বয়স শুধুই একটি সংখ্যা!

এম এ কবীর

একজন মানুষের বয়স একই সময়ে একটিই হয়। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথাগতভাবে জন্ম নেয়ার পরপরই একটি শিশুকে এক বছর বয়সী হিসেবে ধরা হয়। পরের নববর্ষের দিন তার বয়সে যোগ হয় আরও একটি বছর। এর অর্থ, ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুই বছর বয়সী বলে বিবেচিত হবে! তবে বয়স নির্ধারণে কোরিয়ার এই প্রথাগত পদ্ধতি শিগগিরই পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল এই শতাব্দীপ্রাচীন গণনাপদ্ধতি বাতিল করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের অন্তর্র্বর্তীকালীন প্রস্তুতি কমিটির প্রধান লি ইয়াং-হো বলেছেন, আসন্ন নতুন প্রশাসন দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশে^র অন্যান্য অংশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য বয়স গণনা করার পদ্ধতিকে প্রমিত করতে চাইছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষের বয়স গণনা করার উপায় তিনটি। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি ১৯৬২ সাল থেকে বেশির ভাগ আইনি সংজ্ঞা এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির জন্মতারিখ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গণনাপদ্ধতি ব্যবহার করে। বয়স গণনা করার আরেকটি সরকারি উপায় রয়েছে, যেখানে শিশুরা ‘শূন্য’ বছর বয়সে জন্ম নিয়ে প্রতি বছর ১ জানুয়ারিতে তাদের বয়সের সঙ্গে এক বছর যোগ হয়। এর আওতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশুর বয়স ২০২২ সালের মধ্যেই দুই বছর হবে। যদিও সেই বছরের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দুই বছর বয়সী হবে না। তারপর আছে ‘কোরীয় বয়স’ পদ্ধতি, যেটি সাধারণত সমাজের সবাই ব্যবহার করে। এতে প্রত্যেকে জন্মের সময়ই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক বছর বয়সী হয়। আর জন্মতারিখ যা-ই হোক, নববর্ষের দিনেই বয়স এক বছর বেড়ে যায়।

বয়স যাদের ভাটির দিকে তাদের প্রিয়জনরা তাদের আশ^স্ত করতে বলে থাকেন এজ ইজ জাস্ট অ্যা নাম্বার- ষাট হলেও যা, বাহাত্তর হলেও তাই; পঁচাত্তর হলেও যা, সাতানব্বইতেও একই কথা- বয়স শুধুই একটি সংখ্যা!

শরীরিক যত অসামর্থ্যতাই থাকুক ভাবতে ভালো লাগে- যে কোন বয়সে এজ ইজ জাস্ট এ নাম্বার। আবেগহীন অজৈবিক একটি সংখ্যামাত্র। বয়সের কথাটা এমনিতেই আসেনি, উঠিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা সে দেশের প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ইয়ুন সুক ইয়োল। নির্বাচন হয়েছে ৯ মার্চ ২০২২, আনুষ্ঠানিক ফলাফল জানা গেছে পরের দিন, নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করবেন ১০ মে ২০২২। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গদিনসীন হয়েই কোরিয়ানদের বয়স গুনতিতে বিপ্লব সাধন করবেন। দক্ষিণ কোরিয়াতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে নয়, সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে তার বয়স গণনা শুরু হয়। এই গণনার উৎস চীন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন কোন দেশ বয়স গণনার এই চীনা-কোরিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করে। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে এতে সমস্যারই বেশি সৃষ্টি হয়। বয়সের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেলেও বয়স নির্ধারিত প্রতিযোগিতায় (যেমন অনূর্ধ্ব ষোলো, অনূর্ধ্ব আঠার ধরনের প্রতিযোগিতা) মার খেয়ে যায়। ইয়ুন সুক ইয়োল যুগ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ানদের ১৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখের হিসাবে ৫ কোটি ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩২ জন নাগরিকের বয়স ১ বছর করে কমে যাবে। আদেশ জারির পর থেকেই এক বছরের বাড়তি ভার থেকে দক্ষিণ কোরিয়া মুক্তি পাবে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা উডি অ্যালেন বলেছেন : আমি আমার কাজের মাধ্যমে অমরত্ব চাই না, না মরে অমরত্ব পেতে চাই।

দক্ষিণ কোরিয়াতে বয়স কমুক কিংবা যা আছে তাই থাকুক এতে মৃত্যুর কালের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। অ্যান্ডি রুনি লিখেছেন, আমি এতদিনে শিখেছি জীবনটা টয়লেট পেপার রোলের মতো, যতই শেষের কাছাকাছি আসবে ততই দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।

জন মর্টিমার লিখেছেন, বয়স যাই হোক যথাসময়ে বিদায় নেয়াটাই উত্তম, বাড়তি তিন বছর নিয়ে হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ডে কাটানোর কোনো মানে নেই। বিলি ক্রিস্টাল বলেছেন, যখন মানুষ নিজের পদক্ষেপগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখার মতো জ্ঞানী হয়ে উঠে বুঝতে হবে মানুষটি যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গেছে, তাকে একা কোথাও যেতে দেয়া ঠিক হবে না। পল ডান লিখেছেন : তুমি তোমার বিশ^াসের মতো তরুণ, তুমি তোমার সন্দেহের মতো বৃদ্ধ; তুমি তোমার আত্মবিশ^াসের মতো তরুণ, তোমার আতঙ্কের মতো বৃদ্ধ।

কোরিয়ান বয়স গণনার ফর্মুলাটি কৌতূহলোদ্দীপক। ঠিক কোন দিন সন্তানটিকে গর্ভধারণ করল, সে হিসাবও মায়ের পক্ষে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেয়া সম্ভব নয়। মায়ের গর্ভে ফুলটার্ম কাটিয়ে আসুক কি প্রিম্যাচুর বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করুক- জন্মমাত্রই শিশুটির বয়স ধরা হয় এক বছর। যদি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শিশু ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে পরদিনই, অর্থাৎ ১ জানুয়ারি তার বয়স ধরা হয় দুই বছর। এর নাম ‘কোরিয়ান এজ’, পৃথিবী অভ্যস্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল এজ’-এ। বয়স সংশোধনবাদীরা মনে করছেন কোরিয়ান বয়স ঝামেলার সৃষ্টি করছে, আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বিস্তর কাগজপত্র দাখিল করতে হচ্ছে, এতে খরচ যথেষ্ট হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন তা প্রশংসনীয়।

কিন্তু সবাই কি প্রশংসা করছেন? সমীক্ষা বলছে প্রতি ১০ জনে তিনজন বিরোধিতা করছেন। তারা মনে করছেন এ সংশোধনী কোরিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা। আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কোরিয়ান প্রয়াস অনেকদিনের। ২০১৯ এবং ২০২১-এ দুটি বিল উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে তা সমর্থিত হয়ে আইন হিসেবে স্বাক্ষরিত হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামে বয়সের তাগিদটা সবচেয়ে বেশি আসে অ্যালকোহলসেবীদের কাছ থেকে। ১৮ না হলে শুঁড়িখানা থেকে ফিরে আসতে হবে। বয়স ১ বছর কমিয়ে দিলে এখনকার সব অষ্টাদশী সপ্তদশী হয়ে যাবে। যুবকও পিছিয়ে যাবে এক বছর। শুঁড়িখানার মালিকরা তখন মদ্যপানের বয়স ১৭-তে নামিয়ে আনার দাবি জানাবে কিনা তাও ভাবনার বিষয়। প্রেসিডেন্ট ইলেক্টের এই বয়স সংস্কারকে পশ্চিমের বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘স্মার্ট মুভ’।

বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত মুরব্বি প্রজন্মের দুই ধরনের বয়স। প্রকৃত বয়স ও কাগুজে বয়স। প্রকৃত বয়স মানে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন থেকে দিন, মাস, বছর গুনে বয়স নির্ধারণ। ৭ ডিসেম্বর ২০০৪ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের বাধ্যতামূলক আইন ‘দ্য বার্থস অ্যান্ড ডেথ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ২০০৪’ জারি হয়। এটি ২০০৪ সালের ২৯ নম্বর আইন। ২০১৬ সাল থেকে আমরা স্মার্ট এনআইডি কার্ডও ধারণ করছি। রমজান আলী যখন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন তখন প্রধান শিক্ষক তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় জন্মতারিখ লিখে দিলেন ১ জানুয়ারি। তার ক্লাসমেটদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্মদিন ১ জানুয়ারি। বিভিন্ন স্কুলে পড়ার কারণে রমজান আলীর ভাইবোনদের কারও কারও বয়সের ওপর যে সার্জারি পরিচালিত হয়েছে তাতে কনিষ্ঠ একজন বোন জ্যেষ্ঠকে শুধু ডিঙ্গায়নি সহোদর দুই বোনের বয়সের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন কি চার মাস। আবার অনূর্ধ্ব ষোলো দলে উনিশ-কুড়ি বছরের খেলোয়াড়ও ঠাঁই পেয়েছে।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। ২০২১ সালে এই র?্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। সাংবাদিকদের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য অনুসারে, চলতি বছর বাংলাদেশের পয়েন্ট হলো ৩৬ দশমিক ৬৩। গত বছর যা ছিল ৫০ দশমিক ২৯ পয়েন্ট। গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০তম। অর্থনৈতিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৩৮তম। আইনগত নিয়ন্ত্রণ সূচকে ১৪৮তম এবং সামাজিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৪৯তম। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান এসব সূচকের তুলনায় বেশ খানিকটা নিচে। চলতি বছর বৈশি^ক গণমাধ্যম স্বাধীনতা র?্যাংকিংয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ নরওয়ে। দেশটির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক। সুইডেন আগের বছরের মতোই এবারও তৃতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। ১৮০তম দেশ হিসেবে তালিকার সবচেয়ে নিচে রয়েছে উত্তর কোরিয়া।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০২২ , ২৯ বৈশাখ ১৪২৮ ০৯ শাওয়াল ১৪৪৩

বয়স শুধুই একটি সংখ্যা!

এম এ কবীর

একজন মানুষের বয়স একই সময়ে একটিই হয়। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথাগতভাবে জন্ম নেয়ার পরপরই একটি শিশুকে এক বছর বয়সী হিসেবে ধরা হয়। পরের নববর্ষের দিন তার বয়সে যোগ হয় আরও একটি বছর। এর অর্থ, ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুই বছর বয়সী বলে বিবেচিত হবে! তবে বয়স নির্ধারণে কোরিয়ার এই প্রথাগত পদ্ধতি শিগগিরই পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল এই শতাব্দীপ্রাচীন গণনাপদ্ধতি বাতিল করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের অন্তর্র্বর্তীকালীন প্রস্তুতি কমিটির প্রধান লি ইয়াং-হো বলেছেন, আসন্ন নতুন প্রশাসন দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশে^র অন্যান্য অংশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য বয়স গণনা করার পদ্ধতিকে প্রমিত করতে চাইছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষের বয়স গণনা করার উপায় তিনটি। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি ১৯৬২ সাল থেকে বেশির ভাগ আইনি সংজ্ঞা এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির জন্মতারিখ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গণনাপদ্ধতি ব্যবহার করে। বয়স গণনা করার আরেকটি সরকারি উপায় রয়েছে, যেখানে শিশুরা ‘শূন্য’ বছর বয়সে জন্ম নিয়ে প্রতি বছর ১ জানুয়ারিতে তাদের বয়সের সঙ্গে এক বছর যোগ হয়। এর আওতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশুর বয়স ২০২২ সালের মধ্যেই দুই বছর হবে। যদিও সেই বছরের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দুই বছর বয়সী হবে না। তারপর আছে ‘কোরীয় বয়স’ পদ্ধতি, যেটি সাধারণত সমাজের সবাই ব্যবহার করে। এতে প্রত্যেকে জন্মের সময়ই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক বছর বয়সী হয়। আর জন্মতারিখ যা-ই হোক, নববর্ষের দিনেই বয়স এক বছর বেড়ে যায়।

বয়স যাদের ভাটির দিকে তাদের প্রিয়জনরা তাদের আশ^স্ত করতে বলে থাকেন এজ ইজ জাস্ট অ্যা নাম্বার- ষাট হলেও যা, বাহাত্তর হলেও তাই; পঁচাত্তর হলেও যা, সাতানব্বইতেও একই কথা- বয়স শুধুই একটি সংখ্যা!

শরীরিক যত অসামর্থ্যতাই থাকুক ভাবতে ভালো লাগে- যে কোন বয়সে এজ ইজ জাস্ট এ নাম্বার। আবেগহীন অজৈবিক একটি সংখ্যামাত্র। বয়সের কথাটা এমনিতেই আসেনি, উঠিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা সে দেশের প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ইয়ুন সুক ইয়োল। নির্বাচন হয়েছে ৯ মার্চ ২০২২, আনুষ্ঠানিক ফলাফল জানা গেছে পরের দিন, নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করবেন ১০ মে ২০২২। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গদিনসীন হয়েই কোরিয়ানদের বয়স গুনতিতে বিপ্লব সাধন করবেন। দক্ষিণ কোরিয়াতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে নয়, সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে তার বয়স গণনা শুরু হয়। এই গণনার উৎস চীন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন কোন দেশ বয়স গণনার এই চীনা-কোরিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করে। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে এতে সমস্যারই বেশি সৃষ্টি হয়। বয়সের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেলেও বয়স নির্ধারিত প্রতিযোগিতায় (যেমন অনূর্ধ্ব ষোলো, অনূর্ধ্ব আঠার ধরনের প্রতিযোগিতা) মার খেয়ে যায়। ইয়ুন সুক ইয়োল যুগ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ানদের ১৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখের হিসাবে ৫ কোটি ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩২ জন নাগরিকের বয়স ১ বছর করে কমে যাবে। আদেশ জারির পর থেকেই এক বছরের বাড়তি ভার থেকে দক্ষিণ কোরিয়া মুক্তি পাবে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা উডি অ্যালেন বলেছেন : আমি আমার কাজের মাধ্যমে অমরত্ব চাই না, না মরে অমরত্ব পেতে চাই।

দক্ষিণ কোরিয়াতে বয়স কমুক কিংবা যা আছে তাই থাকুক এতে মৃত্যুর কালের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। অ্যান্ডি রুনি লিখেছেন, আমি এতদিনে শিখেছি জীবনটা টয়লেট পেপার রোলের মতো, যতই শেষের কাছাকাছি আসবে ততই দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।

জন মর্টিমার লিখেছেন, বয়স যাই হোক যথাসময়ে বিদায় নেয়াটাই উত্তম, বাড়তি তিন বছর নিয়ে হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ডে কাটানোর কোনো মানে নেই। বিলি ক্রিস্টাল বলেছেন, যখন মানুষ নিজের পদক্ষেপগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখার মতো জ্ঞানী হয়ে উঠে বুঝতে হবে মানুষটি যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গেছে, তাকে একা কোথাও যেতে দেয়া ঠিক হবে না। পল ডান লিখেছেন : তুমি তোমার বিশ^াসের মতো তরুণ, তুমি তোমার সন্দেহের মতো বৃদ্ধ; তুমি তোমার আত্মবিশ^াসের মতো তরুণ, তোমার আতঙ্কের মতো বৃদ্ধ।

কোরিয়ান বয়স গণনার ফর্মুলাটি কৌতূহলোদ্দীপক। ঠিক কোন দিন সন্তানটিকে গর্ভধারণ করল, সে হিসাবও মায়ের পক্ষে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেয়া সম্ভব নয়। মায়ের গর্ভে ফুলটার্ম কাটিয়ে আসুক কি প্রিম্যাচুর বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করুক- জন্মমাত্রই শিশুটির বয়স ধরা হয় এক বছর। যদি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শিশু ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে পরদিনই, অর্থাৎ ১ জানুয়ারি তার বয়স ধরা হয় দুই বছর। এর নাম ‘কোরিয়ান এজ’, পৃথিবী অভ্যস্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল এজ’-এ। বয়স সংশোধনবাদীরা মনে করছেন কোরিয়ান বয়স ঝামেলার সৃষ্টি করছে, আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বিস্তর কাগজপত্র দাখিল করতে হচ্ছে, এতে খরচ যথেষ্ট হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন তা প্রশংসনীয়।

কিন্তু সবাই কি প্রশংসা করছেন? সমীক্ষা বলছে প্রতি ১০ জনে তিনজন বিরোধিতা করছেন। তারা মনে করছেন এ সংশোধনী কোরিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা। আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কোরিয়ান প্রয়াস অনেকদিনের। ২০১৯ এবং ২০২১-এ দুটি বিল উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে তা সমর্থিত হয়ে আইন হিসেবে স্বাক্ষরিত হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামে বয়সের তাগিদটা সবচেয়ে বেশি আসে অ্যালকোহলসেবীদের কাছ থেকে। ১৮ না হলে শুঁড়িখানা থেকে ফিরে আসতে হবে। বয়স ১ বছর কমিয়ে দিলে এখনকার সব অষ্টাদশী সপ্তদশী হয়ে যাবে। যুবকও পিছিয়ে যাবে এক বছর। শুঁড়িখানার মালিকরা তখন মদ্যপানের বয়স ১৭-তে নামিয়ে আনার দাবি জানাবে কিনা তাও ভাবনার বিষয়। প্রেসিডেন্ট ইলেক্টের এই বয়স সংস্কারকে পশ্চিমের বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘স্মার্ট মুভ’।

বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত মুরব্বি প্রজন্মের দুই ধরনের বয়স। প্রকৃত বয়স ও কাগুজে বয়স। প্রকৃত বয়স মানে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন থেকে দিন, মাস, বছর গুনে বয়স নির্ধারণ। ৭ ডিসেম্বর ২০০৪ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের বাধ্যতামূলক আইন ‘দ্য বার্থস অ্যান্ড ডেথ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ২০০৪’ জারি হয়। এটি ২০০৪ সালের ২৯ নম্বর আইন। ২০১৬ সাল থেকে আমরা স্মার্ট এনআইডি কার্ডও ধারণ করছি। রমজান আলী যখন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন তখন প্রধান শিক্ষক তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় জন্মতারিখ লিখে দিলেন ১ জানুয়ারি। তার ক্লাসমেটদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্মদিন ১ জানুয়ারি। বিভিন্ন স্কুলে পড়ার কারণে রমজান আলীর ভাইবোনদের কারও কারও বয়সের ওপর যে সার্জারি পরিচালিত হয়েছে তাতে কনিষ্ঠ একজন বোন জ্যেষ্ঠকে শুধু ডিঙ্গায়নি সহোদর দুই বোনের বয়সের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন কি চার মাস। আবার অনূর্ধ্ব ষোলো দলে উনিশ-কুড়ি বছরের খেলোয়াড়ও ঠাঁই পেয়েছে।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। ২০২১ সালে এই র?্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। সাংবাদিকদের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য অনুসারে, চলতি বছর বাংলাদেশের পয়েন্ট হলো ৩৬ দশমিক ৬৩। গত বছর যা ছিল ৫০ দশমিক ২৯ পয়েন্ট। গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০তম। অর্থনৈতিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৩৮তম। আইনগত নিয়ন্ত্রণ সূচকে ১৪৮তম এবং সামাজিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৪৯তম। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান এসব সূচকের তুলনায় বেশ খানিকটা নিচে। চলতি বছর বৈশি^ক গণমাধ্যম স্বাধীনতা র?্যাংকিংয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ নরওয়ে। দেশটির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক। সুইডেন আগের বছরের মতোই এবারও তৃতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। ১৮০তম দেশ হিসেবে তালিকার সবচেয়ে নিচে রয়েছে উত্তর কোরিয়া।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]