বারবার পেছাচ্ছে রামপাল, বিদ্যুৎ বিভাগের অসন্তোষ

এগারো বছর পেরিয়ে গেলেও উৎপাদনে আসতে পারেনি বাগেরহাটের ‘রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ বার বার পিছিয়ে যাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বাংলাদেশ ও ভারত সরকারে যৌথ বিনিয়োগে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র)’ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির সম-অংশীদারিত্বে ২০১২ সালের অক্টোবরে গঠিত ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের পুরো বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ ক্রয়ের লক্ষ্যে পিডিবির সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে।

কয়েক দফা পেছানোর পর গত বছর ডিসেম্বরে, সর্বশেষ এ বছর ৩১ মার্চ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের (৬৬০ মেগাওয়াট) বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের (৬৬০ মেগাওয়াট) পুনঃসংশোধিত বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ (সিওডি) ছিল এ বছরের ৩০ জুন।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে বিআইএফপিসিএলের প্রতিনিধি জানান, আগামী ৩১ জুলাইয়ের আগে প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসা সম্ভব নয়। একইভাবে দ্বিতীয় ইউনিটের সিওডিও এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত পেছাতে হবে বলে জানান তিনি।

কয়েকবার সময় বাড়ানোর পরও সিওডি অর্জন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বৈঠকের সভাপতি বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মু. মোহসিন চৌধুরী। সিওডি পরিবর্তনের বিষয়ে তার এক প্রশ্নের জবাবে পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বৈঠকে জানান বিআইএফপিসিএল এ বিষয়ে এখনো পিডিবির এপ্রুভাল (অনুমোদন) নেয়নি।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক জেষ্ঠ্য কর্মকর্তার মতে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বিবেচনায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিৎ ছিল তা দেয়া হয়নি। তাই বার বার পেছানো হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের (সিওডি) তারিখ।

দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৮৩৪ একর জমির ওপরে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি।

এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা সই হয়। দুই দেশের রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয় বিআইএফপিসিএল। তখন ধরা হয়েছিল ২০১৬ সালের মধ্যেই এই প্রকল্পটি ‘কমিশনড’ হবে, অর্থাৎ সেখানে উৎপাদন শুরু করা যাবে। কিন্তু নানা কারণে সেই সময়সীমা রক্ষা করা যায়নি।

২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়। ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহ্বান করে চুক্তি সই করা হয় ২০১৬ সালের ১২ জুলাই। প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল।

প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার ভারত হেভি ইলেট্রিক্যালস লিমিটেড (বিএইচইএল)। বাস্তবায়নকারী কোম্পানি বিআইএফপিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, কাজ শুরুর তারিখ থেকে ৪১ মাসের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার কথা ছিল। সে হিসাবে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরেই রামপাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এবং আগস্টে দ্বিতীয় ইউনিটটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। বিআইএফপিসিএল জানায়, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে কাক্সিক্ষত গতিতে কাজ না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি।

এরপর গত বছরের ডিসেম্বরে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। তবে বিআইএফপিসিএল এ বছর মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ায়। এখন মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, রামপাল প্রকল্পে এখনো কাজ চলছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঠিকাদারের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের সিওডি (বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ) যথাক্রমে আগামী জুলাই ও নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিআইএফপিসিএলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল সার্ভিসেস) দিলীপ সিং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানান, প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের টারবাইন জেনারেটর ১-এর টারবাইন বক্সআপ, স্ট্যাটর এবং মোটর ড্রাইভিং ব্রয়লার ফিড পাম্পের লুব অয়েল ফ্ল্যাশিংসহ এটিটি, টারবাইনের ইনসুলেশন, রুফ-শিটের কাজ, চিমনি শেল কনক্রিটিং, বয়লার ১-এর ড্রেনেবল হাইড্রো টেস্ট, কোল মিল, কোল বাঙ্কার ও এপিএইচ, বয়লার ফিড, ফার্নেশ এটিটি ইত্যাদি সম্পন্ন হয়েছে।

ইন্সুলেশন, রাবার লাইনিং, জয়েন্টিং এবং সেগমেন্টের কাজসহ কোল হ্যান্ডেলিং প্ল্যান্ট (সিএইচপি) স্ট্রাকচারাল ইরেকশন, ট্রান্সফার পয়েন্ট (টিপি)-সমুহের ফ্লোর কাস্টিং এবং ইক্যুইপমেন্ট ইরেকশন, কোল শিপ আনলোডার ইরেকশন, কোল শেডের স্ট্রাকচারাল ইরেকশন ও শিটিংয়ের কাজ চলমান আছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের বয়লার স্ট্রাকচারাল ও প্রেসার পার্ট, আইপি টারবাইন ইনলেট পানেল, এলপি হিটারের ইরেকশন চলমনা আছে বলে জানান দিলীপ সিং।

পিডিবির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কমিশনিংয়ের উদ্দেশ কয়লা ক্রয় ও প্রকল্প জেটিতে সরবরাহের চুক্তি হয়েছে গত ৩ মার্চ। প্রকল্পের কয়লা হ্যান্ডেলিং প্রক্রিয়া প্রস্তুত হলে উক্ত কয়লা সরবরাহ চালু হবে। পরবর্তী পরিচালনের নিমিত্তে দীর্ঘমেয়াদি কয়লা ক্রয়ের জন্য দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বান করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষায় সালফার দূরীকরণের জন্য লাইমস্টোন ক্রয় ও প্রকল্প জেটিতে সরবরাহের চুক্তি হয়েছে গত ৭ এপ্রিল। প্রকল্পের লাইমস্টোন হ্যান্ডেলিং প্রক্রিয়া প্রস্তুত হলে উক্ত লাইমস্টোন সরবরাহ চালু হবে।

এ বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৭৯ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ। প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় প্রায় ১২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।

সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি দাবি করে এই প্রকল্পটি বাতিল করতে দেশের পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করছে। তাতে সংহিত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন। তবে দেশে শুরুর দিকে জোরালো ওই আন্দোলনে এখন ভাটা পড়েছে।

তবে শুরু থেকেই সরকারের যুক্তি ছিল, সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি (উন্নত প্রযুক্তি) ব্যবহারের কারণে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের কোন ধরনের ক্ষতি করবে না। নষ্ট হবে না সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদের মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে বর্তমান সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবায়ন থেকে পিছপা হচ্ছে না।

এদিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকিৃত পাওয়া পৃথিবীর অন্যতম বড় ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল)’ সুন্দরবনকে ‘বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের’ তালিকাভুক্ত করতে ইউনেস্কোতে বৈঠক হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল সুন্দরবনের ক্ষতি না করে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করে তা আটকে দিয়েছে। এ বছর অনুষ্ঠেয় ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির’ ৪৫তম সভায় এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের সরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও রামপাল প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশও উৎপাদনে আসতে না পারা এমন কয়লাভিত্তিক ১০ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে। উন্নত দেশগুলে দীর্ঘদিন কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। এখন তারা সরে আসার ঘোষণা দিচ্ছে।

গ্যাস সংকট বিবেচনায় মিশ্র জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমাদের দেশে এখন মনোযোগ দেয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপরে। উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের উদ্যোগ অব্যহত আছে। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী বছর উৎপাদনে আসবে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২ , ১৭ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

বারবার পেছাচ্ছে রামপাল, বিদ্যুৎ বিভাগের অসন্তোষ

ফয়েজ আহমেদ তুষার

এগারো বছর পেরিয়ে গেলেও উৎপাদনে আসতে পারেনি বাগেরহাটের ‘রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ বার বার পিছিয়ে যাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বাংলাদেশ ও ভারত সরকারে যৌথ বিনিয়োগে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র)’ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির সম-অংশীদারিত্বে ২০১২ সালের অক্টোবরে গঠিত ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের পুরো বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ ক্রয়ের লক্ষ্যে পিডিবির সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে।

কয়েক দফা পেছানোর পর গত বছর ডিসেম্বরে, সর্বশেষ এ বছর ৩১ মার্চ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের (৬৬০ মেগাওয়াট) বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের (৬৬০ মেগাওয়াট) পুনঃসংশোধিত বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ (সিওডি) ছিল এ বছরের ৩০ জুন।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে বিআইএফপিসিএলের প্রতিনিধি জানান, আগামী ৩১ জুলাইয়ের আগে প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসা সম্ভব নয়। একইভাবে দ্বিতীয় ইউনিটের সিওডিও এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত পেছাতে হবে বলে জানান তিনি।

কয়েকবার সময় বাড়ানোর পরও সিওডি অর্জন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বৈঠকের সভাপতি বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মু. মোহসিন চৌধুরী। সিওডি পরিবর্তনের বিষয়ে তার এক প্রশ্নের জবাবে পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বৈঠকে জানান বিআইএফপিসিএল এ বিষয়ে এখনো পিডিবির এপ্রুভাল (অনুমোদন) নেয়নি।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক জেষ্ঠ্য কর্মকর্তার মতে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বিবেচনায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিৎ ছিল তা দেয়া হয়নি। তাই বার বার পেছানো হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের (সিওডি) তারিখ।

দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৮৩৪ একর জমির ওপরে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি।

এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা সই হয়। দুই দেশের রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয় বিআইএফপিসিএল। তখন ধরা হয়েছিল ২০১৬ সালের মধ্যেই এই প্রকল্পটি ‘কমিশনড’ হবে, অর্থাৎ সেখানে উৎপাদন শুরু করা যাবে। কিন্তু নানা কারণে সেই সময়সীমা রক্ষা করা যায়নি।

২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়। ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দরপত্র আহ্বান করে চুক্তি সই করা হয় ২০১৬ সালের ১২ জুলাই। প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল।

প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার ভারত হেভি ইলেট্রিক্যালস লিমিটেড (বিএইচইএল)। বাস্তবায়নকারী কোম্পানি বিআইএফপিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, কাজ শুরুর তারিখ থেকে ৪১ মাসের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার কথা ছিল। সে হিসাবে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরেই রামপাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এবং আগস্টে দ্বিতীয় ইউনিটটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। বিআইএফপিসিএল জানায়, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে কাক্সিক্ষত গতিতে কাজ না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি।

এরপর গত বছরের ডিসেম্বরে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। তবে বিআইএফপিসিএল এ বছর মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ায়। এখন মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, রামপাল প্রকল্পে এখনো কাজ চলছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঠিকাদারের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের সিওডি (বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ) যথাক্রমে আগামী জুলাই ও নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিআইএফপিসিএলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল সার্ভিসেস) দিলীপ সিং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানান, প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের টারবাইন জেনারেটর ১-এর টারবাইন বক্সআপ, স্ট্যাটর এবং মোটর ড্রাইভিং ব্রয়লার ফিড পাম্পের লুব অয়েল ফ্ল্যাশিংসহ এটিটি, টারবাইনের ইনসুলেশন, রুফ-শিটের কাজ, চিমনি শেল কনক্রিটিং, বয়লার ১-এর ড্রেনেবল হাইড্রো টেস্ট, কোল মিল, কোল বাঙ্কার ও এপিএইচ, বয়লার ফিড, ফার্নেশ এটিটি ইত্যাদি সম্পন্ন হয়েছে।

ইন্সুলেশন, রাবার লাইনিং, জয়েন্টিং এবং সেগমেন্টের কাজসহ কোল হ্যান্ডেলিং প্ল্যান্ট (সিএইচপি) স্ট্রাকচারাল ইরেকশন, ট্রান্সফার পয়েন্ট (টিপি)-সমুহের ফ্লোর কাস্টিং এবং ইক্যুইপমেন্ট ইরেকশন, কোল শিপ আনলোডার ইরেকশন, কোল শেডের স্ট্রাকচারাল ইরেকশন ও শিটিংয়ের কাজ চলমান আছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের বয়লার স্ট্রাকচারাল ও প্রেসার পার্ট, আইপি টারবাইন ইনলেট পানেল, এলপি হিটারের ইরেকশন চলমনা আছে বলে জানান দিলীপ সিং।

পিডিবির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কমিশনিংয়ের উদ্দেশ কয়লা ক্রয় ও প্রকল্প জেটিতে সরবরাহের চুক্তি হয়েছে গত ৩ মার্চ। প্রকল্পের কয়লা হ্যান্ডেলিং প্রক্রিয়া প্রস্তুত হলে উক্ত কয়লা সরবরাহ চালু হবে। পরবর্তী পরিচালনের নিমিত্তে দীর্ঘমেয়াদি কয়লা ক্রয়ের জন্য দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বান করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষায় সালফার দূরীকরণের জন্য লাইমস্টোন ক্রয় ও প্রকল্প জেটিতে সরবরাহের চুক্তি হয়েছে গত ৭ এপ্রিল। প্রকল্পের লাইমস্টোন হ্যান্ডেলিং প্রক্রিয়া প্রস্তুত হলে উক্ত লাইমস্টোন সরবরাহ চালু হবে।

এ বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৭৯ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ। প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় প্রায় ১২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।

সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি দাবি করে এই প্রকল্পটি বাতিল করতে দেশের পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করছে। তাতে সংহিত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন। তবে দেশে শুরুর দিকে জোরালো ওই আন্দোলনে এখন ভাটা পড়েছে।

তবে শুরু থেকেই সরকারের যুক্তি ছিল, সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি (উন্নত প্রযুক্তি) ব্যবহারের কারণে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের কোন ধরনের ক্ষতি করবে না। নষ্ট হবে না সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীদের মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে বর্তমান সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবায়ন থেকে পিছপা হচ্ছে না।

এদিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকিৃত পাওয়া পৃথিবীর অন্যতম বড় ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল)’ সুন্দরবনকে ‘বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের’ তালিকাভুক্ত করতে ইউনেস্কোতে বৈঠক হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল সুন্দরবনের ক্ষতি না করে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করে তা আটকে দিয়েছে। এ বছর অনুষ্ঠেয় ‘বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির’ ৪৫তম সভায় এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের সরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও রামপাল প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশও উৎপাদনে আসতে না পারা এমন কয়লাভিত্তিক ১০ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে। উন্নত দেশগুলে দীর্ঘদিন কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। এখন তারা সরে আসার ঘোষণা দিচ্ছে।

গ্যাস সংকট বিবেচনায় মিশ্র জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমাদের দেশে এখন মনোযোগ দেয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপরে। উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের উদ্যোগ অব্যহত আছে। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী বছর উৎপাদনে আসবে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।