তিন দিনে সড়কে ঝরলো ৩১ প্রাণ, আহত সাড়ে ৩শ’

ঈদের ছুটির মধ্যে হাসপাতালে বেড়েছে দুর্ঘটনার রোগী। কেবল অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রেই (পঙ্গু হাসপাতাল) তিনদিনে সাড়ে তিনশ’র বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। স্বজনদের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটিয়ে এখনও ঢাকা ফিরছেন অনেকে। গত বুধবার দেশের সাত জেলায় ১৭ জন আর বৃহস্পতিবার ১০ জেলায় অন্তত ১৪ জনের প্রাণ গেছে সড়কে। এসব দুর্ঘটনায় আরও বহু মানুষ আহত হয়েছেন।

গতকালও ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে রোগীদের ভিড় দেখা গেছে। তাদের অনেকে ঢাকার বাইরে থেকেও এসেছেন। হাসপাতালের পরিচালক আবদুল গণি মোল্লা জরুরি বিভাগে আসা রোগীর তথ্য জানিয়ে বলেন, ঈদের আগের দিন সোমবার এসেছিলেন ৭৫ জন, আর মঙ্গলবার ঈদের দিন ১৪০ জন। ঈদের পরের দিন ১৪৫ জন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময় বহির্বিভাগও খোলা ছিল, সেখানেও ৪০-৫০ জন করে রোগী এসেছেন।

পরিচালক জানান, তার হাসপাতালে এবার বাইক দুর্ঘটনার রোগী কম এসেছে, বেশি এসেছে অন্য হাসপাতাল থেকে পাঠানো রোগী। ভাঙা, ফরিদপুর এবং রংপুরের হাসপাতাল থেকে পাঠিয়ে দেয়া রোগীরা ঈদের আগে আসতে পারেননি, তারা এখন আসছেন বলে জানান এই চিকিৎসক। এই রোগীদের কেউ বাইক দুর্ঘটনার শিকার, কেউ গাড়ি দুর্ঘটনায় বা অন্য কোন কারণে আহত হয়েছেন। কোন কোন রোগীর হাত-পা কেটে ফেলার মতো অবস্থাও রয়েছে বলে জানান পরিচালক।

এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ১৯ বছর বয়সী তরুণ আরিফ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার নরসিংদীর পাঁচদোনায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে তার হাত ভেঙেছে। এখন চাচার সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন চিকিৎসার জন্য। আরিফের পাশেই দেখা গেল হাতে এলবো গার্ড, পায়ে নি গার্ড পরা তরুণ সিয়াম আহমেদকে। তিনি মাঝবয়সী নাসিরুল ইসলামকে নিয়ে জরুরি বিভাগে এসেছেন।

সিয়াম জানালেন, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি বাসের পেছনে তিনি বাইক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পথচারী নাসিরুল হঠাৎই তার বাইকের সামনে এসে পড়ায় তিনি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। দুজনই পড়ে যান। এতে নাসিরের থুতনি ও ঠোঁট কেটে গেছে, হাতেও আঘাত লেগেছে। তবে হেলমেটসহ হাতে ও পায়ে নিরাপত্তা সরঞ্জাম পড়ে থাকায় সিয়াম তেমন আহত হননি। ওই বাইকেই তিনি আহত পথচারী নাসিরুলকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। হাসপাতালের তৃতীয় তলায় রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার পিকআপ চালক খোরশেদ আলম জানান, ঈদের আগের দিন বন্ধুর মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে উল্টে পড়ে ডান পা ভেঙেছে তার। স্বজনরা তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে পঙ্গু হাসপাতাল পাঠিয়ে দেন চিকিৎসকরা।

পঙ্গু হাসপাতালে আসার পর পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে শুয়ে থাকতে হচ্ছে খোরশেদকে। চিকিৎসকরা তার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খোরশেদ চাচাতো ভাই মাহতাব আলী বলেন, এইখানে বলছে অপারেশনের সিরিয়াল পাইতে সময় লাগবে। অন্য হাসপাতালে নিমু কি-না ভাবতেছি। এইহানকার এক ডাক্তার আমাগো বাড্ডার একটা হাসপাতালে বসে। ওই স্যারের লগে কথা কইছি, স্যার যদি আইজকা অপারেশন করায়, তাইলে আইজকাই হেই হাসপাতালে নিমু। খোরশেদের পাশের বিছানার রোগী রাজশাহীর ২২ বছরের ইয়ামিন অটোরিকশা দুর্ঘটনায় পা ভেঙেছেন। চিকিৎসার জন্য ইয়ামিনকে পঙ্গু হাসপাতালে এনেছেন স্বজনরা।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনেও সিরিয়াল পাওয়ার আশায় ভিড় করে আছেন রোগীরা। কক্ষের বাইরেই অর্ধশত রোগীকে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যাওয়া এক রোগী জানান, বৃহস্পতিবার তার অস্ত্রোপচারের কথা থাকলেও সিরিয়াল আসেনি এখনও। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক বলেন, গতবার ঈদে যে পরিমাণে বাইক অ্যাকসিডেন্টের রোগী ছিল, এবার সেই পরিমাণে আসেনি।

তিনি জানান ঈদের দিন ৪ থেকে ৫ জন বাইক দুর্ঘটনায় আহত রোগী পেয়েছেন, পরের দিন ২-৩ জন। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকেট ঘরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২ থেকে ৫ মের মধ্যে ৮৯ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ওই হাসপাতালে গেছেন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে আনার পর চারজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঈদের পরদিন বুধবার দেশের সাত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় যে ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের ছয়জন মোটরসাইকেল আরোহী। আর বৃহস্পতিবার ১০ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৪ জনের মধ্যে ছয়জন মোটরসাইকেল আরোহী ও চালক।

শনিবার, ০৭ মে ২০২২ , ২৩ বৈশাখ ১৪২৮ ০৪ শাওয়াল ১৪৪৩

তিন দিনে সড়কে ঝরলো ৩১ প্রাণ, আহত সাড়ে ৩শ’

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

ঈদের দীর্ঘ ছুটি শেষ, চলছে দু’দিনের সাপ্তাহিক ছুটি। রাজধানীতে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ, কিন্তু নেই সড়কে যানজট, খুব কম সংখ্যক যানবাহনের আনাগোনা, কয়েক দিনের স্বস্তির দিন আজ শেষ হচ্ছে -সোহরাব আলম

ঈদের ছুটির মধ্যে হাসপাতালে বেড়েছে দুর্ঘটনার রোগী। কেবল অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রেই (পঙ্গু হাসপাতাল) তিনদিনে সাড়ে তিনশ’র বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। স্বজনদের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটিয়ে এখনও ঢাকা ফিরছেন অনেকে। গত বুধবার দেশের সাত জেলায় ১৭ জন আর বৃহস্পতিবার ১০ জেলায় অন্তত ১৪ জনের প্রাণ গেছে সড়কে। এসব দুর্ঘটনায় আরও বহু মানুষ আহত হয়েছেন।

গতকালও ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে রোগীদের ভিড় দেখা গেছে। তাদের অনেকে ঢাকার বাইরে থেকেও এসেছেন। হাসপাতালের পরিচালক আবদুল গণি মোল্লা জরুরি বিভাগে আসা রোগীর তথ্য জানিয়ে বলেন, ঈদের আগের দিন সোমবার এসেছিলেন ৭৫ জন, আর মঙ্গলবার ঈদের দিন ১৪০ জন। ঈদের পরের দিন ১৪৫ জন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময় বহির্বিভাগও খোলা ছিল, সেখানেও ৪০-৫০ জন করে রোগী এসেছেন।

পরিচালক জানান, তার হাসপাতালে এবার বাইক দুর্ঘটনার রোগী কম এসেছে, বেশি এসেছে অন্য হাসপাতাল থেকে পাঠানো রোগী। ভাঙা, ফরিদপুর এবং রংপুরের হাসপাতাল থেকে পাঠিয়ে দেয়া রোগীরা ঈদের আগে আসতে পারেননি, তারা এখন আসছেন বলে জানান এই চিকিৎসক। এই রোগীদের কেউ বাইক দুর্ঘটনার শিকার, কেউ গাড়ি দুর্ঘটনায় বা অন্য কোন কারণে আহত হয়েছেন। কোন কোন রোগীর হাত-পা কেটে ফেলার মতো অবস্থাও রয়েছে বলে জানান পরিচালক।

এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ১৯ বছর বয়সী তরুণ আরিফ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার নরসিংদীর পাঁচদোনায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে তার হাত ভেঙেছে। এখন চাচার সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন চিকিৎসার জন্য। আরিফের পাশেই দেখা গেল হাতে এলবো গার্ড, পায়ে নি গার্ড পরা তরুণ সিয়াম আহমেদকে। তিনি মাঝবয়সী নাসিরুল ইসলামকে নিয়ে জরুরি বিভাগে এসেছেন।

সিয়াম জানালেন, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি বাসের পেছনে তিনি বাইক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পথচারী নাসিরুল হঠাৎই তার বাইকের সামনে এসে পড়ায় তিনি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। দুজনই পড়ে যান। এতে নাসিরের থুতনি ও ঠোঁট কেটে গেছে, হাতেও আঘাত লেগেছে। তবে হেলমেটসহ হাতে ও পায়ে নিরাপত্তা সরঞ্জাম পড়ে থাকায় সিয়াম তেমন আহত হননি। ওই বাইকেই তিনি আহত পথচারী নাসিরুলকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। হাসপাতালের তৃতীয় তলায় রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার পিকআপ চালক খোরশেদ আলম জানান, ঈদের আগের দিন বন্ধুর মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে উল্টে পড়ে ডান পা ভেঙেছে তার। স্বজনরা তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে পঙ্গু হাসপাতাল পাঠিয়ে দেন চিকিৎসকরা।

পঙ্গু হাসপাতালে আসার পর পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে শুয়ে থাকতে হচ্ছে খোরশেদকে। চিকিৎসকরা তার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খোরশেদ চাচাতো ভাই মাহতাব আলী বলেন, এইখানে বলছে অপারেশনের সিরিয়াল পাইতে সময় লাগবে। অন্য হাসপাতালে নিমু কি-না ভাবতেছি। এইহানকার এক ডাক্তার আমাগো বাড্ডার একটা হাসপাতালে বসে। ওই স্যারের লগে কথা কইছি, স্যার যদি আইজকা অপারেশন করায়, তাইলে আইজকাই হেই হাসপাতালে নিমু। খোরশেদের পাশের বিছানার রোগী রাজশাহীর ২২ বছরের ইয়ামিন অটোরিকশা দুর্ঘটনায় পা ভেঙেছেন। চিকিৎসার জন্য ইয়ামিনকে পঙ্গু হাসপাতালে এনেছেন স্বজনরা।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষের সামনেও সিরিয়াল পাওয়ার আশায় ভিড় করে আছেন রোগীরা। কক্ষের বাইরেই অর্ধশত রোগীকে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যাওয়া এক রোগী জানান, বৃহস্পতিবার তার অস্ত্রোপচারের কথা থাকলেও সিরিয়াল আসেনি এখনও। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক বলেন, গতবার ঈদে যে পরিমাণে বাইক অ্যাকসিডেন্টের রোগী ছিল, এবার সেই পরিমাণে আসেনি।

তিনি জানান ঈদের দিন ৪ থেকে ৫ জন বাইক দুর্ঘটনায় আহত রোগী পেয়েছেন, পরের দিন ২-৩ জন। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকেট ঘরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২ থেকে ৫ মের মধ্যে ৮৯ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ওই হাসপাতালে গেছেন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে আনার পর চারজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঈদের পরদিন বুধবার দেশের সাত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় যে ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের ছয়জন মোটরসাইকেল আরোহী। আর বৃহস্পতিবার ১০ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৪ জনের মধ্যে ছয়জন মোটরসাইকেল আরোহী ও চালক।