উন্নয়নের স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

ওয়াজেদুল ইসলাম খান

মহান মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হিসেবে পহেলা মে সারা বিশ্বে মে দিবস হিসেবে পালিত হয়। উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোন ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা, ছিল না কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা সে সময়ের বৃহত্তম শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদন এই দাবিতে। তৎকালীন মার্কিন সরকার এবং মালিকপক্ষ শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল বল প্রয়োগের মাধ্যমে। পুলিশ ও মালিকদের পেটুয়া বাহিনী নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর নৃশংস হামলা আক্রমণ চালিয়ে ১১ জন শ্রমিককে হত্যা করে। শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়।

১৮৮৬ সাল থেকে ২০২২ সাল সময়ের ব্যবধান অনেক বেশি হলেও শ্রমজীবী মানুষকে এখনো তার ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মস্থল, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে হচ্ছে। প্রযুক্তির আবির্ভাবে মানুষের জীবন যাত্রার অনেক পরিবর্তন আসলেও পরিবর্তন আসেনি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৮ ঘণ্টা শ্রম সময়, ন্যায্য মজুরি ও শোভন কাজের দাবিতে শ্রমজীবী মানুষকে এখনো আন্দোলন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনয়ন অধিকার ও দর-কষাকষির অধিকার এখনো পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

বিশ্বের সব সৃষ্টির নির্মাতা শ্রমিক কর্মচারী মেহনতি মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ আমাদের দেশের সব গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও উন্নয়নে শ্রমিক কর্মচারী মেহনতি মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। গার্মেন্ট, নির্মাণ, প্রবাসী, পাট, চা, চামড়া, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রাবার, স্টিল, রি-রোলিং, শিপব্রেকিং, চাতাল, সুতা, ওষুধ, সিরামিক, প্লাস্টিক, স্বাস্থ্য খাত ও রিকশা ও গৃহ শ্রমিকসহ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীরা হলো আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে প্রতিনিয়ত বর্ধিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার ভা-ার। তাদের শ্রম ও ঘামের ফসল হিসেবে প্রতি বছর দেশের জিডিপি বাড়ছে, বাজেট বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, দেশের সম্মান বাড়ছে। কিন্তু শ্রমিক কর্মচারী মেহনতি মানুষকে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সেভাবে দেয়া হচ্ছে না। তাদের জীবনমানেরও তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। তারা এখনো পরিবার পরিজনসহ জীবনধারণ উপযোগী মজুরি ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। কর্মস্থলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। তাদের যে মজুরি দেয়া হয় তা দিয়ে তারা ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে না কিংবা সন্তানের শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না। দেশের শ্রম বাজারে প্রতিনিয়ত পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি ব্যাপকসংখ্যক নারী শ্রমিকের আগমন ঘটলেও কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মজুরি বৈষম্য ও যৌন হয়রানিসহ নানাবিধ নিপীড়নে অনেক নারী শ্রমিক আবার চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির বিধান রয়েছে। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি হলো শ্রমিকদের যে মজুরি বৈষম্য বিরাজ করছে তা দূরীকরণের লক্ষ্যে সব শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির মানদ- নির্ধারণের লক্ষ্যে জাতীয়ভিত্তিক সব শ্রমিকদের জন্য একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা। আমাদের দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যক্তিমালিকানা নির্বিশেষে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসলেও এখনো এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সমতাভিত্তিক ন্যায্য মজুরি ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এটি সর্বস্তরের শ্রমিক কর্মচারীদের অন্যতম মৌলিক দাবি এটি। সব খাতের সব শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির বিধান রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও একটা নীতিমালা করা উচিত। আমাদের দেশে আগে মহার্ঘ ভাতা চালু ছিল। কিন্তু এখন মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে না। প্রতি বছর জীবনধারণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পায় সেটার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতি বছর মহার্ঘভাতা চালু করা উচিত। যাহা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এর ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরিও রক্ষা পাবে এবং মহার্ঘভাতা সমন্বিত করে মজুরি বৃদ্ধ করা হলে মালিকদেরকেও এককালীন শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির চাপে পড়তে হতো না বা হবে না।

গত দুই বছর থেকে ঘাতকব্যাধী মহামারি করোনাভাইরাসে গোটা পৃথিবীতে ৫০ কোটির অধিক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬৫ লক্ষের অধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গত দুই বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন মেয়াদে সাধারণ ছুটি ও লকডাউন দিয়েছে। এসব ছুটি ও লকডাউনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নি¤œ আয়ের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ। বহুসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ ছাঁটাই এর শিকার হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রায় সব সেক্টরে সাধারণ শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিড মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে সীমিত আকারে প্রণোদনাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রণোদনা ক্ষতিগ্রস্ত এ বিশাল শ্রমগোষ্ঠীর জন্য যথেষ্ট নয়।

শ্রমিক কর্মচারী ও নি¤œ আয়ের মানুষ বিশেষ করে গার্মেন্ট, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চা শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, হকার, চাতাল, ওয়েল্ডিং, গৃহ শ্রমিকদের জন্য সস্তা ও সুলভ মূল্যে রেশন প্রথার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন, চাল, ডাল, তেল, চিনি সরবরাহ করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য রেশন, আবাসন, মহার্ঘ ভাতা ও সার্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী শ্রমিকদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের জন্য শিল্পভিত্তিক পৃথক ডরমেটরি স্থাপন করতে হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য পৃথক প্রক্ষালন কক্ষ ও চাইল্ড ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। শিল্পভিত্তিক শ্রমজীবী হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা করার লক্ষ্যে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল এবং সেন্ট্রাল ফান্ডের কার্যক্রম পরিচালনায় বিশেষ উদ্যোগ এবং মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে। করোনার মতো যে কোন দুর্যোগে সহায়তার জন্য বিশেষ স্কিম চালু করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু অথবা গুরুতর আহত হয়ে কর্মক্ষমতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হলে আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুযায়ী তাকে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, কাজে ফেরার ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় শ্রমজীবী মানুষের অবদানের জন্যই শিল্প ও কৃষি বিপ্লব হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত আমাদের দেশের শ্রমিকরা কাজে দক্ষ ও মেধাবী। কিন্তু তাদের সব ক্ষেত্রে তাদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন কোন সময় শিল্প বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। প্রকৃত পক্ষে আমাদের দেশের মালিক শ্রমিকদের মধ্যে এখনো প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক বিরাজ করছে, যা কোনোভাবেই শিল্প বিকাশের জন্য অনুকূল বা সহায়ক নয়। শ্রমিকদের আস্থায় নিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে যেভাবে শিল্প বিকশিত হয়েছে আমাদের দেশেও সেভাবে শিল্পের বিকাশ সম্ভব।

শিল্প বিকাশের পূর্ব শর্ত হলো আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুযায়ী শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদান, সর্বস্তরের শ্রমিকদের জন্য জাতীয়ভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন, শ্রমিক কর্মচারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সমকাজে সমমজুরী ও কর্ম সময় আট ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত এবং শ্রমিক কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে রেশন প্রথার মাধ্যমে নিত্যপ্রযোজনীয় দ্রব্যাদি সর্বস্তরের শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে প্রদান করা। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্প বিকাশ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এর মাধ্যমেই জাতীয় অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। তবেই শিল্প, শ্রমিক এবং দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে।

দুনিয়ার মজদুর এক হও।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র]

রবিবার, ০১ মে ২০২২ , ১৮ বৈশাখ ১৪২৮ ২৯ রমাদ্বান ১৪৪৩

উন্নয়নের স্বার্থে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

ওয়াজেদুল ইসলাম খান

মহান মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হিসেবে পহেলা মে সারা বিশ্বে মে দিবস হিসেবে পালিত হয়। উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোন ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা, ছিল না কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা সে সময়ের বৃহত্তম শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদন এই দাবিতে। তৎকালীন মার্কিন সরকার এবং মালিকপক্ষ শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল বল প্রয়োগের মাধ্যমে। পুলিশ ও মালিকদের পেটুয়া বাহিনী নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর নৃশংস হামলা আক্রমণ চালিয়ে ১১ জন শ্রমিককে হত্যা করে। শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়।

১৮৮৬ সাল থেকে ২০২২ সাল সময়ের ব্যবধান অনেক বেশি হলেও শ্রমজীবী মানুষকে এখনো তার ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মস্থল, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে হচ্ছে। প্রযুক্তির আবির্ভাবে মানুষের জীবন যাত্রার অনেক পরিবর্তন আসলেও পরিবর্তন আসেনি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৮ ঘণ্টা শ্রম সময়, ন্যায্য মজুরি ও শোভন কাজের দাবিতে শ্রমজীবী মানুষকে এখনো আন্দোলন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনয়ন অধিকার ও দর-কষাকষির অধিকার এখনো পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

বিশ্বের সব সৃষ্টির নির্মাতা শ্রমিক কর্মচারী মেহনতি মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ আমাদের দেশের সব গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও উন্নয়নে শ্রমিক কর্মচারী মেহনতি মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। গার্মেন্ট, নির্মাণ, প্রবাসী, পাট, চা, চামড়া, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রাবার, স্টিল, রি-রোলিং, শিপব্রেকিং, চাতাল, সুতা, ওষুধ, সিরামিক, প্লাস্টিক, স্বাস্থ্য খাত ও রিকশা ও গৃহ শ্রমিকসহ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীরা হলো আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে প্রতিনিয়ত বর্ধিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার ভা-ার। তাদের শ্রম ও ঘামের ফসল হিসেবে প্রতি বছর দেশের জিডিপি বাড়ছে, বাজেট বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, দেশের সম্মান বাড়ছে। কিন্তু শ্রমিক কর্মচারী মেহনতি মানুষকে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সেভাবে দেয়া হচ্ছে না। তাদের জীবনমানেরও তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। তারা এখনো পরিবার পরিজনসহ জীবনধারণ উপযোগী মজুরি ও অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। কর্মস্থলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। তাদের যে মজুরি দেয়া হয় তা দিয়ে তারা ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে না কিংবা সন্তানের শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না। দেশের শ্রম বাজারে প্রতিনিয়ত পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি ব্যাপকসংখ্যক নারী শ্রমিকের আগমন ঘটলেও কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মজুরি বৈষম্য ও যৌন হয়রানিসহ নানাবিধ নিপীড়নে অনেক নারী শ্রমিক আবার চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির বিধান রয়েছে। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি হলো শ্রমিকদের যে মজুরি বৈষম্য বিরাজ করছে তা দূরীকরণের লক্ষ্যে সব শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির মানদ- নির্ধারণের লক্ষ্যে জাতীয়ভিত্তিক সব শ্রমিকদের জন্য একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা। আমাদের দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যক্তিমালিকানা নির্বিশেষে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসলেও এখনো এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সমতাভিত্তিক ন্যায্য মজুরি ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এটি সর্বস্তরের শ্রমিক কর্মচারীদের অন্যতম মৌলিক দাবি এটি। সব খাতের সব শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পৃথিবীর অনেক দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির বিধান রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও একটা নীতিমালা করা উচিত। আমাদের দেশে আগে মহার্ঘ ভাতা চালু ছিল। কিন্তু এখন মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে না। প্রতি বছর জীবনধারণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পায় সেটার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতি বছর মহার্ঘভাতা চালু করা উচিত। যাহা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এর ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরিও রক্ষা পাবে এবং মহার্ঘভাতা সমন্বিত করে মজুরি বৃদ্ধ করা হলে মালিকদেরকেও এককালীন শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির চাপে পড়তে হতো না বা হবে না।

গত দুই বছর থেকে ঘাতকব্যাধী মহামারি করোনাভাইরাসে গোটা পৃথিবীতে ৫০ কোটির অধিক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬৫ লক্ষের অধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গত দুই বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন মেয়াদে সাধারণ ছুটি ও লকডাউন দিয়েছে। এসব ছুটি ও লকডাউনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নি¤œ আয়ের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ। বহুসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ ছাঁটাই এর শিকার হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রায় সব সেক্টরে সাধারণ শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিড মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে সীমিত আকারে প্রণোদনাসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রণোদনা ক্ষতিগ্রস্ত এ বিশাল শ্রমগোষ্ঠীর জন্য যথেষ্ট নয়।

শ্রমিক কর্মচারী ও নি¤œ আয়ের মানুষ বিশেষ করে গার্মেন্ট, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, চা শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, হকার, চাতাল, ওয়েল্ডিং, গৃহ শ্রমিকদের জন্য সস্তা ও সুলভ মূল্যে রেশন প্রথার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন, চাল, ডাল, তেল, চিনি সরবরাহ করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য রেশন, আবাসন, মহার্ঘ ভাতা ও সার্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী শ্রমিকদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের জন্য শিল্পভিত্তিক পৃথক ডরমেটরি স্থাপন করতে হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য পৃথক প্রক্ষালন কক্ষ ও চাইল্ড ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। শিল্পভিত্তিক শ্রমজীবী হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা করার লক্ষ্যে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল এবং সেন্ট্রাল ফান্ডের কার্যক্রম পরিচালনায় বিশেষ উদ্যোগ এবং মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে। করোনার মতো যে কোন দুর্যোগে সহায়তার জন্য বিশেষ স্কিম চালু করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু অথবা গুরুতর আহত হয়ে কর্মক্ষমতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হলে আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুযায়ী তাকে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, কাজে ফেরার ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় শ্রমজীবী মানুষের অবদানের জন্যই শিল্প ও কৃষি বিপ্লব হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত আমাদের দেশের শ্রমিকরা কাজে দক্ষ ও মেধাবী। কিন্তু তাদের সব ক্ষেত্রে তাদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন কোন সময় শিল্প বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। প্রকৃত পক্ষে আমাদের দেশের মালিক শ্রমিকদের মধ্যে এখনো প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক বিরাজ করছে, যা কোনোভাবেই শিল্প বিকাশের জন্য অনুকূল বা সহায়ক নয়। শ্রমিকদের আস্থায় নিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে যেভাবে শিল্প বিকশিত হয়েছে আমাদের দেশেও সেভাবে শিল্পের বিকাশ সম্ভব।

শিল্প বিকাশের পূর্ব শর্ত হলো আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুযায়ী শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদান, সর্বস্তরের শ্রমিকদের জন্য জাতীয়ভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন, শ্রমিক কর্মচারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সমকাজে সমমজুরী ও কর্ম সময় আট ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত এবং শ্রমিক কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে রেশন প্রথার মাধ্যমে নিত্যপ্রযোজনীয় দ্রব্যাদি সর্বস্তরের শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে প্রদান করা। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্প বিকাশ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এর মাধ্যমেই জাতীয় অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। তবেই শিল্প, শ্রমিক এবং দেশ ও জাতি সমৃদ্ধ হবে।

দুনিয়ার মজদুর এক হও।

[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র]