পশ্চিমবঙ্গবাসীর একমাত্র ভবিতব্য

গৌতম রায়

করাচী থেকে মারগালা পাহাড় আর তক্ষশীলার মধ্যে ইসলামাবাদে পাকিস্থানের রাজধানী স্থানান্তর আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের পাট বিক্রির টাকায় সেই নতুন রাজধানী তৈরির প্ল্যান দেয়ার পর ইয়াহিয়া যে পুরস্কার পেয়েছিলেন আইয়ুবের কাছ থেকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যারা সাহিত্য শিরোমণি করলেন, অচিরেই তাদের তেমন পুরস্কার জুটবে... এটা আশা করা যায়। সেই আশাতেই আবার আশঙ্কা; ইয়াহিয়া যে পরিণতি আইয়ুবের করে ছেড়েছিলেন, এরা আবার তেমনটাই ওর করে দেবেন না তো?

এই আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে এখানকার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, এখানকার বাংলা আকাদেমি রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন একটা বিশেষ পুরস্কার দেয়ার প্রেক্ষিতে। বাংলা আকাদেমির সভাপতি তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় কবি, সাহিত্যিকেরা একযোগে, সর্বসম্মতিতে এই নবপ্রবর্তিত পুরস্কারটি মমতাকে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তে এসেছেন। বলাবাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের বিবেচনায় কারা এই বঙ্গের সেরা কবি, সাহিত্যিক, যারা মমতাকে পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করেছেন, তাদের নাম আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। সামাজিক গণমাধ্যমে বাংলা আকাদেমির পরিচালন সমিতির সভ্যদের নামগুলো ঘোরাফেরা করছে। সেই সভ্যদের ভিতরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আবুল বাশার, প্রচেত গুপ্তের পাশে তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ অর্পিতা ঘোষ, প্রকাশক সমিতির একটি গোষ্ঠীর সুধাংশুশেখর দে, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়েরা আছেন। তারা কেউই এখন ও পর্যন্ত এই পুরস্কার দেয়া ঘিরে প্রকাশ্যে একটাও কথা বলেননি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা কত উঁচু দরের সাহিত্যিক, প্রতি বছর বইমেলায় বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় তার কতগুলো বই বের হয়- সেইসব প্রশ্নের ভিতরে ঢুকতেই রুচিতে বাধে। কারণ, সাহিত্য রচনা দেখলেই আমাদের মনে পড়ে যায় স্বৈরাচারী এরশাদের কাব্য চর্চার কথা। আর মনে পড়ে কামরুল হাসানের সেই বিখ্যাত পোস্টার, ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’র কথা।

ভারতে কি দিল্লির সরকার, কি পশ্চিমবঙ্গের সরকার এখন সম্পূর্ণভাবে স্তাবকতার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে। সেই স্তাবকতা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁচেছে যে, একটা পর্যায়ে অবিভক্ত পাকিস্থানে ক্ষমতা পেয়েই আইয়ুব খান নিজেকে গণতন্ত্রী প্রমাণ করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে মার্শাল ল এর দ্বারা রাজনীতিকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন, ঠিক সেই রকম। বামফ্রন্টের আমলে কোন কোন আমলা যে শাসক স্তাবকতার চেষ্টা করেননি তা নয়। কলকাতা শহরের পুলিশ কমিশনার থাকাকালীন তুষার তালুকদার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ‘মনীষী’ অভিধায় অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবুর সঙ্গে মমতার পার্থক্য হল এইখানে যে, তুষার তালুকদারের স্তাবকতাকে পাত্তাই দেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। আর আজ স্তাবকদের প্রতি বকশিসে নিজেকে উজার করে দিতে কার্পণ্য করছেন না মমতা।

গোটা ভারতজুড়ে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে শাসকের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে তা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। অতীতে কংগ্রেস আমলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রথমনাথ বিশীর মতো মানুষ শাসক কংগ্রেসের তাঁবেদারি করতেন। আজ মমতার উগ্র সমর্থক আবুল বাশারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশেষ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর বিচ্ছেদ ঘটবার পর তিনি হঠাৎ করেই বাম সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। মমতা ক্ষমতাসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাশারের রঙ বদল করতে দেরি হয়নি। সুবোধ সরকার মমতা ক্ষমতায় আসার প্রথম পর্যায়েও বাম শিবিরে ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সরাসরি বাম শিবিরে না থাকলেও শীর্ষস্তরের অনেক বাম নেতার আপত্তি সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার তাকে বঙ্কিম পুরস্কার দিয়েছিল তাদের শাসনকালের একদম প্রথম পর্যায়েই। সুনীল অবশ্য পরবর্তীকালে বহু প্রশ্নেই বাম শাসকদের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমর্থক ছিলেন।

অন্নদাশঙ্কর রায় নিবেদিত প্রাণ গান্ধীবাদী হওয়া সত্ত্বেও চিন - ভারত সীমান্ত সমস্যার কালে তার অবস্থান তৎকালীন ভারত শাসক কংগ্রেস মেনে নিতে পারেনি। সেই অন্নদাশঙ্করকেই কিন্তু কংগ্রেস শাসকেরাই ভারতের লোকসভায় রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য করতে চেয়েছিল। রাজানুগ্রহে চিরদিনই অনাগ্রহ অন্নদাশঙ্করের। ফলে তিনি নারাজ হওয়াতেই তারাশঙ্কর কে লোকসভার মনোনীত সদস্য করেছিল কংগ্রেস। তারাশঙ্কর কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ হয়েও চারের দশকে বাম প্রভাবিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘের নেতৃত্ব দিতে দ্বিধা করেন নি।

বামপন্থি নন, কিন্তু আত্মনিবেদিত প্রগতিশীল, তাই তার মানসসন্তান বাংলা আকাদেমি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অন্নদাশঙ্কর কেই তার সভাপতি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। আমৃত্যু অন্নদাশঙ্কর সেই পদে ছিলেন। তসলিমা নাসরিনকে ঘিরে বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমর্থক ছিলেন না অন্নদাশঙ্কর। তা বলে তার বাংলা আকাদেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন ঘিরে কখনওই বামফ্রন্ট সরকার কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। আবার শোনা যায়, বামফ্রন্ট সরকার নাকি তাকে বাংলা আকাদেমির সভাপতি করেনি বলেই বিশেষ অনুরাগী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের থেকে দূরত্ব রচনা করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ।

জ্যোতি বাবুর সি এ জয়কৃষ্ণ ঘোষের দাদার উদ্যোগে সল্ট লেকে একটা মেলা হতো। সেই মেলাতে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে জ্যোতিবাবুকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল কল্পনা দত্তের (যোশী) সঙ্গে। সংবর্ধনার উত্তর দিতে গিয়ে অকপটে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন; কল্পনা যোশীর সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে আপনারা সংবর্ধনা দিচ্ছেন আমাকে? আপনারা জানেন, কল্পনা যোশী কে?

স্তাবকদের স্তাবকতার মুখে জ্যোতিবাবুর মতো জবাব দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- এই প্রত্যাশা কখনো মমতার অতিবড় স্তাবক ও করেন না। তবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন পুরস্কারের মঞ্চে মমতার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রী বিমলচন্দ্র সিংহের বিজ্ঞানী পুত্র ড. বিকাশ সিংহের গদগদ মুখ ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল, মেধার এভাবে ক্ষমতার কাছে আত্মনিবেদিত আত্মসমর্পণ খোদ হিটলার, মুসোলিনীর আমলেও এত নিঃসংকোচে ঘটেনি।

নরেন্দ্র মোদি নিজেই নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করছেন। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রী মমতার অধীন বাংলা আকাদেমি অসামান্য সাহিত্যিকের শিরোপা দিচ্ছে মমতাকে। কেমন যেন আজীএর ভারত, আজকের পশ্চিমবঙ্গ মনে করিয়ে দিচ্ছে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, এরশাদদের শাসনকালটাকে। শিক্ষা, রুচিবোধ, গণতন্ত্রের প্রতি মর্যাদাবোধ কোন স্তরের থাকলে নিজেকে আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এরশাদদের সঙ্গে তুলনীয় করে তোলা যায় তা অনবদ্য মুন্সিয়ানায় মমতা দেখিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের গরিব পাটচাষির রক্ত জল করা টাকায় আইয়ুব- ইয়াহিয়া চক্র যেমন নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ তৈরি করেছিলেন, তেমনিই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের রক্তেই এখন কবীর সুমন বর্ণিত ‘মমতার মন্দির’ই পশ্চিমবঙ্গবাসীর একমাত্র ভবিতব্য হতে চলেছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ১৪ মে ২০২২ , ৩১ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ শাওয়াল ১৪৪৩

পশ্চিমবঙ্গবাসীর একমাত্র ভবিতব্য

গৌতম রায়

করাচী থেকে মারগালা পাহাড় আর তক্ষশীলার মধ্যে ইসলামাবাদে পাকিস্থানের রাজধানী স্থানান্তর আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের পাট বিক্রির টাকায় সেই নতুন রাজধানী তৈরির প্ল্যান দেয়ার পর ইয়াহিয়া যে পুরস্কার পেয়েছিলেন আইয়ুবের কাছ থেকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যারা সাহিত্য শিরোমণি করলেন, অচিরেই তাদের তেমন পুরস্কার জুটবে... এটা আশা করা যায়। সেই আশাতেই আবার আশঙ্কা; ইয়াহিয়া যে পরিণতি আইয়ুবের করে ছেড়েছিলেন, এরা আবার তেমনটাই ওর করে দেবেন না তো?

এই আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে এখানকার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, এখানকার বাংলা আকাদেমি রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন একটা বিশেষ পুরস্কার দেয়ার প্রেক্ষিতে। বাংলা আকাদেমির সভাপতি তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় কবি, সাহিত্যিকেরা একযোগে, সর্বসম্মতিতে এই নবপ্রবর্তিত পুরস্কারটি মমতাকে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তে এসেছেন। বলাবাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের বিবেচনায় কারা এই বঙ্গের সেরা কবি, সাহিত্যিক, যারা মমতাকে পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করেছেন, তাদের নাম আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। সামাজিক গণমাধ্যমে বাংলা আকাদেমির পরিচালন সমিতির সভ্যদের নামগুলো ঘোরাফেরা করছে। সেই সভ্যদের ভিতরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আবুল বাশার, প্রচেত গুপ্তের পাশে তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ অর্পিতা ঘোষ, প্রকাশক সমিতির একটি গোষ্ঠীর সুধাংশুশেখর দে, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়েরা আছেন। তারা কেউই এখন ও পর্যন্ত এই পুরস্কার দেয়া ঘিরে প্রকাশ্যে একটাও কথা বলেননি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা কত উঁচু দরের সাহিত্যিক, প্রতি বছর বইমেলায় বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় তার কতগুলো বই বের হয়- সেইসব প্রশ্নের ভিতরে ঢুকতেই রুচিতে বাধে। কারণ, সাহিত্য রচনা দেখলেই আমাদের মনে পড়ে যায় স্বৈরাচারী এরশাদের কাব্য চর্চার কথা। আর মনে পড়ে কামরুল হাসানের সেই বিখ্যাত পোস্টার, ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’র কথা।

ভারতে কি দিল্লির সরকার, কি পশ্চিমবঙ্গের সরকার এখন সম্পূর্ণভাবে স্তাবকতার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে। সেই স্তাবকতা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁচেছে যে, একটা পর্যায়ে অবিভক্ত পাকিস্থানে ক্ষমতা পেয়েই আইয়ুব খান নিজেকে গণতন্ত্রী প্রমাণ করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে মার্শাল ল এর দ্বারা রাজনীতিকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন, ঠিক সেই রকম। বামফ্রন্টের আমলে কোন কোন আমলা যে শাসক স্তাবকতার চেষ্টা করেননি তা নয়। কলকাতা শহরের পুলিশ কমিশনার থাকাকালীন তুষার তালুকদার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ‘মনীষী’ অভিধায় অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু জ্যোতিবাবুর সঙ্গে মমতার পার্থক্য হল এইখানে যে, তুষার তালুকদারের স্তাবকতাকে পাত্তাই দেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। আর আজ স্তাবকদের প্রতি বকশিসে নিজেকে উজার করে দিতে কার্পণ্য করছেন না মমতা।

গোটা ভারতজুড়ে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে শাসকের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে তা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। অতীতে কংগ্রেস আমলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রথমনাথ বিশীর মতো মানুষ শাসক কংগ্রেসের তাঁবেদারি করতেন। আজ মমতার উগ্র সমর্থক আবুল বাশারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশেষ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর বিচ্ছেদ ঘটবার পর তিনি হঠাৎ করেই বাম সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। মমতা ক্ষমতাসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাশারের রঙ বদল করতে দেরি হয়নি। সুবোধ সরকার মমতা ক্ষমতায় আসার প্রথম পর্যায়েও বাম শিবিরে ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সরাসরি বাম শিবিরে না থাকলেও শীর্ষস্তরের অনেক বাম নেতার আপত্তি সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার তাকে বঙ্কিম পুরস্কার দিয়েছিল তাদের শাসনকালের একদম প্রথম পর্যায়েই। সুনীল অবশ্য পরবর্তীকালে বহু প্রশ্নেই বাম শাসকদের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমর্থক ছিলেন।

অন্নদাশঙ্কর রায় নিবেদিত প্রাণ গান্ধীবাদী হওয়া সত্ত্বেও চিন - ভারত সীমান্ত সমস্যার কালে তার অবস্থান তৎকালীন ভারত শাসক কংগ্রেস মেনে নিতে পারেনি। সেই অন্নদাশঙ্করকেই কিন্তু কংগ্রেস শাসকেরাই ভারতের লোকসভায় রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য করতে চেয়েছিল। রাজানুগ্রহে চিরদিনই অনাগ্রহ অন্নদাশঙ্করের। ফলে তিনি নারাজ হওয়াতেই তারাশঙ্কর কে লোকসভার মনোনীত সদস্য করেছিল কংগ্রেস। তারাশঙ্কর কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ হয়েও চারের দশকে বাম প্রভাবিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘের নেতৃত্ব দিতে দ্বিধা করেন নি।

বামপন্থি নন, কিন্তু আত্মনিবেদিত প্রগতিশীল, তাই তার মানসসন্তান বাংলা আকাদেমি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অন্নদাশঙ্কর কেই তার সভাপতি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। আমৃত্যু অন্নদাশঙ্কর সেই পদে ছিলেন। তসলিমা নাসরিনকে ঘিরে বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমর্থক ছিলেন না অন্নদাশঙ্কর। তা বলে তার বাংলা আকাদেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন ঘিরে কখনওই বামফ্রন্ট সরকার কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। আবার শোনা যায়, বামফ্রন্ট সরকার নাকি তাকে বাংলা আকাদেমির সভাপতি করেনি বলেই বিশেষ অনুরাগী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের থেকে দূরত্ব রচনা করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ।

জ্যোতি বাবুর সি এ জয়কৃষ্ণ ঘোষের দাদার উদ্যোগে সল্ট লেকে একটা মেলা হতো। সেই মেলাতে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে জ্যোতিবাবুকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল কল্পনা দত্তের (যোশী) সঙ্গে। সংবর্ধনার উত্তর দিতে গিয়ে অকপটে জ্যোতিবাবু বলেছিলেন; কল্পনা যোশীর সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে আপনারা সংবর্ধনা দিচ্ছেন আমাকে? আপনারা জানেন, কল্পনা যোশী কে?

স্তাবকদের স্তাবকতার মুখে জ্যোতিবাবুর মতো জবাব দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- এই প্রত্যাশা কখনো মমতার অতিবড় স্তাবক ও করেন না। তবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন পুরস্কারের মঞ্চে মমতার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রী বিমলচন্দ্র সিংহের বিজ্ঞানী পুত্র ড. বিকাশ সিংহের গদগদ মুখ ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল, মেধার এভাবে ক্ষমতার কাছে আত্মনিবেদিত আত্মসমর্পণ খোদ হিটলার, মুসোলিনীর আমলেও এত নিঃসংকোচে ঘটেনি।

নরেন্দ্র মোদি নিজেই নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করছেন। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রী মমতার অধীন বাংলা আকাদেমি অসামান্য সাহিত্যিকের শিরোপা দিচ্ছে মমতাকে। কেমন যেন আজীএর ভারত, আজকের পশ্চিমবঙ্গ মনে করিয়ে দিচ্ছে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, এরশাদদের শাসনকালটাকে। শিক্ষা, রুচিবোধ, গণতন্ত্রের প্রতি মর্যাদাবোধ কোন স্তরের থাকলে নিজেকে আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এরশাদদের সঙ্গে তুলনীয় করে তোলা যায় তা অনবদ্য মুন্সিয়ানায় মমতা দেখিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের গরিব পাটচাষির রক্ত জল করা টাকায় আইয়ুব- ইয়াহিয়া চক্র যেমন নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ তৈরি করেছিলেন, তেমনিই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের রক্তেই এখন কবীর সুমন বর্ণিত ‘মমতার মন্দির’ই পশ্চিমবঙ্গবাসীর একমাত্র ভবিতব্য হতে চলেছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]