প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভেঙে দিল কৃষকের স্বপ্ন

চলতি বোরো মৌসুমে মাঠের ধানখেতগুলো অধিক ফলনের হাতছানি দিচ্ছিল। কৃষকদের আশা ছিল নতুন ধান ঘরে তুলে দায়দেনা পরিশোধ করবেন। মেটাবেন পরিবারের সব সদস্যদের চাহিদা। মাঠের পাকা ধানগুলোতে কৃষকদের অতীতের যেকোন মৌসুমের চেয়ে বেশি ফলনের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। তাদের আশা ছিল বেশ লাভ হবে। ভালোভাবে চলবে সংসার। এমন ভাবনায় ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বোরো চাষিরা ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন।

কিন্তু বিগত মৌসুমের মতো এ বছরও পাকা ধানের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। শেষ মুহূর্তে ধান ঘরে তোলার সময়ে বৈরী আবহাওয়া নির্দয় হয়ে গেছে। নি¤œচাপের প্রভাবে গত ৩ দিনের ভারী বর্ষায় খেতের ধান মাটিতে পড়ে কাদা পানিতে একাকার হয়ে গেছে। কোন কোন মাঠের কাটা ধান পানির ওপর ভাসছে। প্রথম দিকে কৃষকেরা বুক পেতে চেষ্টা করেছে রক্ষার জন্য। কিন্তু লাগাতর ভারী বর্ষণে কৃষকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন নিচু জমির কৃষকেরা অনেকে ধানের আশা ছেড়েই দিয়েছেন।

এখন আকাশে যত কালো মেঘ জমছে কৃষকদের কপালেও পড়ছে বড় বড় নিরাশার ভাঁজ। শুধু একটা সান্ত¡না তাদের, প্রকৃতিতে কারও হাত নেই।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০ হেক্টোর জমিতে। কিন্তু চাষ হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে।

এর মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫ ভাগ জমির ধান কৃষকেরা ইতোমধ্যে ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকিটা খেতের ধান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন মাঠে গেলে দেখা যায়, এ বছর নজরে আসে বোরো ধানের বিচিত্র চিত্র। কোন মাঠে এখনও ধান কাটাই শুরু হয়নি। তবে সারা মাঠের ধান পেকে সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। আবার নিচু এলাকার মাঠের ধানগুলো বাঁচাতে অনেকে প্রখর রোদে ধান কেটে ভালোভাবে ঘরে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা শতকরা ৫ থেকে ৬ ভাগের বেশি নয়। আবার অনেকে ধান কেটে বিচালির আশায় ফেলে রেখেছিলেন।

তাদের ধানগুলো পানিতে ভাসছে। আবার অনেকে ক্ষেতের ধান এখনও কাটেননি। তারাও

পড়েছেন বিপাকে। চলমান নি¤œচাপের প্রভাবে লাগাতর ভারী বর্ষণে আগাভারী পাকা ধান খেতে জমে থাকা হাঁটু পানিতেই একাকার হয়ে গেছে। এ ধানগুলো দু-এক দিনের মধ্যে কেটে না নেয়া হলে সব ধানে চারা গজিয়ে নষ্ট হবে।

খালকুলা গ্রামের কৃষক তোফাজ্জেল হোসেন জানান, তিনি ১০ বিঘা বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। আবহাওয়ার অনেক দিনের আগ থেকে পূর্বাভাস শুনে বেশ চড়া মূল্যে শ্রমিক নিয়ে ধানগুলো ঘরে তুলেছেন। গোখাদ্যের জন্য বিচালিগুলোও সংরক্ষণ করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, তবে তার মাঠে এখনও কমপক্ষে ৮০ ভাগ ধান নিয়ে কৃষকেরা চরম বেকায়দায় আছেন।

খালকুলা গ্রামের মিলন হোসেন জানান, দুই বিঘা ধানের মধ্যে সবটুকুই কেটে শুকাতে দেয়া ছিল। কিন্তু এখন সে ধান পানিতে ভাসছে। কোনভাবে এ ক্ষতি পোষাতে পারবেন না।

বিনোদপুর গ্রামের কৃষক দম্পতি পরিমল কুমার ও অনিমা দাস জানান, খুব কষ্ট করে ১০ কাঠার একটু বেশি জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। সব ধান কেটে শুকানোর জন্য জমিতে ফেলা ছিল কিন্তু গত ৩ দিনের ভারী বর্ষণে সে ধানগুলো খেতেই ভাসছে। ভোর থেকে টেনে টেনে ধানগুলো রাস্তায় উঠানোর চেষ্টা করছেন তাতে কোন ফল হবে বলে মনে হচ্ছে না। এখন কি করে সংসার চালাবেন। আর কিভাবেই বা পাওনাদারের দেনা মেটাবেন সে চিন্তায় আছেন।

কালীগঞ্জের ফয়লা গ্রামের বর্গাচাষি তোতা মিয়া জানান, এ বছর ২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে মাঠে ধান চাষ করেছিলেন। জমিগুলো একটু নিচু মাঠে হওয়ায় খেতের সব পাকা ধান কাদা বৃষ্টিতে একাকার হয়ে গেছে। এখন জমির মালিকের টাকাই পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কি করে সংসার চালাবেন সে চিন্তায় আছেন।

নরেন্দ্রপুর গ্রামের আরেক বর্গাচাষি মনজের আলী জানান, মাঠে নিজের কোন চাষযোগ্য জমি নেই। মাঠের রাকিবুল ইসলাম ও বল্টু মিয়ার ৩ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে সারা মৌসুম খেতে কাজ করেছি। খেতে ধানও হয়েছিল ভালো। কিন্তু গত কয়দিনের বৃষ্টিতে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন না খেয়ে মরতে হবে।

তিনি আরও বলেন, খেতের ধান বাঁচাতে হলে দ্রুতই ভেজা ধান শুকাতে হবে। সেজন্য ভেজা

ধান খেতে পানি থেকে উঠিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেখানেও পানি জমে যাচ্ছে।

সাদিকপুর গ্রামের বোরো চাষি সাজেদুল ইসলাম জানান, মোট ১১ বিঘা বোরো ধানের মধ্যে মাত্র ৪ বিঘা জমির ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকি ধান খেতের পানির ভরা মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। তিনি আরও জানান, এ মৌসুমের ধানের বিচালি বা খড় অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবিঘা জমির বিচালি এখনই বিক্রি হচ্ছে প্রায় সাড়ে

তিন থেকে ৪ হাজার টাকায়। কিন্তু বৃষ্টি পানিতে ধান ও বিচালি উভয়ের চরম ক্ষতি হয়েছে। অবস্থা এমন এবার ধারদেনা করে মানুষ বাঁচতে পারবে কিন্তু কৃষকের সম্পদ গবাদি পশু কিভাবে বাঁচবে। তিনি আরও বলেন, বৃষ্টির আগে কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল কিন্তু বৃষ্টির পরে কৃষি শ্রমিক মেলানোই যাচ্ছেনা। আর আগের চেয়ে মজুরিও আকাশ সমান। এখন মজুরি চাচ্ছেন ৮০০ থেকে হাজার টাকা।

এদিকে একাধিক কৃষক জানান, বিগত কয়েক মৌসুমের বোরো ও আমন ধান ঘরে তোলার সময়ে কৃষকেরা লাগাতর মার খেয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। তারা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের কোন হাত নেই। বিগত কয়েকটি ধান সংগ্রহের মৌসুমে কৃষকদের পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অসংখ্য কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে বেশ কিছু বিষয়

বেরিয়ে এসেছে। অনেক বিষয় কৃষকদের অনুকূলে ছিল না। তা হলোÑ খেতের ধান পেকে

গেলেও এ বছর কৃষি শ্রমিক পাওয়া ছিল সোনার হরিণ। এ বছর অতিথি শ্রমিকের যোগান ছিল কম। খেতের ধান ঘরে তুলতে এলাকায় পরিবহনেরও যোগান যথেষ্ট ছিল না। অনেক আগে থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ঘোষণা করা হলেও অনেক কৃষক সে বিষয়ে কর্ণপাত করেননি।

তথ্যে জানা গেছে, এ বছর প্রায় সারাবছরের বোরো ধান একবারে পেকেছে। যে কারণে অতিথি শ্রমিক কম ছিল। যা পাওয়া গেছে তাদের মজুরি ছিল অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। তারপরও অনেকে শ্রমিক মেলাতে পারেনি। তাই পাকা ধান তাদের খেতেই পড়ে আছে। যা পানিতে ভাসছে।

অনেক কৃষক ধান পাকলেই ধান কাটার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় মূল্যবান গো-খাদ্যের জন্য অনেকে খেতে বিচালি ফেলে শুকাচ্ছিলেন এখন নি¤œচাপের পানির নিচে সব ধান।

সারা বিশে^ ধান রোপণ কর্তন ও সংগ্রহের জন্য আধুনিক যন্তপাতি বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি খাতে এ দেশেও আধুনিক যন্ত্রনির্ভর চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে বেশকিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষক পর্যায়ে দেয়া হয়েছে, তবে কৃষকেরা সেভাবে আকৃষ্ট হননি। আমাদের দেশের কৃষকেরা এখনও অতটা সচেতন হয়নি। ফলে ধান পাকা ও কর্তনের সময়ে কৃষি ও জেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে গ্রাম এলাকায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস ঘোষণা করা হলে অসচেতন কৃষক সচেতন হবে। সঙ্গে সঙ্গে কৃষকেরা উপকৃত হবেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খন্দকার মোহায়মেন আক্তার জানান, ইতোমধে ২০ থেকে ৩০ ভাগ ধান কৃষকেরা ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকিটা খেতেই পড়ে আছে। তিনি বলেন, প্রকৃতিতে কারও হাত নেই ফলে পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০২২ , ২৯ বৈশাখ ১৪২৮ ০৯ শাওয়াল ১৪৪৩

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভেঙে দিল কৃষকের স্বপ্ন

সাবজাল হোসেন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)

image

কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) : মাঠ ভরা ধান, ভারি বর্ষণে বিনষ্ট ফসল -সংবাদ

চলতি বোরো মৌসুমে মাঠের ধানখেতগুলো অধিক ফলনের হাতছানি দিচ্ছিল। কৃষকদের আশা ছিল নতুন ধান ঘরে তুলে দায়দেনা পরিশোধ করবেন। মেটাবেন পরিবারের সব সদস্যদের চাহিদা। মাঠের পাকা ধানগুলোতে কৃষকদের অতীতের যেকোন মৌসুমের চেয়ে বেশি ফলনের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। তাদের আশা ছিল বেশ লাভ হবে। ভালোভাবে চলবে সংসার। এমন ভাবনায় ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বোরো চাষিরা ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন।

কিন্তু বিগত মৌসুমের মতো এ বছরও পাকা ধানের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। শেষ মুহূর্তে ধান ঘরে তোলার সময়ে বৈরী আবহাওয়া নির্দয় হয়ে গেছে। নি¤œচাপের প্রভাবে গত ৩ দিনের ভারী বর্ষায় খেতের ধান মাটিতে পড়ে কাদা পানিতে একাকার হয়ে গেছে। কোন কোন মাঠের কাটা ধান পানির ওপর ভাসছে। প্রথম দিকে কৃষকেরা বুক পেতে চেষ্টা করেছে রক্ষার জন্য। কিন্তু লাগাতর ভারী বর্ষণে কৃষকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন নিচু জমির কৃষকেরা অনেকে ধানের আশা ছেড়েই দিয়েছেন।

এখন আকাশে যত কালো মেঘ জমছে কৃষকদের কপালেও পড়ছে বড় বড় নিরাশার ভাঁজ। শুধু একটা সান্ত¡না তাদের, প্রকৃতিতে কারও হাত নেই।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫০ হেক্টোর জমিতে। কিন্তু চাষ হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে।

এর মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ২৫ ভাগ জমির ধান কৃষকেরা ইতোমধ্যে ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকিটা খেতের ধান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন মাঠে গেলে দেখা যায়, এ বছর নজরে আসে বোরো ধানের বিচিত্র চিত্র। কোন মাঠে এখনও ধান কাটাই শুরু হয়নি। তবে সারা মাঠের ধান পেকে সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। আবার নিচু এলাকার মাঠের ধানগুলো বাঁচাতে অনেকে প্রখর রোদে ধান কেটে ভালোভাবে ঘরে তুলে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা শতকরা ৫ থেকে ৬ ভাগের বেশি নয়। আবার অনেকে ধান কেটে বিচালির আশায় ফেলে রেখেছিলেন।

তাদের ধানগুলো পানিতে ভাসছে। আবার অনেকে ক্ষেতের ধান এখনও কাটেননি। তারাও

পড়েছেন বিপাকে। চলমান নি¤œচাপের প্রভাবে লাগাতর ভারী বর্ষণে আগাভারী পাকা ধান খেতে জমে থাকা হাঁটু পানিতেই একাকার হয়ে গেছে। এ ধানগুলো দু-এক দিনের মধ্যে কেটে না নেয়া হলে সব ধানে চারা গজিয়ে নষ্ট হবে।

খালকুলা গ্রামের কৃষক তোফাজ্জেল হোসেন জানান, তিনি ১০ বিঘা বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। আবহাওয়ার অনেক দিনের আগ থেকে পূর্বাভাস শুনে বেশ চড়া মূল্যে শ্রমিক নিয়ে ধানগুলো ঘরে তুলেছেন। গোখাদ্যের জন্য বিচালিগুলোও সংরক্ষণ করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, তবে তার মাঠে এখনও কমপক্ষে ৮০ ভাগ ধান নিয়ে কৃষকেরা চরম বেকায়দায় আছেন।

খালকুলা গ্রামের মিলন হোসেন জানান, দুই বিঘা ধানের মধ্যে সবটুকুই কেটে শুকাতে দেয়া ছিল। কিন্তু এখন সে ধান পানিতে ভাসছে। কোনভাবে এ ক্ষতি পোষাতে পারবেন না।

বিনোদপুর গ্রামের কৃষক দম্পতি পরিমল কুমার ও অনিমা দাস জানান, খুব কষ্ট করে ১০ কাঠার একটু বেশি জমি বর্গা নিয়ে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। সব ধান কেটে শুকানোর জন্য জমিতে ফেলা ছিল কিন্তু গত ৩ দিনের ভারী বর্ষণে সে ধানগুলো খেতেই ভাসছে। ভোর থেকে টেনে টেনে ধানগুলো রাস্তায় উঠানোর চেষ্টা করছেন তাতে কোন ফল হবে বলে মনে হচ্ছে না। এখন কি করে সংসার চালাবেন। আর কিভাবেই বা পাওনাদারের দেনা মেটাবেন সে চিন্তায় আছেন।

কালীগঞ্জের ফয়লা গ্রামের বর্গাচাষি তোতা মিয়া জানান, এ বছর ২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে মাঠে ধান চাষ করেছিলেন। জমিগুলো একটু নিচু মাঠে হওয়ায় খেতের সব পাকা ধান কাদা বৃষ্টিতে একাকার হয়ে গেছে। এখন জমির মালিকের টাকাই পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কি করে সংসার চালাবেন সে চিন্তায় আছেন।

নরেন্দ্রপুর গ্রামের আরেক বর্গাচাষি মনজের আলী জানান, মাঠে নিজের কোন চাষযোগ্য জমি নেই। মাঠের রাকিবুল ইসলাম ও বল্টু মিয়ার ৩ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে সারা মৌসুম খেতে কাজ করেছি। খেতে ধানও হয়েছিল ভালো। কিন্তু গত কয়দিনের বৃষ্টিতে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন না খেয়ে মরতে হবে।

তিনি আরও বলেন, খেতের ধান বাঁচাতে হলে দ্রুতই ভেজা ধান শুকাতে হবে। সেজন্য ভেজা

ধান খেতে পানি থেকে উঠিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেখানেও পানি জমে যাচ্ছে।

সাদিকপুর গ্রামের বোরো চাষি সাজেদুল ইসলাম জানান, মোট ১১ বিঘা বোরো ধানের মধ্যে মাত্র ৪ বিঘা জমির ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকি ধান খেতের পানির ভরা মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। তিনি আরও জানান, এ মৌসুমের ধানের বিচালি বা খড় অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবিঘা জমির বিচালি এখনই বিক্রি হচ্ছে প্রায় সাড়ে

তিন থেকে ৪ হাজার টাকায়। কিন্তু বৃষ্টি পানিতে ধান ও বিচালি উভয়ের চরম ক্ষতি হয়েছে। অবস্থা এমন এবার ধারদেনা করে মানুষ বাঁচতে পারবে কিন্তু কৃষকের সম্পদ গবাদি পশু কিভাবে বাঁচবে। তিনি আরও বলেন, বৃষ্টির আগে কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল কিন্তু বৃষ্টির পরে কৃষি শ্রমিক মেলানোই যাচ্ছেনা। আর আগের চেয়ে মজুরিও আকাশ সমান। এখন মজুরি চাচ্ছেন ৮০০ থেকে হাজার টাকা।

এদিকে একাধিক কৃষক জানান, বিগত কয়েক মৌসুমের বোরো ও আমন ধান ঘরে তোলার সময়ে কৃষকেরা লাগাতর মার খেয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। তারা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের কোন হাত নেই। বিগত কয়েকটি ধান সংগ্রহের মৌসুমে কৃষকদের পাকা ধান নিয়ে বিপাকে পড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অসংখ্য কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে বেশ কিছু বিষয়

বেরিয়ে এসেছে। অনেক বিষয় কৃষকদের অনুকূলে ছিল না। তা হলোÑ খেতের ধান পেকে

গেলেও এ বছর কৃষি শ্রমিক পাওয়া ছিল সোনার হরিণ। এ বছর অতিথি শ্রমিকের যোগান ছিল কম। খেতের ধান ঘরে তুলতে এলাকায় পরিবহনেরও যোগান যথেষ্ট ছিল না। অনেক আগে থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ঘোষণা করা হলেও অনেক কৃষক সে বিষয়ে কর্ণপাত করেননি।

তথ্যে জানা গেছে, এ বছর প্রায় সারাবছরের বোরো ধান একবারে পেকেছে। যে কারণে অতিথি শ্রমিক কম ছিল। যা পাওয়া গেছে তাদের মজুরি ছিল অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। তারপরও অনেকে শ্রমিক মেলাতে পারেনি। তাই পাকা ধান তাদের খেতেই পড়ে আছে। যা পানিতে ভাসছে।

অনেক কৃষক ধান পাকলেই ধান কাটার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় মূল্যবান গো-খাদ্যের জন্য অনেকে খেতে বিচালি ফেলে শুকাচ্ছিলেন এখন নি¤œচাপের পানির নিচে সব ধান।

সারা বিশে^ ধান রোপণ কর্তন ও সংগ্রহের জন্য আধুনিক যন্তপাতি বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি খাতে এ দেশেও আধুনিক যন্ত্রনির্ভর চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে বেশকিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষক পর্যায়ে দেয়া হয়েছে, তবে কৃষকেরা সেভাবে আকৃষ্ট হননি। আমাদের দেশের কৃষকেরা এখনও অতটা সচেতন হয়নি। ফলে ধান পাকা ও কর্তনের সময়ে কৃষি ও জেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে গ্রাম এলাকায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস ঘোষণা করা হলে অসচেতন কৃষক সচেতন হবে। সঙ্গে সঙ্গে কৃষকেরা উপকৃত হবেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খন্দকার মোহায়মেন আক্তার জানান, ইতোমধে ২০ থেকে ৩০ ভাগ ধান কৃষকেরা ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকিটা খেতেই পড়ে আছে। তিনি বলেন, প্রকৃতিতে কারও হাত নেই ফলে পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে।