ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর অনিন্দ্য সুন্দর জীবনের খোঁজে

শেখর ভট্টাচার্য

রবীন্দ্র সমালোচনার একটি অতি পুরাতন ধারা হলো আলোচক, সমালোচকরা রবীন্দ্রনাথকে অতিন্দ্রীয় পুরুষ, ঋষি কিংবা দেবতা স্থির করেই আলোচনা, সমালোচনা শুরু করেন। নির্মোহ রবীন্দ্র গবেষকরা অতি আবেগী রবীন্দ্র মূল্যায়ন নিয়ে রবীন্দ্রপ্রেমীদের সতর্ক থাকতে উপদেশ দেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কবিগুরু, বিশ্ব পরিম-লে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সম্মানের স্থানে পৌঁছে দিতে তার অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্র সাহিত্যের ব্যপকতা, বিশালত্ব, দার্শনিক মূল্যকে অতিক্রম করা এখন পর্যন্ত দুরূহ কাজ বলে অধিকাংশ প-িতেরা অভিমত প্রকাশ করেন; তাই বলে তার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ভুলে গেলে চলবে না, তিনি আমাদের মতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ ছিলেন। মানুষ রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথকে বোঝা খুব কষ্টকর এমন কি অসম্ভব। আমরা নিশ্চয় চাই না খ-িত কিংবা বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে উপস্থিত হন। আমরা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও মহৎ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের এক ও অভীন্ন সত্ত্বাকে একসঙ্গে দেখতে চাই এবং এটাই শুদ্ধ রবীন্দ্র চর্চাকারীদের আন্তরিক চাওয়া।

আমাদের আর একটি সংবেদনশীল অনুভূতির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গন্ধুকে নিয়ে আলোচনার সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা আবেগে এতোই বিহব্বল হয়ে পড়ি যে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু চাপা পড়ে যান নেতা বঙ্গবন্ধুর ছায়ার নিচে। অথচ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবন কতো বৈচিত্র্যময়, মানবিকতায় পরিপূর্ণ, রসবোধে টুইটুম্বুর। তার অনুভূতিতে সাধারণ মানুষের মতো কতো উপাদান বহমান। ব্যক্তি মুজিবকে যথাযথ অধ্যয়ন না করলে তার চরিত্রের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য অনুধাবন করা সাধারন মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন।

বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলেই আমাদের মনে আসে ইতিহাসের বাঁক ঘুরানো বড় বড় মাইল স্টোনের কথা। যেহেতু তিনি রাজনীতিবিদ তাকে হয়তো, বাঁক ঘুরানো সময়ের সিঁড়িতেই খোঁজা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এ কথা ও তো সত্য মানুষের জীবন ও কর্মের সম্মিলিত রূপই হলো একজন সামগ্রিক মানুষ। শাশ্বত বাঙালির আবেগ, সেচ্ছাসেবা, সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, রবীন্দ্রনাথের মতো জাতি চরিত্রের সবলতা, দুর্বলতার অনুসন্ধান, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, নেতার প্রতি ভক্তিতে অবিচল থাকা, এগুলো হলো ব্যক্তি মুজিব চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ব্যক্তি মুজিব প্রায় অনুপস্থিত অথবা তার অস্পষ্ট রূপ আমরা দেখতে পাই মুজিব গবেষকদের গবেষণায়।

মুজিবের জীবন কত বৈচিত্র্যময়, যুগপৎভাবে কত সাধারণ এবং অসাধারন, তা তার রচিত বইয়ের পৃষ্ঠায়, পৃষ্ঠায় ঘুরে বেড়ালে অনুধাবন করা যায়। বাবা শেখ লুৎফর রহমানের দলের সঙ্গে ২০ বছর বয়সে কোমর বেধে আনুষ্ঠানিক ফুটবল ম্যাচে লড়ে যেতে দেখি আমরা তাকে। তা ও এক দিন নয়, বাবার দলের সঙ্গে পর পর পাঁচ দিন হাড্ডা হাড্ডি লড়াই। একদিকের গোল রক্ষক পিতা অন্য দিকের গোলরক্ষক পুত্র, যে পুত্র আমৃত্যু বাঙালি জাতির গোলবারের সামনে বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই পুত্র শেখ মুজিব। বাবা ছেলের সম্পর্ক কি মধুর, কিন্তু খেলার ক্ষেত্রে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সুচাগ্র মেদিনী’। বাবার দল হল, গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব। অফিসার্স ক্লাব গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলকে হারানোর জন্য বাইরে থেকে খেলোয়াড় ভাড়া করে নিয়ে আসে। পর, পর পাঁচ দিন যখন খেলা ড্র, ষষ্ঠ দিনে শেখ মুজিবের স্কুল দলের ১১ জন খেলোয়াড় ক্লান্ত। এ দিকে ভাড়া করা খেলোয়াড়দের ভাড়ার টাকা গুনতে গিয়ে প্রায় ফতুর অফিসার্স ক্লাব। ষষ্ঠ দিনে স্কুল দল খেলবে না আর অফিসার্স ক্লাবের খেলতেই হবে। এ নিয়ে বাগ্বিত-া। শেষ পর্যন্ত হাল ধরলেন হেডমাস্টার রসময় বাবু। শেখ মুজিব তো এবার কাবু, হেড স্যারের অনুরোধে খেলতে হলো ষষ্ঠ দিন সকালে। ছেলের দল এক-শূন্য গোলে পরাজিত হলো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার এসব কাহিনী আমরা জানতেই পারতাম না, বঙ্গবন্ধু যদি তার আত্মজীবনী লিখে না যেতেন। গবেষকরা নেতা বঙ্গবন্ধুর কর্মের দিকে শতভাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবনের এসব আটপৌরে, মানবিক গল্প থেকে আমাদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত দায় মেটাতে হলো বঙ্গবন্ধুকেই, তার লেখা আত্মজীবনী থেকেই আমরা জানতে পারি ব্যক্তি মুজিবের জীবনের এসব মনকাড়া, আটপৌরে গল্পগুলো।

মানুষ মুজিবের মনুষ্যত্ত্ববোধের প্রথম ঝলক আমরা কোথায় দেখি? তার বাড়ির লজিং মাস্টার আবদুল হামিদ এমএসসি, মুসলিম সেবা সমতি গঠন করলেন, দরিদ্র মুসলিম ছাত্রদের বই, পরীক্ষা ও অন্যান্য শিক্ষার খরচ বহন করার জন্য। শেখ মুজিব তার দল বল নিয়ে বাড়ি বাড়ি মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠানোর দায়িত্ব নেন। সেই চাল বিক্রির টাকায় কিছু দরিদ্র মুসলিম শিক্ষার্থীদের লেখা পড়ার খরচ চলতে লাগল। যক্ষ্মা তখন ভয়াবহ রোগ। ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’, এ রকম কথা তখন মানুষের মুখে মুখে। হঠাৎ করে মুজিবের সেই সমাজসেবী শিক্ষক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শিক্ষক মারা গেলেও তার এই মহৎ উদ্যোগ কিন্তু থেমে যেতে দেননি শেখ মুজিব, সেচ্ছায় মাথায় তুলে নেন মুসলিম সেবা সমিতির ভার। তিনি হলেন সম্পাদক আর তার মাথার ওপর রাখলেন আর একজন শিক্ষককে সভাপতি হিসেবে। মুষ্টি ভিক্ষা ও দরিদ্র ছাত্রদের সহায়তা কিন্তু বন্ধ হলো না। শেখ মুজিবের বয়স তখন কত? মাত্র ১৭ বছর। এই বয়সে কতজন বাঙালি এরকম স্ব-উদ্যোগী কর্মকা- মাথায় তুলে নিতে পারে। ব্যক্তি মুজিবের এ রকম উদ্যোগগুলো নিয়ে আমাদের অনেক কথাই বলার আছে। আমরা কি বলব? বলবেন কি আগামী দিনের মুজিব গবেষকরা?

পিতা শেখ লুৎফর রহমান আর শেখ মুজিবের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল? ওই যে আমরা বলি বন্ধু, দার্শনিক, পথ প্রদর্শকের মতো। বাপ ছেলের রাজনীতির আলোচনা চলতো মধ্য রাত পর্যন্ত। ছেলের রাজনৈতিক চিন্তার প্রতি বাবার সমীহ ছিল অনেক। বাবা ছেলে আসলে বন্ধুই ছিলেন। বাবা বটবৃক্ষের মতো মমতার ছায়া দিয়ে ছেলেকে আগলে রাখতেন। নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল অনেকের প্রতিই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তিনি মান্য করতেন গুরুর মতো। আর একজনের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল প্রগাঢ়, তিনি হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। বাংলাদেশের মাটি থেকে উঠে আসা নেতা, কৃষক শ্রমিকদের প্রাণের নেতা ছিলেন শেরেবাংলা। আর এ কারণেই শেখ লুৎফর রহমানের পরামর্শ ছিল পুত্র শেখ মুজিবের প্রতি ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।’ শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা হন নাই’। বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা এ নেতাকে কখনো ত্যাগ করেননি শেখ মুজিব। পথ, মত ভিন্ন হলেও শ্রদ্ধা কিন্তু ছিল অবিচল। এই হলেন শেখ মুজিব। এই হলো ভিন্নমতের প্রতি তার আস্থা, ভালোবাসার উদাহরণ।

বঙ্গবন্ধু কারা অন্তরীণ অবস্থায়ও অনেক মানবিক কাজ করেছেন। সেকালে গরুর বদলে কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল সংগ্রহ করা হতো কারাগারে। সরাকারের একটি আদেশ ছিল, কয়েদিদের দিয়ে এ রকম কাজ না করানোর জন্য। কিন্তু জেলার সাহেবরা এ রকম কাজ সরকারি সমর্থনেই করে যেতেন। বঙ্গবন্ধু যখন ফরিদপুর জেলে তখন এই অমানবিক কাজ চলতো ফরিদপুরের কারা অন্তরালে। বঙ্গবন্ধুর নজর এড়ায়নি এই অমানবিক কাজের ওপর। বঙ্গবন্ধু জেলার সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মানুষকে দিয়ে এরকম অমানবিক কাজ বন্ধ করতে বলেন। শেষ পর্যন্ত জেলার সৈয়দ আহমেদ মানুষ দিয়ে ঘানি টানার কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন। ব্যক্তি শেখ মুজিব আজীবনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন। জেলের ভেতরে হোক, দেশের শীর্ষ ক্ষমতাশালী ব্যক্তির সামনে হোক, অন্যায় কখনো প্রশ্রয় পায়নি মুজিবের সামনে।

রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তি মুজিব ও বাঙালি চরিত্রের কিছু দুর্বল দিকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন। বাঙালির পরশ্রীকাতরতা তাকে দুঃখ দিত। ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, “পরশ্রীকাতরতা”। রবীন্দ্রনাথ যেমন বাঙালি চরিত্রের এরকম ধুসর দিক দেখে, আক্ষেপ করে বলেছেন, “সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি”। এ রকম ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর একই সমতলে অবস্থান।

বঙ্গবন্ধুকে আসলে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন তার সমবয়সী কিংবা কনিষ্ঠ মানুষেরা। তারা অবাক হয়ে তাদের “মুজিব ভাইকে” দেখেছেন জাতির পিতা হিসেবে জাতির মধ্যমনিতে রূপান্তরিত হতে। সমকালে নির্মোহ মূল্যায়ন কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। একজন মানুষকে বিচার করতে হয় সামগ্রিকভাবে। সমসাময়িক, পরশ্রীকাতর মূল্যায়নকারীরা তাকে নেতা, প্রশাসক নানাভাবে মূল্যায়ন করে খ-বিখ- করেছেন। তারা ভাবেননি, প্রখর সূর্যকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারে যে মানুষ তার জীবনের মূল্যায়ন করতে হয় বঙ্গোপসাগরের মতো হৃদয় ধারণ করে। তার মতো করে আর কেউ বাঙালিকে এত ভালোবসেছে, সীমাহীন বিশ্বাস করেছে এমন মানুষের কথা আমাদের জানা নেই। তিনি তার ভালোবাসা বিশ্বাসে আমৃত্যু অটল ছিলেন। আমাদের বিশ্বাস ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু, আর নেতা বঙ্গবন্ধুর সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন আধুনিক মনের, নির্মোহ গবেষকরা, কারন বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম এখন তাদের কাছে আরও স্বচ্ছ আরও স্থির আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে। আমরা অপেক্ষায় আছি, ব্যক্তি ও নেতা মুজিবের অনিন্দ্য সুন্দর সত্ত্বাকে অখ-ভাবে তুলে ধরবেন এ প্রজন্ম কিংবা আগামী প্রজন্মের নির্মোহ, আধুনিক গবেষকেরা। এ দায় কিন্তু এখন মূলত তাদের কাঁধেই বর্তায়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২ , ১৭ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর অনিন্দ্য সুন্দর জীবনের খোঁজে

শেখর ভট্টাচার্য

image

রবীন্দ্র সমালোচনার একটি অতি পুরাতন ধারা হলো আলোচক, সমালোচকরা রবীন্দ্রনাথকে অতিন্দ্রীয় পুরুষ, ঋষি কিংবা দেবতা স্থির করেই আলোচনা, সমালোচনা শুরু করেন। নির্মোহ রবীন্দ্র গবেষকরা অতি আবেগী রবীন্দ্র মূল্যায়ন নিয়ে রবীন্দ্রপ্রেমীদের সতর্ক থাকতে উপদেশ দেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কবিগুরু, বিশ্ব পরিম-লে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সম্মানের স্থানে পৌঁছে দিতে তার অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্র সাহিত্যের ব্যপকতা, বিশালত্ব, দার্শনিক মূল্যকে অতিক্রম করা এখন পর্যন্ত দুরূহ কাজ বলে অধিকাংশ প-িতেরা অভিমত প্রকাশ করেন; তাই বলে তার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ভুলে গেলে চলবে না, তিনি আমাদের মতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ ছিলেন। মানুষ রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথকে বোঝা খুব কষ্টকর এমন কি অসম্ভব। আমরা নিশ্চয় চাই না খ-িত কিংবা বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে উপস্থিত হন। আমরা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও মহৎ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের এক ও অভীন্ন সত্ত্বাকে একসঙ্গে দেখতে চাই এবং এটাই শুদ্ধ রবীন্দ্র চর্চাকারীদের আন্তরিক চাওয়া।

আমাদের আর একটি সংবেদনশীল অনুভূতির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গন্ধুকে নিয়ে আলোচনার সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা আবেগে এতোই বিহব্বল হয়ে পড়ি যে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু চাপা পড়ে যান নেতা বঙ্গবন্ধুর ছায়ার নিচে। অথচ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবন কতো বৈচিত্র্যময়, মানবিকতায় পরিপূর্ণ, রসবোধে টুইটুম্বুর। তার অনুভূতিতে সাধারণ মানুষের মতো কতো উপাদান বহমান। ব্যক্তি মুজিবকে যথাযথ অধ্যয়ন না করলে তার চরিত্রের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য অনুধাবন করা সাধারন মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন।

বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলেই আমাদের মনে আসে ইতিহাসের বাঁক ঘুরানো বড় বড় মাইল স্টোনের কথা। যেহেতু তিনি রাজনীতিবিদ তাকে হয়তো, বাঁক ঘুরানো সময়ের সিঁড়িতেই খোঁজা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এ কথা ও তো সত্য মানুষের জীবন ও কর্মের সম্মিলিত রূপই হলো একজন সামগ্রিক মানুষ। শাশ্বত বাঙালির আবেগ, সেচ্ছাসেবা, সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, রবীন্দ্রনাথের মতো জাতি চরিত্রের সবলতা, দুর্বলতার অনুসন্ধান, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, নেতার প্রতি ভক্তিতে অবিচল থাকা, এগুলো হলো ব্যক্তি মুজিব চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ব্যক্তি মুজিব প্রায় অনুপস্থিত অথবা তার অস্পষ্ট রূপ আমরা দেখতে পাই মুজিব গবেষকদের গবেষণায়।

মুজিবের জীবন কত বৈচিত্র্যময়, যুগপৎভাবে কত সাধারণ এবং অসাধারন, তা তার রচিত বইয়ের পৃষ্ঠায়, পৃষ্ঠায় ঘুরে বেড়ালে অনুধাবন করা যায়। বাবা শেখ লুৎফর রহমানের দলের সঙ্গে ২০ বছর বয়সে কোমর বেধে আনুষ্ঠানিক ফুটবল ম্যাচে লড়ে যেতে দেখি আমরা তাকে। তা ও এক দিন নয়, বাবার দলের সঙ্গে পর পর পাঁচ দিন হাড্ডা হাড্ডি লড়াই। একদিকের গোল রক্ষক পিতা অন্য দিকের গোলরক্ষক পুত্র, যে পুত্র আমৃত্যু বাঙালি জাতির গোলবারের সামনে বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই পুত্র শেখ মুজিব। বাবা ছেলের সম্পর্ক কি মধুর, কিন্তু খেলার ক্ষেত্রে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সুচাগ্র মেদিনী’। বাবার দল হল, গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব। অফিসার্স ক্লাব গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলকে হারানোর জন্য বাইরে থেকে খেলোয়াড় ভাড়া করে নিয়ে আসে। পর, পর পাঁচ দিন যখন খেলা ড্র, ষষ্ঠ দিনে শেখ মুজিবের স্কুল দলের ১১ জন খেলোয়াড় ক্লান্ত। এ দিকে ভাড়া করা খেলোয়াড়দের ভাড়ার টাকা গুনতে গিয়ে প্রায় ফতুর অফিসার্স ক্লাব। ষষ্ঠ দিনে স্কুল দল খেলবে না আর অফিসার্স ক্লাবের খেলতেই হবে। এ নিয়ে বাগ্বিত-া। শেষ পর্যন্ত হাল ধরলেন হেডমাস্টার রসময় বাবু। শেখ মুজিব তো এবার কাবু, হেড স্যারের অনুরোধে খেলতে হলো ষষ্ঠ দিন সকালে। ছেলের দল এক-শূন্য গোলে পরাজিত হলো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার এসব কাহিনী আমরা জানতেই পারতাম না, বঙ্গবন্ধু যদি তার আত্মজীবনী লিখে না যেতেন। গবেষকরা নেতা বঙ্গবন্ধুর কর্মের দিকে শতভাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবনের এসব আটপৌরে, মানবিক গল্প থেকে আমাদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত দায় মেটাতে হলো বঙ্গবন্ধুকেই, তার লেখা আত্মজীবনী থেকেই আমরা জানতে পারি ব্যক্তি মুজিবের জীবনের এসব মনকাড়া, আটপৌরে গল্পগুলো।

মানুষ মুজিবের মনুষ্যত্ত্ববোধের প্রথম ঝলক আমরা কোথায় দেখি? তার বাড়ির লজিং মাস্টার আবদুল হামিদ এমএসসি, মুসলিম সেবা সমতি গঠন করলেন, দরিদ্র মুসলিম ছাত্রদের বই, পরীক্ষা ও অন্যান্য শিক্ষার খরচ বহন করার জন্য। শেখ মুজিব তার দল বল নিয়ে বাড়ি বাড়ি মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠানোর দায়িত্ব নেন। সেই চাল বিক্রির টাকায় কিছু দরিদ্র মুসলিম শিক্ষার্থীদের লেখা পড়ার খরচ চলতে লাগল। যক্ষ্মা তখন ভয়াবহ রোগ। ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’, এ রকম কথা তখন মানুষের মুখে মুখে। হঠাৎ করে মুজিবের সেই সমাজসেবী শিক্ষক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শিক্ষক মারা গেলেও তার এই মহৎ উদ্যোগ কিন্তু থেমে যেতে দেননি শেখ মুজিব, সেচ্ছায় মাথায় তুলে নেন মুসলিম সেবা সমিতির ভার। তিনি হলেন সম্পাদক আর তার মাথার ওপর রাখলেন আর একজন শিক্ষককে সভাপতি হিসেবে। মুষ্টি ভিক্ষা ও দরিদ্র ছাত্রদের সহায়তা কিন্তু বন্ধ হলো না। শেখ মুজিবের বয়স তখন কত? মাত্র ১৭ বছর। এই বয়সে কতজন বাঙালি এরকম স্ব-উদ্যোগী কর্মকা- মাথায় তুলে নিতে পারে। ব্যক্তি মুজিবের এ রকম উদ্যোগগুলো নিয়ে আমাদের অনেক কথাই বলার আছে। আমরা কি বলব? বলবেন কি আগামী দিনের মুজিব গবেষকরা?

পিতা শেখ লুৎফর রহমান আর শেখ মুজিবের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল? ওই যে আমরা বলি বন্ধু, দার্শনিক, পথ প্রদর্শকের মতো। বাপ ছেলের রাজনীতির আলোচনা চলতো মধ্য রাত পর্যন্ত। ছেলের রাজনৈতিক চিন্তার প্রতি বাবার সমীহ ছিল অনেক। বাবা ছেলে আসলে বন্ধুই ছিলেন। বাবা বটবৃক্ষের মতো মমতার ছায়া দিয়ে ছেলেকে আগলে রাখতেন। নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল অনেকের প্রতিই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তিনি মান্য করতেন গুরুর মতো। আর একজনের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল প্রগাঢ়, তিনি হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। বাংলাদেশের মাটি থেকে উঠে আসা নেতা, কৃষক শ্রমিকদের প্রাণের নেতা ছিলেন শেরেবাংলা। আর এ কারণেই শেখ লুৎফর রহমানের পরামর্শ ছিল পুত্র শেখ মুজিবের প্রতি ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।’ শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা হন নাই’। বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা এ নেতাকে কখনো ত্যাগ করেননি শেখ মুজিব। পথ, মত ভিন্ন হলেও শ্রদ্ধা কিন্তু ছিল অবিচল। এই হলেন শেখ মুজিব। এই হলো ভিন্নমতের প্রতি তার আস্থা, ভালোবাসার উদাহরণ।

বঙ্গবন্ধু কারা অন্তরীণ অবস্থায়ও অনেক মানবিক কাজ করেছেন। সেকালে গরুর বদলে কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল সংগ্রহ করা হতো কারাগারে। সরাকারের একটি আদেশ ছিল, কয়েদিদের দিয়ে এ রকম কাজ না করানোর জন্য। কিন্তু জেলার সাহেবরা এ রকম কাজ সরকারি সমর্থনেই করে যেতেন। বঙ্গবন্ধু যখন ফরিদপুর জেলে তখন এই অমানবিক কাজ চলতো ফরিদপুরের কারা অন্তরালে। বঙ্গবন্ধুর নজর এড়ায়নি এই অমানবিক কাজের ওপর। বঙ্গবন্ধু জেলার সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মানুষকে দিয়ে এরকম অমানবিক কাজ বন্ধ করতে বলেন। শেষ পর্যন্ত জেলার সৈয়দ আহমেদ মানুষ দিয়ে ঘানি টানার কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন। ব্যক্তি শেখ মুজিব আজীবনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন। জেলের ভেতরে হোক, দেশের শীর্ষ ক্ষমতাশালী ব্যক্তির সামনে হোক, অন্যায় কখনো প্রশ্রয় পায়নি মুজিবের সামনে।

রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তি মুজিব ও বাঙালি চরিত্রের কিছু দুর্বল দিকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন। বাঙালির পরশ্রীকাতরতা তাকে দুঃখ দিত। ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, “পরশ্রীকাতরতা”। রবীন্দ্রনাথ যেমন বাঙালি চরিত্রের এরকম ধুসর দিক দেখে, আক্ষেপ করে বলেছেন, “সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি”। এ রকম ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর একই সমতলে অবস্থান।

বঙ্গবন্ধুকে আসলে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন তার সমবয়সী কিংবা কনিষ্ঠ মানুষেরা। তারা অবাক হয়ে তাদের “মুজিব ভাইকে” দেখেছেন জাতির পিতা হিসেবে জাতির মধ্যমনিতে রূপান্তরিত হতে। সমকালে নির্মোহ মূল্যায়ন কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। একজন মানুষকে বিচার করতে হয় সামগ্রিকভাবে। সমসাময়িক, পরশ্রীকাতর মূল্যায়নকারীরা তাকে নেতা, প্রশাসক নানাভাবে মূল্যায়ন করে খ-বিখ- করেছেন। তারা ভাবেননি, প্রখর সূর্যকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারে যে মানুষ তার জীবনের মূল্যায়ন করতে হয় বঙ্গোপসাগরের মতো হৃদয় ধারণ করে। তার মতো করে আর কেউ বাঙালিকে এত ভালোবসেছে, সীমাহীন বিশ্বাস করেছে এমন মানুষের কথা আমাদের জানা নেই। তিনি তার ভালোবাসা বিশ্বাসে আমৃত্যু অটল ছিলেন। আমাদের বিশ্বাস ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু, আর নেতা বঙ্গবন্ধুর সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন আধুনিক মনের, নির্মোহ গবেষকরা, কারন বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম এখন তাদের কাছে আরও স্বচ্ছ আরও স্থির আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে। আমরা অপেক্ষায় আছি, ব্যক্তি ও নেতা মুজিবের অনিন্দ্য সুন্দর সত্ত্বাকে অখ-ভাবে তুলে ধরবেন এ প্রজন্ম কিংবা আগামী প্রজন্মের নির্মোহ, আধুনিক গবেষকেরা। এ দায় কিন্তু এখন মূলত তাদের কাঁধেই বর্তায়।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]