ঈদুল ফিতর : ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ

এম এ কবীর

ঈদুল ফিতর বিশ^ মুসলিমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দোৎসব। ইসলামি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। রমজানের শেষ দিন সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে শাওয়াল মাসের বাঁকা চাঁদ উদিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে ঈদুল ফিতরের আহ্বান: ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। পবিত্র আনন্দধারায় উদ্ভাসিত হয় সব সিয়াম সাধকের চিত্ত।

ঈদুল ফিতরের উৎসব একদিকে যেমনি আমাদের নির্মল-নিষ্কলুষ আনন্দে উজ্জীবিত করে অন্যদিকে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের চেতনায় করে অনুপ্রাণিত। ঈদ অর্থ খুশি। তবে এ খুশি একা ভোগ করার জন্য নয়, সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার মধ্যেই নিহিত এর সার্থকতা। ধনী-নির্ধন সবাই যাতে এ উৎসব প্রাণভরে উপভোগ করতে পারে, সেজন্য বিত্তশালীদের উচিত গরিব-দুস্থদের দিকে সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। পবিত্র রমজানে ইবাদত বন্দেগির কারণে যেভাবে পাপ থেকে মুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার ফলে প্রত্যেক রোজাদার যে পরিশুদ্ধতা অর্জন করে সে কারণে ঈদ তাদের জন্য এক স্বর্গীয় আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মুসলমান যে কঠোর সংযমের প্রশিক্ষণ লাভ করে তারই মূল্যায়নের দিন ঈদুল ফিতর।

রোজাদার একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নফসকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে রক্ষা করে অন্তরকে খাঁটি কলুষমুক্ত করে। তার মন-মানসিকতায় ধ্বনিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার নৈকট্য লাভের তীব্র আকাক্সক্ষা। এমন সুফলদায়ক প্রশিক্ষণ যাতে বাকি ১১ মাস কার্যকর থাকে, চিন্তা-চেতনায় শাণিত থাকে তার শপথ নেয়ার দিন ঈদুল ফিতর।

প্রথম ঈদ পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর ১ শাওয়াল ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ মদিনায়। আর মক্কায় প্রথম ঈদ পালিত হয় অষ্টম হিজরী ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের প্রায় ১১ দিন পর। নবী করিম (সা.) মদিনায় গমন করে দেখতে পেলেন, পারসিক প্রভাবে মদিনায় বসবাসকারী লোকেরা শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মিহিরজান’ নামাক দুটি উৎসব অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পালন করছে। এ উৎসবে তারা নানা আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ উদযাপন করত। প্রাক ইসলামি যুগে আরব দেশে অন্যদের অনুকরণে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের রেওয়াজ ছিল। হজরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করলেন, তখন তাদের দুটি দিন ছিল যাতে তারা উৎসব পালন করত।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ দু’দিন কিসের উৎসব পালন করো?’ তারা বললো ‘আমরা জাহেলী যুগে এ দুই দিন উৎসব পালন করতাম। এ ভাবধারাই চলে আসছে।’ তাদের এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের এই দুই দিনের বদলে দুটি মহান উৎসবের দিন প্রদান করেছেন। একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আজহা’। এতে তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে উৎসব পালন করো।

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। বাংলাদেশে প্রথম কোথায় ঈদ পালিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায়, চট্টগ্রামের সন্দীপ অঞ্চলে প্রথম ঈদের জামায়াত হয়েছিল। ঢাকায় সম্ভবত প্রথম ঈদ উদ্যাপিত হয় সুলতানি আমলে (১৩০০-১৫৩৮ খ্রি.) মোটামুটি দুইশত বছরের বেশি সময়ে নগরকেন্দ্রিক ঈদ উৎসবের কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, ১০০ বছর আগেও কি এভাবে হতো? সাধারণ মানুষ কি আজকের মতো অধীর আগ্রহ, উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন ঈদের চাঁদের দিকে? ঈদের ধুমধামের দিকে? ইতিহাস বলে ‘না’।

ইসলাম প্রচারের শুরুতে অর্থাৎ আদি বাঙালি মুসলমানরা কীভাবে ঈদ উৎসব পালন করত, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তবে বলা যেতে পারে আদিতে প্রচার করা আরবের উদযাপিত ঈদের আদি রূপই হয়তো তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কালের গর্ভে সময়ের বিবর্তনে সে রূপ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কখনো ধর্মীয় নেতারা মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন তাদের নিজের গড়া নতুন অনুষ্ঠান। কখনো শাসকশ্রেণির নির্দেশে যুক্ত হয়েছে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকর্ম। কখনো-বা লৌকিক ধর্মের প্রভাব এসেছে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে। বাংলাদেশে যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, তাতে প্রভাব ফেলেছে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ^াস। উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ শতবর্ষ আগে ঈদের দিনটি কীভাবে পালন করতেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আর্থসামাজিক পটভূমিতে মানুষের মনেরও পরিবর্তন ঘটেছে। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের ফলে। শতবর্ষ আগে সাহিত্য, সংবাদ সাময়িকী পত্রে ঈদের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। এ দেশের হিন্দু, মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখেছেন, তাদের রচনায় দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, মহররম, এমনকি রথযাত্রা, দোল পূর্ণিমা, দিপালী উৎসব এরূপ বিভিন্ন পূজা-পার্বণ সম্পর্কে বিস্তর উল্লেখ পাওয়া যায়। শুধু পাওয়া যায় না ঈদুল ফিতর সম্পর্কে। তবে একালে যারা জন্মেছেন, তাদের বিবরণীতে ঈদুল ফিতর সম্পর্কে খানিকটা তথ্য পাওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় ঈদুল ফিতরের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উৎসব শতবর্ষ আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে আজকের মতো অনাবিল হাসি, আনন্দের বার্তা বয়ে আনতে পারেনি। এ থেকে বলা যায় ঈদুল ফিতর সেকালে বাংলাদেশে তেমন কোন বড় উৎসব হিসেবে পালন হয়নি। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি, বাঙালির ঈদকে দেখি একটা সামাজিক ধর্মীয় বড় উৎসব হিসেবে তা কিন্তু সত্তর-আশি বছরের ঐতিহ্য মাত্র।

বর্তমানে গ্রাম বাংলায় রোজা ও ঈদ যেভাবে পালিত হচ্ছে, তা কিন্তু নব্বই বছর আগেও এভাবে পালিত হতো না। ব্রিটিশ আমলে যে উৎসব সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে এ বাংলায় প্রচলিত ছিল এবং ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল, তা হলো খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের “ক্রিসমাস ডে”। ব্রিটিশ আমলে বিদ্যার দিক থেকে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের থেকে ছিল অনেক পিছিয়ে। ফলে “ক্রিসমাসের” পরেই সরকারিভাবে, সস্প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে এই অঞ্চলে হিন্দুদের “দুর্গাপূজা” হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জমকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। অফিস-আদালতে ইংরেজ আমলে সরকারি ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকেও পূজার জন্য ছিল অনেক বেশি। সে আমলে সরকারি নথিপত্রেও পূজা সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্যাদি।

কোভিড-১৯ বৈশি^ক মহামারীর মধ্যে এবারও এসেছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই মহামারীতে বিশে^ এ পর্যন্ত ৬৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫১ কোটি। আর বাংলাদেশে মারা গেছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ পেরিয়ে গেছে।

শুধু ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমেই নয়; আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেও যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এর বাস্তব উদাহরণ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদ মুসলিম উম্মার প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ দান। এবারের ঈদুল ফিতর আমাদের মধ্যে খুশি ও আনন্দ বয়ে আনুক। সুখ ও শান্তির ফ-ুধারা বয়ে যাক সমাজের প্রতিটি স্তরে। ঈদুল ফিতরের এ খুশি আমাদের অন্তর থেকে দূর করুক সব কুটিলতা। সমাজে ফিরিয়ে আনুক অনাবিল শান্তি। ঈদ মোবারক।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

রবিবার, ০১ মে ২০২২ , ১৮ বৈশাখ ১৪২৮ ২৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

ঈদুল ফিতর : ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ

এম এ কবীর

ঈদুল ফিতর বিশ^ মুসলিমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দোৎসব। ইসলামি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। রমজানের শেষ দিন সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে শাওয়াল মাসের বাঁকা চাঁদ উদিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে ঈদুল ফিতরের আহ্বান: ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’। পবিত্র আনন্দধারায় উদ্ভাসিত হয় সব সিয়াম সাধকের চিত্ত।

ঈদুল ফিতরের উৎসব একদিকে যেমনি আমাদের নির্মল-নিষ্কলুষ আনন্দে উজ্জীবিত করে অন্যদিকে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের চেতনায় করে অনুপ্রাণিত। ঈদ অর্থ খুশি। তবে এ খুশি একা ভোগ করার জন্য নয়, সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করার মধ্যেই নিহিত এর সার্থকতা। ধনী-নির্ধন সবাই যাতে এ উৎসব প্রাণভরে উপভোগ করতে পারে, সেজন্য বিত্তশালীদের উচিত গরিব-দুস্থদের দিকে সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। পবিত্র রমজানে ইবাদত বন্দেগির কারণে যেভাবে পাপ থেকে মুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার ফলে প্রত্যেক রোজাদার যে পরিশুদ্ধতা অর্জন করে সে কারণে ঈদ তাদের জন্য এক স্বর্গীয় আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মুসলমান যে কঠোর সংযমের প্রশিক্ষণ লাভ করে তারই মূল্যায়নের দিন ঈদুল ফিতর।

রোজাদার একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নফসকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে রক্ষা করে অন্তরকে খাঁটি কলুষমুক্ত করে। তার মন-মানসিকতায় ধ্বনিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার নৈকট্য লাভের তীব্র আকাক্সক্ষা। এমন সুফলদায়ক প্রশিক্ষণ যাতে বাকি ১১ মাস কার্যকর থাকে, চিন্তা-চেতনায় শাণিত থাকে তার শপথ নেয়ার দিন ঈদুল ফিতর।

প্রথম ঈদ পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরীর ১ শাওয়াল ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ মদিনায়। আর মক্কায় প্রথম ঈদ পালিত হয় অষ্টম হিজরী ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের প্রায় ১১ দিন পর। নবী করিম (সা.) মদিনায় গমন করে দেখতে পেলেন, পারসিক প্রভাবে মদিনায় বসবাসকারী লোকেরা শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মিহিরজান’ নামাক দুটি উৎসব অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পালন করছে। এ উৎসবে তারা নানা আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ উদযাপন করত। প্রাক ইসলামি যুগে আরব দেশে অন্যদের অনুকরণে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের রেওয়াজ ছিল। হজরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করলেন, তখন তাদের দুটি দিন ছিল যাতে তারা উৎসব পালন করত।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ দু’দিন কিসের উৎসব পালন করো?’ তারা বললো ‘আমরা জাহেলী যুগে এ দুই দিন উৎসব পালন করতাম। এ ভাবধারাই চলে আসছে।’ তাদের এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের এই দুই দিনের বদলে দুটি মহান উৎসবের দিন প্রদান করেছেন। একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আজহা’। এতে তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে উৎসব পালন করো।

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ৬৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। বাংলাদেশে প্রথম কোথায় ঈদ পালিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায়, চট্টগ্রামের সন্দীপ অঞ্চলে প্রথম ঈদের জামায়াত হয়েছিল। ঢাকায় সম্ভবত প্রথম ঈদ উদ্যাপিত হয় সুলতানি আমলে (১৩০০-১৫৩৮ খ্রি.) মোটামুটি দুইশত বছরের বেশি সময়ে নগরকেন্দ্রিক ঈদ উৎসবের কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, ১০০ বছর আগেও কি এভাবে হতো? সাধারণ মানুষ কি আজকের মতো অধীর আগ্রহ, উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন ঈদের চাঁদের দিকে? ঈদের ধুমধামের দিকে? ইতিহাস বলে ‘না’।

ইসলাম প্রচারের শুরুতে অর্থাৎ আদি বাঙালি মুসলমানরা কীভাবে ঈদ উৎসব পালন করত, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তবে বলা যেতে পারে আদিতে প্রচার করা আরবের উদযাপিত ঈদের আদি রূপই হয়তো তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কালের গর্ভে সময়ের বিবর্তনে সে রূপ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কখনো ধর্মীয় নেতারা মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন তাদের নিজের গড়া নতুন অনুষ্ঠান। কখনো শাসকশ্রেণির নির্দেশে যুক্ত হয়েছে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকর্ম। কখনো-বা লৌকিক ধর্মের প্রভাব এসেছে লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে। বাংলাদেশে যেভাবে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে, তাতে প্রভাব ফেলেছে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ^াস। উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ শতবর্ষ আগে ঈদের দিনটি কীভাবে পালন করতেন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আর্থসামাজিক পটভূমিতে মানুষের মনেরও পরিবর্তন ঘটেছে। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের ফলে। শতবর্ষ আগে সাহিত্য, সংবাদ সাময়িকী পত্রে ঈদের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। এ দেশের হিন্দু, মুসলমান যিনিই আত্মজীবনী লিখেছেন, তাদের রচনায় দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, মহররম, এমনকি রথযাত্রা, দোল পূর্ণিমা, দিপালী উৎসব এরূপ বিভিন্ন পূজা-পার্বণ সম্পর্কে বিস্তর উল্লেখ পাওয়া যায়। শুধু পাওয়া যায় না ঈদুল ফিতর সম্পর্কে। তবে একালে যারা জন্মেছেন, তাদের বিবরণীতে ঈদুল ফিতর সম্পর্কে খানিকটা তথ্য পাওয়া যায়। এতে প্রমাণিত হয় ঈদুল ফিতরের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উৎসব শতবর্ষ আগেও বাঙালির ঘরে ঘরে আজকের মতো অনাবিল হাসি, আনন্দের বার্তা বয়ে আনতে পারেনি। এ থেকে বলা যায় ঈদুল ফিতর সেকালে বাংলাদেশে তেমন কোন বড় উৎসব হিসেবে পালন হয়নি। আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি, বাঙালির ঈদকে দেখি একটা সামাজিক ধর্মীয় বড় উৎসব হিসেবে তা কিন্তু সত্তর-আশি বছরের ঐতিহ্য মাত্র।

বর্তমানে গ্রাম বাংলায় রোজা ও ঈদ যেভাবে পালিত হচ্ছে, তা কিন্তু নব্বই বছর আগেও এভাবে পালিত হতো না। ব্রিটিশ আমলে যে উৎসব সবচেয়ে ধুমধামের সঙ্গে এ বাংলায় প্রচলিত ছিল এবং ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি ছুটি বরাদ্দ ছিল, তা হলো খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের “ক্রিসমাস ডে”। ব্রিটিশ আমলে বিদ্যার দিক থেকে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের থেকে ছিল অনেক পিছিয়ে। ফলে “ক্রিসমাসের” পরেই সরকারিভাবে, সস্প্রদায়গত আধিপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে এই অঞ্চলে হিন্দুদের “দুর্গাপূজা” হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়, জমকালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। অফিস-আদালতে ইংরেজ আমলে সরকারি ছুটির পরিমাণ ঈদের থেকেও পূজার জন্য ছিল অনেক বেশি। সে আমলে সরকারি নথিপত্রেও পূজা সম্পর্কে আছে পর্যাপ্ত তথ্যাদি।

কোভিড-১৯ বৈশি^ক মহামারীর মধ্যে এবারও এসেছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই মহামারীতে বিশে^ এ পর্যন্ত ৬৩ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫১ কোটি। আর বাংলাদেশে মারা গেছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ পেরিয়ে গেছে।

শুধু ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমেই নয়; আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেও যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এর বাস্তব উদাহরণ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদ মুসলিম উম্মার প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ দান। এবারের ঈদুল ফিতর আমাদের মধ্যে খুশি ও আনন্দ বয়ে আনুক। সুখ ও শান্তির ফ-ুধারা বয়ে যাক সমাজের প্রতিটি স্তরে। ঈদুল ফিতরের এ খুশি আমাদের অন্তর থেকে দূর করুক সব কুটিলতা। সমাজে ফিরিয়ে আনুক অনাবিল শান্তি। ঈদ মোবারক।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]