দিল্লিতে বাংলাভাষীদের উচ্ছেদের নেপথ্যে

গৌতম রায়

আগামী লোকসভা ভোটকে (২০২৪) পাখির চোখ করে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের কার্যক্রম জোরদার ভাবে গোটা ভারত জুড়ে শুরু হয়ে গেছে। সেই কার্যক্রমে এখন হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের বিশেষ লক্ষ্যস্থল হলেন বাঙালিরা। বাংলাভাষী মাত্রেই বাংলাদেশের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী- এই তত্ত্ব গত শতকের নয়ের দশকের শেষ সময় থেকেই বাজারে হাজির করেছিল আরএসএস। বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আবেগপ্রবণ হওয়ার জন্যে প্রায় শতবর্ষের মুখে দাঁড়ানো, বঙ্গীয় নবজাগরণের শেষ প্রতিনিধি অন্নদাশঙ্কর রায়কে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী শিবির তখন করেছিল। বিষয়টি জানতে পেরে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অন্নদাশঙ্করের আপত্তি সত্ত্বেও তার পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন।

গুজরাট গণহত্যার কালে গোটে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির যেভাবে তাদের আক্রমণের ছক সাজিয়েছিল, সেই পর্যায়ক্রমের বিকাশ সাম্প্রতিক অতীতে আমরা একমাত্র দেখতে পেয়েছি দিল্লি গণহত্যার কালে। তার বাইরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মুসলমান সম্প্রদায়কে টার্গেট করবার তাগিদে সব সময়েই ব্যস্ত থেকেছে ভাষা, কথ্যভঙ্গি, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যভ্যাস ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। তাদের সাম্প্রদায়িক অভিষ্পা যাতে সরাসরি মানুষের ধরা পড়ে না যায়, সেইজন্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।

অতি সম্প্রতি দিল্লি এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লাগোয়া জাহাঙ্গীরপুরীতে যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে গেল, হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা সংগঠিত সেই নারকীয়তার প্রতিটি পর্বে আর এস এসের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে প্রচেষ্টা ছিল প্রচ- ভাবে তীব্র। স্থানীয় পৌরনিগমের পক্ষ থেকে যে বেআইনি বস্তি তৈরির আভিযোগ উঠেছে, তেমন বেআইনি বস্তির অভিযোগ তো গোটা দিল্লি জুড়ে কম নেই। তাহলে কেন উচ্ছেদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নেয়া হলো জাহাঙ্গীরপুরীর বস্তিটিকেই?

উত্তর খুব সোজা। জাহাঙ্গীরপুরীর বস্তিবাসীদের সিংহভাগই হলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেটের টানে জড়ো হওয়া মানুষ। সেই মানুষদের একটা বড় অংশ ধর্মবিশ্বাসে পবিত্র ইসলামের অনুসারী। তাই বেছে বেছে মুসলমান উচ্ছেদের যে ঘোষিত- অঘোষিত কর্মসূচি রয়েছে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির, সেই কর্মসূচির রূপায়নের উদ্দেশেই দিল্লি পুলিশ বেছে নিয়েছিল এই জাহাঙ্গীরপুরীর বস্তিটিকে। রমজান মাসে রোজারত মানুষদের ওপর সম্পূর্ণ বিনা নোটিসে আক্রমণ নামিয়ে আনে দিল্লি পুলিশ। সিপিআই (এম) নেত্রী বৃন্দা করাত এই অন্যায় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যান এবং স্থগিতাদেশ ও পান উচ্ছেদ ঘিরে। তা সত্ত্বেও উচ্ছেদে অনড় থাকে দিল্লি পুলিশ, যেটি নিয়ন্ত্রণ করেন সরাসরি অমিত শাহ।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে দিল্লি পুলিশ জাহাঙ্গীরপুরীতে উচ্ছেদ চালাচ্ছে শুনে সতীর্থদের নিয়ে বৃন্দা করাত অকুস্থলে ছুটে যান। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ হাতে নিয়ে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়ান চলন্ত বুলডোজারের সামনে। দিল্লি পুলিশ বাধ্য হয় বুলডোজার থামাতে। বৃন্দা পরের দিন আবার ও সুপ্রিম কোর্টে যান। মহামান্য আদালত উচ্ছেদের কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন। ভারতের শীর্ষ আদালতের নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে ‘বীরবিক্রমে’ দিনের আলো ফোটার আগে দিল্লি পুলিশ জাহাঙ্গীরপুরীতে উচ্ছেদ অভিযান চালাতেই থাকে।

আদালতকে উপেক্ষা করবার এ সাহস ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ ‘অর্জন’ করে এই কারণে যে, তারা খুব ভালো করে ওয়াকিবহাল ছিল, মূলত, বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত জাহাঙ্গীরনগর বস্তি উচ্ছেদের কাজটি যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালক বিজেপির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেটা খুব ভালোভাবেই জানতো দিল্লি পুলিশের হত্তাকত্তারা। তাই দিল্লি পুলিশের শীর্ষকর্তাদের এই আত্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই ছিল যে, আদালতের নির্দেশ তারা অমান্য করবার মতো অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে স্বয়ং কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাত তাদের মাথার ওপর আছে বলে।

গোটা ভারতজুড়েই দীর্ঘদিন ধরে বাংলাভাষী মানুষ মানেই তারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভেবে অনুপ্রবেশ করেছেÑ এই ধারণাটার সামাজিক প্রযুক্তি চালাচ্ছে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। সেই কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে নেহরু জামানার ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনে বিজেপি। সেই সংশোধনীটি ছিল এন আরসির প্রথম পদক্ষেপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করবার তাগিদে এই বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা ভোটার তালিকা ভর্তি করা হয়েছে, আরএসএসের তত্ত্বের শুধু উগ্র সমর্থকই ছিলেন না, সঙ্ঘের এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি নিজের সমস্তটুকু রাজনৈতিক অস্তিত্বকে নিয়োগ করেছিলেন।

দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতে উচ্ছেদের নামে দিল্লি পুলিশ যে কার্যক্রম দেখালো, সেটি কিন্তু আরএসএসের সেই কর্মকা-কেই একটা আইনি স্বীকৃতি দেয়ার নামান্তর দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে একদম আরএসএসের সুরে সুর মিলিয়ে প্রকাশ্যে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা নাকি জাহাঙ্গীরপুরী অবৈধ নির্মাণকার্য চলেছে। অবৈধ বস্তি তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই তারা সেখানে এই উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে।

দিল্লি পুলিশ প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, তারা নাকি জাহাঙ্গীরপুরীতে অবস্থানরত বাঙালিদের মুখের ভাষা শুনেই বুঝতে পেরে গেছে তারা বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের এটা বোধহয় সবথেকে বড় কৃতিত্ব যে, তার নেতৃত্বাধীন পুলিশ, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে কোন রকম কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে না পারলেও, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি তারা নিজেদের ‘ভাষাতাত্ত্বিক’ হিসেবে পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

আজ পর্যন্ত কোন দেশের পুলিশ অপরাধী সাব্যস্ত করা কোন মানুষের ভাষা, শুধু শুনে, কোনরকম বিচার-বিশ্লেষণ না করেই, অভিযুক্ত অপরাধীকে ‘বিদেশি নাগরিক’ বলে শনাক্ত করতে পেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে নেই। সে দিক থেকে অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন পুলিশ এক অভিনব নজীর সৃষ্টি করল সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ।

লোকসভার নির্বাচন ভারতে প্রায় দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফার কর্মকা-ে যে ভয়াবহ আর্থিক সংকট গোটা ভারতজুড়ে চেপে বসেছে, সেখানে থেকে মানুষের দৃষ্টিতে অন্য খাতে সরিয়ে, আর্থসামাজিক সব ধরনের সমস্যা, বেকার সমস্যা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নারীদের নিরাপত্তা , স্বাস্থ্য-সব কিছু থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আবার এই বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী বিষয়টিকে আরএসএস সামনে তুলে আনছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২২ , ১৭ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমাদ্বান ১৪৪৩

দিল্লিতে বাংলাভাষীদের উচ্ছেদের নেপথ্যে

গৌতম রায়

আগামী লোকসভা ভোটকে (২০২৪) পাখির চোখ করে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের কার্যক্রম জোরদার ভাবে গোটা ভারত জুড়ে শুরু হয়ে গেছে। সেই কার্যক্রমে এখন হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের বিশেষ লক্ষ্যস্থল হলেন বাঙালিরা। বাংলাভাষী মাত্রেই বাংলাদেশের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী- এই তত্ত্ব গত শতকের নয়ের দশকের শেষ সময় থেকেই বাজারে হাজির করেছিল আরএসএস। বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আবেগপ্রবণ হওয়ার জন্যে প্রায় শতবর্ষের মুখে দাঁড়ানো, বঙ্গীয় নবজাগরণের শেষ প্রতিনিধি অন্নদাশঙ্কর রায়কে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী শিবির তখন করেছিল। বিষয়টি জানতে পেরে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অন্নদাশঙ্করের আপত্তি সত্ত্বেও তার পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন।

গুজরাট গণহত্যার কালে গোটে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির যেভাবে তাদের আক্রমণের ছক সাজিয়েছিল, সেই পর্যায়ক্রমের বিকাশ সাম্প্রতিক অতীতে আমরা একমাত্র দেখতে পেয়েছি দিল্লি গণহত্যার কালে। তার বাইরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মুসলমান সম্প্রদায়কে টার্গেট করবার তাগিদে সব সময়েই ব্যস্ত থেকেছে ভাষা, কথ্যভঙ্গি, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যভ্যাস ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। তাদের সাম্প্রদায়িক অভিষ্পা যাতে সরাসরি মানুষের ধরা পড়ে না যায়, সেইজন্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।

অতি সম্প্রতি দিল্লি এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লাগোয়া জাহাঙ্গীরপুরীতে যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে গেল, হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা সংগঠিত সেই নারকীয়তার প্রতিটি পর্বে আর এস এসের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে প্রচেষ্টা ছিল প্রচ- ভাবে তীব্র। স্থানীয় পৌরনিগমের পক্ষ থেকে যে বেআইনি বস্তি তৈরির আভিযোগ উঠেছে, তেমন বেআইনি বস্তির অভিযোগ তো গোটা দিল্লি জুড়ে কম নেই। তাহলে কেন উচ্ছেদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নেয়া হলো জাহাঙ্গীরপুরীর বস্তিটিকেই?

উত্তর খুব সোজা। জাহাঙ্গীরপুরীর বস্তিবাসীদের সিংহভাগই হলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেটের টানে জড়ো হওয়া মানুষ। সেই মানুষদের একটা বড় অংশ ধর্মবিশ্বাসে পবিত্র ইসলামের অনুসারী। তাই বেছে বেছে মুসলমান উচ্ছেদের যে ঘোষিত- অঘোষিত কর্মসূচি রয়েছে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির, সেই কর্মসূচির রূপায়নের উদ্দেশেই দিল্লি পুলিশ বেছে নিয়েছিল এই জাহাঙ্গীরপুরীর বস্তিটিকে। রমজান মাসে রোজারত মানুষদের ওপর সম্পূর্ণ বিনা নোটিসে আক্রমণ নামিয়ে আনে দিল্লি পুলিশ। সিপিআই (এম) নেত্রী বৃন্দা করাত এই অন্যায় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যান এবং স্থগিতাদেশ ও পান উচ্ছেদ ঘিরে। তা সত্ত্বেও উচ্ছেদে অনড় থাকে দিল্লি পুলিশ, যেটি নিয়ন্ত্রণ করেন সরাসরি অমিত শাহ।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে দিল্লি পুলিশ জাহাঙ্গীরপুরীতে উচ্ছেদ চালাচ্ছে শুনে সতীর্থদের নিয়ে বৃন্দা করাত অকুস্থলে ছুটে যান। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ হাতে নিয়ে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়ান চলন্ত বুলডোজারের সামনে। দিল্লি পুলিশ বাধ্য হয় বুলডোজার থামাতে। বৃন্দা পরের দিন আবার ও সুপ্রিম কোর্টে যান। মহামান্য আদালত উচ্ছেদের কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন। ভারতের শীর্ষ আদালতের নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে ‘বীরবিক্রমে’ দিনের আলো ফোটার আগে দিল্লি পুলিশ জাহাঙ্গীরপুরীতে উচ্ছেদ অভিযান চালাতেই থাকে।

আদালতকে উপেক্ষা করবার এ সাহস ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ ‘অর্জন’ করে এই কারণে যে, তারা খুব ভালো করে ওয়াকিবহাল ছিল, মূলত, বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত জাহাঙ্গীরনগর বস্তি উচ্ছেদের কাজটি যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালক বিজেপির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেটা খুব ভালোভাবেই জানতো দিল্লি পুলিশের হত্তাকত্তারা। তাই দিল্লি পুলিশের শীর্ষকর্তাদের এই আত্মবিশ্বাস নিশ্চয়ই ছিল যে, আদালতের নির্দেশ তারা অমান্য করবার মতো অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে স্বয়ং কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাত তাদের মাথার ওপর আছে বলে।

গোটা ভারতজুড়েই দীর্ঘদিন ধরে বাংলাভাষী মানুষ মানেই তারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভেবে অনুপ্রবেশ করেছেÑ এই ধারণাটার সামাজিক প্রযুক্তি চালাচ্ছে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। সেই কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে নেহরু জামানার ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনে বিজেপি। সেই সংশোধনীটি ছিল এন আরসির প্রথম পদক্ষেপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করবার তাগিদে এই বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা ভোটার তালিকা ভর্তি করা হয়েছে, আরএসএসের তত্ত্বের শুধু উগ্র সমর্থকই ছিলেন না, সঙ্ঘের এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি নিজের সমস্তটুকু রাজনৈতিক অস্তিত্বকে নিয়োগ করেছিলেন।

দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতে উচ্ছেদের নামে দিল্লি পুলিশ যে কার্যক্রম দেখালো, সেটি কিন্তু আরএসএসের সেই কর্মকা-কেই একটা আইনি স্বীকৃতি দেয়ার নামান্তর দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে একদম আরএসএসের সুরে সুর মিলিয়ে প্রকাশ্যে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা নাকি জাহাঙ্গীরপুরী অবৈধ নির্মাণকার্য চলেছে। অবৈধ বস্তি তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই তারা সেখানে এই উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে।

দিল্লি পুলিশ প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, তারা নাকি জাহাঙ্গীরপুরীতে অবস্থানরত বাঙালিদের মুখের ভাষা শুনেই বুঝতে পেরে গেছে তারা বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের এটা বোধহয় সবথেকে বড় কৃতিত্ব যে, তার নেতৃত্বাধীন পুলিশ, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে কোন রকম কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে না পারলেও, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি তারা নিজেদের ‘ভাষাতাত্ত্বিক’ হিসেবে পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

আজ পর্যন্ত কোন দেশের পুলিশ অপরাধী সাব্যস্ত করা কোন মানুষের ভাষা, শুধু শুনে, কোনরকম বিচার-বিশ্লেষণ না করেই, অভিযুক্ত অপরাধীকে ‘বিদেশি নাগরিক’ বলে শনাক্ত করতে পেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে নেই। সে দিক থেকে অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন পুলিশ এক অভিনব নজীর সৃষ্টি করল সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ।

লোকসভার নির্বাচন ভারতে প্রায় দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফার কর্মকা-ে যে ভয়াবহ আর্থিক সংকট গোটা ভারতজুড়ে চেপে বসেছে, সেখানে থেকে মানুষের দৃষ্টিতে অন্য খাতে সরিয়ে, আর্থসামাজিক সব ধরনের সমস্যা, বেকার সমস্যা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নারীদের নিরাপত্তা , স্বাস্থ্য-সব কিছু থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আবার এই বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী বিষয়টিকে আরএসএস সামনে তুলে আনছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]