পাকিস্তানের আনপ্রেডিক্টেবল রাজনীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

পার্লামেন্টের জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটে হেরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। ২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ, ভুট্টো এবং শরিফ পরিবারের দীর্ঘদিনের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে ইমরান খান ক্ষমতায় এসে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। ইমরান খান তার সরকারের পতনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নাড়ছে বলে বারবার অভিযোগ করে যাচ্ছেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইমরান খানের মস্কো সফরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখেনি। ইমরান খানের প্রতি আমেরিকার রুষ্ট হওয়ার আরও কারণ আছে- রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিন্দা প্রস্তাবে পাকিস্তান ভোট দানে বিরত ছিল; রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল আমদানি অব্যাহত রাখার ঘোষণায় ইমরান খান ভারতের প্রশংসা করেছেন। এছাড়া তিনি আমেরিকার মুসলিম নীতির বিরুদ্ধে মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতো বড় বড় বক্তব্য দিয়েছেন।

পাকিস্তান একটি ধর্মান্ধ দেশ, ধর্ম পালনে একনিষ্ঠ নয়, কিন্তু ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দিয়ে অন্যদের খুন করতে একটু কুণ্ঠিত হয় না। রাজনৈতিক অস্থিরতায় হরতাল, ধর্মঘট, আন্দোলন লেগেই আছে। তালেবান, আইএস প্রভৃতি উগ্রগোষ্ঠী পাকিস্তানে সক্রিয়- তাদের বোমা হামলায় রাজপথ, গণজমায়েত, মসজিদ, নামাজের জামাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদ- কখনো সোজা ও মজবুত হতে পারেনি। ইমরান এগুলো থেকে পাকিস্তানকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু নির্বাচনকালীন দেয়া ইমরান খানের কোন প্রতিশ্রুতিই সন্তোষজনকভাবে পালিত হয়নি। দুর্নীতি নির্মূলে তার ‘জাস্টিস মুভমেন্ট’ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে, দুর্নীতি নির্মূল করে ‘রিয়াসতে মদিনা’ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপ জনগণের নিকট দৃশ্যমান হয়ে উঠেনি। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে ইমরান সরকারের ব্যর্থতা জনগণকে হতাশ করেছে। পাকিস্তানকে সুইডেন বানানোর ইমরান খানের স্বপ্নও তাই জাতির মধ্যে কোন উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দামেও পাকিস্তানের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩%। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় মুদ্রা অবমূল্যায়নে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়েছে; বাংলাদেশি এক টাকায় এখন পাকিস্তানি দুই রুপি পাওয়া যায়। ইমরান খান নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, বৈদেশিক ঋণ কমাবেন, কিন্তু তার আমলে ঋণ পরিশোধের জন্যই পাকিস্তানকে পুনরায় বিদেশ থেকে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণ নিতে হয়েছে।

বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ড দীর্ঘ সময় ধরে সেনা শাসন সহ্য করেছে। থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনী স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। এ দেশগুলোয় সেনাবাহিনীকে পাস কাটিয়ে কোন গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। এ দেশগুলোর সেনাবাহিনী নিজেদের দেশ শাসনে অপরিহার্য অভিভাবক মনে করে। সেনা সমর্থিত দল নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় মায়ানমারের সেনাবাহিনী অং সাং সূচির বিজয়ী দলকে ক্ষমতায় বসতেই দিল না। জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধেক সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটি সরাসরি শাসন করেছে। ইমরান খানের ক্ষমতায় আসার পেছনে সেনাবাহিনীর মদদ ছিল বলে সবার ধারণা। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় সমর্থন ইমরান খান পরে হারিয়ে ফেলেন। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ইমরান খান ও সেনা প্রধানের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়; ইউক্রেন যুদ্ধে ইমরান খান সেনা প্রধানের পরামর্শ মোতাবেক ভøাদিমির পুতিনের নিন্দা না করায় বিরোধ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস কায়ানি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দক্ষতা ও সফলতা নিয়ে একটি ইন্টারেস্টিং মন্তব্য করেছিলেন- পাকিস্তান সেনারা যুদ্ধে অন্য কোন দেশের সঙ্গে পারে না, পারে নিজের দেশ দখল করতে।

নির্বাচিত দলের কাছে শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি পাকিস্তানে গড়ে ওঠেনি বলেই পাকিস্তানের কোন প্রধানমন্ত্রীই তাদের ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ১৯৫১ সনে হত্যা করা হয়। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীরা আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন, ১৯৫১ সন থেকে ১৯৫৭ সন পর্যন্ত ৬ জন প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হন। লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন, তাকে ১৯৫৩ সনেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তারপর মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও ১৯৫৫ সনেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উভয়ে ১ বছর ১ মাস করে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগার ছিলেন ২ মাস। মালিক ফিরোজ খানকে ১০ মাসের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন। আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়া খান মিলে ১৩ বছর দেশ শাসন করেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের অধীনে নুরুল আমিনকে ১৩ দিনের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রিত্বের ৩ বছর ১১ মাস অতিবাহিত হলে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা প্রধান জিয়াউল হক ক্ষমতায় আসেন এবং ভুট্টোকে ফাঁসিতে লটকিয়ে দেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীদের কেউই পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন না। চৌধুরী সুজাত ছিলেন মাত্র ২ মাস।

১৯৪৭ সন থেকে ১৯৭১ সন পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র তিন জন প্রধানমন্ত্রী হন, তিনজনের মধ্যে দুজন নবাব পরিবারের লোক এবং অন্যজন নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাত্র ১৩ দিন। সেনা শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ১১ বছর। আইয়ুব খানের সঙ্গে বিশ্বখ্যাত মডেল ক্রিস্টান কেলার সুইমিং কস্টিউম পরে সাঁতার কেটেছেন। অপর সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান উপমহাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা নূর জাহানকে পাওয়ার জন্য পাকিস্তান বিক্রির মনোবাসনাও পোষণ করেছিলেন। তিনি ‘ব্ল্যাক ডগ’ হুইস্কি আর নারী নিয়ে এতবেশি বুঁদ হয়ে থাকতেন যে, একাত্তরে যুদ্ধের খবর নেয়ার সময়ও তিনি পেতেন না। মাতাল, চরিত্রহীন এই দুই লোকের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমানের কোন অভিযোগ ছিল না, অভিযোগ আর আপত্তি ছিল শুধু বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে। অদ্ভুত দেশ বলেই প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফকে মৃত্যুদ- দিয়ে আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল , দ- কার্যকরের আগে মৃত্যু হলে তার মৃতদেহ ইসলামাবাদে পার্লামেন্টের বাইরে টেনে এনে তিন দিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখা উচিত হবে।

ক্ষমতা হারিয়ে ইমরান খান পাকিস্তানের দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য দেশব্যাপী সংগ্রাম শুরু করেছেন। ইমরান খান মনে করেন, বিদেশি শক্তি চক্রান্ত করে তার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। সম্ভবত জনগণের অনুকম্পা আদায়ের নিমিত্তে ইমরান খান বলে বেড়াচ্ছেন, তার জীবন বিপন্ন, তাকে খুন করা হতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরান খানের জনসভায় জনতার ভিড়ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইমরানের পতনের পর জনগণ অকস্মাৎ উপলব্ধি করতে পেরেছে, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিনির্ভর কোন দেশই পণ্যের মূল্য কমাতে পারবে না। ইমরান খান কিছু ভালো কাজও করেছেন। করোনাকালীন কড়া লকডাউন না দিয়েও তিনি সফলভাবে করোনা মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন, লকডাউন না থাকায় বিদেশি ক্রেতারা পাকিস্তান থেকে প্রচুর পণ্য ক্রয় করতে পেরেছিল। ইমরান খান সরকারের দেয়া স্বাস্থ্যকার্ড গরিবদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছিল। আশ্রয়হীনদের জন্য বাড়ি ও খাবারের ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন, কম মূল্যে জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করেছিলেন। পতনের পর একই জনগণ ইমরানের প্রতি কিছুটা আর্দ্র হয়ে উঠেছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে যে জনগণ রাস্তায় ইমরান খানের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের অনেকেই এখন ইমরান খানকে সমর্থন করে তার জনসভায় যোগ দিচ্ছেন।

ধর্মীয় উন্মাদনা দেশটিকে স্থিতিশীল হতে দিল না। জেনারেল জিয়াউল হক তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পাকিস্তানে শরিয়াহ্ আইন চালু করেছিলেন, এখন শরিয়াহ্ আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকলেও কেউ তা আর বাদ দিতে সাহস করছে না। প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন কায়েম হওয়ার পর তা পাকিস্তানে রপ্তানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তানের ক্রিকেটের মতো পাকিস্তানের রাজনীতিও আনপ্রেডিক্টেবল- পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রেডিক্ট করা কঠিন।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ০১ মে ২০২২ , ১৮ বৈশাখ ১৪২৮ ২৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

পাকিস্তানের আনপ্রেডিক্টেবল রাজনীতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

পার্লামেন্টের জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটে হেরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। ২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ, ভুট্টো এবং শরিফ পরিবারের দীর্ঘদিনের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে ইমরান খান ক্ষমতায় এসে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। ইমরান খান তার সরকারের পতনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নাড়ছে বলে বারবার অভিযোগ করে যাচ্ছেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইমরান খানের মস্কো সফরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখেনি। ইমরান খানের প্রতি আমেরিকার রুষ্ট হওয়ার আরও কারণ আছে- রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিন্দা প্রস্তাবে পাকিস্তান ভোট দানে বিরত ছিল; রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল আমদানি অব্যাহত রাখার ঘোষণায় ইমরান খান ভারতের প্রশংসা করেছেন। এছাড়া তিনি আমেরিকার মুসলিম নীতির বিরুদ্ধে মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতো বড় বড় বক্তব্য দিয়েছেন।

পাকিস্তান একটি ধর্মান্ধ দেশ, ধর্ম পালনে একনিষ্ঠ নয়, কিন্তু ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দিয়ে অন্যদের খুন করতে একটু কুণ্ঠিত হয় না। রাজনৈতিক অস্থিরতায় হরতাল, ধর্মঘট, আন্দোলন লেগেই আছে। তালেবান, আইএস প্রভৃতি উগ্রগোষ্ঠী পাকিস্তানে সক্রিয়- তাদের বোমা হামলায় রাজপথ, গণজমায়েত, মসজিদ, নামাজের জামাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদ- কখনো সোজা ও মজবুত হতে পারেনি। ইমরান এগুলো থেকে পাকিস্তানকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু নির্বাচনকালীন দেয়া ইমরান খানের কোন প্রতিশ্রুতিই সন্তোষজনকভাবে পালিত হয়নি। দুর্নীতি নির্মূলে তার ‘জাস্টিস মুভমেন্ট’ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে, দুর্নীতি নির্মূল করে ‘রিয়াসতে মদিনা’ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপ জনগণের নিকট দৃশ্যমান হয়ে উঠেনি। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে ইমরান সরকারের ব্যর্থতা জনগণকে হতাশ করেছে। পাকিস্তানকে সুইডেন বানানোর ইমরান খানের স্বপ্নও তাই জাতির মধ্যে কোন উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দামেও পাকিস্তানের জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩%। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় মুদ্রা অবমূল্যায়নে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়েছে; বাংলাদেশি এক টাকায় এখন পাকিস্তানি দুই রুপি পাওয়া যায়। ইমরান খান নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, বৈদেশিক ঋণ কমাবেন, কিন্তু তার আমলে ঋণ পরিশোধের জন্যই পাকিস্তানকে পুনরায় বিদেশ থেকে শ্রীলঙ্কার মতো ঋণ নিতে হয়েছে।

বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ড দীর্ঘ সময় ধরে সেনা শাসন সহ্য করেছে। থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনী স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। এ দেশগুলোয় সেনাবাহিনীকে পাস কাটিয়ে কোন গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। এ দেশগুলোর সেনাবাহিনী নিজেদের দেশ শাসনে অপরিহার্য অভিভাবক মনে করে। সেনা সমর্থিত দল নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় মায়ানমারের সেনাবাহিনী অং সাং সূচির বিজয়ী দলকে ক্ষমতায় বসতেই দিল না। জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধেক সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটি সরাসরি শাসন করেছে। ইমরান খানের ক্ষমতায় আসার পেছনে সেনাবাহিনীর মদদ ছিল বলে সবার ধারণা। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় সমর্থন ইমরান খান পরে হারিয়ে ফেলেন। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ইমরান খান ও সেনা প্রধানের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়; ইউক্রেন যুদ্ধে ইমরান খান সেনা প্রধানের পরামর্শ মোতাবেক ভøাদিমির পুতিনের নিন্দা না করায় বিরোধ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস কায়ানি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দক্ষতা ও সফলতা নিয়ে একটি ইন্টারেস্টিং মন্তব্য করেছিলেন- পাকিস্তান সেনারা যুদ্ধে অন্য কোন দেশের সঙ্গে পারে না, পারে নিজের দেশ দখল করতে।

নির্বাচিত দলের কাছে শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি পাকিস্তানে গড়ে ওঠেনি বলেই পাকিস্তানের কোন প্রধানমন্ত্রীই তাদের ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ১৯৫১ সনে হত্যা করা হয়। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীরা আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন, ১৯৫১ সন থেকে ১৯৫৭ সন পর্যন্ত ৬ জন প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হন। লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন, তাকে ১৯৫৩ সনেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তারপর মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও ১৯৫৫ সনেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উভয়ে ১ বছর ১ মাস করে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগার ছিলেন ২ মাস। মালিক ফিরোজ খানকে ১০ মাসের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন। আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়া খান মিলে ১৩ বছর দেশ শাসন করেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের অধীনে নুরুল আমিনকে ১৩ দিনের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রিত্বের ৩ বছর ১১ মাস অতিবাহিত হলে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা প্রধান জিয়াউল হক ক্ষমতায় আসেন এবং ভুট্টোকে ফাঁসিতে লটকিয়ে দেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীদের কেউই পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন না। চৌধুরী সুজাত ছিলেন মাত্র ২ মাস।

১৯৪৭ সন থেকে ১৯৭১ সন পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র তিন জন প্রধানমন্ত্রী হন, তিনজনের মধ্যে দুজন নবাব পরিবারের লোক এবং অন্যজন নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাত্র ১৩ দিন। সেনা শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ১১ বছর। আইয়ুব খানের সঙ্গে বিশ্বখ্যাত মডেল ক্রিস্টান কেলার সুইমিং কস্টিউম পরে সাঁতার কেটেছেন। অপর সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান উপমহাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা নূর জাহানকে পাওয়ার জন্য পাকিস্তান বিক্রির মনোবাসনাও পোষণ করেছিলেন। তিনি ‘ব্ল্যাক ডগ’ হুইস্কি আর নারী নিয়ে এতবেশি বুঁদ হয়ে থাকতেন যে, একাত্তরে যুদ্ধের খবর নেয়ার সময়ও তিনি পেতেন না। মাতাল, চরিত্রহীন এই দুই লোকের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমানের কোন অভিযোগ ছিল না, অভিযোগ আর আপত্তি ছিল শুধু বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে। অদ্ভুত দেশ বলেই প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফকে মৃত্যুদ- দিয়ে আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল , দ- কার্যকরের আগে মৃত্যু হলে তার মৃতদেহ ইসলামাবাদে পার্লামেন্টের বাইরে টেনে এনে তিন দিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখা উচিত হবে।

ক্ষমতা হারিয়ে ইমরান খান পাকিস্তানের দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য দেশব্যাপী সংগ্রাম শুরু করেছেন। ইমরান খান মনে করেন, বিদেশি শক্তি চক্রান্ত করে তার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। সম্ভবত জনগণের অনুকম্পা আদায়ের নিমিত্তে ইমরান খান বলে বেড়াচ্ছেন, তার জীবন বিপন্ন, তাকে খুন করা হতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরান খানের জনসভায় জনতার ভিড়ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইমরানের পতনের পর জনগণ অকস্মাৎ উপলব্ধি করতে পেরেছে, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিনির্ভর কোন দেশই পণ্যের মূল্য কমাতে পারবে না। ইমরান খান কিছু ভালো কাজও করেছেন। করোনাকালীন কড়া লকডাউন না দিয়েও তিনি সফলভাবে করোনা মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন, লকডাউন না থাকায় বিদেশি ক্রেতারা পাকিস্তান থেকে প্রচুর পণ্য ক্রয় করতে পেরেছিল। ইমরান খান সরকারের দেয়া স্বাস্থ্যকার্ড গরিবদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছিল। আশ্রয়হীনদের জন্য বাড়ি ও খাবারের ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন, কম মূল্যে জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করেছিলেন। পতনের পর একই জনগণ ইমরানের প্রতি কিছুটা আর্দ্র হয়ে উঠেছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে যে জনগণ রাস্তায় ইমরান খানের বিরোধিতা করেছিলেন তাদের অনেকেই এখন ইমরান খানকে সমর্থন করে তার জনসভায় যোগ দিচ্ছেন।

ধর্মীয় উন্মাদনা দেশটিকে স্থিতিশীল হতে দিল না। জেনারেল জিয়াউল হক তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পাকিস্তানে শরিয়াহ্ আইন চালু করেছিলেন, এখন শরিয়াহ্ আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকলেও কেউ তা আর বাদ দিতে সাহস করছে না। প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন কায়েম হওয়ার পর তা পাকিস্তানে রপ্তানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তানের ক্রিকেটের মতো পাকিস্তানের রাজনীতিও আনপ্রেডিক্টেবল- পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রেডিক্ট করা কঠিন।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]