যশোরে এক বছরে ব্যাংকে নগদ লেনদেন ২৭ হাজার কোটি টাকা

অস্বাভাবিক বলেছেন বিএফআইইউ

গত এক বছরে যশোরে নগদ টাকার লেনদেন হয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। যা অস্বাভাবিক বলছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

পেমেন্ট ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় নিমিষেই স্থানান্তর করা যাচ্ছে অর্থ। জনপ্রিয়তা পেয়েছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসও (এমএফএস)। নগদ অর্থের লেনদেন কমাতে পেমেন্ট ব্যবস্থা সহজ ও আধুনিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও কমছে না নগদ অর্থের লেনদেন। বরং প্রতি বছরই নগদ অর্থের লেনদেন বাড়ছে।

বিএফআইইউর পর্যালোচনা বলছে, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি।

অবৈধ চোরাচালান, হুন্ডি, সোনা চোরাচালান, মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসার কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন বেশি হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি নগদ লেনদেন হয়েছে যশোরে। জেলাটিতে গত অর্থবছরে নগদ লেনদেন হয়েছে ২৭ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা।

কোন নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে দিনে ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ জমা বা উত্তোলন হলে তার জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) রিপোর্ট করতে হয়। এ ধরনের লেনদেনকে ‘ক্যাশ ট্রানজেকশনস’ বা নগদ লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করে থাকে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন হয়েছিল ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ ১৪ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে তিন বছরে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন

বেড়েছে ২০৯ শতাংশেরও বেশি।

ক্রমবর্ধমান নগদ অর্থের লেনদেনের ঘটনায় নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বিএফআইইউ। মূলত উপার্জিত অর্থের উৎস ও গন্তব্য গোপন রাখতে মানুষ নগদ লেনদেনের আশ্রয় নিচ্ছে বলে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বিএফআইইউর ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের যেকোন সময়ের তুলনায় দেশের ব্যাংক খাত অনেক বেশি ডিজিটালাইজড। সরকারের পক্ষ থেকেও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এবং অন্য ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারপরও প্রতি বছরই নগদ লেনদেন বেড়েই চলছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, যশোরের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে নগদ যে লেনদেন হচ্ছে, তার বড় অংশই হুন্ডি, সোনা চোরাচালান, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ। সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় অংশ নগদ লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এ কারণে চেষ্টা করেও নগদ লেনদেন কমানো যাচ্ছে না।

যশোরের একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, যশোরে ট্রেডিং ব্যবসা ঘিরে বিপুল পরিমাণে নগদ অর্থের লেনদেন হয়। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে নগদে লেনদেন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করেও তাদের দিয়ে চেক বা অন্য কোন মাধ্যমে লেনদেন করানো সম্ভব হয় না। তবে বেনাপোল স্থলবন্দরসহ সীমান্তের অবৈধ চোরাচালানোর বড় রুট হওয়ার কারণে যশোরে নগদ অর্থের প্রবাহ বেশি। তাছাড়া দেশে হুন্ডি তৎপরতার একটি বড় হাব হয়ে উঠেছে যশোর।

রূপালী ব্যাংক যশেরাঞ্চলের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রোকনুজ্জামান বলেন, যশোরে খুলনা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক লেনদেন হয়ে থাকে। যে কারণে নগদ লেনদেন বেশি। তবে নগদ টাকার লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা গ্রাহকদের ডিজিটাল লেনদেন করতে উৎসাহী করছি।

ইসলামী ব্যাংক যশোর জোন প্রধান শফিউল আযম বলেন, যশোরে ট্রেডিং ব্যবসা ভালো। আবার বিভিন্ন ফসলের আবাদ বেশি হয়ে থাকে। কৃষকরা নগদ টাকা গ্রহণ করেন। সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানে নগদ টাকার প্রবাহ বেশি। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক যশোর জোনের প্রধান ফকির আক্তারুজ্জামান বলেন, অনেকে সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিতেও নগদ লেনদেন পছন্দ করেন। আবার ঠিকাদাররা সম্প্রতি সরকারের বিল পাবার কারণে বড় টাকা নগদ লেনদেন হয়েছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ১০ লাখ বা তার বেশি অর্থ ব্যাংকে নগদে জমা কিংবা উত্তোলন হলে বিএফআইইউতে রিপোর্ট করতে হয়। আগে এ ধরনের রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াটি কিছুটা জটিল ছিল। সম্প্রতি ব্যাংকারদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াটিও সহজ করায় আগের চেয়ে বেশি অর্থ লেনদেনের তথ্য বিএফআইইউতে আসছে। নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত করতে বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অর্থপাচার প্রতিরোধ ও অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ করতেও আমরা সচেষ্ট রয়েছি।

বুধবার, ১১ মে ২০২২ , ২৮ বৈশাখ ১৪২৮ ০৮ শাওয়াল ১৪৪৩

যশোরে এক বছরে ব্যাংকে নগদ লেনদেন ২৭ হাজার কোটি টাকা

অস্বাভাবিক বলেছেন বিএফআইইউ

যশোর অফিস

গত এক বছরে যশোরে নগদ টাকার লেনদেন হয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। যা অস্বাভাবিক বলছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

পেমেন্ট ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় নিমিষেই স্থানান্তর করা যাচ্ছে অর্থ। জনপ্রিয়তা পেয়েছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসও (এমএফএস)। নগদ অর্থের লেনদেন কমাতে পেমেন্ট ব্যবস্থা সহজ ও আধুনিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও কমছে না নগদ অর্থের লেনদেন। বরং প্রতি বছরই নগদ অর্থের লেনদেন বাড়ছে।

বিএফআইইউর পর্যালোচনা বলছে, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি।

অবৈধ চোরাচালান, হুন্ডি, সোনা চোরাচালান, মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসার কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন বেশি হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি নগদ লেনদেন হয়েছে যশোরে। জেলাটিতে গত অর্থবছরে নগদ লেনদেন হয়েছে ২৭ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা।

কোন নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে দিনে ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ জমা বা উত্তোলন হলে তার জন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) রিপোর্ট করতে হয়। এ ধরনের লেনদেনকে ‘ক্যাশ ট্রানজেকশনস’ বা নগদ লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করে থাকে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন হয়েছিল ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেনের পরিমাণ ১৪ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে তিন বছরে ব্যাংক খাতে নগদ লেনদেন

বেড়েছে ২০৯ শতাংশেরও বেশি।

ক্রমবর্ধমান নগদ অর্থের লেনদেনের ঘটনায় নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বিএফআইইউ। মূলত উপার্জিত অর্থের উৎস ও গন্তব্য গোপন রাখতে মানুষ নগদ লেনদেনের আশ্রয় নিচ্ছে বলে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বিএফআইইউর ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের যেকোন সময়ের তুলনায় দেশের ব্যাংক খাত অনেক বেশি ডিজিটালাইজড। সরকারের পক্ষ থেকেও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এবং অন্য ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারপরও প্রতি বছরই নগদ লেনদেন বেড়েই চলছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, যশোরের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে নগদ যে লেনদেন হচ্ছে, তার বড় অংশই হুন্ডি, সোনা চোরাচালান, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ। সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় অংশ নগদ লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এ কারণে চেষ্টা করেও নগদ লেনদেন কমানো যাচ্ছে না।

যশোরের একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, যশোরে ট্রেডিং ব্যবসা ঘিরে বিপুল পরিমাণে নগদ অর্থের লেনদেন হয়। ব্যবসায়ীরা ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে নগদে লেনদেন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করেও তাদের দিয়ে চেক বা অন্য কোন মাধ্যমে লেনদেন করানো সম্ভব হয় না। তবে বেনাপোল স্থলবন্দরসহ সীমান্তের অবৈধ চোরাচালানোর বড় রুট হওয়ার কারণে যশোরে নগদ অর্থের প্রবাহ বেশি। তাছাড়া দেশে হুন্ডি তৎপরতার একটি বড় হাব হয়ে উঠেছে যশোর।

রূপালী ব্যাংক যশেরাঞ্চলের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রোকনুজ্জামান বলেন, যশোরে খুলনা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক লেনদেন হয়ে থাকে। যে কারণে নগদ লেনদেন বেশি। তবে নগদ টাকার লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা গ্রাহকদের ডিজিটাল লেনদেন করতে উৎসাহী করছি।

ইসলামী ব্যাংক যশোর জোন প্রধান শফিউল আযম বলেন, যশোরে ট্রেডিং ব্যবসা ভালো। আবার বিভিন্ন ফসলের আবাদ বেশি হয়ে থাকে। কৃষকরা নগদ টাকা গ্রহণ করেন। সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানে নগদ টাকার প্রবাহ বেশি। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক যশোর জোনের প্রধান ফকির আক্তারুজ্জামান বলেন, অনেকে সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিতেও নগদ লেনদেন পছন্দ করেন। আবার ঠিকাদাররা সম্প্রতি সরকারের বিল পাবার কারণে বড় টাকা নগদ লেনদেন হয়েছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ১০ লাখ বা তার বেশি অর্থ ব্যাংকে নগদে জমা কিংবা উত্তোলন হলে বিএফআইইউতে রিপোর্ট করতে হয়। আগে এ ধরনের রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াটি কিছুটা জটিল ছিল। সম্প্রতি ব্যাংকারদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রিপোর্ট করার প্রক্রিয়াটিও সহজ করায় আগের চেয়ে বেশি অর্থ লেনদেনের তথ্য বিএফআইইউতে আসছে। নগদ লেনদেন নিরুৎসাহিত করতে বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অর্থপাচার প্রতিরোধ ও অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ করতেও আমরা সচেষ্ট রয়েছি।