায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পণ্য পায় ২২.৪৫ শতাংশ, গ্রহণযোগ্য মূল্যে কেনাকাটা করে ১৬ শতাংশ এবং বিবরণ অনুযায়ী পণ্য পায় ১৪ শতাংশ অনলাইন ক্রেতা। এতে উল্লেখ করা হয়, সময়ের স্বল্পতা, অবস্থানগত সুবিধা এবং পণ্যের প্রকরণ ও ভিন্নতা এ তিনটি কারণে মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করে। গত পাঁচ বছরে অনলাইনে কেনাকাটা বহুগুণ বেড়েছে।

দেশে বর্তমানে ৬ হাজারের বেশি ‘সেলার রেটিংসহ’ সক্রিয় অনলাইন সাইট রয়েছে। জানা যায়, বিভিন্ন বয়স, পেশা ও আর্থসামাজিক অবস্হান থেকে উঠে আসা ক্রেতাদের ওপর জরিপ করে গবেষণা নিবন্ধটি পরিচালনা করা হয়। যারা কমপক্ষে এক বছর অনলাইনে কেনাকাটা করেছেন, এমন ১ হাজার ৫৬০ জনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের মধ্যে ৯৩৬ জন পুরুষ ও ৬২৬ জন নারী। তবে গবেষণায় শুধু নন-ফুড পণ্য দ্রব্যকে বিবেচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক এসএম ইখতিয়ার আলম বলেন, বিদেশে অনলাইন ব্যবস্হার সুফল দেখে দেশে একের পর এক অনলাইন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। তবে অনেকে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা করছে।

আমরা চাই, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতটি দ্রুত প্রসার লাভ করুক। তবে এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। একজন উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান কতটা অরিজিনাল বা অথেনটিক তা নিশ্চিত করার বিধান থাকা অবশ্যক। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতাদের সতর্ক থাকতে হবে। অস্বাভাবিক অফার বা অতি দামী জিনিস স্বল্পমূল্যে পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের আগে পণ্য বুঝে পাওয়া পরে দাম পরিশোধ করার নীতি অবলম্বন করতে হবে। আগামী কোরবানি ঈদ উপলক্ষে এরই মধ্যে অনলাইনে গরু বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রেও ক্রেতাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে তারা প্রতারণার শিকার না হন। আমরা মনে করি, যেসব বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের সতর্ক থাকতে হবে।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট]