রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, হুমকিতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা

এনবিআরের পৌষ মাস, ভোক্তার সর্বনাশ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের জ্বালানি খাতেও পড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আর বিশ্ব বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে আমদানিকৃত জ্বালানিতে অনেক বেশি রাজস্ব বা শুল্ক (আমদানি শুল্ক) পাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। হিসাবে দেখা যাচ্ছে আগের চেয়ে প্রায় তিনগুণ শুল্ক দিতে হচ্ছে।

আগে প্রতি টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করা হতো ২৫০ মার্কিন ডলারে, যা এখন ৭০০ মার্কিন ডলার। আগেও ৩০ শতাংশ ডিউটি নেয়া হতো, এখনও ৩০ শতাংশই নেয়া হচ্ছে। ফলে ৭০০ ডলারের ওপর ডিউটি দাঁড়াচ্ছে ২১০ ডলার। যা আগের ডিউটির চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।

এনবিআরের এই অতিরিক্ত আয় এখন জ্বালানি খাতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’, শেষ পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের ঘাড়েই পড়বে বলে মনে করছে ভোক্তা সংগঠনগুলো।

দেশে চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করছে। আমদানি করা হচ্ছে ফার্নেস তেল, ডিজেল, এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস)।

রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে ডিজেল, এলএনজি, এলপিজিসহ জ্বালানি পণ্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে, তবে টাকা দিয়েও জ্বালানি আমদানি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকদের মতে, রুবলে দাম পরিশোধ করতে রাজি না হওয়ায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। এখন দেশটি (রাশিয়া) যদি ইউরোপের অন্যান্য দেশেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে নিশ্চিতভাবে এই সংকটের ধাক্কা লাগবে বৈশ্বিক এলএনজির বাজারে। অল্প কিছু দেশ যারা এলএনজি সরবরাহ করে, ইউরোপ চেষ্টা করবে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে। ফলে এলএনজি নিয়ে তৈরি হবে মহাসংকট।

এ ঘটনা বাংলাদেশের জন্যও বড় দুশ্চিন্তার কারণ। কেননা বাংলাদেশ কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে। ইউরোপের অনেক দেশ এখন কাতার থেকে এলএনজি সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এ কারণে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম হবে আকাশচুম্বী। হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কারণে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানিও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে গ্যাসের সংকট চলছে। শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা পূরণে সরকার ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে। এখন কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করা হয়, আবার স্পট মার্কেট থেকেও সংগ্রহ করা হয়। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন এখন যে অবস্থায় আছে তাতে কোন কারণে এলএনজি আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অধিকাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া গ্যাসের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলা শিল্প-কারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এ বিষয়ে সংবাদকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ এখন এলএনজি সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে এলএনজির দাম অনেক বাড়বে। অনেক দেশ বাড়তি দাম দিয়ে জ্বালানি সংগ্রহ করবে। তবে এমন অবস্থা দাঁড়াতে পারে যে, টাকা হলেই সবাই এলএনজি সংগ্রহ করতে পারবে না।’

এনবিআরের শুল্ক প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বিপু বলেন, ‘তারা (এনবিআর) যেভাবে ডিউটি, ভ্যাট, ট্যাক্স ধরে; সেটা আসলে রিভাইজ (সংশোধন) করা উচিত।’

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘টনপ্রতি ডিউটি, ভ্যাট, ট্যাক্স নিলে সহনীয় হতো। আমদানিকৃত মূল্যের ওপর শতকরা হারে ডিউটি হওয়ায়, আমদানিমূল যখন অনেক বেড়ে যায়, ডিউটি-ভ্যাট-ট্যাক্সও বেড়ে যায়। ফলে জ্বালানি বিভাগকে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ জ্বালানি কেনা, ডিউটি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ পরিশোধ করতে হয়। ফলে সরকারের ভর্তুকি বাড়ে। সর্বশেষ মূল্য পরিশোধ করতে হয় সাধারণ মানুষকেই।’

মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে বসবে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বিপু বলেন, ‘এনবিআরের উচিত আমদানি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শুল্ক আদায় করা। তারা কোন কোন পণ্যে কয়েক দফা ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। এখন এলএনজি অনেক বেশি দামে সংগ্রহ করে দেশে সরবরাহ করতে হচ্ছে। ফলে এখানে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া দরকার।’

এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এনবিআরকে আমদানির ক্ষেত্রে জ্বালানি মূল্যে ডিউটি, ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে তার প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত গড়াবে। ডিজেলের দাম বেড়ে গেলে কৃষিতে সেচের খরচ বাড়বে, যার প্রভাব ধান-চালের মূল্যে পড়বে। পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে, এতে পণ্য সরবরাহে খরচ বাড়বে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

রবিবার, ০৮ মে ২০২২ , ২৪ বৈশাখ ১৪২৮ ০৫ শাওয়াল ১৪৪৩

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, হুমকিতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা

এনবিআরের পৌষ মাস, ভোক্তার সর্বনাশ

ফয়েজ আহমেদ তুষার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের জ্বালানি খাতেও পড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আর বিশ্ব বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে আমদানিকৃত জ্বালানিতে অনেক বেশি রাজস্ব বা শুল্ক (আমদানি শুল্ক) পাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। হিসাবে দেখা যাচ্ছে আগের চেয়ে প্রায় তিনগুণ শুল্ক দিতে হচ্ছে।

আগে প্রতি টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করা হতো ২৫০ মার্কিন ডলারে, যা এখন ৭০০ মার্কিন ডলার। আগেও ৩০ শতাংশ ডিউটি নেয়া হতো, এখনও ৩০ শতাংশই নেয়া হচ্ছে। ফলে ৭০০ ডলারের ওপর ডিউটি দাঁড়াচ্ছে ২১০ ডলার। যা আগের ডিউটির চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।

এনবিআরের এই অতিরিক্ত আয় এখন জ্বালানি খাতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’, শেষ পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের ঘাড়েই পড়বে বলে মনে করছে ভোক্তা সংগঠনগুলো।

দেশে চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করছে। আমদানি করা হচ্ছে ফার্নেস তেল, ডিজেল, এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস)।

রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে ডিজেল, এলএনজি, এলপিজিসহ জ্বালানি পণ্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে, তবে টাকা দিয়েও জ্বালানি আমদানি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকদের মতে, রুবলে দাম পরিশোধ করতে রাজি না হওয়ায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। এখন দেশটি (রাশিয়া) যদি ইউরোপের অন্যান্য দেশেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে নিশ্চিতভাবে এই সংকটের ধাক্কা লাগবে বৈশ্বিক এলএনজির বাজারে। অল্প কিছু দেশ যারা এলএনজি সরবরাহ করে, ইউরোপ চেষ্টা করবে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে। ফলে এলএনজি নিয়ে তৈরি হবে মহাসংকট।

এ ঘটনা বাংলাদেশের জন্যও বড় দুশ্চিন্তার কারণ। কেননা বাংলাদেশ কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে। ইউরোপের অনেক দেশ এখন কাতার থেকে এলএনজি সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এ কারণে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম হবে আকাশচুম্বী। হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কারণে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানিও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে গ্যাসের সংকট চলছে। শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা পূরণে সরকার ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে। এখন কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করা হয়, আবার স্পট মার্কেট থেকেও সংগ্রহ করা হয়। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন এখন যে অবস্থায় আছে তাতে কোন কারণে এলএনজি আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অধিকাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া গ্যাসের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলা শিল্প-কারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এ বিষয়ে সংবাদকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ এখন এলএনজি সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে এলএনজির দাম অনেক বাড়বে। অনেক দেশ বাড়তি দাম দিয়ে জ্বালানি সংগ্রহ করবে। তবে এমন অবস্থা দাঁড়াতে পারে যে, টাকা হলেই সবাই এলএনজি সংগ্রহ করতে পারবে না।’

এনবিআরের শুল্ক প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বিপু বলেন, ‘তারা (এনবিআর) যেভাবে ডিউটি, ভ্যাট, ট্যাক্স ধরে; সেটা আসলে রিভাইজ (সংশোধন) করা উচিত।’

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘টনপ্রতি ডিউটি, ভ্যাট, ট্যাক্স নিলে সহনীয় হতো। আমদানিকৃত মূল্যের ওপর শতকরা হারে ডিউটি হওয়ায়, আমদানিমূল যখন অনেক বেড়ে যায়, ডিউটি-ভ্যাট-ট্যাক্সও বেড়ে যায়। ফলে জ্বালানি বিভাগকে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ জ্বালানি কেনা, ডিউটি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ পরিশোধ করতে হয়। ফলে সরকারের ভর্তুকি বাড়ে। সর্বশেষ মূল্য পরিশোধ করতে হয় সাধারণ মানুষকেই।’

মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে বসবে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বিপু বলেন, ‘এনবিআরের উচিত আমদানি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শুল্ক আদায় করা। তারা কোন কোন পণ্যে কয়েক দফা ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। এখন এলএনজি অনেক বেশি দামে সংগ্রহ করে দেশে সরবরাহ করতে হচ্ছে। ফলে এখানে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া দরকার।’

এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এনবিআরকে আমদানির ক্ষেত্রে জ্বালানি মূল্যে ডিউটি, ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে তার প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত গড়াবে। ডিজেলের দাম বেড়ে গেলে কৃষিতে সেচের খরচ বাড়বে, যার প্রভাব ধান-চালের মূল্যে পড়বে। পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে, এতে পণ্য সরবরাহে খরচ বাড়বে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।