পরিবারতন্ত্র ও শ্রীলঙ্কার অস্থিরতা

সজীব ওয়াফি

একটু কল্পনার জগৎ থেকে ঘুরে আসি; ধরুন একেই পরিবারের চার ব্যক্তি গণতান্ত্রিক কোন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন। বিশেষত সেটা যদি হয় চার ভাইয়ের সমাবেশ। সে রাষ্ট্রের রূপ কি হবে? আর সেই পরিবারটাও কতটা শক্তিশালী এবং আগ্রাসী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে? সেই রাষ্ট্র কি গণতান্ত্রিক থাকে? নাকি গণতন্ত্রের মুখে ধোঁয়া দিয়ে রাজতন্ত্রের কূটকৌশল! কেউ বলবেন ভোটাভুটি যেহেতু আছে তাই গণতান্ত্রিক, আবার কেউ বলবেন এ তো স্রেফ রাজরাজড়ার দরবার হলো। তর্কে-বিতর্কে যে পক্ষই বিজয়ী হোক এটা সত্য যে শত অন্যায় করলেও ওই পরিবারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করবে না। তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে কে নিজের মু-ুকাটা দেবে! রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরামর্শদাতারাও তাদের সমীহ করে চলবেন, মোসাহেবি করবেন। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি হয়েছে ঠিক এরকমই। ছোট ভাই রাষ্ট্রপতি, বড়ভাই প্রধানমন্ত্রী, একভাই অর্থমন্ত্রী এবং আরেক ভাই কৃষিমন্ত্রী। এভাবে একসঙ্গে চার ভাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রবল ক্ষমতায় আসীন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পরিণামে অর্থনীতিতে ভজঘট তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।

দীর্ঘদিন থেকে দেশটি চরম অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগেছে, পরিশেষে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। বাজার পরিস্থিতি মারাত্মক রকমের ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক। খাদ্য সংকট আছে ব্যাপক মাত্রায়। অর্থনীতির বিপর্যয় সামাল দিতে গত দেড় বছরে একাধিকবার জরুরি অবস্থা জারি করেছিল সরকারপক্ষ। কাজের কাজ হয়নি কিছুই। মন্দা কাটাতে শুরু থেকেই পাশে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করেছে শ্রীলঙ্কাকে। বাংলাদেশও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের প্রতি। প্রতিবেশী হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। মানবিক কারণে হলেও বিপদের দিনে যে কারও পাশে থাকা উচিত। কিন্তু অভাবের চুলার মুখ যে ছাই দিয়েও ভরে না! ফলত, ব্যর্থ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে থেমে থেমে বিক্ষোভ হচ্ছিল। এক মাস আগে বিক্ষোভ থেকে গণবিক্ষোভে রূপান্তর ঘটে। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার অভিযোগ তুলে বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে সাধারণ জনতার অংশগ্রহণ ঘটে। স্পষ্ট করে উল্লেখ করলে গত ৯ এপ্রিল থেকে রাজাপাকসের পরিবারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে গণমানুষ। এমনকি তারা তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সামনেও।

দেশজুড়ে কারফিউ জারি থাকলেও মানুষ ব্যাপক বিক্ষোভ দেখিয়েছেন দেশটির রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে। সরকার সমর্থক এবং বিরোধীদের মধ্যে হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। অত্যন্ত দুঃখজনক যে পুলিশের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষ চলাকালে নিহত হয়েছেন একজন আইনপ্রণেতা। আগুন দেওয়া হয়েছে সরকারদলীয় সাবেক এক মন্ত্রীর বাড়িতে। শত চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার শেষ রক্ষা হয়নি। মোটাদাগে গণ-আন্দোলনের মুখোমুখি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মাহিন্দা। সাধারণ জনতা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকাসেরও পদত্যাগ চাচ্ছেন। কেননা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দারই ছোট ভাই। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে মাহিন্দা এবং প্রেসিডেন্ট বাদে তার অন্য ভাইদের এই পদত্যাগ বস্তুত রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতাহীনতা নয়। বরং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার যৌথ সরকারের নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে মাহিন্দ্রার আবার আবির্ভাব সম্ভব। তবে এটা ঠিক যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব আরও গতি পেল।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তাহলে কীভাবে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি দায়ী হয়? সংক্ষিপ্ততাকারে বললে সরকারের প্রেসিডেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোতে ছিল পারিবারিক দাপট, অদূরদর্শী নীতি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন। পরিবারটি এতটাই ঐশ্বরিক ক্ষমতা পেয়েছিল যে তাদের পরিকল্পিত নীতির বিরুদ্ধে কেউ সমালোচনা করার সুযোগ পায়নি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সৃষ্টি হওয়া প্রবল ক্ষমতার বিপরীতে ওই রকমের কার্যকরী বিরোধী শক্তি না থাকলে যা হওয়ার তাই হয়। রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্টসহ বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকা- করে তারা এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত। তারা হিসাব করেনি তাদের মেগা মেগা প্রকল্পে খরচের বিপরীতে আয় হবে নাকি লোকসান গুনতে হবে।

আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মতো নেই। তবে কখনো লবনকান্ড, কখনো পেঁয়াজকা- এবং তেল-ওয়ালাদের তেলসামাতি বারবারই জনগণকে বিপাকে ফেলছে। দ্রব্যমূল্য এতটাই ‘পাগলা ঘোড়া লাগাম ছাড়া’ পরিস্থিতি যে জনগণের পকেট খালি, প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বাড়ছে জনরোষ। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য ভাঙতে সরকার নিজেও হিমশিম খাচ্ছে, যা বাণিজ্যমন্ত্রীর অসহায়ত্বক বক্তব্যে পরিষ্কার। আমাদের রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎসও শ্রীলঙ্কার ন্যায় শুধু পর্যটন কেন্দ্রিক নয়; আছে গার্মেন্টস শিল্প, রেমিট্যান্স আর কৃষিতে উচ্চপ্রযুক্তির ব্যবহার। রাজনীতিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরিবার কেন্দ্রিক হলেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ দপ্তর শ্রীলঙ্কার মতো এক পরিবারের দাপট এখানে অনুপস্থিত। স্বজনপ্রীতি একটু-আধটু যে নেই এটাও কেউ অস্বীকার যাবে না।

করোনা মহামারী এবং ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতি বেশ কিছু রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মহামন্দা সৃষ্টি করছে। কাজেই আমরা এখনো ভালো আছি চিন্তা করে নিশ্চিন্তে হাতগুটিয়ে বসে থাকাও অপরিপক্ব কাজ। আমাদের বৈদেশিক ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে বেকারত্ব। অনেকেই করোনায় চাকরি হারিয়েছেন, সে সব পরিবারের আছে অর্থনৈতিক সংকট। অন্যদিকে আমরা এ মুহূর্তে অতিক্রম করছি জনসংখ্যার বোনাস যুগ। বোনাস যুগের এই সুবিধা কাজে না লাগাতে পারলে, দ্রব্যমূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না নিলে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বাংলায় লাগতেই বা কতক্ষণ!

শ্রীলঙ্কার পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং তাদের ভুল নীতির জন্য অর্থনৈতিক অস্থিরতায় পরেছে দেশটি, শ্রীলঙ্কার জনগণের ভেতরে অনাস্থা তৈরি করেছে; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিস্তারে উৎকর্ষতা জুগিয়েছে। যা হোক রাজাপাকসের পদত্যাগ নিঃসন্দেহে দেশটির জনগণ এবং বিরোধী শক্তিগুলোর জন্য একটা বিজয়। তবে এতেই কি দেশটিতে শান্তি ফিরবে? হয়তো নাও ফিরতে পারে। অর্থনৈতিক মুক্তি তো আরও দূরের পথ। নতুন সর্বদলীয় সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিলেও অর্থনীতির জটিল এই পরিস্থিতি কাটতে তাদের কমপক্ষে দুই থেকে পাঁচ বছর সময়ের প্রয়োজন। তবে আলাদিনের কোন চেরাগ যদি তারা পেয়ে যায় সেটা তাদের জনগণের ভাগ্যের ব্যাপার।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০২২ , ২৯ বৈশাখ ১৪২৮ ০৯ শাওয়াল ১৪৪৩

পরিবারতন্ত্র ও শ্রীলঙ্কার অস্থিরতা

সজীব ওয়াফি

image

একটু কল্পনার জগৎ থেকে ঘুরে আসি; ধরুন একেই পরিবারের চার ব্যক্তি গণতান্ত্রিক কোন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন। বিশেষত সেটা যদি হয় চার ভাইয়ের সমাবেশ। সে রাষ্ট্রের রূপ কি হবে? আর সেই পরিবারটাও কতটা শক্তিশালী এবং আগ্রাসী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে? সেই রাষ্ট্র কি গণতান্ত্রিক থাকে? নাকি গণতন্ত্রের মুখে ধোঁয়া দিয়ে রাজতন্ত্রের কূটকৌশল! কেউ বলবেন ভোটাভুটি যেহেতু আছে তাই গণতান্ত্রিক, আবার কেউ বলবেন এ তো স্রেফ রাজরাজড়ার দরবার হলো। তর্কে-বিতর্কে যে পক্ষই বিজয়ী হোক এটা সত্য যে শত অন্যায় করলেও ওই পরিবারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করবে না। তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে কে নিজের মু-ুকাটা দেবে! রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরামর্শদাতারাও তাদের সমীহ করে চলবেন, মোসাহেবি করবেন। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি হয়েছে ঠিক এরকমই। ছোট ভাই রাষ্ট্রপতি, বড়ভাই প্রধানমন্ত্রী, একভাই অর্থমন্ত্রী এবং আরেক ভাই কৃষিমন্ত্রী। এভাবে একসঙ্গে চার ভাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রবল ক্ষমতায় আসীন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পরিণামে অর্থনীতিতে ভজঘট তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।

দীর্ঘদিন থেকে দেশটি চরম অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগেছে, পরিশেষে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। বাজার পরিস্থিতি মারাত্মক রকমের ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক। খাদ্য সংকট আছে ব্যাপক মাত্রায়। অর্থনীতির বিপর্যয় সামাল দিতে গত দেড় বছরে একাধিকবার জরুরি অবস্থা জারি করেছিল সরকারপক্ষ। কাজের কাজ হয়নি কিছুই। মন্দা কাটাতে শুরু থেকেই পাশে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করেছে শ্রীলঙ্কাকে। বাংলাদেশও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের প্রতি। প্রতিবেশী হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। মানবিক কারণে হলেও বিপদের দিনে যে কারও পাশে থাকা উচিত। কিন্তু অভাবের চুলার মুখ যে ছাই দিয়েও ভরে না! ফলত, ব্যর্থ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে থেমে থেমে বিক্ষোভ হচ্ছিল। এক মাস আগে বিক্ষোভ থেকে গণবিক্ষোভে রূপান্তর ঘটে। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার অভিযোগ তুলে বিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে সাধারণ জনতার অংশগ্রহণ ঘটে। স্পষ্ট করে উল্লেখ করলে গত ৯ এপ্রিল থেকে রাজাপাকসের পরিবারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে গণমানুষ। এমনকি তারা তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সামনেও।

দেশজুড়ে কারফিউ জারি থাকলেও মানুষ ব্যাপক বিক্ষোভ দেখিয়েছেন দেশটির রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে। সরকার সমর্থক এবং বিরোধীদের মধ্যে হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। অত্যন্ত দুঃখজনক যে পুলিশের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষ চলাকালে নিহত হয়েছেন একজন আইনপ্রণেতা। আগুন দেওয়া হয়েছে সরকারদলীয় সাবেক এক মন্ত্রীর বাড়িতে। শত চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার শেষ রক্ষা হয়নি। মোটাদাগে গণ-আন্দোলনের মুখোমুখি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মাহিন্দা। সাধারণ জনতা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকাসেরও পদত্যাগ চাচ্ছেন। কেননা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দারই ছোট ভাই। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে মাহিন্দা এবং প্রেসিডেন্ট বাদে তার অন্য ভাইদের এই পদত্যাগ বস্তুত রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতাহীনতা নয়। বরং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার যৌথ সরকারের নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে মাহিন্দ্রার আবার আবির্ভাব সম্ভব। তবে এটা ঠিক যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব আরও গতি পেল।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তাহলে কীভাবে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি দায়ী হয়? সংক্ষিপ্ততাকারে বললে সরকারের প্রেসিডেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোতে ছিল পারিবারিক দাপট, অদূরদর্শী নীতি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন। পরিবারটি এতটাই ঐশ্বরিক ক্ষমতা পেয়েছিল যে তাদের পরিকল্পিত নীতির বিরুদ্ধে কেউ সমালোচনা করার সুযোগ পায়নি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সৃষ্টি হওয়া প্রবল ক্ষমতার বিপরীতে ওই রকমের কার্যকরী বিরোধী শক্তি না থাকলে যা হওয়ার তাই হয়। রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্টসহ বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকা- করে তারা এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত। তারা হিসাব করেনি তাদের মেগা মেগা প্রকল্পে খরচের বিপরীতে আয় হবে নাকি লোকসান গুনতে হবে।

আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মতো নেই। তবে কখনো লবনকান্ড, কখনো পেঁয়াজকা- এবং তেল-ওয়ালাদের তেলসামাতি বারবারই জনগণকে বিপাকে ফেলছে। দ্রব্যমূল্য এতটাই ‘পাগলা ঘোড়া লাগাম ছাড়া’ পরিস্থিতি যে জনগণের পকেট খালি, প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বাড়ছে জনরোষ। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য ভাঙতে সরকার নিজেও হিমশিম খাচ্ছে, যা বাণিজ্যমন্ত্রীর অসহায়ত্বক বক্তব্যে পরিষ্কার। আমাদের রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎসও শ্রীলঙ্কার ন্যায় শুধু পর্যটন কেন্দ্রিক নয়; আছে গার্মেন্টস শিল্প, রেমিট্যান্স আর কৃষিতে উচ্চপ্রযুক্তির ব্যবহার। রাজনীতিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরিবার কেন্দ্রিক হলেও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ দপ্তর শ্রীলঙ্কার মতো এক পরিবারের দাপট এখানে অনুপস্থিত। স্বজনপ্রীতি একটু-আধটু যে নেই এটাও কেউ অস্বীকার যাবে না।

করোনা মহামারী এবং ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতি বেশ কিছু রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মহামন্দা সৃষ্টি করছে। কাজেই আমরা এখনো ভালো আছি চিন্তা করে নিশ্চিন্তে হাতগুটিয়ে বসে থাকাও অপরিপক্ব কাজ। আমাদের বৈদেশিক ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে বেকারত্ব। অনেকেই করোনায় চাকরি হারিয়েছেন, সে সব পরিবারের আছে অর্থনৈতিক সংকট। অন্যদিকে আমরা এ মুহূর্তে অতিক্রম করছি জনসংখ্যার বোনাস যুগ। বোনাস যুগের এই সুবিধা কাজে না লাগাতে পারলে, দ্রব্যমূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না নিলে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বাংলায় লাগতেই বা কতক্ষণ!

শ্রীলঙ্কার পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং তাদের ভুল নীতির জন্য অর্থনৈতিক অস্থিরতায় পরেছে দেশটি, শ্রীলঙ্কার জনগণের ভেতরে অনাস্থা তৈরি করেছে; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিস্তারে উৎকর্ষতা জুগিয়েছে। যা হোক রাজাপাকসের পদত্যাগ নিঃসন্দেহে দেশটির জনগণ এবং বিরোধী শক্তিগুলোর জন্য একটা বিজয়। তবে এতেই কি দেশটিতে শান্তি ফিরবে? হয়তো নাও ফিরতে পারে। অর্থনৈতিক মুক্তি তো আরও দূরের পথ। নতুন সর্বদলীয় সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিলেও অর্থনীতির জটিল এই পরিস্থিতি কাটতে তাদের কমপক্ষে দুই থেকে পাঁচ বছর সময়ের প্রয়োজন। তবে আলাদিনের কোন চেরাগ যদি তারা পেয়ে যায় সেটা তাদের জনগণের ভাগ্যের ব্যাপার।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]