বেপরোয়া নিধনে হুমকির মুখে নদীর সুস্বাদু পাঙাশ

নির্লিপ্ত মৎস্য কর্মকর্তারা

‘পাঙ্গাস’ মিঠা পানির নদ-নদীর একটি সুস্বাদু, লোভনীয় ও কাঁটাবিহীন তৈলাক্ত মাছ। প্রজনন নিরাপদ করতে না পারায় এ মাছটি প্রায় বিলুপ্তির পথে গিয়েছিল। তবে ইলিশ প্রজনন নিরাপদ আইন কার্যকর করতে গিয়ে সুফল মিলেছে পাঙ্গাস মাছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীন নদ নদীতে পাঙ্গাসের প্রজনন বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্ত প্রজনন হওয়া পাঙ্গাস বাচ্চা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন মৎস্য অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তারা। তাদের অসততার সুযোগে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজারে প্রকাশ্যে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ৩ থেকে ৭-৮ ইঞ্চি সাইজের পাঙ্গাস মাছের বাচ্চা। প্রতিদিন কত হাজার মন পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন এবং ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে তার কোন সঠিক হিসাবে নেই। অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে এ মাছ নিধনে বাঁশের তৈরী বিশেষ ‘চাই’ (মাছ নিধনের উপকরন) ব্যবহার করছেন জেলেরা।

বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, মৎস্য আইনে ১২ ইঞ্চির কম সাইজের পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন এবং ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীকে ১ বছরের কারাদ- সহ জরিমানার বিধান রয়েছে। তিনি আরও জানান, ইলিশের নিরাপদ প্রজনন ও বড় হওয়া নিশ্চিত করতে অভয়াশ্রমগুলোতে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল টানা দুই মাস এবং আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে ও পরে মোট ২২ দিন জলসীমায় সব ধরনের মাছ আহরন নিষিদ্ধ থাকে। আইনটি ইলিশের জন্য হলেও এসময়ে অন্যান্য মাছও নিরাপদ প্রজননের সুযোগ পায়। যে কারণে নদ-নদীতে পাঙ্গাস ও পোমা মাছের উৎপাদনও বেড়েছে।

গত ৩ বছর পাঙ্গাস মাছের মৌসুম আশ্বিন-কার্তিক মাসে ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের মাছ বেশী পরিমান ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। পাঙ্গাস বাচ্চা বেপরোয়াভাবে নিধন হচ্ছে স্বীকার করে মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক মাঠ কর্মকর্তা বলেছেন, প্রজনের পর এক বছরে একটি পাঙ্গাসের ওজন হয় ২ থেকে আড়াই কেজি পর্যন্ত। ২ থেকে ৩ বছর বেঁচে থাকলে আট থেকে দশ কেজি ওজন ছাড়িয়ে যায়। পাঙ্গাস বাচ্চা রক্ষা করতে পারলে এটি দেশের অন্যতম মৎস্য সম্পদে পরিনত হতে পারতো। এই মাছ বিদেশেও রফতানি করা যেত। মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, পাঙ্গাস মাছেরও প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-মার্চে। যে কারণে এই সময়ে নদনদী পাঙ্গাসের বাচ্চায় ভরপুর থাকে।

গত প্রায় একমাস যাবত বরিশাল নগরীর সবগুলো বাজার এবং অলিগলিতে ফেরি করে ৩ থেকে ৬-৭ ইঞ্চি সাইজের পাঙ্গাস বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে দাম আকার ভেদে প্রতিকেজি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বিক্রেতারা জানান, তারা নগরীর পোর্ট রোড এবং সদর উপজেলার তালতলী, চন্দ্রমোহন এবং বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ মোকাম থেকে এ মাছ পাইকারি কেনেন। প্রতিদিন শত শত মণ পাঙ্গাস বাচ্চা বিক্রি করা হয় এসব মোকামে। এর সত্যতা মেলে সম্প্রতি বরিশাল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহনে। কালাবদর নদীর তীরে স্থাপিত এই মোকামটি বরিশাল নগরীর নদীর মাছ সরবরাহের বড় কেন্দ্র। সেখানে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা গেছে কিছুক্ষণ পর পরই নদী থেকে জেলেরা নৌকা নিয়ে অন্য মাছের সঙ্গে পাঙ্গাস বাচ্চা নিয়ে আসছেন। এক একজন জেলে ৫ থেকে ১০ কেজি বা তার বেশি পরিমাণ পাঙ্গাস বাচ্চা আনছেন। ডাকে ওই মাছ কিনে নিচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি চন্দ্রমোহন শাখার সভাপতি আলী আকবর আকন জানালেন, কালাবদর ও তৎসংলগ্ন তেঁতুলিয়া নদীতে নিধন করা পাঙ্গাস বাচ্চা প্রতিদিন এভাবে চন্দ্রমোহন মোকামে বিক্রি হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিঠা পানির গভীর জলের এ মাছটি দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো বড় নদীতে বেপরোয়াভাবে নিধন করছেন অসাধু জেলেরা।

পাঙ্গাস বাচ্চা নিধনের বিশেষ কৌশল

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর জানান, তার নিজ এলাকা হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন মেঘনায় পাঙ্গাস বাচ্চা নিধনে চীন থেকে আমদানি করা ‘চাইজাল’ নামক বিশেষ জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০০ থেকে ২০০ হাত লম্বা ওই জালের পকেটে ঘ্রানজাতীয় হরমোন মিশ্রিত খাবার রেখে নদীতে পাতা হয়। ঘ্রানে খাবার খেতে এসে পকেটে আটকা পড়ছে পাঙ্গাস মাছের বাচ্চাগুলো।

মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, গভীর মেঘনায় বাঁশের তৈরি বিশেষ চাঁই দিয়ে পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন করার কথা তিনি শুনেছেন। নিধনের স্থানগুলো শনাক্ত করতে না পারায় তিনি অভিযান চালাতে পারছেন না। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি ধলা মাঝি জানান, তার এলাকায় রামনাবাদ নদীর চালিতাবুনিয়া গরুভাঙ্গা নামক পয়েন্টে সবচেয়ে বেশি পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন হয়। জেলেরা বাঁশ দিয়ে ৭-৮ ফুট লম্বা বিশেষ ‘চাঁই’ তৈরি করেন।

তার ভেতর ঘ্রানযুক্ত ওষুধ মেশানো খাবার রেখে জাহাজ বাঁধার ‘গ্রাফি’ দিয়ে চাই নদীর মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। ওই খাবার খেতে এসে এক একটি চাইতে শত শত পাঙ্গাস বাচ্চা ধরা পড়ছে। একই কথা জানান রাঙ্গাবালী উপজেলার ক্ষুদ্র জেলের সমিতির সভাপতি মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, রাঙ্গাবালীর পাশ দিয়ে আগুনমুখা নদীতে এই পদ্ধতিতে পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন করা হচ্ছে।

শনিবার, ১৪ মে ২০২২ , ৩১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ শাওয়াল ১৪৪৩

বেপরোয়া নিধনে হুমকির মুখে নদীর সুস্বাদু পাঙাশ

নির্লিপ্ত মৎস্য কর্মকর্তারা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, বরিশাল

‘পাঙ্গাস’ মিঠা পানির নদ-নদীর একটি সুস্বাদু, লোভনীয় ও কাঁটাবিহীন তৈলাক্ত মাছ। প্রজনন নিরাপদ করতে না পারায় এ মাছটি প্রায় বিলুপ্তির পথে গিয়েছিল। তবে ইলিশ প্রজনন নিরাপদ আইন কার্যকর করতে গিয়ে সুফল মিলেছে পাঙ্গাস মাছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে অভ্যন্তরীন নদ নদীতে পাঙ্গাসের প্রজনন বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্ত প্রজনন হওয়া পাঙ্গাস বাচ্চা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন মৎস্য অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তারা। তাদের অসততার সুযোগে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজারে প্রকাশ্যে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ৩ থেকে ৭-৮ ইঞ্চি সাইজের পাঙ্গাস মাছের বাচ্চা। প্রতিদিন কত হাজার মন পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন এবং ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে তার কোন সঠিক হিসাবে নেই। অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে এ মাছ নিধনে বাঁশের তৈরী বিশেষ ‘চাই’ (মাছ নিধনের উপকরন) ব্যবহার করছেন জেলেরা।

বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, মৎস্য আইনে ১২ ইঞ্চির কম সাইজের পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন এবং ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীকে ১ বছরের কারাদ- সহ জরিমানার বিধান রয়েছে। তিনি আরও জানান, ইলিশের নিরাপদ প্রজনন ও বড় হওয়া নিশ্চিত করতে অভয়াশ্রমগুলোতে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল টানা দুই মাস এবং আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে ও পরে মোট ২২ দিন জলসীমায় সব ধরনের মাছ আহরন নিষিদ্ধ থাকে। আইনটি ইলিশের জন্য হলেও এসময়ে অন্যান্য মাছও নিরাপদ প্রজননের সুযোগ পায়। যে কারণে নদ-নদীতে পাঙ্গাস ও পোমা মাছের উৎপাদনও বেড়েছে।

গত ৩ বছর পাঙ্গাস মাছের মৌসুম আশ্বিন-কার্তিক মাসে ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের মাছ বেশী পরিমান ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। পাঙ্গাস বাচ্চা বেপরোয়াভাবে নিধন হচ্ছে স্বীকার করে মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক মাঠ কর্মকর্তা বলেছেন, প্রজনের পর এক বছরে একটি পাঙ্গাসের ওজন হয় ২ থেকে আড়াই কেজি পর্যন্ত। ২ থেকে ৩ বছর বেঁচে থাকলে আট থেকে দশ কেজি ওজন ছাড়িয়ে যায়। পাঙ্গাস বাচ্চা রক্ষা করতে পারলে এটি দেশের অন্যতম মৎস্য সম্পদে পরিনত হতে পারতো। এই মাছ বিদেশেও রফতানি করা যেত। মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, পাঙ্গাস মাছেরও প্রজনন মৌসুম ফেব্রুয়ারি-মার্চে। যে কারণে এই সময়ে নদনদী পাঙ্গাসের বাচ্চায় ভরপুর থাকে।

গত প্রায় একমাস যাবত বরিশাল নগরীর সবগুলো বাজার এবং অলিগলিতে ফেরি করে ৩ থেকে ৬-৭ ইঞ্চি সাইজের পাঙ্গাস বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে দাম আকার ভেদে প্রতিকেজি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বিক্রেতারা জানান, তারা নগরীর পোর্ট রোড এবং সদর উপজেলার তালতলী, চন্দ্রমোহন এবং বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ মোকাম থেকে এ মাছ পাইকারি কেনেন। প্রতিদিন শত শত মণ পাঙ্গাস বাচ্চা বিক্রি করা হয় এসব মোকামে। এর সত্যতা মেলে সম্প্রতি বরিশাল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহনে। কালাবদর নদীর তীরে স্থাপিত এই মোকামটি বরিশাল নগরীর নদীর মাছ সরবরাহের বড় কেন্দ্র। সেখানে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা গেছে কিছুক্ষণ পর পরই নদী থেকে জেলেরা নৌকা নিয়ে অন্য মাছের সঙ্গে পাঙ্গাস বাচ্চা নিয়ে আসছেন। এক একজন জেলে ৫ থেকে ১০ কেজি বা তার বেশি পরিমাণ পাঙ্গাস বাচ্চা আনছেন। ডাকে ওই মাছ কিনে নিচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি চন্দ্রমোহন শাখার সভাপতি আলী আকবর আকন জানালেন, কালাবদর ও তৎসংলগ্ন তেঁতুলিয়া নদীতে নিধন করা পাঙ্গাস বাচ্চা প্রতিদিন এভাবে চন্দ্রমোহন মোকামে বিক্রি হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিঠা পানির গভীর জলের এ মাছটি দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো বড় নদীতে বেপরোয়াভাবে নিধন করছেন অসাধু জেলেরা।

পাঙ্গাস বাচ্চা নিধনের বিশেষ কৌশল

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর জানান, তার নিজ এলাকা হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন মেঘনায় পাঙ্গাস বাচ্চা নিধনে চীন থেকে আমদানি করা ‘চাইজাল’ নামক বিশেষ জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০০ থেকে ২০০ হাত লম্বা ওই জালের পকেটে ঘ্রানজাতীয় হরমোন মিশ্রিত খাবার রেখে নদীতে পাতা হয়। ঘ্রানে খাবার খেতে এসে পকেটে আটকা পড়ছে পাঙ্গাস মাছের বাচ্চাগুলো।

মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, গভীর মেঘনায় বাঁশের তৈরি বিশেষ চাঁই দিয়ে পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন করার কথা তিনি শুনেছেন। নিধনের স্থানগুলো শনাক্ত করতে না পারায় তিনি অভিযান চালাতে পারছেন না। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সভাপতি ধলা মাঝি জানান, তার এলাকায় রামনাবাদ নদীর চালিতাবুনিয়া গরুভাঙ্গা নামক পয়েন্টে সবচেয়ে বেশি পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন হয়। জেলেরা বাঁশ দিয়ে ৭-৮ ফুট লম্বা বিশেষ ‘চাঁই’ তৈরি করেন।

তার ভেতর ঘ্রানযুক্ত ওষুধ মেশানো খাবার রেখে জাহাজ বাঁধার ‘গ্রাফি’ দিয়ে চাই নদীর মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। ওই খাবার খেতে এসে এক একটি চাইতে শত শত পাঙ্গাস বাচ্চা ধরা পড়ছে। একই কথা জানান রাঙ্গাবালী উপজেলার ক্ষুদ্র জেলের সমিতির সভাপতি মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, রাঙ্গাবালীর পাশ দিয়ে আগুনমুখা নদীতে এই পদ্ধতিতে পাঙ্গাস বাচ্চা নিধন করা হচ্ছে।