বরেন্দ্রভূমি কি আদিবাসীশূন্য হতে চলেছে

মিথুশিলাক মুরমু

রাজশাহী মহানগর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমে আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম নিমঘুটু। এই গ্রামেই গত ২৩ মার্চ অভিনাথ মারা-ী এবং ২৫ মার্চ রাতে রবি মারা-ী মৃত্যুবরণ করেন। চাষকৃত জমিতে গভীর নলকূপ থেকে পানির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষার পরও পানি না পাওয়ায় নলকূপের পাশেই কীটনাশক সেবন করে কৃষক দুজন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুর পরই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নিয়োগকৃত অপারেটর মো. সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করেছেন অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম। প্রায় মাসাধিককাল পরে ২ মে, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ পরিদর্শনে যাওয়া আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও রাজশাহী- ২ আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা এ আত্মহত্যাকে ‘কাঠামোগত হত্যাকা-’ বলে অভিহিত করেছেন।

বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন থেকেই আদিবাসীদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা, অত্যাচার-নির্যাতনের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অনড় অবস্থান নিয়ে মানবতার ঝা-া উচ্চীকৃত করে রেখেছেন। ২ মে নিমঘুটু সাঁওতাল পল্লীতে গিয়ে ফজলে হোসেন বাদশা স্বচক্ষে দেখেছেন যে, অভিনাথ ও রবির পরিবার গ্রাম ছেড়েছেন, কোথায় গিয়েছে, কোনদিকে গিয়েছে, কেন গিয়েছে কোন কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না। এমপি বাদশা বলেছেন, ‘আমরা আসব এটি তারা কাল থেকেই জানে। অথচ আজ সকাল থেকে তারা কেউ নেই। দুই কৃষকের বাড়ি ঘুরে দেখে মনে হলো, এখানে সন্ত্রাসের কায়েম হয়েছে।’ তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আরও বলেছেন, ‘দুই কৃষকের মৃত্যুর পরে তাদের পরিবারের লোকজন কেমন আছেন ও তাদের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে মূলত সেটি দেখতেই আমাদের প্রতিনিধিদল এখানে এসেছে। আসার আগে প্রশাসনকেও বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, আদিবাসীশূন্য! তারা কোথায় গেল? কেন গেল? এটি খুব পরিষ্কারÑ এখানে সন্ত্রাসীদের প্রভুত্ব চলছে।’ তিনি নিজ সংসদীয় আসন ছেড়ে রাজশাহীÑ১ (তানোর-গোদাগাড়ী) অঞ্চলের সাঁওতালদের পক্ষাবলম্বন করে মাঠে নেমে পড়েছেন। এটিতে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞ ও কৃতার্থ হই।

রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমিতে বসবাস করছে সাঁওতাল, উরাঁও, মাহালী, মু-া, রাজোয়াড়, তুরী, পাহাড়িয়া, কোল, কোডা ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী। সাংসদ বাদশা নিজেই স্বীকার করে থাকেনÑতার গ্রাম হড়গ্রামে এক সময় সাঁওতালদের অভয়াশ্রম ছিল কিন্তু এখন সেখানে কেউ-ই নেই। সাঁওতালী ভাষা ‘হড়’ মানে মানুষ অর্থাৎ সাঁওতাল মানুষের বসবাস ছিলো। বরেন্দ্রাঞ্চলের অনেক আদিবাসী গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে, শুধু প্রবীণদের মুখ থেকেই জানা যায়, অমুক-তুমুক এলাকাটি ছিল আদিবাসীদের অনেক ছোট-বড় গ্রাম। এখনো আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি, বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রতিটি আদিবাসী গ্রাম থেকেই কোন না কোন পরিবার স্থানচ্যুত হয়েছে, দেশান্তরিত হচ্ছে। অনেকে রাতের অন্ধকারে চোখের জল মুছতে মুছতে নীরবে নিভৃতে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এমপি মহোদয় অত্যন্ত সত্যি কথাটি উন্মোচন করেছেন, সেটি প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে-আবডালে হোক রাজনৈতিক পরিচয়ে কিংবা ক্ষমতাবানদের প্রভুত্ব প্রতীয়মান হয়েছে।

অভিনাথ ও রবি মারা-ী চাষকৃত জমিতে পানি দেবে, সেটিও বিবেচনা হয়েছে রাজনৈতিক ধারায়। আদিবাসী গ্রামগুলোর আশপাশে বা মধ্যে ছিটেফোঁটা খাসজমি থাকলে, সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশীরা। কিন্তু কেন! আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জীবনাচরণে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী গ্রামের অভ্যন্তরে গিয়েই একটির পর একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং একসময় আদিবাসী গ্রামটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের গ্রামে পরিণত হয়। এটিই বাস্তবতা, এটিই চরম সত্য। এমপির মুখ থেকে শোনা, হড়গ্রামে এখন আর সাঁওতালদের উপস্থিতি নেই। গোদাগাড়ীর নিমঘুটুতে কী আদিবাসী শূন্যতার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে! দলবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সাঁওতাল সমাজে স্থানান্তরের শুরু মড়করূপ ধারণ করে থাকে। বরেন্দ্রাঞ্চলে আদিবাসী শূন্যতাকে ঠেকাতে বিশেষ কমিশন আবশ্যিক।

আমরা খুবই আশ্চার্যন্বিত হয়েছি, আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক আত্মহত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রায় দেড় মাস অতিক্রম করতে চলেছে কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিত না হওয়া আমাদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। জেনেছি, স্থানীয় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী পরিবার দুটির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান নিঃসন্দেহে অভিনন্দনীয় কিন্তু তার চেয়েও বড় দরকার রয়েছে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সহমর্মিতা জানানো, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা ব্যাপারে পরিবারের সাক্ষাতে মুখোমুখি দাঁড়ানো। দু’একজন আদিবাসী নেতা ক্ষুব্ধতার সঙ্গেই বলেছেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে দলবল নিয়ে কখনো গাড়িতে, কখনো হেঁটে আদিবাসীদের গ্রামে পৌঁছিয়েছেন, আদিবাসীদের যে কোন বিপদ-আপদে পাশে থাকার অঙ্গীকার কী শুধুই রাজনৈতিক বুলি, এটির মধ্যে কী সামান্যতম মানবিকতা, ভালোবাসা, দায়দায়িত্বের দায়বদ্ধতা নেই! মাননীয় সাংসদের কাছের আদিবাসী নেতাদের রহস্যজনক নীরবতা দলীয় রাজনীতির নতজানু মনোভাব বহিঃপ্রকাশ হয়েছে।

বরেন্দ্রাঞ্চলের আদিবাসীরা একদা কাজের সন্ধানে অনেক দূরে, দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়তেন। তবে প্রায় দেড়-দুই যুগের মধ্যে অবিশ^াস্য পরিবর্তন ঘটেছে। উঁচু-নিচু থরে থরে সাজানো জমিতে বছরে একবারই ফসল ফলতো কিন্তু বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) আশির্বাদে এখন জমিতে তিনটি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। আদিবাসী নারী-পুরুষরা এখন নিজ গ্রামে থেকেই পরিশ্রম করে থাকে, জমিতে ধান ফলিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা না হলেও দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের সংকুলান হয়ে থাকে, প্রতিদিন জমিতে কামলা খেটে দিনের শেষে হাসিমুখে ঘরে ফিরে আসে। সাঁওতালরা এটিতেই খুশি, আনন্দিত ও সন্তুষ্ট। আদিবাসীদের সহজ-সরল জীবনে ‘কাঠামোগত হত্যাকা-’, ‘সন্ত্রাসীদের প্রভুত্ব’-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলিয়েছে। পূর্বে ভাতে মারার চেষ্টা করতেন, আর এখন কৌশল বদলিয়েছে কিন্তু চেতনার পরিবর্তন ঘটেনি। বরেন্দ্রাঞ্চলের আদিবাসী শূন্যতা ঠেকাতে প্রয়োজন ব্যাপক গণসচেতনা, ক্ষমতায়ন ও বিশেষ নজর। প্রয়োজন বিশেষ ভূমি কমিশন, বৈষম্য বিলোপ আইন এবং বেঙ্গল ট্যানেন্সি অ্যাক্টের ৯৭ ধারার যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার।

আদিবাসীরা মাতৃভূমিকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে, বেঁচে থাকে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে দিয়ে থাকে। বরেন্দ্রভূমির লাল এঁটেল মাটিতে এদের অস্তিত্ব সংগ্রোথিত রয়েছে, আদিবাসীরাই বরেন্দ্র ভূমির ঐশ^র্য। কাঠামোগত হত্যাকা- এবং সন্ত্রাসীদের প্রভুত্ব থেকে আইনগতভাবে বাঁচিয়ে রেখে আদিবাসীদের জীবনযাত্রাকে সজীব ও সক্রিয় করে তুলি। উন্নয়নের মিছিলে শামিল করে অগ্রসর হই, আদিবাসীরা উন্নত হবে, জাতি উন্নত হবে; সর্বোপরি দেশ উন্নয়নের মহাসড়কের দিকে ধাবিত হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

মঙ্গলবার, ১০ মে ২০২২ , ২৭ বৈশাখ ১৪২৮ ০৭ শাওয়াল ১৪৪৩

বরেন্দ্রভূমি কি আদিবাসীশূন্য হতে চলেছে

মিথুশিলাক মুরমু

রাজশাহী মহানগর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমে আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম নিমঘুটু। এই গ্রামেই গত ২৩ মার্চ অভিনাথ মারা-ী এবং ২৫ মার্চ রাতে রবি মারা-ী মৃত্যুবরণ করেন। চাষকৃত জমিতে গভীর নলকূপ থেকে পানির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষার পরও পানি না পাওয়ায় নলকূপের পাশেই কীটনাশক সেবন করে কৃষক দুজন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুর পরই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নিয়োগকৃত অপারেটর মো. সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করেছেন অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম। প্রায় মাসাধিককাল পরে ২ মে, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ পরিদর্শনে যাওয়া আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও রাজশাহী- ২ আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা এ আত্মহত্যাকে ‘কাঠামোগত হত্যাকা-’ বলে অভিহিত করেছেন।

বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন থেকেই আদিবাসীদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা, অত্যাচার-নির্যাতনের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অনড় অবস্থান নিয়ে মানবতার ঝা-া উচ্চীকৃত করে রেখেছেন। ২ মে নিমঘুটু সাঁওতাল পল্লীতে গিয়ে ফজলে হোসেন বাদশা স্বচক্ষে দেখেছেন যে, অভিনাথ ও রবির পরিবার গ্রাম ছেড়েছেন, কোথায় গিয়েছে, কোনদিকে গিয়েছে, কেন গিয়েছে কোন কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না। এমপি বাদশা বলেছেন, ‘আমরা আসব এটি তারা কাল থেকেই জানে। অথচ আজ সকাল থেকে তারা কেউ নেই। দুই কৃষকের বাড়ি ঘুরে দেখে মনে হলো, এখানে সন্ত্রাসের কায়েম হয়েছে।’ তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আরও বলেছেন, ‘দুই কৃষকের মৃত্যুর পরে তাদের পরিবারের লোকজন কেমন আছেন ও তাদের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে মূলত সেটি দেখতেই আমাদের প্রতিনিধিদল এখানে এসেছে। আসার আগে প্রশাসনকেও বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, আদিবাসীশূন্য! তারা কোথায় গেল? কেন গেল? এটি খুব পরিষ্কারÑ এখানে সন্ত্রাসীদের প্রভুত্ব চলছে।’ তিনি নিজ সংসদীয় আসন ছেড়ে রাজশাহীÑ১ (তানোর-গোদাগাড়ী) অঞ্চলের সাঁওতালদের পক্ষাবলম্বন করে মাঠে নেমে পড়েছেন। এটিতে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞ ও কৃতার্থ হই।

রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমিতে বসবাস করছে সাঁওতাল, উরাঁও, মাহালী, মু-া, রাজোয়াড়, তুরী, পাহাড়িয়া, কোল, কোডা ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী। সাংসদ বাদশা নিজেই স্বীকার করে থাকেনÑতার গ্রাম হড়গ্রামে এক সময় সাঁওতালদের অভয়াশ্রম ছিল কিন্তু এখন সেখানে কেউ-ই নেই। সাঁওতালী ভাষা ‘হড়’ মানে মানুষ অর্থাৎ সাঁওতাল মানুষের বসবাস ছিলো। বরেন্দ্রাঞ্চলের অনেক আদিবাসী গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে, শুধু প্রবীণদের মুখ থেকেই জানা যায়, অমুক-তুমুক এলাকাটি ছিল আদিবাসীদের অনেক ছোট-বড় গ্রাম। এখনো আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি, বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রতিটি আদিবাসী গ্রাম থেকেই কোন না কোন পরিবার স্থানচ্যুত হয়েছে, দেশান্তরিত হচ্ছে। অনেকে রাতের অন্ধকারে চোখের জল মুছতে মুছতে নীরবে নিভৃতে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এমপি মহোদয় অত্যন্ত সত্যি কথাটি উন্মোচন করেছেন, সেটি প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে-আবডালে হোক রাজনৈতিক পরিচয়ে কিংবা ক্ষমতাবানদের প্রভুত্ব প্রতীয়মান হয়েছে।

অভিনাথ ও রবি মারা-ী চাষকৃত জমিতে পানি দেবে, সেটিও বিবেচনা হয়েছে রাজনৈতিক ধারায়। আদিবাসী গ্রামগুলোর আশপাশে বা মধ্যে ছিটেফোঁটা খাসজমি থাকলে, সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশীরা। কিন্তু কেন! আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জীবনাচরণে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী গ্রামের অভ্যন্তরে গিয়েই একটির পর একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং একসময় আদিবাসী গ্রামটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের গ্রামে পরিণত হয়। এটিই বাস্তবতা, এটিই চরম সত্য। এমপির মুখ থেকে শোনা, হড়গ্রামে এখন আর সাঁওতালদের উপস্থিতি নেই। গোদাগাড়ীর নিমঘুটুতে কী আদিবাসী শূন্যতার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে! দলবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সাঁওতাল সমাজে স্থানান্তরের শুরু মড়করূপ ধারণ করে থাকে। বরেন্দ্রাঞ্চলে আদিবাসী শূন্যতাকে ঠেকাতে বিশেষ কমিশন আবশ্যিক।

আমরা খুবই আশ্চার্যন্বিত হয়েছি, আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক আত্মহত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রায় দেড় মাস অতিক্রম করতে চলেছে কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিত না হওয়া আমাদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। জেনেছি, স্থানীয় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী পরিবার দুটির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান নিঃসন্দেহে অভিনন্দনীয় কিন্তু তার চেয়েও বড় দরকার রয়েছে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সহমর্মিতা জানানো, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা ব্যাপারে পরিবারের সাক্ষাতে মুখোমুখি দাঁড়ানো। দু’একজন আদিবাসী নেতা ক্ষুব্ধতার সঙ্গেই বলেছেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে দলবল নিয়ে কখনো গাড়িতে, কখনো হেঁটে আদিবাসীদের গ্রামে পৌঁছিয়েছেন, আদিবাসীদের যে কোন বিপদ-আপদে পাশে থাকার অঙ্গীকার কী শুধুই রাজনৈতিক বুলি, এটির মধ্যে কী সামান্যতম মানবিকতা, ভালোবাসা, দায়দায়িত্বের দায়বদ্ধতা নেই! মাননীয় সাংসদের কাছের আদিবাসী নেতাদের রহস্যজনক নীরবতা দলীয় রাজনীতির নতজানু মনোভাব বহিঃপ্রকাশ হয়েছে।

বরেন্দ্রাঞ্চলের আদিবাসীরা একদা কাজের সন্ধানে অনেক দূরে, দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়তেন। তবে প্রায় দেড়-দুই যুগের মধ্যে অবিশ^াস্য পরিবর্তন ঘটেছে। উঁচু-নিচু থরে থরে সাজানো জমিতে বছরে একবারই ফসল ফলতো কিন্তু বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) আশির্বাদে এখন জমিতে তিনটি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। আদিবাসী নারী-পুরুষরা এখন নিজ গ্রামে থেকেই পরিশ্রম করে থাকে, জমিতে ধান ফলিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা না হলেও দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের সংকুলান হয়ে থাকে, প্রতিদিন জমিতে কামলা খেটে দিনের শেষে হাসিমুখে ঘরে ফিরে আসে। সাঁওতালরা এটিতেই খুশি, আনন্দিত ও সন্তুষ্ট। আদিবাসীদের সহজ-সরল জীবনে ‘কাঠামোগত হত্যাকা-’, ‘সন্ত্রাসীদের প্রভুত্ব’-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদলিয়েছে। পূর্বে ভাতে মারার চেষ্টা করতেন, আর এখন কৌশল বদলিয়েছে কিন্তু চেতনার পরিবর্তন ঘটেনি। বরেন্দ্রাঞ্চলের আদিবাসী শূন্যতা ঠেকাতে প্রয়োজন ব্যাপক গণসচেতনা, ক্ষমতায়ন ও বিশেষ নজর। প্রয়োজন বিশেষ ভূমি কমিশন, বৈষম্য বিলোপ আইন এবং বেঙ্গল ট্যানেন্সি অ্যাক্টের ৯৭ ধারার যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার।

আদিবাসীরা মাতৃভূমিকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে, বেঁচে থাকে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে দিয়ে থাকে। বরেন্দ্রভূমির লাল এঁটেল মাটিতে এদের অস্তিত্ব সংগ্রোথিত রয়েছে, আদিবাসীরাই বরেন্দ্র ভূমির ঐশ^র্য। কাঠামোগত হত্যাকা- এবং সন্ত্রাসীদের প্রভুত্ব থেকে আইনগতভাবে বাঁচিয়ে রেখে আদিবাসীদের জীবনযাত্রাকে সজীব ও সক্রিয় করে তুলি। উন্নয়নের মিছিলে শামিল করে অগ্রসর হই, আদিবাসীরা উন্নত হবে, জাতি উন্নত হবে; সর্বোপরি দেশ উন্নয়নের মহাসড়কের দিকে ধাবিত হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]