মেয়ে হয়েছে বলে বাবা মুখে বিষ ঢেলে দেন, সেই লিজা এখন পরিবারের গর্ব

রাজশাহীর বাঘায় মেয়ে সন্তান হয়ে জন্ম নেয়ায় ৯ মাসের শিশু লিজা খাতুনের মুখে বিষ ঢেলে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন তার বাবা রিফাজ উদ্দিন। সেই মেয়েটি বড় হয়ে এখন পুলিশে চাকরি পেয়েছেন। তাকে নিয়ে এখন গর্ববোধ করছেন পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। উপজেলা নারায়ণপুর গ্রামের বুলবুলি বেগমের ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয় চন্ডিপুর গ্রামের দিনমজুর রিফাজ উদ্দিনের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকে সংসারে শান্তি ছিল না। তাদের বিয়ের দুই বছরের মাথায় পৃথিবীতে আসে মেয়ে সন্তান লিজা। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না তার বাবা। লিজার বয়স যখন ৯ মাস, তখন বাবা রিফাজ উদ্দিন নিষ্পাপ শিশুর মুখে বিষ ঢেলে দেয়।

বিষয়টি তার মা বুঝতে পেরে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসা শেষে মেয়েকে সুস্থ করে তার বোনের বাড়িতে চলে যান। সেখানেই লিজার দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা। মামা-খালাদের কাছে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। স্কুল-কলেজের গ-ি পেরিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে বাঘা শাহাদৌলা সরকারি কলেজে অনার্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। এদিকে গত মাসে পুলিশে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন লিজা। তারপর যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে জয় করেন চাকরি।

লিজা খাতুন বলেন, আমার এই পথ খুব একটা সহজ ছিল না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবা নেই, মা, খালা ও মামার সহযোগিতায় বড় হয়েছি। খালা ও মামার সহযোগিতায় স্কুল-কলেজের গ-ি পেরিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। বড় হওয়ার পর শুনেছি বাবার নিষ্ঠুরতার কথা। বাবা সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। এসএসসি পাস করার পর মনের মধ্যে জেদ চেপে বসে। তিনি বলেন, প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য মা-বাবাকে দেখার। আমার মাকে দেখতে হবে। সেই থেকেই কঠোর পরিশ্রমী মনোভাব তৈরি করি। সংগ্রামী জীবনে অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুব একটা সফল হইনি। পুলিশের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করি। উচ্চতা, শরীর চর্চা, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভাসহ সাতটি ধাপ পার করি আমার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে। এরপর পুলিশে চূড়ান্তভাবে মানোনীত হয়েছি।

লিজার মা বুলবুলি বেগম জানান, ২০ বছর আগে তার বিয়ে হয়। দিনমজুর স্বামীর কাজ তেমন ছিল না। বিয়ের পর স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। মেয়েসন্তান হওয়ার পর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। নিজের মেয়ের মুখে বিষ ঢেলে হত্যা করতে চেয়েছিল। তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে এ ধরনের কাজ করবে না প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়িতে আসার কিছুদিন পর ঢাকায় চাকরি করতে যাওয়ার নাম করে আর ফিরে আসেনি। ভাইবোন মিলে অনেক কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করেছি।

রাজশাহী পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলছেন, লিজা অনেক মেধাবী। সে ১০ হাজার প্রার্থীর মধ্যে একজন ছিল। নকআউট সিস্টেমে একের পর এক পরীক্ষার সাতটি ধাপ পার করে পুলিশের চাকরি পেয়েছে। পুলিশের চাকরির অনিয়ম, তদবির ও সুপারিশ বন্ধ এবং সরকারের নতুন চাকরি পদ্ধতির কারণে বহু অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পুলিশের চাকরি পাচ্ছে। এ বছর রাজশাহী জেলায় যে ৭২ জন চাকরি পেয়েছে, এদের বড় একটি অংশ অসচ্ছল পরিবার থেকে আসা। আশা করি আগামীতে এসব সদ্য নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্য দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে।

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২ , ১৭ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

মেয়ে হয়েছে বলে বাবা মুখে বিষ ঢেলে দেন, সেই লিজা এখন পরিবারের গর্ব

জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

image

মা-মেয়ে

রাজশাহীর বাঘায় মেয়ে সন্তান হয়ে জন্ম নেয়ায় ৯ মাসের শিশু লিজা খাতুনের মুখে বিষ ঢেলে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন তার বাবা রিফাজ উদ্দিন। সেই মেয়েটি বড় হয়ে এখন পুলিশে চাকরি পেয়েছেন। তাকে নিয়ে এখন গর্ববোধ করছেন পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। উপজেলা নারায়ণপুর গ্রামের বুলবুলি বেগমের ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয় চন্ডিপুর গ্রামের দিনমজুর রিফাজ উদ্দিনের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকে সংসারে শান্তি ছিল না। তাদের বিয়ের দুই বছরের মাথায় পৃথিবীতে আসে মেয়ে সন্তান লিজা। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না তার বাবা। লিজার বয়স যখন ৯ মাস, তখন বাবা রিফাজ উদ্দিন নিষ্পাপ শিশুর মুখে বিষ ঢেলে দেয়।

বিষয়টি তার মা বুঝতে পেরে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসা শেষে মেয়েকে সুস্থ করে তার বোনের বাড়িতে চলে যান। সেখানেই লিজার দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা। মামা-খালাদের কাছে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। স্কুল-কলেজের গ-ি পেরিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে বাঘা শাহাদৌলা সরকারি কলেজে অনার্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। এদিকে গত মাসে পুলিশে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন লিজা। তারপর যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে জয় করেন চাকরি।

লিজা খাতুন বলেন, আমার এই পথ খুব একটা সহজ ছিল না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবা নেই, মা, খালা ও মামার সহযোগিতায় বড় হয়েছি। খালা ও মামার সহযোগিতায় স্কুল-কলেজের গ-ি পেরিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। বড় হওয়ার পর শুনেছি বাবার নিষ্ঠুরতার কথা। বাবা সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। এসএসসি পাস করার পর মনের মধ্যে জেদ চেপে বসে। তিনি বলেন, প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য মা-বাবাকে দেখার। আমার মাকে দেখতে হবে। সেই থেকেই কঠোর পরিশ্রমী মনোভাব তৈরি করি। সংগ্রামী জীবনে অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুব একটা সফল হইনি। পুলিশের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করি। উচ্চতা, শরীর চর্চা, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভাসহ সাতটি ধাপ পার করি আমার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে। এরপর পুলিশে চূড়ান্তভাবে মানোনীত হয়েছি।

লিজার মা বুলবুলি বেগম জানান, ২০ বছর আগে তার বিয়ে হয়। দিনমজুর স্বামীর কাজ তেমন ছিল না। বিয়ের পর স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। মেয়েসন্তান হওয়ার পর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। নিজের মেয়ের মুখে বিষ ঢেলে হত্যা করতে চেয়েছিল। তারপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে এ ধরনের কাজ করবে না প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়িতে আসার কিছুদিন পর ঢাকায় চাকরি করতে যাওয়ার নাম করে আর ফিরে আসেনি। ভাইবোন মিলে অনেক কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করেছি।

রাজশাহী পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলছেন, লিজা অনেক মেধাবী। সে ১০ হাজার প্রার্থীর মধ্যে একজন ছিল। নকআউট সিস্টেমে একের পর এক পরীক্ষার সাতটি ধাপ পার করে পুলিশের চাকরি পেয়েছে। পুলিশের চাকরির অনিয়ম, তদবির ও সুপারিশ বন্ধ এবং সরকারের নতুন চাকরি পদ্ধতির কারণে বহু অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পুলিশের চাকরি পাচ্ছে। এ বছর রাজশাহী জেলায় যে ৭২ জন চাকরি পেয়েছে, এদের বড় একটি অংশ অসচ্ছল পরিবার থেকে আসা। আশা করি আগামীতে এসব সদ্য নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্য দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে।