বৃষ্টির দেখা নেই, পুকুর-জলাশয় ভরাট হয়ে বাড়ছে কংক্রিটের শহর

বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সেচকাজে ও ভূ-গর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে নগরীর সিংহভাগ পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেই স্থানে হচ্ছে কংক্রিটের বহুতল ভবন। পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনে রাজশাহীর সর্বত্র বিরাজ করছে রুক্ষ আবহাওয়া। একই সঙ্গে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশক্ষাজনক হারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমনটা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে রাজশাহীতে তিব্র পানির সংকট দেখা দেবে।

গত ৪ এপ্রিল রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তার পরিমাণ ছিল মাত্র ০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। এরপর টানা তাপপ্রবাহের পর গত ২০ এপ্রিল ১৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম বলেন, গত ৪ এপ্রিল রাজশাহীতে বৃষ্টি হয়েছিল। তবে তার পরিমাণ ছিল মাত্র ০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। আর গত ২০ এপ্রিল রাজশাহীতে ১৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এরপর আর বৃষ্টির দেখা নেই।

মূলত ৪ এপ্রিলের পর থেকে শুরু হয় তাপপ্রবাহ। বৃষ্টি না হওয়ায় সেই তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হয়। এর মধ্যে আট বছর পর গত ১৫ এপ্রিল রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ সব রেকর্ড ভাঙে। ওইদিন রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই দেশের সর্বোচ্চ এ তাপমাত্রায় পদ্মাপাড়ের রাজশাহীর জনজীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে।

এদিকে গত দুই দিনে দেশের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, আজও একই পরিস্থিতি বিরাজ করবে। গত সোমবার চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী ও ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। একই সঙ্গে রাজশাহী অঞ্চলেও পড়েছে এর প্রভাব। আর এ কারণে আবহাওয়াতে ঘটছে পরিবর্তন। এরই অংশ হিসেবে রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাতাসে মেঘ ঘনিভূত কম হচ্ছে। বনায়ন কার্যক্রমও সন্তোষজনক নয়। এসব কারণেই রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমছে বলে পানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

গত চার দশকের বৃষ্টিপাত পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮১ সালে যেখানে বৃষ্টি হয়েছে ২২৪১ মিলিমিটার সেখানে ১৯৯২ সালে বৃষ্টিপাত হয় ৮৪৩ মিলিমিটার। গবেষক ড. ইশরাত আরা কেকার এ গবেষণায় আরও বলা হচ্ছে, বরেন্দ্র এলাকার জীবন এবং জীবিকার ওপর এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় আমন মৌসুমে আবাদ কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। গবেষণায় ১৯৭১ সাল থেকে বৃষ্টিপাতের যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে ৭৩, ৭৮, ৭৯, ৮১, ৮২, ৮৯, ৯২, ৯৪ এবং ৯৫ সালে খরা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে এতে জানানো হয়। এতে লক্ষনীয় বিষয় ছিল পর পর দুই বছর খরা। যেমন ৭৮-৮৯ সালে, ৮১-৮২ সালে এবং ৯৪-৯৫ সালে কম বৃষ্টিপাতের জন্য খরা দেখা দেয়। গত বছর ১১১৩.৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। গত বছর তুলনামূলক ভালো বৃষ্টিপাত হয়। খরা প্রবণতায় এর তেমন কোন প্রভাব পড়েনি।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের একটি সূত্র জানায়, খরা মওসুমে এই অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪/৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৭ সালের ৩১ মে রাজশাহীতে ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল ৪২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০০৫ সালের ২ জুন ৪২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস। আর স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই এ যাবতকালের অর্থাৎ ৪০ বছরের মধ্যে রাজশাহীর সর্বাধিক তাপমাত্রা।

দিনদিন বাড়ছে তপ্ত-উত্তপ্ত বরেন্দ্রভূমির রুক্ষতার মাত্রা। বিশেষ করে এই অঞ্চলে পানি সংকটের প্রভাবে জনজীবনে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত প্রতিকূলতা। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এই ধরনের আশঙ্কাজনক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধানেও মিলেছে অনুরূপ তথ্য।

রাজশাহী বিভাগীয় জনস্থাস্থ প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পানির স্তর দিনদিন নেমে যাওয়ায় তারা বিভিন্ন সময় প্রযুক্তি বদলেছেন। কিন্তু কোনটি বেশিদিন কার্যকর হয়নি। উক্ত দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ৩০ থেকে ৪০ ফুট নেমে যায় খরা মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি।

১৯৮৯ সালে জনস্বাস্থ্য দপ্তর কর্তৃক এক জরিপে দেখা গেছে, নগরীর হেতেখা এলাকায ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৩৪ ফুট গভীরে, ওই সময় রামচন্দপুর এলাকায় ৩৬ ফুট, বড়কুঠি এলাকায় ৩৬-৪০ ফুট এবং বোয়ালিয়াপাড়ায় ৩৫-৪২ ফুট গভীরে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর সাবেক প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের ছোট-বড় ৭৯টি নদনদী বছরে বেশির ভাগ সময় শুষ্ক থাকছে। শুষ্ক মৌসুমে নদনদীগুলো পানিবিহীন থাকায় এ এলাকার জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকা-ে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এছাড়া রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমির জনগোষ্ঠীর পানির আধার হিসেবে পরিচিত ৭৫ হাজার পুকুর জলাধারে বছরের ৬ মাস কোন পানি থাকছে না। এতে পশুপালন, সেচ, গৃহস্থালি ছাড়াও কৃষি কাজে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট মেটাতে এই অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। কিন্তু দিনদিন ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নতুন করে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী মহানগরীতে ৬০-এর দশকে পুকুরের সংখ্যা ছিল ৪ হাজারেরও অধিক। ২০০০ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৭০০। যেটি এখন দাঁড়িয়েছে ২০টির নিচে। পুকুর ভরাট প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও এর কোন তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে পানির চরম সংকট দেখা দিবে। এ ধরনের সমস্যার কথা অনেক আগে থেকেই পরিবেশবাদীরা বলে আসছিলেন। ভূ-গর্ভস্থ পানির লেয়ার বিগত এক যুগে দ্বিগুণের বেশি নিচে নেমে গেছে।

এর আগে ২০১৫ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচে নামায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩টি পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়নকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডাসকো ফাউন্ডেশন পরিচালিত সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডব্লিউআরএম) নামে একটি প্রকল্প জরিপ চালিয়ে এসব এলাকাকে অতিঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে।

ঝুঁকিপূর্ণ ওইসব এলাকায় জরুরিভাবে ভূ-গর্ভ থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ করে বিকল্প উপায়ে পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই ওইসব এলাকায় মিঠাপানির তিব্র সংকট দেখা দিবে বলে জানিয়েছেন তারা।

দীর্ঘ ১ বছর বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে জরিপ চালিয়ে সরকারেকে এমনই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আইডব্লিউআরএম। ২০১৪ সালে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠপর্যায়ে এই জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বরেন্দ্রে অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে গবেষণা করছেন। ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামায় চিন্তিত গবেষকরা। কারণ নিচে পানিশূন্য হলে বালি, পাথর ফাঁকা হয়ে পড়বে। তাতে সামান্য ভূমিকম্প হলেই দেবে যেতে পারে।

এ গবেষক আরও বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলকে বাঁচাতে পানির কোন বিকল্প নেয়। প্রথমেই ভূ-গর্ভস্থ থেকে সেচ কাজে পানি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর বেশি করে খনন করতে হবে। বাসা-বাড়ির ছাদের পানি ভূ-গর্ভস্থ ভেতরে রিফারিং করে ঢুকাতে হবে। এক কথায় বৃষ্টির পানি বেশি বেশি রির্চাজ করতে হবে।

এজন্য সরকারের পাশাপাশি এসব অঞ্চলের কৃষক, শিক্ষক, ও সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তার আগে সরকারকে এসব অঞ্চলের কৃষি জমিতে সেচ দিতে বিকল্প উপায়ে পানির ব্যবস্থা করতে পারলেই সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান হবে বলে মনে হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম জানান, ১৯৮০ সালে এ অঞ্চলে পানির স্তর মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। তবে ৩৬ বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটি পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এ এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার।

রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের এই বিরূপতা জনজীবনকে মারাত্মকভাবে বিঘিœত করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল। তিনি বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে পরিবেশগত প্রতিকূলতা এখন আশঙ্কার পর্যায়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ এখনই প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

রবিবার, ০১ মে ২০২২ , ১৮ বৈশাখ ১৪২৮ ২৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

বৃষ্টির দেখা নেই, পুকুর-জলাশয় ভরাট হয়ে বাড়ছে কংক্রিটের শহর

জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সেচকাজে ও ভূ-গর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে নগরীর সিংহভাগ পুকুর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেই স্থানে হচ্ছে কংক্রিটের বহুতল ভবন। পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনে রাজশাহীর সর্বত্র বিরাজ করছে রুক্ষ আবহাওয়া। একই সঙ্গে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশক্ষাজনক হারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমনটা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে রাজশাহীতে তিব্র পানির সংকট দেখা দেবে।

গত ৪ এপ্রিল রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছিল। তার পরিমাণ ছিল মাত্র ০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। এরপর টানা তাপপ্রবাহের পর গত ২০ এপ্রিল ১৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম বলেন, গত ৪ এপ্রিল রাজশাহীতে বৃষ্টি হয়েছিল। তবে তার পরিমাণ ছিল মাত্র ০ দশমিক ৬ মিলিমিটার। আর গত ২০ এপ্রিল রাজশাহীতে ১৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এরপর আর বৃষ্টির দেখা নেই।

মূলত ৪ এপ্রিলের পর থেকে শুরু হয় তাপপ্রবাহ। বৃষ্টি না হওয়ায় সেই তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হয়। এর মধ্যে আট বছর পর গত ১৫ এপ্রিল রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ সব রেকর্ড ভাঙে। ওইদিন রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই দেশের সর্বোচ্চ এ তাপমাত্রায় পদ্মাপাড়ের রাজশাহীর জনজীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে।

এদিকে গত দুই দিনে দেশের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, আজও একই পরিস্থিতি বিরাজ করবে। গত সোমবার চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী ও ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। একই সঙ্গে রাজশাহী অঞ্চলেও পড়েছে এর প্রভাব। আর এ কারণে আবহাওয়াতে ঘটছে পরিবর্তন। এরই অংশ হিসেবে রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাতাসে মেঘ ঘনিভূত কম হচ্ছে। বনায়ন কার্যক্রমও সন্তোষজনক নয়। এসব কারণেই রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমছে বলে পানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

গত চার দশকের বৃষ্টিপাত পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮১ সালে যেখানে বৃষ্টি হয়েছে ২২৪১ মিলিমিটার সেখানে ১৯৯২ সালে বৃষ্টিপাত হয় ৮৪৩ মিলিমিটার। গবেষক ড. ইশরাত আরা কেকার এ গবেষণায় আরও বলা হচ্ছে, বরেন্দ্র এলাকার জীবন এবং জীবিকার ওপর এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় আমন মৌসুমে আবাদ কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। গবেষণায় ১৯৭১ সাল থেকে বৃষ্টিপাতের যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে ৭৩, ৭৮, ৭৯, ৮১, ৮২, ৮৯, ৯২, ৯৪ এবং ৯৫ সালে খরা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে এতে জানানো হয়। এতে লক্ষনীয় বিষয় ছিল পর পর দুই বছর খরা। যেমন ৭৮-৮৯ সালে, ৮১-৮২ সালে এবং ৯৪-৯৫ সালে কম বৃষ্টিপাতের জন্য খরা দেখা দেয়। গত বছর ১১১৩.৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। গত বছর তুলনামূলক ভালো বৃষ্টিপাত হয়। খরা প্রবণতায় এর তেমন কোন প্রভাব পড়েনি।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের একটি সূত্র জানায়, খরা মওসুমে এই অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪/৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৭ সালের ৩১ মে রাজশাহীতে ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল ৪২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০০৫ সালের ২ জুন ৪২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস। আর স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই এ যাবতকালের অর্থাৎ ৪০ বছরের মধ্যে রাজশাহীর সর্বাধিক তাপমাত্রা।

দিনদিন বাড়ছে তপ্ত-উত্তপ্ত বরেন্দ্রভূমির রুক্ষতার মাত্রা। বিশেষ করে এই অঞ্চলে পানি সংকটের প্রভাবে জনজীবনে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত প্রতিকূলতা। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এই ধরনের আশঙ্কাজনক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধানেও মিলেছে অনুরূপ তথ্য।

রাজশাহী বিভাগীয় জনস্থাস্থ প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পানির স্তর দিনদিন নেমে যাওয়ায় তারা বিভিন্ন সময় প্রযুক্তি বদলেছেন। কিন্তু কোনটি বেশিদিন কার্যকর হয়নি। উক্ত দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ৩০ থেকে ৪০ ফুট নেমে যায় খরা মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি।

১৯৮৯ সালে জনস্বাস্থ্য দপ্তর কর্তৃক এক জরিপে দেখা গেছে, নগরীর হেতেখা এলাকায ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৩৪ ফুট গভীরে, ওই সময় রামচন্দপুর এলাকায় ৩৬ ফুট, বড়কুঠি এলাকায় ৩৬-৪০ ফুট এবং বোয়ালিয়াপাড়ায় ৩৫-৪২ ফুট গভীরে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর সাবেক প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের ছোট-বড় ৭৯টি নদনদী বছরে বেশির ভাগ সময় শুষ্ক থাকছে। শুষ্ক মৌসুমে নদনদীগুলো পানিবিহীন থাকায় এ এলাকার জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকা-ে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এছাড়া রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমির জনগোষ্ঠীর পানির আধার হিসেবে পরিচিত ৭৫ হাজার পুকুর জলাধারে বছরের ৬ মাস কোন পানি থাকছে না। এতে পশুপালন, সেচ, গৃহস্থালি ছাড়াও কৃষি কাজে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট মেটাতে এই অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। কিন্তু দিনদিন ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নতুন করে সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী মহানগরীতে ৬০-এর দশকে পুকুরের সংখ্যা ছিল ৪ হাজারেরও অধিক। ২০০০ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৭০০। যেটি এখন দাঁড়িয়েছে ২০টির নিচে। পুকুর ভরাট প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও এর কোন তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে পানির চরম সংকট দেখা দিবে। এ ধরনের সমস্যার কথা অনেক আগে থেকেই পরিবেশবাদীরা বলে আসছিলেন। ভূ-গর্ভস্থ পানির লেয়ার বিগত এক যুগে দ্বিগুণের বেশি নিচে নেমে গেছে।

এর আগে ২০১৫ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগতভাবে নিচে নামায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ৩টি পৌরসভা ও ১৫ ইউনিয়নকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডাসকো ফাউন্ডেশন পরিচালিত সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (আইডব্লিউআরএম) নামে একটি প্রকল্প জরিপ চালিয়ে এসব এলাকাকে অতিঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে।

ঝুঁকিপূর্ণ ওইসব এলাকায় জরুরিভাবে ভূ-গর্ভ থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ করে বিকল্প উপায়ে পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই ওইসব এলাকায় মিঠাপানির তিব্র সংকট দেখা দিবে বলে জানিয়েছেন তারা।

দীর্ঘ ১ বছর বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে জরিপ চালিয়ে সরকারেকে এমনই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আইডব্লিউআরএম। ২০১৪ সালে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠপর্যায়ে এই জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বরেন্দ্রে অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে গবেষণা করছেন। ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামায় চিন্তিত গবেষকরা। কারণ নিচে পানিশূন্য হলে বালি, পাথর ফাঁকা হয়ে পড়বে। তাতে সামান্য ভূমিকম্প হলেই দেবে যেতে পারে।

এ গবেষক আরও বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলকে বাঁচাতে পানির কোন বিকল্প নেয়। প্রথমেই ভূ-গর্ভস্থ থেকে সেচ কাজে পানি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর বেশি করে খনন করতে হবে। বাসা-বাড়ির ছাদের পানি ভূ-গর্ভস্থ ভেতরে রিফারিং করে ঢুকাতে হবে। এক কথায় বৃষ্টির পানি বেশি বেশি রির্চাজ করতে হবে।

এজন্য সরকারের পাশাপাশি এসব অঞ্চলের কৃষক, শিক্ষক, ও সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তার আগে সরকারকে এসব অঞ্চলের কৃষি জমিতে সেচ দিতে বিকল্প উপায়ে পানির ব্যবস্থা করতে পারলেই সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান হবে বলে মনে হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম জানান, ১৯৮০ সালে এ অঞ্চলে পানির স্তর মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। তবে ৩৬ বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটি পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এ এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার।

রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের এই বিরূপতা জনজীবনকে মারাত্মকভাবে বিঘিœত করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল। তিনি বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে পরিবেশগত প্রতিকূলতা এখন আশঙ্কার পর্যায়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ এখনই প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।