বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ নিয়ে ৭৪ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনী দুর্নীতিতে জড়িত বলে দাবি করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্নীতি, নিপীড়ন ও হত্যার তদন্ত এবং অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। রিপোর্টে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, বাক্সভর্তি জাল ভোট, বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের কথা রয়েছে। ২০২১ সনের ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এই রিপোর্টে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ আরও যেসব বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, তা হলো- বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, কারাগারে জীবননাশের বিরাজমান হুমকি, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর নজরদারি, একজনের অপরাধে পরিবারের অন্য সদস্যকে হয়রানি করা ইত্যাদি। বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, শিশু নির্যাতন, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সহিংসতার হুমকি, সমকামীদের অধিকার সুরক্ষার পথে প্রতিবন্ধক আইনের অস্তিত্ব বা ব্যবহার, শরণার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার কথাও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতি বছর বিশ্বের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এ বছর রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্টে সব সরকারের আমলে ঘুরেফিরে এই কথাগুলোই ওঠে আসে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকার এই সব অভিযোগ স্বীকার করেনি, বাস্তবতা বিবর্জিত বলে রিপোর্টের বক্তব্য নাকচ করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও ২০২১ সনের রিপোর্টের বক্তব্যকে এই মর্মে নাকচ করেছে, যাদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে তাদের ‘পলিটিক্যাল এজেন্ডা’ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের এমন যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ তথ্য-উপাত্তের উৎসের চেয়ে তার সত্যতা আমেরিকার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ, দুর্যোগপ্রবণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সরকার স্বীকার করে না যে, দেশে সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নেই, সুশাসনের অভাব রয়েছে, ক্রসফায়ারে নিরপরাধ মানুষও মরছে, ডিজিটাল আইন ব্লাসফেমি আইনের মতো ধর্মান্ধদের উজ্জীবিত করছে, ভোটাধিকার প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ে চাপ আসতে পারে, সাহায্য-সহযোগিতা সংকুচিত হতে পারে, আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের গুরুত্ব কমে যেতে পারে। ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘিত হওয়ার খবর প্রচারিত হলে তা বাংলাদেশের ইমেজের জন্য অনুকূলও হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর রিপোর্টে বলছে, বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ন্যাস্ত। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানও প্রধানমন্ত্রীকে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও অফুরন্ত ক্ষমতা। সংবিধান বা বিধি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা না থাকলেও সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাঁধেই চাপানো হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় স¦ মন্ত্রী তাদের মন্ত্রণালয়ের সাধারণ কাজের ক্ষেত্রেও বলে থাকেন, ‘এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী দেখছেন’। দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র কোন ভালো ইমেজ নেই, দলীয় নেতা বা নেত্রীর ইমেজে দল চলে। এই কারণে দলীয় প্রধানের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিপক্ষে কথা বলার শক্তিও অন্য কোন নেতার থাকে না। শুনেছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তৎকালীন আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিতর্কে জড়াতেন, যুক্তিযুক্ত হলে বঙ্গবন্ধু তাদের মতামত মেনে নিতেন, কিন্তু এখন কি কোন দলীয় প্রধানের সঙ্গে দলের অন্য কোন নেতা বিতর্ক করার সাহস রাখেন? দলীয় নেতার ইমেজ দিয়ে দলের ভাবমূর্তি গড়ে উঠে বিধায় সব সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ইগনোর করার কোন উপায় থাকে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট মেনে সমকামীদের প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী আইন প্রণয়ন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয়া সম্ভব নয়। ভাসানচর থেকে পালানোর সময় সমুদ্রে ডুবে শরণার্থী মারা যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দায়ী করাও ঠিক নয়। সমকামী সম্পর্কিত বিষয়টি আমাদের ধর্ম পরিপন্থি, আর রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয়া হলে তা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। গুম হওয়ার বিষয়টি যে কোন সরকারের জন্য কলঙ্কজনক। দেশের একজন নাগরিক গুম হয়ে যাওয়ার পর তাকে খুঁজে বের করার দৃশ্যমান তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দেখা না গেলেই জনগণ গুমের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে থাকে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সব সরকারের আমলেই হয়েছে এবং বিএনপির আমলেও হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বিচার প্রার্থীদের এত বেশি হতাশাগ্রস্ত করে তোলে যে, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকেও সমর্থন করে হতাশার বিষাদ থেকে মুক্তি পেতে চায়। জনসম্মুখে সংঘটিত অপরাধের কোন প্রতিকার হয় না, অপরাধীর বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী হতে সাহস করে না, দুর্নীতির আড়ালে বিকৃত হয়ে যায় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, চার্জশিটের স্থলে হয়ে যায় মামলা খারিজের ফাইনাল রিপোর্ট, জামিনে মুক্ত হয়ে আসার পর অপরাধীর অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়- এতগুলো অনিয়ম যখন নিয়মে পর্যবসিত হয় তখন সমাজের নিরীহ মানুষগুলোর পক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- পছন্দ না করে উপায় থাকে না। তবে নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও নিষ্ঠুর শাস্তি সংবিধান রহিত করলেও আটক অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদে মারাত্মক শারীরিক নির্যাতন করা হয়; কারণ, শারীরিক নির্যাতনই আমাদের দেশে অপরাধীর অপরাধ স্বীকার করানোর মূল অস্ত্র।

সুশাসনের অভাবে জবাবদিহিতাও নেই। জবাবদিহিতা না থাকায় দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি দেশ বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বোঝা কাঁধে নিয়ে ক্ষমতা হারায়। বিচারহীনতার কোন প্রতিকার নেই। সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় না এলে কোন সরকারেরই নৈতিক মনোবল অটুট থাকে না। বিগত নির্বাচনে ভোটের বাক্সে ভোটের পূর্ব রাতে ব্যালটপেপার ঢুকানোর কাহিনী তো লুকানো যায়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের জেতার সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনাকে অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বিএনপির অনেক ব্যর্থতা এবং আগুন সন্ত্রাসের বদনাম থাকা সত্ত্বেও তাদের দলের জাঁদরেল নেতাদের ভোটে জামানত হারানোর কথা ছিল না, জনগণকে তা বিশ্বাস করানো যাবে না। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের অর্বাচিন আচরণে জনগণ আওয়ামী লীগের প্রতিও বিরক্ত হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয় লাভ করে ক্ষমতায় থাকার মধ্যে তৃপ্তি ও সাহস থাকে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কোন বড় নেতার গ্রহণযোগ্য ইমেজ নেই। বিরোধী দলের অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য জবাব দেয়ার অক্ষমতা বড় বড় নেতাকে আওয়ামী লীগের জন্য অনুপযুক্ত রূপে প্রতিভাত করে তুলেছে।

সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ বিচার-বিশ্লেষণ না করেই অস্বীকার বা নাকচ করার বাতিক কোন সরকার পরিহার করতে পারেনি। রিপোর্ট নাকচ করে দেশের জনগণের কাছে ইমেজ রক্ষার চেষ্টা করা হলেও বহির্বিশ্বের সবাইকে তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা যাবে না। মানবাধিকারের অহরহ লঙ্ঘন হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে সম্প্রতি আফ্রিকার তিন দেশ ইথিওপিয়া, মালি ও গিনির শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০৪১ সনে আমাদের দেশ উন্নত দেশের পর্যায়ভুক্ত হবে- এমন মিশন-ভিশন সফল করতে হলে সর্বপ্রথম দেশের ইমেজ বা ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা অপরিহার্য।

যুক্তরাষ্ট্রের এই রিপোর্টে সাধারণত তাদের দেশের প্রতি বৈরী দেশগুলোর তীব্র সমালোচনা করা হয় বলে চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবা প্রভৃতি দেশে এই রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই নেই। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে প্রতি বছর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাই চীন মনে করে, অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির নিন্দা করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই। সাংবাদিক জামাল খাসোগীকে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতর করাত দিয়ে টুকরো টুকরো কাটার পরও সৌদি আরব মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়নি, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তখন মানবাধিকারের চেয়ে সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, গুয়ান্তামোবেতে বন্দীদের নির্যাতন নিয়ে সারা বিশ্বে শোরগোল হলেও যুক্তরাষ্ট্র নিরব। বাংলাদেশ সরকার সহসা এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি যার জন্য বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে, রিপোর্টে যা যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা তা অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থানও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুনজরে বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না। ভারতকে এড়িয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতার ওপরও যুক্তরাষ্ট্রের নজর পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদদে প্রতিষ্ঠিত র‌্যাব জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও হঠাৎ তারা আমেরিকার রোষানলে পড়ার কারণ বাংলাদেশকে রাজনৈতিক চাপে রাখার কৌশলও হতে পারে।

আমেরিকা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে, আমেরিকার পরিকল্পনার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্ত হলে সমূহ বিপদ। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কর্মকা- তুলে ধরার জন্য বিএনপি পয়সা খরচ করে লবিস্ট বা দালাল নিয়োগ দিয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারই আমেরিকার রোষানল থেকে বাঁচার জন্য লবিস্ট রেখেছে- দুটোতেই আমেরিকা লাভবান হচ্ছে। তবে লবিস্ট নিয়োগ না দিয়েও আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করা যাবে যদি সরকার তাদের কথা শোনে; নতুবা স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করেও ক্ষমতায় আসা ও টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। স্বস্তির বিষয় হলো, সরকার নানা কথা বলার পর শেষ পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট আমলে নিয়েছে এবং উত্থাপিত অভিযোগগুলোর নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়নের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মেও যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তবে আমেরিকা ও ইউরোপ রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাই পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরেকটু বেশি কৌশলী হতে হবে, জনতাকে তুষ্ট করার জনপ্রিয় সস্তা কথা না বলে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নেয়া শ্রেয় হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ০৮ মে ২০২২ , ২৪ বৈশাখ ১৪২৮ ০৫ শাওয়াল ১৪৪৩

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ নিয়ে ৭৪ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনী দুর্নীতিতে জড়িত বলে দাবি করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্নীতি, নিপীড়ন ও হত্যার তদন্ত এবং অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। রিপোর্টে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, বাক্সভর্তি জাল ভোট, বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের কথা রয়েছে। ২০২১ সনের ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এই রিপোর্টে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ আরও যেসব বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, তা হলো- বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, কারাগারে জীবননাশের বিরাজমান হুমকি, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর নজরদারি, একজনের অপরাধে পরিবারের অন্য সদস্যকে হয়রানি করা ইত্যাদি। বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, শিশু নির্যাতন, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সহিংসতার হুমকি, সমকামীদের অধিকার সুরক্ষার পথে প্রতিবন্ধক আইনের অস্তিত্ব বা ব্যবহার, শরণার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার কথাও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতি বছর বিশ্বের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এ বছর রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্টে সব সরকারের আমলে ঘুরেফিরে এই কথাগুলোই ওঠে আসে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকার এই সব অভিযোগ স্বীকার করেনি, বাস্তবতা বিবর্জিত বলে রিপোর্টের বক্তব্য নাকচ করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও ২০২১ সনের রিপোর্টের বক্তব্যকে এই মর্মে নাকচ করেছে, যাদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে তাদের ‘পলিটিক্যাল এজেন্ডা’ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের এমন যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ তথ্য-উপাত্তের উৎসের চেয়ে তার সত্যতা আমেরিকার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ, দুর্যোগপ্রবণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সরকার স্বীকার করে না যে, দেশে সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নেই, সুশাসনের অভাব রয়েছে, ক্রসফায়ারে নিরপরাধ মানুষও মরছে, ডিজিটাল আইন ব্লাসফেমি আইনের মতো ধর্মান্ধদের উজ্জীবিত করছে, ভোটাধিকার প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ে চাপ আসতে পারে, সাহায্য-সহযোগিতা সংকুচিত হতে পারে, আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের গুরুত্ব কমে যেতে পারে। ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘিত হওয়ার খবর প্রচারিত হলে তা বাংলাদেশের ইমেজের জন্য অনুকূলও হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর রিপোর্টে বলছে, বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ন্যাস্ত। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানও প্রধানমন্ত্রীকে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও অফুরন্ত ক্ষমতা। সংবিধান বা বিধি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা না থাকলেও সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাঁধেই চাপানো হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় স¦ মন্ত্রী তাদের মন্ত্রণালয়ের সাধারণ কাজের ক্ষেত্রেও বলে থাকেন, ‘এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী দেখছেন’। দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র কোন ভালো ইমেজ নেই, দলীয় নেতা বা নেত্রীর ইমেজে দল চলে। এই কারণে দলীয় প্রধানের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিপক্ষে কথা বলার শক্তিও অন্য কোন নেতার থাকে না। শুনেছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তৎকালীন আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিতর্কে জড়াতেন, যুক্তিযুক্ত হলে বঙ্গবন্ধু তাদের মতামত মেনে নিতেন, কিন্তু এখন কি কোন দলীয় প্রধানের সঙ্গে দলের অন্য কোন নেতা বিতর্ক করার সাহস রাখেন? দলীয় নেতার ইমেজ দিয়ে দলের ভাবমূর্তি গড়ে উঠে বিধায় সব সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ইগনোর করার কোন উপায় থাকে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট মেনে সমকামীদের প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী আইন প্রণয়ন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয়া সম্ভব নয়। ভাসানচর থেকে পালানোর সময় সমুদ্রে ডুবে শরণার্থী মারা যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দায়ী করাও ঠিক নয়। সমকামী সম্পর্কিত বিষয়টি আমাদের ধর্ম পরিপন্থি, আর রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয়া হলে তা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। গুম হওয়ার বিষয়টি যে কোন সরকারের জন্য কলঙ্কজনক। দেশের একজন নাগরিক গুম হয়ে যাওয়ার পর তাকে খুঁজে বের করার দৃশ্যমান তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দেখা না গেলেই জনগণ গুমের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে থাকে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সব সরকারের আমলেই হয়েছে এবং বিএনপির আমলেও হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বিচার প্রার্থীদের এত বেশি হতাশাগ্রস্ত করে তোলে যে, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকেও সমর্থন করে হতাশার বিষাদ থেকে মুক্তি পেতে চায়। জনসম্মুখে সংঘটিত অপরাধের কোন প্রতিকার হয় না, অপরাধীর বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী হতে সাহস করে না, দুর্নীতির আড়ালে বিকৃত হয়ে যায় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, চার্জশিটের স্থলে হয়ে যায় মামলা খারিজের ফাইনাল রিপোর্ট, জামিনে মুক্ত হয়ে আসার পর অপরাধীর অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়- এতগুলো অনিয়ম যখন নিয়মে পর্যবসিত হয় তখন সমাজের নিরীহ মানুষগুলোর পক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- পছন্দ না করে উপায় থাকে না। তবে নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও নিষ্ঠুর শাস্তি সংবিধান রহিত করলেও আটক অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদে মারাত্মক শারীরিক নির্যাতন করা হয়; কারণ, শারীরিক নির্যাতনই আমাদের দেশে অপরাধীর অপরাধ স্বীকার করানোর মূল অস্ত্র।

সুশাসনের অভাবে জবাবদিহিতাও নেই। জবাবদিহিতা না থাকায় দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি দেশ বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতি উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বোঝা কাঁধে নিয়ে ক্ষমতা হারায়। বিচারহীনতার কোন প্রতিকার নেই। সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় না এলে কোন সরকারেরই নৈতিক মনোবল অটুট থাকে না। বিগত নির্বাচনে ভোটের বাক্সে ভোটের পূর্ব রাতে ব্যালটপেপার ঢুকানোর কাহিনী তো লুকানো যায়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের জেতার সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনাকে অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বিএনপির অনেক ব্যর্থতা এবং আগুন সন্ত্রাসের বদনাম থাকা সত্ত্বেও তাদের দলের জাঁদরেল নেতাদের ভোটে জামানত হারানোর কথা ছিল না, জনগণকে তা বিশ্বাস করানো যাবে না। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের অর্বাচিন আচরণে জনগণ আওয়ামী লীগের প্রতিও বিরক্ত হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয় লাভ করে ক্ষমতায় থাকার মধ্যে তৃপ্তি ও সাহস থাকে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কোন বড় নেতার গ্রহণযোগ্য ইমেজ নেই। বিরোধী দলের অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য জবাব দেয়ার অক্ষমতা বড় বড় নেতাকে আওয়ামী লীগের জন্য অনুপযুক্ত রূপে প্রতিভাত করে তুলেছে।

সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ বিচার-বিশ্লেষণ না করেই অস্বীকার বা নাকচ করার বাতিক কোন সরকার পরিহার করতে পারেনি। রিপোর্ট নাকচ করে দেশের জনগণের কাছে ইমেজ রক্ষার চেষ্টা করা হলেও বহির্বিশ্বের সবাইকে তা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা যাবে না। মানবাধিকারের অহরহ লঙ্ঘন হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে সম্প্রতি আফ্রিকার তিন দেশ ইথিওপিয়া, মালি ও গিনির শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০৪১ সনে আমাদের দেশ উন্নত দেশের পর্যায়ভুক্ত হবে- এমন মিশন-ভিশন সফল করতে হলে সর্বপ্রথম দেশের ইমেজ বা ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা অপরিহার্য।

যুক্তরাষ্ট্রের এই রিপোর্টে সাধারণত তাদের দেশের প্রতি বৈরী দেশগুলোর তীব্র সমালোচনা করা হয় বলে চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনিজুয়েলা, কিউবা প্রভৃতি দেশে এই রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই নেই। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে প্রতি বছর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাই চীন মনে করে, অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির নিন্দা করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই। সাংবাদিক জামাল খাসোগীকে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতর করাত দিয়ে টুকরো টুকরো কাটার পরও সৌদি আরব মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়নি, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তখন মানবাধিকারের চেয়ে সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, গুয়ান্তামোবেতে বন্দীদের নির্যাতন নিয়ে সারা বিশ্বে শোরগোল হলেও যুক্তরাষ্ট্র নিরব। বাংলাদেশ সরকার সহসা এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি যার জন্য বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে, রিপোর্টে যা যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা তা অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থানও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুনজরে বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না। ভারতকে এড়িয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতার ওপরও যুক্তরাষ্ট্রের নজর পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদদে প্রতিষ্ঠিত র‌্যাব জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও হঠাৎ তারা আমেরিকার রোষানলে পড়ার কারণ বাংলাদেশকে রাজনৈতিক চাপে রাখার কৌশলও হতে পারে।

আমেরিকা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে, আমেরিকার পরিকল্পনার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্ত হলে সমূহ বিপদ। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কর্মকা- তুলে ধরার জন্য বিএনপি পয়সা খরচ করে লবিস্ট বা দালাল নিয়োগ দিয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারই আমেরিকার রোষানল থেকে বাঁচার জন্য লবিস্ট রেখেছে- দুটোতেই আমেরিকা লাভবান হচ্ছে। তবে লবিস্ট নিয়োগ না দিয়েও আমেরিকাকে সন্তুষ্ট করা যাবে যদি সরকার তাদের কথা শোনে; নতুবা স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করেও ক্ষমতায় আসা ও টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। স্বস্তির বিষয় হলো, সরকার নানা কথা বলার পর শেষ পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট আমলে নিয়েছে এবং উত্থাপিত অভিযোগগুলোর নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়নের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মেও যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তবে আমেরিকা ও ইউরোপ রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাই পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরেকটু বেশি কৌশলী হতে হবে, জনতাকে তুষ্ট করার জনপ্রিয় সস্তা কথা না বলে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নেয়া শ্রেয় হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]