ছুটির ফাঁদে ব্যবসা

সাধারণ সময়ে রাজধানীর বায়তুল মোকররমে শুক্রবার গম গম করতে থাকে ক্রেতা-বিক্রেতার সোরগোলে। গতকাল ছিল শুক্রবার, তারওপর একবারে ঈদ আসন্ন। সেই হিসেবে উপচেপড়া ভিড় থাকার কথা থাকলেও দেখা যায় উল্টো চিত্র। অলস সময় পার করছেন বায়তুল মোকাররম ও তার আশপাশের মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।

শিশুদের তৈরি পোশাকের দোকানি শাহাজাহান ভূঁইয়া হতাশ সুরে বলেন, ‘ ছুটি ব্যবসা খাইয়া ফেলছে। একসঙ্গে এত ছুটি। ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। কেনাকাটার চাইতে বাড়ি যাওয়া জরুরি।’

প্রায় ৩০ বছর ধরে বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতে ব্যবসা করে আসছেন শাহাজাহান। তিনি বলেন, ‘এবার ব্যবসা ভালো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসা হয় নাই। একসঙ্গে ছুটি পরছে অনেক। ছুটি পাইলেই কেউ আর ঢাকায় থাকতে চায় না। আর আমাদের ফুটপাত দোকানের মূল কাস্টমার ঢাকার বাইরের মানুষ। তারা না থাকলে ব্যবসাও থাকে না।’

শাহজাহান বলেন, ‘আমাদের এখানে শুক্রবারই ঈদের মতো ব্যবসা হয়। আইজকা একে শুক্রবার তারওপর ঈদ। আপনে দেখেন মানুষজন আছে (?) মানুষের হাতে টাকা পয়সা নাই বুঝছেন।’

কথা বলার ফাঁকে দেবাশীষ রায় নামের একজন ক্রেতা ছেলে বাচ্চার পোশাক পছন্দ করে দাম মেটালেন। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন দেবাশীষ। গত বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পর গ্রামের বাড়ি ভোলা যাওয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত জানজটের ভয়ে যাননি। তিনি বলেন, ‘এত গরমে এত কষ্ট করে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এতদিন ছুটি। ঢাকায় কিছু করার নেই।’

৫ বছর আর ২ বছর বয়সী ২ ছেলের জন্য দুটো ড্রেস কিনে দাম মেটাতে মেটাতে দেবাশীষ বলেন, আমার চারপাশের সবাই মুসলিম। সবাই নতুন পোশাক পরবে আমার ছেলেরা বাদ যাবে কেন। আর ওই যে সবাই বলেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’

দু’জন কম বয়সী যুবক বাচ্চাদের দুটো রোদ চশমা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দরদাম করছিলেন। এক পর্যায়ে বিক্রেতা কিছু দাম কমালেন আর বিক্রেতা বাড়িয়ে দুটো লাল রঙের বাচ্চাদের রোদ চশমা কিনে নিলেন। বেশ খুশি হয়ে একজন ব্যগে পুড়লেন চশমার প্যাকেট। কার জন্য চশমা কিনলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘বোনের দুই ছেলের জন্য।’

এখনো লেখাপড়া করেন, বেশি কিছু কিনতে পারবেন না জানিয়ে তারা বলেন, ‘এই চশমা দুই বছর আগেও ৩০ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যেত এখন ১২০ টাকায় কিনলাম।’ তাদের কথার সঙ্গে সায় দিয়ে বিক্রেতা ফুল মিয়া বলেন, ‘আগে আমিও বিক্রি করছি এই দামে। কিন্তু এখন পারি না।’

ফুল মিয়া বলেন, ‘স্বাধীনতার ১৭ দিন পর থেকে এই বায়তুল মোকাররমে ব্যবসা করছি। ব্যবসায় লাভ-লস থাকবে। কিন্তু দুই বছর করোনার পর ভাবছিলাম ভালো ব্যবসা করবো। কিন্তু তা আর হইলো না। চীন থেকে সময়মতো মাল আসে না বলে পাইকাররা ঠিকমতো মালামাল সাপ্লাই দিতে পারে না। আবার সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। আমাদেরও তো চলতে হবে।’

ঈদের দুই তিন দিন আগে থেকে কসমেটিকস, জুয়েলারি, জুতা, টুপি, আতরের দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। কিন্তু গতকাল বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম, গুলিস্তান ও আশপাশের বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঈদে যেমন ক্রেতা সমাগম হওয়ার কথা এবার তেমন নাই।

ইমিটেশন জুয়েলারির ব্যবসায়ী আল-আমিনও সন্তুষ্ট নন ঈদ ব্যবসায়। তিনিও একই কথা বলে সংবাদকে জানান, ‘সারামাস টুকটাক ব্যবস হইছে। ঈদে যেমন জমজমাট হয় তেমন হয় নাই। এই দুইদিনও ভালো ব্যবসা হবে না জানি। টুকটাক যা হবে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’

মতিঝিলে একটা করপোরেট অফিসে কাজ করেন আবদুল আলীম। বাসা ভাড়া নিয়ে রামপুরায় থাকনে। আজ রাতের ট্রেনে যাবেন দিনাজপুর। স্ত্রীকে নিয়ে টুকিটাকি সামান্য কিছু ঈদ উপহার কিনতে এসেছেন বাবা মা ও ভাই বোনদের জন্য।

আলীম বলেন, ‘করোনার সময় বেতন কমিয়ে ফেলেছে, তা আর বাড়েনি। কিন্তু অন্য সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সবকিছুর। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অনেক উপহার নেয়ার। যা প্রয়োজন তাই কিনছি।’

ফুটপাতে ক্রোকারিজ সামগ্রীর পসরা নিয়ে বসেছেন জাহিদুল ইসলাম সৈকত। একদাম, ১০০ টাকার দোকান। যা কিনবেন তাই ১০০ টাকা। তার কাছে জানতে চাইলে নতুন কিছু বলতে পারলেন না। ঈদে যে হৈচৈ হওয়ার কথা তা নেই জানিয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘ঈদের আগের তিন দিন কথা বলার সময় পায় না ব্যবসায়ীরা। তারা এখন অলস বসে আছে।’

ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে তিনিও বলেন দীর্ঘ ছুটির কথা। সৈকত আরও বলেন, ‘মানুষের হাতে এখন টাকা পয়সা কম। সবাই এখন যা দরকার তাই কেনাকাটা করেন। ঈদে ব্যবসা না হলে ঈদের পর কি হবে তাই ভাবতেছি।’

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২ , ১৭ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

ছুটির ফাঁদে ব্যবসা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

সাধারণ সময়ে রাজধানীর বায়তুল মোকররমে শুক্রবার গম গম করতে থাকে ক্রেতা-বিক্রেতার সোরগোলে। গতকাল ছিল শুক্রবার, তারওপর একবারে ঈদ আসন্ন। সেই হিসেবে উপচেপড়া ভিড় থাকার কথা থাকলেও দেখা যায় উল্টো চিত্র। অলস সময় পার করছেন বায়তুল মোকাররম ও তার আশপাশের মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।

শিশুদের তৈরি পোশাকের দোকানি শাহাজাহান ভূঁইয়া হতাশ সুরে বলেন, ‘ ছুটি ব্যবসা খাইয়া ফেলছে। একসঙ্গে এত ছুটি। ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। কেনাকাটার চাইতে বাড়ি যাওয়া জরুরি।’

প্রায় ৩০ বছর ধরে বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতে ব্যবসা করে আসছেন শাহাজাহান। তিনি বলেন, ‘এবার ব্যবসা ভালো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসা হয় নাই। একসঙ্গে ছুটি পরছে অনেক। ছুটি পাইলেই কেউ আর ঢাকায় থাকতে চায় না। আর আমাদের ফুটপাত দোকানের মূল কাস্টমার ঢাকার বাইরের মানুষ। তারা না থাকলে ব্যবসাও থাকে না।’

শাহজাহান বলেন, ‘আমাদের এখানে শুক্রবারই ঈদের মতো ব্যবসা হয়। আইজকা একে শুক্রবার তারওপর ঈদ। আপনে দেখেন মানুষজন আছে (?) মানুষের হাতে টাকা পয়সা নাই বুঝছেন।’

কথা বলার ফাঁকে দেবাশীষ রায় নামের একজন ক্রেতা ছেলে বাচ্চার পোশাক পছন্দ করে দাম মেটালেন। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন দেবাশীষ। গত বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পর গ্রামের বাড়ি ভোলা যাওয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত জানজটের ভয়ে যাননি। তিনি বলেন, ‘এত গরমে এত কষ্ট করে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এতদিন ছুটি। ঢাকায় কিছু করার নেই।’

৫ বছর আর ২ বছর বয়সী ২ ছেলের জন্য দুটো ড্রেস কিনে দাম মেটাতে মেটাতে দেবাশীষ বলেন, আমার চারপাশের সবাই মুসলিম। সবাই নতুন পোশাক পরবে আমার ছেলেরা বাদ যাবে কেন। আর ওই যে সবাই বলেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’

দু’জন কম বয়সী যুবক বাচ্চাদের দুটো রোদ চশমা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দরদাম করছিলেন। এক পর্যায়ে বিক্রেতা কিছু দাম কমালেন আর বিক্রেতা বাড়িয়ে দুটো লাল রঙের বাচ্চাদের রোদ চশমা কিনে নিলেন। বেশ খুশি হয়ে একজন ব্যগে পুড়লেন চশমার প্যাকেট। কার জন্য চশমা কিনলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘বোনের দুই ছেলের জন্য।’

এখনো লেখাপড়া করেন, বেশি কিছু কিনতে পারবেন না জানিয়ে তারা বলেন, ‘এই চশমা দুই বছর আগেও ৩০ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যেত এখন ১২০ টাকায় কিনলাম।’ তাদের কথার সঙ্গে সায় দিয়ে বিক্রেতা ফুল মিয়া বলেন, ‘আগে আমিও বিক্রি করছি এই দামে। কিন্তু এখন পারি না।’

ফুল মিয়া বলেন, ‘স্বাধীনতার ১৭ দিন পর থেকে এই বায়তুল মোকাররমে ব্যবসা করছি। ব্যবসায় লাভ-লস থাকবে। কিন্তু দুই বছর করোনার পর ভাবছিলাম ভালো ব্যবসা করবো। কিন্তু তা আর হইলো না। চীন থেকে সময়মতো মাল আসে না বলে পাইকাররা ঠিকমতো মালামাল সাপ্লাই দিতে পারে না। আবার সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। আমাদেরও তো চলতে হবে।’

ঈদের দুই তিন দিন আগে থেকে কসমেটিকস, জুয়েলারি, জুতা, টুপি, আতরের দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। কিন্তু গতকাল বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম, গুলিস্তান ও আশপাশের বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঈদে যেমন ক্রেতা সমাগম হওয়ার কথা এবার তেমন নাই।

ইমিটেশন জুয়েলারির ব্যবসায়ী আল-আমিনও সন্তুষ্ট নন ঈদ ব্যবসায়। তিনিও একই কথা বলে সংবাদকে জানান, ‘সারামাস টুকটাক ব্যবস হইছে। ঈদে যেমন জমজমাট হয় তেমন হয় নাই। এই দুইদিনও ভালো ব্যবসা হবে না জানি। টুকটাক যা হবে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’

মতিঝিলে একটা করপোরেট অফিসে কাজ করেন আবদুল আলীম। বাসা ভাড়া নিয়ে রামপুরায় থাকনে। আজ রাতের ট্রেনে যাবেন দিনাজপুর। স্ত্রীকে নিয়ে টুকিটাকি সামান্য কিছু ঈদ উপহার কিনতে এসেছেন বাবা মা ও ভাই বোনদের জন্য।

আলীম বলেন, ‘করোনার সময় বেতন কমিয়ে ফেলেছে, তা আর বাড়েনি। কিন্তু অন্য সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সবকিছুর। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অনেক উপহার নেয়ার। যা প্রয়োজন তাই কিনছি।’

ফুটপাতে ক্রোকারিজ সামগ্রীর পসরা নিয়ে বসেছেন জাহিদুল ইসলাম সৈকত। একদাম, ১০০ টাকার দোকান। যা কিনবেন তাই ১০০ টাকা। তার কাছে জানতে চাইলে নতুন কিছু বলতে পারলেন না। ঈদে যে হৈচৈ হওয়ার কথা তা নেই জানিয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘ঈদের আগের তিন দিন কথা বলার সময় পায় না ব্যবসায়ীরা। তারা এখন অলস বসে আছে।’

ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে তিনিও বলেন দীর্ঘ ছুটির কথা। সৈকত আরও বলেন, ‘মানুষের হাতে এখন টাকা পয়সা কম। সবাই এখন যা দরকার তাই কেনাকাটা করেন। ঈদে ব্যবসা না হলে ঈদের পর কি হবে তাই ভাবতেছি।’