বাহারি রেশমি চুড়ি : রুমা বেগমের সংগ্রামী জীবন

ফার্মগেট হলিক্রস কলেজের সামনের ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে একজন শীর্ণ শরীরের নারী নিরীহ চাহনি নিয়ে কয়েক ঝুড়ি নানা রঙের কাঁচের চুড়ি নিয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর হাতের কাপড় দিয়ে চুড়ির ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করছেন। আর ক্রেতার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছেন রাস্তার ব্যস্ত মানুষের দিকে।

‘কেমন আছেন?’ ‘আপনার নাম কি?’ এমন প্রশ্নে কিছু সময় অবাক তাকিয়ে থাকেন, যেন নামটা ভুলে গেছেন। কিছুক্ষণ পর মুচকি হেসে বলেন, ‘আমার নাম ধইরা কেউ ডাকে না। নামটাই ভুইলা গেছি।’ তাহলে কি ডাকে এ কথায় তিনি বলেন, ‘চুড়িওয়ালী চাচি-খালা ডাকে।’ তারপর নরম সুরে বলেন, ‘আমার নাম রুমা, রুমা বেগম।’

লাল, নীল, হলুদ, সাদা, কালো নানা রঙের বাহারি কাঁচের রেশমি চুড়ি নিয়ে প্রায় ৩০ বছর ব্যবসা করছেন রুমা। চোখের সামনে ভাঙাচোরা টিনশেডের বাড়িঘর ভেঙে বড় বড় দোকান-পাট, বাসা-বাড়ি গড়তে দেখেছেন তিনি। জনহীন ফার্মগেট এলাকা এখন লোকে লোকারণ্য। এত গাড়ি, এত মানুষ, এত জিনিষ সব তার চোখের সামনেই হয়েছে। এ যেন একটি স্বপ্ন, বলেন রুমা।

মানুষ বেড়েছে কিন্তু আগের মতো মানুষ আর নাই আক্ষেপ রুমার। ‘কেউ আর এখন আগের মতো আইসা বসে না। আগে অনেক ভালো আছিলাম। চুড়ি কিনতে আইসা কত কথা, কত গল্প করত। এহন তো চুড়ি বেচাই হয় কম।’

‘আইজ (২৩ এপ্রিল) কোন বেচা-বিক্রি হয় নাই। কি খামু হেইডা বুঝতাছি না। রাস্তার ভাড়া ৫০ টাকা কই থিকা দিমু।’

রাস্তার ভাড়া মানে, ফুটপাতের ভাড়া কে নেয় এ কথায় যেন অস্বস্তিতে পরেন তিনি। তারপর উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে বলেন, ‘লাইনম্যান নেয়।’

সামনে ঈদ, কী করবেন, কীভাবে কাটাবেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘ঈদের আনন্দ কেমনে করবো। আজ কয়দিন বেচাকেনা কম। আইজকা একেবারে নাই। একটা চুড়িও বিক্রি হয় নাই।’

‘আমার জীবনে এত কষ্ট আর পাই নাই। রাতে একটা ছাপড়া ঘরে ঘুমাইতাম। মাসে ২ হাজার টাকা ভাড়া আছিলো। বেচা বিক্রি কইম্যা যাওয়ায় ছাইড়া দিয়া এখন রাস্তায় ঘুমাই’- শুকনো মুখে মায়া জড়ানো চোখে কথাগুলো বলছিলেন নানা রঙের কাঁচের চুড়ি বিক্রেতা রুমা বেগম।

অন্য কোন ব্যবসা করতে পারতেন। চুড়ি ব্যবসায় কেন এলেন এ প্রশ্নে রুমা বলেন, ‘আমার মা চুড়ির ব্যবসা করতেন। আমি তো এহন ফুটপাতে বইসা বেচাবিক্রি করি। মা মাথায় চুড়ির ঝাপি নিয়া কলাবাগান, কাঁঠালবাগান থিকা শুরু কইরা মিরপুর দশ, বারো, চৌদ্দ ঘুরতেন। আমিও ঘুরতাম মায়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেই সময় বাসার ভেতরে ঢুইকা চুড়ি বেচত মা। এক বাসায় ঢুকলে আশপাশের বউ মাইয়ারা (মেয়ে) চইলা আসত।’

‘তারা চুড়িও নিত, খাইতেও দিত। আমি খাওনের লাইগা যাইতাম মায়ের সঙ্গে সঙ্গে,’ এ কথা বলতে বলতে হেসে ওঠেন। তবে পরক্ষণেই বলেন, ‘এখন কেউ ডাকে না। বাসা বাড়িতে ঢুকাও যায় না।’

‘এক ডজন চুড়ি আগে আড়াই টাকায় বিক্রি করছি,’ জানিয়ে রুমা বলেন, ‘এখন এক ডজন চুড়ির দাম ৬০ টাকা। সব জিনিষের দাম বাড়তি। মানুষ খাওনের জিনিষ কিনবো না চুড়ি কিনবো। আগে এমন দিন গেছে দিনে দেড়-দুই হাজার টাকার চুড়ি বিক্রি করছি।’

জামালপুরের মেয়ে রুমার শ্বশুরবাড়িও জামালপুর। স্বামী মোজাম্মেল মিয়া যখন মন চায় কাজ করেন, মন চায় না কাজ করেন না। ৪ মেয়ে ২ ছেলে নিয়ে সংসার রুমা আর মোজাম্মেলের। এত বড় সংসার চালাতে আগে কষ্ট হতো না। এখন সংসার ছোট হয়ে এসেছে। এক ছেলে আর মেয়েদের সবার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। খুব ইচ্ছা ছোট ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখানোর। কিন্তু কিছুতেই যেন জীবনের লাগাম টেনে ধরতে পারছেন না।

স্বামী মোজাম্মেল এখন গ্রামে তেল পড়া, পানি পড়া দিয়ে বেড়ান (কবিরাজ)। কিন্তু এর বিনিময়ে কোন টাকা পয়সা নেন না। আবার তেমন কোন কাজও করেন না ফলে সংসারের সবটুকু দায়িত্ব এসে পড়েছে রুমার ওপর।

রুমা বলেন, ‘ব্যবসায় আসছি কষ্টে পইড়া। বিয়ার পর কোনরকম সংসার চলতে আছিল। দুই বাচ্চা হওয়ার পর স্বামীর যে কী হইলো, ঘর সংসারে ঠিক মতো খেয়াল করে না। তখন বাধ্য হইয়া এই ব্যবসায় নামি। মায়ের কাছে এই ব্যবসাই শিখছি। আর কিছু শিখি নাই।’

সংসারের কথা ভেবে আর ব্যবসার অবস্থা নাজুক হওয়ায় মাসিক দুই হাজার টাকায় ভাড়া নেয়া ঘরটি ছেড়ে দেন রুমা। ঘুমান কখনো ফুটপাতে কখনো কারো বাসার বারান্দায়। তার জীবনের চেয়েও যেন তার মাল-সামানার দাম বেশি। তার চুড়ির ঝুড়িগুলো রাখেন প্রতিরাত ২০ টাকা ভাড়ায় এক দোকোনের ভেতর।

নানান রঙের চুড়ি বিক্রি করলেও তার হাতে কোন চুড়ি নেই। চুড়ি পড়তে ইচ্ছে করে না এমন প্রশ্নে আবারো হাসেন। তারপর বললেন, ‘করে। ভাইঙা যায়। আর আমি যে চুড়ি পরবো সেইটা বিক্রি করলে আমার লাভ হইবো।’

অনেক অতীতে চলে যান রুমা। তার বিয়ের সময় পর্যন্ত তার মা ব্যবসা করতেন। মা এর দোকান থেকে ইচ্ছেমতো চুড়ি নিয়ে পরেছেন। সেই ছিল তার ইচ্ছেমতো চুড়ি পরা। ছেলেমেয়েদের দেখভালের সময় চুড়ি ভেঙে যেতে পারে, বাচ্চার আঘাত লাগতে পারে বলে শত ইচ্ছা থাকলেও আর চুড়ি পরা হয় নাই, তার হাত আর চুড়িতে ভরে নাই।

জীবনের কঠিন সময় পার করছেন রুমা। মেয়েদের বিয়ে হলেও তারা সুখী না। মেয়েদের একদিনের জন্য যে নিজের কাছে এনে রাখবেন অভাবের কারণে তা পারেন না।

রুমা আজও স্বপ্ন দেখেন তার নিজের ছোট্ট একটা দোকান হবে। তার ছোট ছেলেটা লেখাপড়া শিখবে।

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২ , ১৭ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

বাহারি রেশমি চুড়ি : রুমা বেগমের সংগ্রামী জীবন

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

image

ফার্মগেট হলিক্রস কলেজের সামনের ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে একজন শীর্ণ শরীরের নারী নিরীহ চাহনি নিয়ে কয়েক ঝুড়ি নানা রঙের কাঁচের চুড়ি নিয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর হাতের কাপড় দিয়ে চুড়ির ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করছেন। আর ক্রেতার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছেন রাস্তার ব্যস্ত মানুষের দিকে।

‘কেমন আছেন?’ ‘আপনার নাম কি?’ এমন প্রশ্নে কিছু সময় অবাক তাকিয়ে থাকেন, যেন নামটা ভুলে গেছেন। কিছুক্ষণ পর মুচকি হেসে বলেন, ‘আমার নাম ধইরা কেউ ডাকে না। নামটাই ভুইলা গেছি।’ তাহলে কি ডাকে এ কথায় তিনি বলেন, ‘চুড়িওয়ালী চাচি-খালা ডাকে।’ তারপর নরম সুরে বলেন, ‘আমার নাম রুমা, রুমা বেগম।’

লাল, নীল, হলুদ, সাদা, কালো নানা রঙের বাহারি কাঁচের রেশমি চুড়ি নিয়ে প্রায় ৩০ বছর ব্যবসা করছেন রুমা। চোখের সামনে ভাঙাচোরা টিনশেডের বাড়িঘর ভেঙে বড় বড় দোকান-পাট, বাসা-বাড়ি গড়তে দেখেছেন তিনি। জনহীন ফার্মগেট এলাকা এখন লোকে লোকারণ্য। এত গাড়ি, এত মানুষ, এত জিনিষ সব তার চোখের সামনেই হয়েছে। এ যেন একটি স্বপ্ন, বলেন রুমা।

মানুষ বেড়েছে কিন্তু আগের মতো মানুষ আর নাই আক্ষেপ রুমার। ‘কেউ আর এখন আগের মতো আইসা বসে না। আগে অনেক ভালো আছিলাম। চুড়ি কিনতে আইসা কত কথা, কত গল্প করত। এহন তো চুড়ি বেচাই হয় কম।’

‘আইজ (২৩ এপ্রিল) কোন বেচা-বিক্রি হয় নাই। কি খামু হেইডা বুঝতাছি না। রাস্তার ভাড়া ৫০ টাকা কই থিকা দিমু।’

রাস্তার ভাড়া মানে, ফুটপাতের ভাড়া কে নেয় এ কথায় যেন অস্বস্তিতে পরেন তিনি। তারপর উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে বলেন, ‘লাইনম্যান নেয়।’

সামনে ঈদ, কী করবেন, কীভাবে কাটাবেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘ঈদের আনন্দ কেমনে করবো। আজ কয়দিন বেচাকেনা কম। আইজকা একেবারে নাই। একটা চুড়িও বিক্রি হয় নাই।’

‘আমার জীবনে এত কষ্ট আর পাই নাই। রাতে একটা ছাপড়া ঘরে ঘুমাইতাম। মাসে ২ হাজার টাকা ভাড়া আছিলো। বেচা বিক্রি কইম্যা যাওয়ায় ছাইড়া দিয়া এখন রাস্তায় ঘুমাই’- শুকনো মুখে মায়া জড়ানো চোখে কথাগুলো বলছিলেন নানা রঙের কাঁচের চুড়ি বিক্রেতা রুমা বেগম।

অন্য কোন ব্যবসা করতে পারতেন। চুড়ি ব্যবসায় কেন এলেন এ প্রশ্নে রুমা বলেন, ‘আমার মা চুড়ির ব্যবসা করতেন। আমি তো এহন ফুটপাতে বইসা বেচাবিক্রি করি। মা মাথায় চুড়ির ঝাপি নিয়া কলাবাগান, কাঁঠালবাগান থিকা শুরু কইরা মিরপুর দশ, বারো, চৌদ্দ ঘুরতেন। আমিও ঘুরতাম মায়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেই সময় বাসার ভেতরে ঢুইকা চুড়ি বেচত মা। এক বাসায় ঢুকলে আশপাশের বউ মাইয়ারা (মেয়ে) চইলা আসত।’

‘তারা চুড়িও নিত, খাইতেও দিত। আমি খাওনের লাইগা যাইতাম মায়ের সঙ্গে সঙ্গে,’ এ কথা বলতে বলতে হেসে ওঠেন। তবে পরক্ষণেই বলেন, ‘এখন কেউ ডাকে না। বাসা বাড়িতে ঢুকাও যায় না।’

‘এক ডজন চুড়ি আগে আড়াই টাকায় বিক্রি করছি,’ জানিয়ে রুমা বলেন, ‘এখন এক ডজন চুড়ির দাম ৬০ টাকা। সব জিনিষের দাম বাড়তি। মানুষ খাওনের জিনিষ কিনবো না চুড়ি কিনবো। আগে এমন দিন গেছে দিনে দেড়-দুই হাজার টাকার চুড়ি বিক্রি করছি।’

জামালপুরের মেয়ে রুমার শ্বশুরবাড়িও জামালপুর। স্বামী মোজাম্মেল মিয়া যখন মন চায় কাজ করেন, মন চায় না কাজ করেন না। ৪ মেয়ে ২ ছেলে নিয়ে সংসার রুমা আর মোজাম্মেলের। এত বড় সংসার চালাতে আগে কষ্ট হতো না। এখন সংসার ছোট হয়ে এসেছে। এক ছেলে আর মেয়েদের সবার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। খুব ইচ্ছা ছোট ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখানোর। কিন্তু কিছুতেই যেন জীবনের লাগাম টেনে ধরতে পারছেন না।

স্বামী মোজাম্মেল এখন গ্রামে তেল পড়া, পানি পড়া দিয়ে বেড়ান (কবিরাজ)। কিন্তু এর বিনিময়ে কোন টাকা পয়সা নেন না। আবার তেমন কোন কাজও করেন না ফলে সংসারের সবটুকু দায়িত্ব এসে পড়েছে রুমার ওপর।

রুমা বলেন, ‘ব্যবসায় আসছি কষ্টে পইড়া। বিয়ার পর কোনরকম সংসার চলতে আছিল। দুই বাচ্চা হওয়ার পর স্বামীর যে কী হইলো, ঘর সংসারে ঠিক মতো খেয়াল করে না। তখন বাধ্য হইয়া এই ব্যবসায় নামি। মায়ের কাছে এই ব্যবসাই শিখছি। আর কিছু শিখি নাই।’

সংসারের কথা ভেবে আর ব্যবসার অবস্থা নাজুক হওয়ায় মাসিক দুই হাজার টাকায় ভাড়া নেয়া ঘরটি ছেড়ে দেন রুমা। ঘুমান কখনো ফুটপাতে কখনো কারো বাসার বারান্দায়। তার জীবনের চেয়েও যেন তার মাল-সামানার দাম বেশি। তার চুড়ির ঝুড়িগুলো রাখেন প্রতিরাত ২০ টাকা ভাড়ায় এক দোকোনের ভেতর।

নানান রঙের চুড়ি বিক্রি করলেও তার হাতে কোন চুড়ি নেই। চুড়ি পড়তে ইচ্ছে করে না এমন প্রশ্নে আবারো হাসেন। তারপর বললেন, ‘করে। ভাইঙা যায়। আর আমি যে চুড়ি পরবো সেইটা বিক্রি করলে আমার লাভ হইবো।’

অনেক অতীতে চলে যান রুমা। তার বিয়ের সময় পর্যন্ত তার মা ব্যবসা করতেন। মা এর দোকান থেকে ইচ্ছেমতো চুড়ি নিয়ে পরেছেন। সেই ছিল তার ইচ্ছেমতো চুড়ি পরা। ছেলেমেয়েদের দেখভালের সময় চুড়ি ভেঙে যেতে পারে, বাচ্চার আঘাত লাগতে পারে বলে শত ইচ্ছা থাকলেও আর চুড়ি পরা হয় নাই, তার হাত আর চুড়িতে ভরে নাই।

জীবনের কঠিন সময় পার করছেন রুমা। মেয়েদের বিয়ে হলেও তারা সুখী না। মেয়েদের একদিনের জন্য যে নিজের কাছে এনে রাখবেন অভাবের কারণে তা পারেন না।

রুমা আজও স্বপ্ন দেখেন তার নিজের ছোট্ট একটা দোকান হবে। তার ছোট ছেলেটা লেখাপড়া শিখবে।