ভোজ্যতেলের সংকট : মুক্তি কোন পথে

মাজহার মান্নান

ভোজ্যতেলের অতিমাত্রায় দাম বৃদ্ধিতে নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে চরম হতাশা। দেশের সাধারণ এবং গরিব মানুষেরা আন্তর্জাতিক বাজার বুঝে না, তারা কত মূল্যে পণ্যটি পাচ্ছে সেটা নিয়েই তাদের যত মাথা ব্যথ্যা। গত দুই বছের করোনায় বহু মানুষ আর্থিক দীনতার শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। সর্বশেষ সয়াবিন তেলের অসহনীয় দাম সাধারণ ভোক্তাদের চরম বিপাকে ফেলেছে। এক লাফে প্রতি লিটার সয়াবিনে ৪০ টাকা বেড়ে গেলো এবং কেজিপ্রতি ধার্য হলো ১৯৮ টাকা। চারজন সদস্যের একটি পরিবারে মাসে ৬ থেকে ৭ লিটার তেল প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে ওই পরিবারকে তেল বাবদ মাসে খরচ করতে হবে প্রায় ১৪০০ টাকা। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামে এমনিতেই টালমাটাল অবস্থা, তার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পাম তেলের নিষেধাজ্ঞায় পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।

তবে হুট করে লিটারে ৪০ টাকা বৃদ্ধি মোটেই স্বাভাবিক বিষয় নয়। জীবনযাত্রায় এর একটি চাপ পড়বে। প্রস্তুতকৃত অনেক খাবারের দাম বেড়ে যাবে। সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছেÑ দেশে তেলের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ঈদের আগে ভোজ্যতেলের চরম কৃত্রিম সংকট দৃশ্যমান হয়েছে। অনেকে বলেছেনÑ এটা ডিলারদের কারসাজি। তেলের দাম বৃদ্ধি পাবে এই টার্গেটে ডিলাররা তেল মজুদ করতে শুরু করে। যাই হোক, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তেল খাওয়ার পরিমাণ পূর্বের তুলোনায় বেড়েছে। গত চার বছরে জনপ্রতি খাবার তেলের ভোগ বেড়েছে প্রায় ৬ লিটার। মাথাপিছু খাবার তেলের ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

বর্তমানে শতকরা ৯৫ ভাগ ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়, আর এ ব্যাপক আমদানি নির্ভরতা দেশের বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলছে। তবে সরকার থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা আছে। টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে সরকারের। বিশ্ববাজারের অস্থিরতার কারণে দেশের আমদানিকারকদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় পাম তেলের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ২০০ ডলার বেড়েছে। বিশ্ব অস্থিতিশীল বাজারে গুজবও কম নেই। গুজবের কারণে বাজার আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। করোনার শুরু থেকেই দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি হতে থাকে। দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের নাজেহাল করে তোলে। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে দেশের বাজার ক্রমশ অস্থির হতে থাকে।

এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন নতুন করে আগুনে ঘি ঢেলে দিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ওই সব অঞ্চল থেকে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহে ধস নামে; যা আন্তর্জাতিক বাজারকে আরো সংকটময় করে তোলে। দেশে প্রতি মাসে গড়ে ৬৫ হাজার টন সয়াবিন তেল অপরিশোধিত আকারে আমদানি করা হয়। এছাড়াও সয়াবিন বীজ মাড়াই করেও সয়াবিন তেল উৎপাদন করে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে প্রতি মাসে ২৮ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করে। সব মিলিয়ে মাসে এক লাখ টনের কাছাকাছি সয়াবিন তেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। বিশ্ব বাজারে অস্থিরতা থাকায় কিছু দিন ধরে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। যাই হোক, কেজিপ্রতি ভোজ্যতেলের দাম ১৯৮ টাকা নির্ধারিত হয়েছে; কিন্তু এই দামই যে শেষ এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। যে কোন মুহূর্তে দাম আবার বৃদ্ধি পেতে পারে।

বিশ্ব বাজার কখন কোন দিকে মোড় নেয় তা বলা মুশকিল। সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? এক্ষেত্রে করণীয় একটাই আর সেটা হলো মাথাপিছু ভোজ্যতেলের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশীয় ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী নতুন নতুন তেল বীজের উদ্ভাবন করতে হবে এবং আবাদ বহুগুণে বাড়াতে হবে। দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। দেশে এক সময় ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষাই প্রধান ছিল। শুধু তেল নয়, পুষ্টি সমৃদ্ধ খৈল হতে পশু ও মৎস খাদ্য তৈরি হয়। বর্তমানে তেল বীজ আমদানি করতে হয়। এটা কমিয়ে এনে দেশেই তেল বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন, গর্জনতিল, কুসুম ফুল অন্যতম। বর্তমানে দেশের আবাদি জমির মাত্র ৪ শতাংশ জমিতে তৈল ফসলের আবাদ হয়। দেশে সামান্য সয়াবিন উৎপন্ন হয়।

বাংলাদেশে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২০-২২ গ্রাম তেল খায়; কিন্তু দেশে যে তৈল ফসল উৎপাদিত হয় তা চাহিদার তুলোনায় মাত্র ৯-১০ শতাংশ। তাই তেল ফসল উৎপাদনের আপাতত কোন বিকল্প নেই। উন্নত তেল বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা প্রদান, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, যাবতীয় উপকরণ সরবরাহসহ অন্যান্য সব সুবিধা নিশ্চিতকরণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের মাটি খুবই উর্বর। এমন সম্পদ পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। কোন কোন জাতের সরিষা চাষ করতে সময় লাগে মাত্র তিন মাস। সরিষার উৎপাদন খরচও অন্যান্য ফসলের তুলোনায় কম। সরিষার সংরক্ষণে কোন হিমাগার প্রয়োজন হয় না। আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাপক সরিষার আবাদ করা সম্ভব। সরিষা আবাদে অন্যান্য ফসলের মতো সার ও সেচের প্রয়োজন হয় না। সরিষায় শতকরা ৪০ -৪৫ ভাগ থাকে তেল এবং ২০- ২৫ ভাগ থাকে প্রোটিন। বর্তমানে দেশের তেল বীজ আবাদি জমির ৭৮ শতাংশে সরিষা চাষ করা হয়। দেশে প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমির পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে কমছে তেল বীজের জমির পরিমাণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ, মানুষের রুচি ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তনসহ নানা কারণে তৈল ফসলের উৎপাদন কমছে। প্রতিদিনের রান্না-বান্নায় ভোজ্যতেল অপরিহার্য। এছাড়াও বিভিন্ন আচার, আয়ুবের্দি ওষুধ, মোম, সাবানসহ নানা প্রসাধনী তৈরিতে ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বেকারিতেও রয়েছে এর বহুমুখী ব্যবহার। বাংলাদেশে প্রতি বছর তেল ও চর্বি জাতীয় খাদ্যের ব্যবহারের পরিমাণ হলো ৩০ লাখ ৩০ হাজার টন; যার ৯০ ভাগই আমদানিকৃত। বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের ২০০ কোটি ডলারের অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে। মূল্য ও গুণগত বিবেচনায় বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভোজ্যতেলের শতকরা ৫৫-৬০ ভাগ হলো পাম তেল। দেশে বছরে আমনের চাষ হয় ৫৮-৬০ লাখ হেক্টর জমিতে। অধিকাংশ কৃষক আমন ধান কাটার পর জমি পতিত রাখেন; কিন্তু এ সময়ে যদি সরিষার চাষ করা যায় তবে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সারা বছর সরিষার চাহিদা থাকে এবং ভালো বাজার মূল্যও পাওয়া যায়। এতে কৃষক লাভবান হবে এবং দেশ উপকৃত হবে। সরিষা আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে ৬ লাখ টন ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব এবং সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। এ তথ্যটি কোন সাধারণ জরিপে আসেনি। বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এমন পরামর্শ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সয়াবিন তেল আমদানিকারক দেশ। তবে আশার সংবাদ হলোÑ এ দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ছে। সরিষার উৎপাদন অনেক বাড়াতে হবে এবং সরিষার ভিতরে ভূতকেও তাড়াতে হবে। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসলের আবাদ বাড়াতে হবে। অন্যথায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আমাদের জন্য কঠিন হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

রবিবার, ০৮ মে ২০২২ , ২৪ বৈশাখ ১৪২৮ ০৫ শাওয়াল ১৪৪৩

ভোজ্যতেলের সংকট : মুক্তি কোন পথে

মাজহার মান্নান

image

ভোজ্যতেলের অতিমাত্রায় দাম বৃদ্ধিতে নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে চরম হতাশা। দেশের সাধারণ এবং গরিব মানুষেরা আন্তর্জাতিক বাজার বুঝে না, তারা কত মূল্যে পণ্যটি পাচ্ছে সেটা নিয়েই তাদের যত মাথা ব্যথ্যা। গত দুই বছের করোনায় বহু মানুষ আর্থিক দীনতার শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। সর্বশেষ সয়াবিন তেলের অসহনীয় দাম সাধারণ ভোক্তাদের চরম বিপাকে ফেলেছে। এক লাফে প্রতি লিটার সয়াবিনে ৪০ টাকা বেড়ে গেলো এবং কেজিপ্রতি ধার্য হলো ১৯৮ টাকা। চারজন সদস্যের একটি পরিবারে মাসে ৬ থেকে ৭ লিটার তেল প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে ওই পরিবারকে তেল বাবদ মাসে খরচ করতে হবে প্রায় ১৪০০ টাকা। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামে এমনিতেই টালমাটাল অবস্থা, তার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পাম তেলের নিষেধাজ্ঞায় পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।

তবে হুট করে লিটারে ৪০ টাকা বৃদ্ধি মোটেই স্বাভাবিক বিষয় নয়। জীবনযাত্রায় এর একটি চাপ পড়বে। প্রস্তুতকৃত অনেক খাবারের দাম বেড়ে যাবে। সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছেÑ দেশে তেলের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ঈদের আগে ভোজ্যতেলের চরম কৃত্রিম সংকট দৃশ্যমান হয়েছে। অনেকে বলেছেনÑ এটা ডিলারদের কারসাজি। তেলের দাম বৃদ্ধি পাবে এই টার্গেটে ডিলাররা তেল মজুদ করতে শুরু করে। যাই হোক, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তেল খাওয়ার পরিমাণ পূর্বের তুলোনায় বেড়েছে। গত চার বছরে জনপ্রতি খাবার তেলের ভোগ বেড়েছে প্রায় ৬ লিটার। মাথাপিছু খাবার তেলের ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

বর্তমানে শতকরা ৯৫ ভাগ ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়, আর এ ব্যাপক আমদানি নির্ভরতা দেশের বাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলছে। তবে সরকার থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা আছে। টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে সরকারের। বিশ্ববাজারের অস্থিরতার কারণে দেশের আমদানিকারকদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় পাম তেলের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ২০০ ডলার বেড়েছে। বিশ্ব অস্থিতিশীল বাজারে গুজবও কম নেই। গুজবের কারণে বাজার আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। করোনার শুরু থেকেই দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি হতে থাকে। দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের নাজেহাল করে তোলে। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে দেশের বাজার ক্রমশ অস্থির হতে থাকে।

এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন নতুন করে আগুনে ঘি ঢেলে দিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ওই সব অঞ্চল থেকে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহে ধস নামে; যা আন্তর্জাতিক বাজারকে আরো সংকটময় করে তোলে। দেশে প্রতি মাসে গড়ে ৬৫ হাজার টন সয়াবিন তেল অপরিশোধিত আকারে আমদানি করা হয়। এছাড়াও সয়াবিন বীজ মাড়াই করেও সয়াবিন তেল উৎপাদন করে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে প্রতি মাসে ২৮ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করে। সব মিলিয়ে মাসে এক লাখ টনের কাছাকাছি সয়াবিন তেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। বিশ্ব বাজারে অস্থিরতা থাকায় কিছু দিন ধরে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। যাই হোক, কেজিপ্রতি ভোজ্যতেলের দাম ১৯৮ টাকা নির্ধারিত হয়েছে; কিন্তু এই দামই যে শেষ এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। যে কোন মুহূর্তে দাম আবার বৃদ্ধি পেতে পারে।

বিশ্ব বাজার কখন কোন দিকে মোড় নেয় তা বলা মুশকিল। সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? এক্ষেত্রে করণীয় একটাই আর সেটা হলো মাথাপিছু ভোজ্যতেলের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশীয় ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী নতুন নতুন তেল বীজের উদ্ভাবন করতে হবে এবং আবাদ বহুগুণে বাড়াতে হবে। দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। দেশে এক সময় ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষাই প্রধান ছিল। শুধু তেল নয়, পুষ্টি সমৃদ্ধ খৈল হতে পশু ও মৎস খাদ্য তৈরি হয়। বর্তমানে তেল বীজ আমদানি করতে হয়। এটা কমিয়ে এনে দেশেই তেল বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন, গর্জনতিল, কুসুম ফুল অন্যতম। বর্তমানে দেশের আবাদি জমির মাত্র ৪ শতাংশ জমিতে তৈল ফসলের আবাদ হয়। দেশে সামান্য সয়াবিন উৎপন্ন হয়।

বাংলাদেশে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২০-২২ গ্রাম তেল খায়; কিন্তু দেশে যে তৈল ফসল উৎপাদিত হয় তা চাহিদার তুলোনায় মাত্র ৯-১০ শতাংশ। তাই তেল ফসল উৎপাদনের আপাতত কোন বিকল্প নেই। উন্নত তেল বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা প্রদান, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, যাবতীয় উপকরণ সরবরাহসহ অন্যান্য সব সুবিধা নিশ্চিতকরণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের মাটি খুবই উর্বর। এমন সম্পদ পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। কোন কোন জাতের সরিষা চাষ করতে সময় লাগে মাত্র তিন মাস। সরিষার উৎপাদন খরচও অন্যান্য ফসলের তুলোনায় কম। সরিষার সংরক্ষণে কোন হিমাগার প্রয়োজন হয় না। আমন ও বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাপক সরিষার আবাদ করা সম্ভব। সরিষা আবাদে অন্যান্য ফসলের মতো সার ও সেচের প্রয়োজন হয় না। সরিষায় শতকরা ৪০ -৪৫ ভাগ থাকে তেল এবং ২০- ২৫ ভাগ থাকে প্রোটিন। বর্তমানে দেশের তেল বীজ আবাদি জমির ৭৮ শতাংশে সরিষা চাষ করা হয়। দেশে প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমির পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে কমছে তেল বীজের জমির পরিমাণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ, মানুষের রুচি ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তনসহ নানা কারণে তৈল ফসলের উৎপাদন কমছে। প্রতিদিনের রান্না-বান্নায় ভোজ্যতেল অপরিহার্য। এছাড়াও বিভিন্ন আচার, আয়ুবের্দি ওষুধ, মোম, সাবানসহ নানা প্রসাধনী তৈরিতে ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বেকারিতেও রয়েছে এর বহুমুখী ব্যবহার। বাংলাদেশে প্রতি বছর তেল ও চর্বি জাতীয় খাদ্যের ব্যবহারের পরিমাণ হলো ৩০ লাখ ৩০ হাজার টন; যার ৯০ ভাগই আমদানিকৃত। বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের ২০০ কোটি ডলারের অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে। মূল্য ও গুণগত বিবেচনায় বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভোজ্যতেলের শতকরা ৫৫-৬০ ভাগ হলো পাম তেল। দেশে বছরে আমনের চাষ হয় ৫৮-৬০ লাখ হেক্টর জমিতে। অধিকাংশ কৃষক আমন ধান কাটার পর জমি পতিত রাখেন; কিন্তু এ সময়ে যদি সরিষার চাষ করা যায় তবে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সারা বছর সরিষার চাহিদা থাকে এবং ভালো বাজার মূল্যও পাওয়া যায়। এতে কৃষক লাভবান হবে এবং দেশ উপকৃত হবে। সরিষা আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে ৬ লাখ টন ভোজ্যতেলের ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব এবং সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। এ তথ্যটি কোন সাধারণ জরিপে আসেনি। বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এমন পরামর্শ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সয়াবিন তেল আমদানিকারক দেশ। তবে আশার সংবাদ হলোÑ এ দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ছে। সরিষার উৎপাদন অনেক বাড়াতে হবে এবং সরিষার ভিতরে ভূতকেও তাড়াতে হবে। সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসলের আবাদ বাড়াতে হবে। অন্যথায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আমাদের জন্য কঠিন হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]