আইন কার জন্য

এম এ কবীর

স্বাধীনতা ও সাম্য মানুষের চিরন্তন চাওয়া। স্বাধীনতার কোন সীমা নেই, কিন্তু সীমাহীন স্বাধীনতা প্রদান করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয় না। মানুষের শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করে। যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের প্রমাণ করে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করে। এসব সুযোগ-সুবিধা সমতার ভিত্তিতে বণ্টন হলো কি না, তা শুধু আইনের মাধ্যমে নিরূপণ করা হয়। আইন মানব সমাজের দর্পণস্বরূপ। সমাজে একসঙ্গে বসবাস করার জন্য নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলা অপরিহার্য। মানব কল্যাণের স্বার্থেই নিয়মকানুন প্রয়োজন। স্বীকৃত এই নিয়মকানুনই হলো আইন। আইন ফার্সি শব্দ, যার অর্থ সুনির্দিষ্ট নীতি বা নিয়ম। আইন এর ইংরেজি প্রতিশব্দ “Law যার অর্থ ‘স্থির বা অপরিবতর্নীয় এবং সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। এরিস্টটল বলেছেন ‘সমাজের যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই হচ্ছে আইন’ (Law is the passionless reason)। অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে আইন হচ্ছে সেই সাধারণ নিয়ম, যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যা প্রয়োগ করেন।” অর্থাৎ মানব জাতির বৃহত্তর কল্যাণে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র যে সব বিধিনিষেধ প্রণয়ন করে সাধারণভাবে সেগুলোকেই আইন বলা হয়।

মন্ত্রী গেছেন একটি সভায় প্রধান অতিথি হয়ে। সেখানে ছোট খালের ওপর পাশাপাশি দুটি একই রকম ব্রিজ দেখে মন্ত্রী স্থানীয় কর্মকর্তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। কর্মকর্তা বললেন, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সরকারি নির্দেশ এসেছিল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি উচ্চশিক্ষিত। দুই ভাষাতেই তিনি সমান পারদর্শী। তাই দুটি আদেশই তিনি তামিল করেছেন। দুটি ব্রিজ বানিয়ে।

আইন তৈরি হয় জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে। সুবিধার জন্য তৈরি আইনের কারণে যদি অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায় তখন আইনে পরিবর্তনও আসে, অনেক সময় তা বাতিলও হয়ে যায়। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি মানুষের বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিকমাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদের সব সময়ই আতঙ্কে থাকতে হয়, এই বুঝি তার ওপর এই আইনের খড়গ নেমে এল। অথচ, এই আইনটি প্রণয়নের আগে অনেক আলোচনা হয়েছিল, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নানা ধরনের মতামত দিয়েছিল। মর্মান্তিক হলো, আইন প্রণয়নের সময় সেসব মতামতের সিংহভাগকেই উপেক্ষা করা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এর আগে তথ্যপ্রযুক্তি আইন নামে প্রায় একই রকম আরও একটা আইন ছিল। সেটির কয়েকটি ধারা নিয়ে খুব সমালোচনা হয়। সরকারের একাধিক মন্ত্রীও স্বীকার করেন, কিছু সমস্যা আসলেই রয়ে গেছে। সেই সমস্যা দূর করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে নতুন এই আইন। কিন্তু দেখা গেল, আগের আইনে যে ৫৭ ধারা নিয়ে এত আপত্তি, এত সমালোচনা, সেটিই কয়েকটি ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়ে গেছে নতুন আইনেও। এ নিয়েও আপত্তি উঠল। বলা হলো ৫৭ ধারা তো গেল না, বরং আরও ডিটেইলে জায়গা করে নিল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আমরা এ আইনের কারণে সমালোচিত হয়েছি, রেটিংয়ে পিছিয়ে পড়েছি। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের মুক্তসাংবাদিকতার তালিকায় আমাদের অবস্থান এ নতুন আইনের পর কয়েক ধাপ পিছিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে এমন একটা সময় এসেছে, এখন আর কাউকে কষ্ট করে কিছু প্রমাণ করতে হয় না। শুধু মুখ ফুটে দাবি করলেই হয়। কী বলা হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কে বলল- সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। সেই হত্যাকা-ের পর দীপনের বাবা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না, সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক’।

তার সেই বক্তব্য নিয়ে উপহাস করেছিলেন অনেকে। তার বক্তব্যের মূল পর্যবেক্ষণ সম্ভবত অনেকে বুঝতে পারেননি কিংবা সেটিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তিনি কেন বিচার চান না?’ ঠিক একই বিষয়ের যেন পুনরাবৃত্তি শোনা গেল দীপন হত্যাকা-ের প্রায় ৭ বছর পর। ঢাকা কলেজ এবং নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী এবং কর্মচারীদের মধ্যেকার সংঘর্ষে প্রাণ হারানো নাহিদের বাবার মুখে। নাহিদের বাবা নাদিম হোসেন গণমাধ্যমে বলেছেন নাহিদের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি মামলা করবেন না। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা অসহায় মানুষ। আমার ছেলে একটা ঘটনায় মারা গেছে। আমি চাই দোষীদের বিচার হোক। কিন্তু আমি মামলা করুম না’। যদিও নাহিদের স্ত্রী ডলি বলেছেন, ‘আমি এ ঘটনার বিচার চাই, ক্ষতিপূরণ চাই।’ একই ঘটনায় মারা গেছেন মুরসালিন নামে একজন দোকান কর্মচারী। তার ভাইও ঠিক একই কথা বলেছেন সাংবাদিকদের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সাংবাদিকরা যখন তার ভাইয়ের কাছে জানতে চান- তিনি মামলা করবেন কিনা? তখন মুরসালিনের ভাই জানান, ‘... কার নামে মামলা করব? ভাইটা কীভাবে মারা গেল, কিছুই জানলাম না। এটা শুধু ও আর আল্লাহ জানেন।’

গত এক মাসে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে মৃতের পরিবারের সদস্যদের বিচার না-চাওয়ার মনস্কতা বুক ধুকধুক করার পাশাপাশি এক বড়সড় প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। গত মাসের ২৪ তারিখ রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। সে সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতিও নিহত হন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী প্রীতির মা-ও বিচার চাননি। বলেছেন, ‘বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।’ আর গণমাধ্যম প্রীতির বাবার বক্তব্য এভাবে জানিয়েছে: ‘আমি কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না... মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই। গত পহেলা এপ্রিল রাতে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেলে স্বামীর সঙ্গে থাকা নাসরিন মারা যান। নাসরিনের স্বামীও স্ত্রী হত্যার বিচার চাননি।

প্রীতির বাবা, দীপনের বাবা, নাসরিনের স্বামী, নাহিদের বাবা কিংবা মুরসালিনের ভাই কেউই কেন বিচার চান না? ধরে নিই নাহিদের বাবা কিংবা মুরসালিনের ভাই বিচার চান না, কারণ মামলা চালিয়ে নেয়ার মতো তাদের অর্থনৈতিক সংগতি নেই। কিন্তু অন্যরা সেই ইঙ্গিত না দিলেও আরও অনেক ইঙ্গিতই দিয়েছেন। কেন এখন মানুষ আর বিচার চান না? কেউ কেউ মামলা করেই পিছিয়ে যায়, আবার কেউ কেউ আপস করতে বাধ্য হয়। আবার কেউ বিচার চাইলেও আইনের কাছে যায় না। কেন এখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি টপকে বিচার না-চাওয়ার সংস্কৃতি জোরদার হচ্ছে? কেন এই আস্থাহীনতার জায়গা? এর উত্তর হতে পারে অনেক কিছুই। মানুষ জেনে গেছে মামলা করতে এবং সেটি চালিয়ে নিতে ঘাটে ঘাটে অনেক পয়সা খরচ করতে হয়। মামলা চালাতে গিয়ে বেশির ভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর হয়ে যায়। এদেশে মামলার রায় পেতে বহু সময় লাগে। মানুষ আরও জেনে গেছে, এদেশে বিচার পেতে শুধু টাকা নয়, ক্ষমতাও লাগে। তা না-হলে উল্টো সমস্যা হয়, যেটি প্রীতির বাবার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে ন্যায়বিচার তো দূরের কথা উল্টো আরও জীবনের হুমকি তৈরি হয়। তৃতীয়ত, নাহিদ কিংবা মুরসালিনের ক্ষেত্রে মামলা কার বিরুদ্ধে করবেন সেটি তারা জানেন না। কারণ, তারা লাশ পেয়েছেন। খুনির পরিচয় জানেন না। তারপর এত কিছু পেরিয়ে ন্যায়বিচার পাবেন কিনা সেই বিষয়েও তাঁরা নিশ্চিত নন। আর দরিদ্রের জন্য এই বিচার পাওয়া অনেক দুরূহের বিষয়ও। তাই বিচার এখন মানুষ আর চায় না। আমরা এতদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি, লড়াই করেছি। বিচার নেই বলেই বেড়ে চলেছে অপরাধ- বলে এসেছি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এদেশে একজন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে যখন সাধারণ মানুষও বুঝে যায় দেশে বিচার বলতে খুব বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই, তখন বিচারের কথা না বলাই ভালো। এই যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, এটি হেলাফেলার বিষয় নয়, বরং বড় বিপদের সংকেত।

আইন জারির আগে খেয়াল রাখা দরকার, যাদের জন্য আইন জারি করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে এটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে কি না। আইন পালন করা সম্ভব কি না, তার প্রতি খেয়াল না রেখে আইন জারি, বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের চেষ্টা করলে আইনের শাসন নয়, বরং দুঃশাসনের রাজ কায়েম হয়।

যাবতীয় আইন, নীতি, নির্দেশনা ও প্রজ্ঞাপন জারির ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার, মানুষ আইনের জন্য নয়, বরং আইন মানুষের জন্য। তবেই ভেদাভেদহীন সুখী সমৃদ্ধ পারস্পরিক সহমর্মিতার সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

শনিবার, ০৭ মে ২০২২ , ২৩ বৈশাখ ১৪২৮ ০৪ শাওয়াল ১৪৪৩

আইন কার জন্য

এম এ কবীর

স্বাধীনতা ও সাম্য মানুষের চিরন্তন চাওয়া। স্বাধীনতার কোন সীমা নেই, কিন্তু সীমাহীন স্বাধীনতা প্রদান করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয় না। মানুষের শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করে। যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের প্রমাণ করে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করে। এসব সুযোগ-সুবিধা সমতার ভিত্তিতে বণ্টন হলো কি না, তা শুধু আইনের মাধ্যমে নিরূপণ করা হয়। আইন মানব সমাজের দর্পণস্বরূপ। সমাজে একসঙ্গে বসবাস করার জন্য নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলা অপরিহার্য। মানব কল্যাণের স্বার্থেই নিয়মকানুন প্রয়োজন। স্বীকৃত এই নিয়মকানুনই হলো আইন। আইন ফার্সি শব্দ, যার অর্থ সুনির্দিষ্ট নীতি বা নিয়ম। আইন এর ইংরেজি প্রতিশব্দ “Law যার অর্থ ‘স্থির বা অপরিবতর্নীয় এবং সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। এরিস্টটল বলেছেন ‘সমাজের যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই হচ্ছে আইন’ (Law is the passionless reason)। অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে আইন হচ্ছে সেই সাধারণ নিয়ম, যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যা প্রয়োগ করেন।” অর্থাৎ মানব জাতির বৃহত্তর কল্যাণে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র যে সব বিধিনিষেধ প্রণয়ন করে সাধারণভাবে সেগুলোকেই আইন বলা হয়।

মন্ত্রী গেছেন একটি সভায় প্রধান অতিথি হয়ে। সেখানে ছোট খালের ওপর পাশাপাশি দুটি একই রকম ব্রিজ দেখে মন্ত্রী স্থানীয় কর্মকর্তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। কর্মকর্তা বললেন, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সরকারি নির্দেশ এসেছিল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি উচ্চশিক্ষিত। দুই ভাষাতেই তিনি সমান পারদর্শী। তাই দুটি আদেশই তিনি তামিল করেছেন। দুটি ব্রিজ বানিয়ে।

আইন তৈরি হয় জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে। সুবিধার জন্য তৈরি আইনের কারণে যদি অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায় তখন আইনে পরিবর্তনও আসে, অনেক সময় তা বাতিলও হয়ে যায়। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি মানুষের বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিকমাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদের সব সময়ই আতঙ্কে থাকতে হয়, এই বুঝি তার ওপর এই আইনের খড়গ নেমে এল। অথচ, এই আইনটি প্রণয়নের আগে অনেক আলোচনা হয়েছিল, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নানা ধরনের মতামত দিয়েছিল। মর্মান্তিক হলো, আইন প্রণয়নের সময় সেসব মতামতের সিংহভাগকেই উপেক্ষা করা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এর আগে তথ্যপ্রযুক্তি আইন নামে প্রায় একই রকম আরও একটা আইন ছিল। সেটির কয়েকটি ধারা নিয়ে খুব সমালোচনা হয়। সরকারের একাধিক মন্ত্রীও স্বীকার করেন, কিছু সমস্যা আসলেই রয়ে গেছে। সেই সমস্যা দূর করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে নতুন এই আইন। কিন্তু দেখা গেল, আগের আইনে যে ৫৭ ধারা নিয়ে এত আপত্তি, এত সমালোচনা, সেটিই কয়েকটি ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়ে গেছে নতুন আইনেও। এ নিয়েও আপত্তি উঠল। বলা হলো ৫৭ ধারা তো গেল না, বরং আরও ডিটেইলে জায়গা করে নিল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আমরা এ আইনের কারণে সমালোচিত হয়েছি, রেটিংয়ে পিছিয়ে পড়েছি। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের মুক্তসাংবাদিকতার তালিকায় আমাদের অবস্থান এ নতুন আইনের পর কয়েক ধাপ পিছিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে এমন একটা সময় এসেছে, এখন আর কাউকে কষ্ট করে কিছু প্রমাণ করতে হয় না। শুধু মুখ ফুটে দাবি করলেই হয়। কী বলা হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কে বলল- সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। সেই হত্যাকা-ের পর দীপনের বাবা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না, সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক’।

তার সেই বক্তব্য নিয়ে উপহাস করেছিলেন অনেকে। তার বক্তব্যের মূল পর্যবেক্ষণ সম্ভবত অনেকে বুঝতে পারেননি কিংবা সেটিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তিনি কেন বিচার চান না?’ ঠিক একই বিষয়ের যেন পুনরাবৃত্তি শোনা গেল দীপন হত্যাকা-ের প্রায় ৭ বছর পর। ঢাকা কলেজ এবং নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী এবং কর্মচারীদের মধ্যেকার সংঘর্ষে প্রাণ হারানো নাহিদের বাবার মুখে। নাহিদের বাবা নাদিম হোসেন গণমাধ্যমে বলেছেন নাহিদের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি মামলা করবেন না। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা অসহায় মানুষ। আমার ছেলে একটা ঘটনায় মারা গেছে। আমি চাই দোষীদের বিচার হোক। কিন্তু আমি মামলা করুম না’। যদিও নাহিদের স্ত্রী ডলি বলেছেন, ‘আমি এ ঘটনার বিচার চাই, ক্ষতিপূরণ চাই।’ একই ঘটনায় মারা গেছেন মুরসালিন নামে একজন দোকান কর্মচারী। তার ভাইও ঠিক একই কথা বলেছেন সাংবাদিকদের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সাংবাদিকরা যখন তার ভাইয়ের কাছে জানতে চান- তিনি মামলা করবেন কিনা? তখন মুরসালিনের ভাই জানান, ‘... কার নামে মামলা করব? ভাইটা কীভাবে মারা গেল, কিছুই জানলাম না। এটা শুধু ও আর আল্লাহ জানেন।’

গত এক মাসে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে মৃতের পরিবারের সদস্যদের বিচার না-চাওয়ার মনস্কতা বুক ধুকধুক করার পাশাপাশি এক বড়সড় প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। গত মাসের ২৪ তারিখ রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। সে সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতিও নিহত হন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী প্রীতির মা-ও বিচার চাননি। বলেছেন, ‘বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।’ আর গণমাধ্যম প্রীতির বাবার বক্তব্য এভাবে জানিয়েছে: ‘আমি কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না... মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই। গত পহেলা এপ্রিল রাতে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেলে স্বামীর সঙ্গে থাকা নাসরিন মারা যান। নাসরিনের স্বামীও স্ত্রী হত্যার বিচার চাননি।

প্রীতির বাবা, দীপনের বাবা, নাসরিনের স্বামী, নাহিদের বাবা কিংবা মুরসালিনের ভাই কেউই কেন বিচার চান না? ধরে নিই নাহিদের বাবা কিংবা মুরসালিনের ভাই বিচার চান না, কারণ মামলা চালিয়ে নেয়ার মতো তাদের অর্থনৈতিক সংগতি নেই। কিন্তু অন্যরা সেই ইঙ্গিত না দিলেও আরও অনেক ইঙ্গিতই দিয়েছেন। কেন এখন মানুষ আর বিচার চান না? কেউ কেউ মামলা করেই পিছিয়ে যায়, আবার কেউ কেউ আপস করতে বাধ্য হয়। আবার কেউ বিচার চাইলেও আইনের কাছে যায় না। কেন এখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি টপকে বিচার না-চাওয়ার সংস্কৃতি জোরদার হচ্ছে? কেন এই আস্থাহীনতার জায়গা? এর উত্তর হতে পারে অনেক কিছুই। মানুষ জেনে গেছে মামলা করতে এবং সেটি চালিয়ে নিতে ঘাটে ঘাটে অনেক পয়সা খরচ করতে হয়। মামলা চালাতে গিয়ে বেশির ভাগই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর হয়ে যায়। এদেশে মামলার রায় পেতে বহু সময় লাগে। মানুষ আরও জেনে গেছে, এদেশে বিচার পেতে শুধু টাকা নয়, ক্ষমতাও লাগে। তা না-হলে উল্টো সমস্যা হয়, যেটি প্রীতির বাবার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে ন্যায়বিচার তো দূরের কথা উল্টো আরও জীবনের হুমকি তৈরি হয়। তৃতীয়ত, নাহিদ কিংবা মুরসালিনের ক্ষেত্রে মামলা কার বিরুদ্ধে করবেন সেটি তারা জানেন না। কারণ, তারা লাশ পেয়েছেন। খুনির পরিচয় জানেন না। তারপর এত কিছু পেরিয়ে ন্যায়বিচার পাবেন কিনা সেই বিষয়েও তাঁরা নিশ্চিত নন। আর দরিদ্রের জন্য এই বিচার পাওয়া অনেক দুরূহের বিষয়ও। তাই বিচার এখন মানুষ আর চায় না। আমরা এতদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি, লড়াই করেছি। বিচার নেই বলেই বেড়ে চলেছে অপরাধ- বলে এসেছি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এদেশে একজন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে যখন সাধারণ মানুষও বুঝে যায় দেশে বিচার বলতে খুব বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই, তখন বিচারের কথা না বলাই ভালো। এই যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, এটি হেলাফেলার বিষয় নয়, বরং বড় বিপদের সংকেত।

আইন জারির আগে খেয়াল রাখা দরকার, যাদের জন্য আইন জারি করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে এটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে কি না। আইন পালন করা সম্ভব কি না, তার প্রতি খেয়াল না রেখে আইন জারি, বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের চেষ্টা করলে আইনের শাসন নয়, বরং দুঃশাসনের রাজ কায়েম হয়।

যাবতীয় আইন, নীতি, নির্দেশনা ও প্রজ্ঞাপন জারির ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার, মানুষ আইনের জন্য নয়, বরং আইন মানুষের জন্য। তবেই ভেদাভেদহীন সুখী সমৃদ্ধ পারস্পরিক সহমর্মিতার সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]