রবীন্দ্র সমসাময়িক ছোটগল্পকার প্রভাতকুমার

গৌতম হাজরা

রবীন্দ্র সমসাময়িক ছোটগল্পকার হিসেবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের (১৮৭৩-১৯৩২) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্র সমসাময়িক হয়েও তার গল্পের বিষয় ভাবনা ও শৈলী ছিল একদম অন্যরকম। তাঁর রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৪টি হলেও, তিনি কিন্তু বিশেষভাবে দক্ষ ছিলেন ছোটগল্পকার হিসাবে। তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা ১১৮টি। তিনি যে ছোটগল্প লিখতে ভালোবাসতেন তা তাঁর গল্পের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়। এ প্রসঙ্গে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, “তাঁর উপন্যাসগুলি পড়লে মনে হয়, যেন ছোটগল্পের উপযুক্ত স্বল্প পরিমাণ আখ্যানবস্তু কেবল ঘটনা সমাবেশের দ্বারা অস্বাভাবিকরূপে স্ফীত করা হইয়াছে।... আমাদের জীবনে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গের ঢেউ লাগে, যে ছোটখাটো সমস্যার স্পর্শে ইহা আন্দোলিত হয় তাহার সমস্ত বুদ্বুদ ও উত্তেজনা ছোটখাটো পেয়ারায় বেশ স্বচ্ছন্দে ও সুশোভনভাবে ধরিয়া যায়। এই ছোটগল্পের আর্টে প্রভাতকুমারের স্বাভাবিক নিপুণতা বিস্ময়কর।”

প্রভাতকুমারের গল্প লেখার পেছনে রবীন্দ্রনাথের যে প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তা তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, “রবিবাবুর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইয়াই আমি গদ্য রচনায় হাত দিই। তিনি আমায় যখন গদ্য লিখতে অনুরোধ করেন, আমি তাঁহাকে লিখিয়াছিলাম- কবিতার মা বাপ নাই, যা খুশি লিখিয়া যাই- কবিতা হয়। কিন্তু গদ্য লিখিতে হইলে যথেষ্ট পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন। সে পাণ্ডিত্য আমার কই?” এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “গদ্য রচনার জন্য প্রধান জিনিস হইতেছে রস। রীতিমত আয়োজন না করিয়া, কোমর না বাঁধিয়া সমালোচনা হউক, প্রবন্ধ হউক, একটা কিছু লিখিয়া ফেল দেখি।”

প্রথমদিকে “প্রদীপ” পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি গল্পে প্রভাতকুমার “রাধামণি দেবী” ছদ্মনামের আড?ালে আত্মগোপন করেছিলেন। এই ছদ্মনামেই “পূজার চিঠি” গল্প লিখে তিনি “কুন্তলীন” পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি স্বনামে গল্প লিখতে শুরু করেন।

প্রভাতকুমারের গল্প সেকালের সাধারণ পাঠককুলের কাছে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এমনকি জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি রবীন্দ্রগল্পকেও ছাপিয়ে যান। যদিও তিনি অনেকগুলি উপন্যাস লিখেছিলেন, তবুও তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয়তা ছিল ছোটগল্পেই। আসলে পাঠককুল রবীন্দ্রনাথের গল্পে যা পাননি, প্রভাতকুমারের গল্পে ছিল সেই না পাওয়ার ক্ষতিপূরণ। এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পাঠকের চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে লেখা নয়। তাঁর লেখায় ছিল সমুদ্রবিস্তারতা। পাঠককুলের কোনো সাধ্যই ছিল না সাঁতার কাটার।

প্রভাতকুমারের গল্পের পাঠক বিস্তৃতির প্রধান কারণ তাঁর গল্পের রস। গল্পের কাছে সাধারণ পাঠক আদ্যন্ত সমন্বিত একটি গল্প চায়। একটিমাত্র ভাবনা, উপলব্ধি বা ঘটনামাত্রকে অবলম্বন করে দার্শনিকতত্ত্ব বা হৃদয়তত্ত্ব তারা চান না। সেক্ষেত্রে প্রভাতকুমারের গল্পগুলি ছিল গল্পরসে সুসমৃদ্ধ ও তত্ত্বনিরপেক্ষ।

প্রভাতকুমারের গল্প হাস্যরসের বর্ণচ্ছটায় সমুজ্জ্বল। তাঁর গল্পে আছে হিউমার। তাই অনেক সময় হাসির আড়ালেও চোখ জল আসে। তাঁর গল্পে কৌতুকও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। সে তুলনায় বুদ্ধিদৃপ্ত বাক্যচ্ছটা খুবই কম আর ব্যঙ্গের চাবুক নেই বললেই চলে।

তাঁর ছোটগল্পে পরিণাম, রমণীয়তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। “দেবী”, “কাশীবাসিনী”, “আদরিণী” মূলত এই তিনটি বাদে তাঁর বিপুল গল্পভাণ্ডারে কোনো ট্রাজিক পরিণতির গল্প নেই। তেমনি বাঙালি জীবনের সুখদুঃখ তাঁর গল্পের প্রধান উপাদান। তাঁর গল্পের নরনারীদের সঙ্গে পাঠকদের অপরিচয়েরও দূরত্ব নেই।

প্রভাতকুমারের গল্পে সমাজের অন্যায়, অসঙ্গতি, মূঢ়তা, কুসংস্কার মূলত চালচিত্র হিসাবে ব্যবহৃত। সামাজিক সমস্যা, সংকট তাঁর গল্পের অভিমুখ নয়। তাঁর চালচিত্রে তিনি স্থাপন করেছেন স্নেহ সমধুর ও কৌতুক। সমাজের অন্যায় অসঙ্গতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কোনো উত্তপ্ত জেহাদ নেই।

ফরাসি গল্পের ভক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রভাতকুমারের গল্পের উচ্চ প্রশংসা করে গেছেন। গল্পাঞ্জলির গল্প ছয়টি যথাক্রমে “বাল্যবন্ধু”, “বিলাতফেরতের বিপদ”, “মাদুলী”, “রসময়ীর রসিকতা”, “মাতৃহীন” ও “আদরিণী” পাঠ করে তিনি লেখককে জানান... “তোমার রচিত কোনো গল্প মাসিক পত্রিকাতে বাহির হইলেই আমি আগ্রহের সহিত পড়িয়া থাকি। তোমার গল্প আমার খুবই ভালো লাগে। বড় বড় ফরাসি গল্প লেখকদের গল্প অপেক্ষা তোমার গল্প কোনো অংশে দীন নহে। তোমার প্রতিভায় বঙ্গসাহিত্যের একটি অংশ উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।”

প্রমথ চৌধুরী প্রভাতকুমারকে গী দ্য মপাঁসার সঙ্গে তুলনা করেন আর সেই সূত্রেই প্রভাতকুমারকে বলা হতো বাংলার মপাঁসা। যদিও মপাঁসার গল্পের ছায়ামাত্রও ছিল না প্রভাতকুমারের গল্পে। মপাঁসার গল্পের জগৎ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “A French World Created by a Frenchman and peopled by Frenchmen”। প্রভাতকুমার বিলেতের পটভূমিতে কয়েকটি বিলাতি গল্প লিখলেও সেই গল্পের ইংরেজ নরনারীরা ব্রিটিশ স্বভাববিবর্জিত এবং তাদের বাঙালিকরণ বলা হয়েছে।

গল্পের গঠন কৌশলের দিক দিয়েও মপাঁসা ও প্রভাতকুমারের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেজন্য মপাঁসার সঙ্গে প্রভাতকুমারের তুলনা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। মপাঁসার মস্তিষ্কপ্রসূত গল্প আর প্রভাতকুমারের হৃদয়প্রসূত গল্পের মধ্যে তাই যথেষ্ট ফারাক। তাই মপাঁসা যদি হন স্যাটায়ারিস্ট তাহলে প্রভাতকুমার হবেন হিউমারিস্ট।

প্রভাতকুমারের যে গল্পে এই লঘু হাস্যকৌতুক পাওয়া যায় সে গল্পটি হলো “বলবান জামাতা”। এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গল্প। জামাতা বাবাজি নলিনীর মেয়েলি ধরনের নরম চেহারা, লাজুক স্বভাব। সেজন্য শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্যালিকা কাছে সে উপহাসিত হয়। সেই অপমানের জ্বালা জুড়ানোর জন্য সে পেশিযুক্ত পুরুষালি চেহারা গড়ে তোলে। এবং এই পালোয়ান চেহারা নিয়ে সে এলাহাবাদে শ্বশুরবাড়িতে যাত্রা করে। শ্বশুর ছিলেন সেখানকার উকিল। তারপর নলিনীর শ্বশুরের নামেই আর এক উকিলের বাড়িতে গিয়ে সে পৌঁছায় গাড়োয়ানের ভুলে। সে ঘটনা নিয়ে বেশ হাস্যকৌতুক জমে ওঠে। অবশেষে সে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছালে গল্পের হাস্যকৌতুকের নিষ্পত্তি।

প্রভাতকুমারের “প্রণয় পরিণাম” গল্পে আছে ১৪ বছরের এক অকালপক্ব কিশোরের প্রণয়াবেগের হাস্যমধুর পরিণাম। “নিষিদ্ধ ফল” গল্পে আছে ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক গতির কথা। “বউচুরি” গল্পটিও সমজাতীয়, যেখানে দেখানো হয়েছে প্রকৃতির মধুর প্রতিশোধ। যৌবনের স্বাভাবিক দাবিকে অস্বীকার করার ব্যর্থতা স্বামী স্ত্রীর মিলন কামনায় এখানে মধুর পরিসমাপ্তি লাভ করেছে।

“বিষবৃক্ষের ফল” এবং “পোস্টমাস্টার” দুটি গল্পই দারুণ উপভোগ্য। “বিবাহের বিজ্ঞাপন” গল্পে আছে লালারাম অবতারের দুর্গতি। প্রতিজ্ঞাপূরণ গল্পে দেখানো হয়েছে অবাস্তব আদর্শবাদের অসারতা। লঘু হাস্যরস প্রধান গল্পগুলির মধ্যে “মাষ্টার মহাশয়” ও “রসময়ীর রসিকতা” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। “রসময়ীর রসিকতা” গল্পটি দাম্পত্য সম্পর্কের। তবে সে সম্পর্ককে ঠিক প্রেমের সম্পর্ক বলা চলে না। স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠাই এই গল্পের ভিত্তিভূমি। আর “মাষ্টার মহাশয়” গল্পে দুই গ্রামের মাষ্টার মশাইয়ের বিদ্যাবুদ্ধির প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধে চতুরতর শিক্ষকটি “I don’t know প্রশ্ন নিক্ষেপ করে জয় হাসিল করেছে। “যজ্ঞভঙ্গ” গল্পে এক ভক্ত

সন্ন্যাসীর মাধ্যমে তন্ত্রমতে মারণযজ্ঞের দ্বারা ছোট ভাইয়ের প্রাণনাশকতাকল্পে বডোভাই বঙ্কুর অপচেষ্টা ও তন্ত্রে অন্ধবিশ্বাস। “খুড়ো মহাশয়” গল্পে ভূতের কুসংস্কার প্রভৃতি হাস্যরস সৃষ্টির উপাদান হিসাবে ব্যবহার।

দু’একটা গল্পে প্রভাতকুমারকে একটু বিপরীতমুখী দেখা যায়। “হীরালাল” গল্প এদিক থেকে ব্যতিক্রমী। প্রভাতকুমারের কোনো কোনো গল্পে সামাজিক কুপ্রথার সমস্যা ও সমালোচনা দেখা যায়। সেই গল্পগুলি যথাক্রমে “কুড়ানো মেয়ে” ও “অঙ্গহীনা”। তার বেশ কিছু গল্পে সার্থক হিউমার সৃষ্টির নৈপুণ্যে সমুজ্জ্বল। এইরকম একটি মর্মস্পর্শী গল্পের নাম “বাজীকর”। ম্যাজিক দেখিয়ে চিত্তবিনোদনের বিনিময়ে পাওয়া যৎসামান্য আয়ে চলে বাজিকরের দেনা জর্জর সংসার। অভিনবত্ব দেখিয়ে জ্যান্ত মানুষ ভক্ষণ করতে যাওয়ার কৌতুককর পরিণতি গল্পটির পরিচয়। কিন্তু এর আড়ালে হতদরিদ্র ম্যাজিশিয়ানের চরম অভাব অনটনের অশ্রুসজল কারুণ্য মরমি পাঠকের চোখে জল এনে দেবে।

১৯০১ সালে প্রভাতকুমার ব্যারিস্টারি পড?ার জন্য লন্ডন যান। ১৯০৩ এর শেষে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। তিন বছরের বিলেতবাসের অভিজ্ঞতা তাঁকে বিলেতের পটভূমিকায় গল্প লিখতে প্রাণিত করে। সে গল্পগুলি যথাক্রমে দেশী ও বিলিতি, গল্প সংকলনের পর্যায়ভুক্ত মুক্তি, ফুলের মূল্য, পুনর্মুষিক ও প্রবাসিনী এই শ্রেণির গল্প। গল্পাঞ্জলি, মাতৃহীন এবং গল্পবীথি-র কুমুদের বন্ধু, নবকথার ভিখারী সাহেব, বিলাসিনী ও অন্যান্য গল্প সংকলনের সতী প্রভৃতি গল্পও এই পর্যায়ের। এই পর্যায়ের গল্পগুলির মধ্যে ফুলের মূল্য সর্বাধিক মর্মস্পর্শী এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটি জননী অপত্যস্নেহ ও অগ্রজের প্রতি সহোদরার ভালোবাসার এক অনুপম যুগলবন্দি। তেমনি লন্ডনের পটভূমিতে লেখা মাতৃহীন গল্পের মধ্যে এই অপত্যস্নেহও দেখতে পাই।

ইংরেজ সমাজের চিত্র হিসেবে বিলেতফেরতের বিপদ গল্পটিও স্মরণীয়। মুক্তি গল্পে আছে বিলেতে এক বাঙালি যুবকের সস্তা আমোদপ্রিয়তা ও নষ্টামির সমালোচনা। পুনর্মুষিক গল্পে আছে হিন্দুধর্মের আচার বিচারের প্রতি ইংরেজ যুবতী মিস টেম্পলের হাস্যকর আসক্তির বিবরণ। এইসব গল্পে তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে বাঙালির রাজনৈতিক বিরোধ, সংঘর্ষের আগুনে ইংরেজ-বাঙালির পারস্পরিক প্রেমপ্রীতি দেখিয়েছেন।

প্রভাতকুমার জীবনের সহজ সুন্দররূপের দ্রষ্টা ও রূপকার। সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনে দুঃখ-দারিদ্র্য, শোষণ-পীডন আছেই- এ সত্য তার অজানা ছিল না। কিন্তু তিনি সেদিকে যাননি। কারণ, তিনি ছিলেন এসবের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তিনি তাই সবকিছুকেই হাস্যরূপের মাধ্যমেই চালিত করতে চেয়েছেন। তাই প্রভাতকুমারকে মূল্যায়ন করতে হয় একটু অন্যভাবেই। কারণ, তিনি তাঁর গল্পে যে কৌতুকরস ও ঘটনাবৈচিত্র এনেছেন তা খুব কম গল্পকারের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ , ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৭ শাওয়াল ১৪৪৩

রবীন্দ্র সমসাময়িক ছোটগল্পকার প্রভাতকুমার

গৌতম হাজরা

image

রবীন্দ্র সমসাময়িক ছোটগল্পকার হিসেবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের (১৮৭৩-১৯৩২) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্র সমসাময়িক হয়েও তার গল্পের বিষয় ভাবনা ও শৈলী ছিল একদম অন্যরকম। তাঁর রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৪টি হলেও, তিনি কিন্তু বিশেষভাবে দক্ষ ছিলেন ছোটগল্পকার হিসাবে। তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা ১১৮টি। তিনি যে ছোটগল্প লিখতে ভালোবাসতেন তা তাঁর গল্পের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়। এ প্রসঙ্গে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, “তাঁর উপন্যাসগুলি পড়লে মনে হয়, যেন ছোটগল্পের উপযুক্ত স্বল্প পরিমাণ আখ্যানবস্তু কেবল ঘটনা সমাবেশের দ্বারা অস্বাভাবিকরূপে স্ফীত করা হইয়াছে।... আমাদের জীবনে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গের ঢেউ লাগে, যে ছোটখাটো সমস্যার স্পর্শে ইহা আন্দোলিত হয় তাহার সমস্ত বুদ্বুদ ও উত্তেজনা ছোটখাটো পেয়ারায় বেশ স্বচ্ছন্দে ও সুশোভনভাবে ধরিয়া যায়। এই ছোটগল্পের আর্টে প্রভাতকুমারের স্বাভাবিক নিপুণতা বিস্ময়কর।”

প্রভাতকুমারের গল্প লেখার পেছনে রবীন্দ্রনাথের যে প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তা তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, “রবিবাবুর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইয়াই আমি গদ্য রচনায় হাত দিই। তিনি আমায় যখন গদ্য লিখতে অনুরোধ করেন, আমি তাঁহাকে লিখিয়াছিলাম- কবিতার মা বাপ নাই, যা খুশি লিখিয়া যাই- কবিতা হয়। কিন্তু গদ্য লিখিতে হইলে যথেষ্ট পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন। সে পাণ্ডিত্য আমার কই?” এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “গদ্য রচনার জন্য প্রধান জিনিস হইতেছে রস। রীতিমত আয়োজন না করিয়া, কোমর না বাঁধিয়া সমালোচনা হউক, প্রবন্ধ হউক, একটা কিছু লিখিয়া ফেল দেখি।”

প্রথমদিকে “প্রদীপ” পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি গল্পে প্রভাতকুমার “রাধামণি দেবী” ছদ্মনামের আড?ালে আত্মগোপন করেছিলেন। এই ছদ্মনামেই “পূজার চিঠি” গল্প লিখে তিনি “কুন্তলীন” পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি স্বনামে গল্প লিখতে শুরু করেন।

প্রভাতকুমারের গল্প সেকালের সাধারণ পাঠককুলের কাছে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এমনকি জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি রবীন্দ্রগল্পকেও ছাপিয়ে যান। যদিও তিনি অনেকগুলি উপন্যাস লিখেছিলেন, তবুও তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয়তা ছিল ছোটগল্পেই। আসলে পাঠককুল রবীন্দ্রনাথের গল্পে যা পাননি, প্রভাতকুমারের গল্পে ছিল সেই না পাওয়ার ক্ষতিপূরণ। এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পাঠকের চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে লেখা নয়। তাঁর লেখায় ছিল সমুদ্রবিস্তারতা। পাঠককুলের কোনো সাধ্যই ছিল না সাঁতার কাটার।

প্রভাতকুমারের গল্পের পাঠক বিস্তৃতির প্রধান কারণ তাঁর গল্পের রস। গল্পের কাছে সাধারণ পাঠক আদ্যন্ত সমন্বিত একটি গল্প চায়। একটিমাত্র ভাবনা, উপলব্ধি বা ঘটনামাত্রকে অবলম্বন করে দার্শনিকতত্ত্ব বা হৃদয়তত্ত্ব তারা চান না। সেক্ষেত্রে প্রভাতকুমারের গল্পগুলি ছিল গল্পরসে সুসমৃদ্ধ ও তত্ত্বনিরপেক্ষ।

প্রভাতকুমারের গল্প হাস্যরসের বর্ণচ্ছটায় সমুজ্জ্বল। তাঁর গল্পে আছে হিউমার। তাই অনেক সময় হাসির আড়ালেও চোখ জল আসে। তাঁর গল্পে কৌতুকও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। সে তুলনায় বুদ্ধিদৃপ্ত বাক্যচ্ছটা খুবই কম আর ব্যঙ্গের চাবুক নেই বললেই চলে।

তাঁর ছোটগল্পে পরিণাম, রমণীয়তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। “দেবী”, “কাশীবাসিনী”, “আদরিণী” মূলত এই তিনটি বাদে তাঁর বিপুল গল্পভাণ্ডারে কোনো ট্রাজিক পরিণতির গল্প নেই। তেমনি বাঙালি জীবনের সুখদুঃখ তাঁর গল্পের প্রধান উপাদান। তাঁর গল্পের নরনারীদের সঙ্গে পাঠকদের অপরিচয়েরও দূরত্ব নেই।

প্রভাতকুমারের গল্পে সমাজের অন্যায়, অসঙ্গতি, মূঢ়তা, কুসংস্কার মূলত চালচিত্র হিসাবে ব্যবহৃত। সামাজিক সমস্যা, সংকট তাঁর গল্পের অভিমুখ নয়। তাঁর চালচিত্রে তিনি স্থাপন করেছেন স্নেহ সমধুর ও কৌতুক। সমাজের অন্যায় অসঙ্গতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কোনো উত্তপ্ত জেহাদ নেই।

ফরাসি গল্পের ভক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রভাতকুমারের গল্পের উচ্চ প্রশংসা করে গেছেন। গল্পাঞ্জলির গল্প ছয়টি যথাক্রমে “বাল্যবন্ধু”, “বিলাতফেরতের বিপদ”, “মাদুলী”, “রসময়ীর রসিকতা”, “মাতৃহীন” ও “আদরিণী” পাঠ করে তিনি লেখককে জানান... “তোমার রচিত কোনো গল্প মাসিক পত্রিকাতে বাহির হইলেই আমি আগ্রহের সহিত পড়িয়া থাকি। তোমার গল্প আমার খুবই ভালো লাগে। বড় বড় ফরাসি গল্প লেখকদের গল্প অপেক্ষা তোমার গল্প কোনো অংশে দীন নহে। তোমার প্রতিভায় বঙ্গসাহিত্যের একটি অংশ উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।”

প্রমথ চৌধুরী প্রভাতকুমারকে গী দ্য মপাঁসার সঙ্গে তুলনা করেন আর সেই সূত্রেই প্রভাতকুমারকে বলা হতো বাংলার মপাঁসা। যদিও মপাঁসার গল্পের ছায়ামাত্রও ছিল না প্রভাতকুমারের গল্পে। মপাঁসার গল্পের জগৎ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “A French World Created by a Frenchman and peopled by Frenchmen”। প্রভাতকুমার বিলেতের পটভূমিতে কয়েকটি বিলাতি গল্প লিখলেও সেই গল্পের ইংরেজ নরনারীরা ব্রিটিশ স্বভাববিবর্জিত এবং তাদের বাঙালিকরণ বলা হয়েছে।

গল্পের গঠন কৌশলের দিক দিয়েও মপাঁসা ও প্রভাতকুমারের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেজন্য মপাঁসার সঙ্গে প্রভাতকুমারের তুলনা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। মপাঁসার মস্তিষ্কপ্রসূত গল্প আর প্রভাতকুমারের হৃদয়প্রসূত গল্পের মধ্যে তাই যথেষ্ট ফারাক। তাই মপাঁসা যদি হন স্যাটায়ারিস্ট তাহলে প্রভাতকুমার হবেন হিউমারিস্ট।

প্রভাতকুমারের যে গল্পে এই লঘু হাস্যকৌতুক পাওয়া যায় সে গল্পটি হলো “বলবান জামাতা”। এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গল্প। জামাতা বাবাজি নলিনীর মেয়েলি ধরনের নরম চেহারা, লাজুক স্বভাব। সেজন্য শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্যালিকা কাছে সে উপহাসিত হয়। সেই অপমানের জ্বালা জুড়ানোর জন্য সে পেশিযুক্ত পুরুষালি চেহারা গড়ে তোলে। এবং এই পালোয়ান চেহারা নিয়ে সে এলাহাবাদে শ্বশুরবাড়িতে যাত্রা করে। শ্বশুর ছিলেন সেখানকার উকিল। তারপর নলিনীর শ্বশুরের নামেই আর এক উকিলের বাড়িতে গিয়ে সে পৌঁছায় গাড়োয়ানের ভুলে। সে ঘটনা নিয়ে বেশ হাস্যকৌতুক জমে ওঠে। অবশেষে সে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছালে গল্পের হাস্যকৌতুকের নিষ্পত্তি।

প্রভাতকুমারের “প্রণয় পরিণাম” গল্পে আছে ১৪ বছরের এক অকালপক্ব কিশোরের প্রণয়াবেগের হাস্যমধুর পরিণাম। “নিষিদ্ধ ফল” গল্পে আছে ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক গতির কথা। “বউচুরি” গল্পটিও সমজাতীয়, যেখানে দেখানো হয়েছে প্রকৃতির মধুর প্রতিশোধ। যৌবনের স্বাভাবিক দাবিকে অস্বীকার করার ব্যর্থতা স্বামী স্ত্রীর মিলন কামনায় এখানে মধুর পরিসমাপ্তি লাভ করেছে।

“বিষবৃক্ষের ফল” এবং “পোস্টমাস্টার” দুটি গল্পই দারুণ উপভোগ্য। “বিবাহের বিজ্ঞাপন” গল্পে আছে লালারাম অবতারের দুর্গতি। প্রতিজ্ঞাপূরণ গল্পে দেখানো হয়েছে অবাস্তব আদর্শবাদের অসারতা। লঘু হাস্যরস প্রধান গল্পগুলির মধ্যে “মাষ্টার মহাশয়” ও “রসময়ীর রসিকতা” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। “রসময়ীর রসিকতা” গল্পটি দাম্পত্য সম্পর্কের। তবে সে সম্পর্ককে ঠিক প্রেমের সম্পর্ক বলা চলে না। স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠাই এই গল্পের ভিত্তিভূমি। আর “মাষ্টার মহাশয়” গল্পে দুই গ্রামের মাষ্টার মশাইয়ের বিদ্যাবুদ্ধির প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধে চতুরতর শিক্ষকটি “I don’t know প্রশ্ন নিক্ষেপ করে জয় হাসিল করেছে। “যজ্ঞভঙ্গ” গল্পে এক ভক্ত

সন্ন্যাসীর মাধ্যমে তন্ত্রমতে মারণযজ্ঞের দ্বারা ছোট ভাইয়ের প্রাণনাশকতাকল্পে বডোভাই বঙ্কুর অপচেষ্টা ও তন্ত্রে অন্ধবিশ্বাস। “খুড়ো মহাশয়” গল্পে ভূতের কুসংস্কার প্রভৃতি হাস্যরস সৃষ্টির উপাদান হিসাবে ব্যবহার।

দু’একটা গল্পে প্রভাতকুমারকে একটু বিপরীতমুখী দেখা যায়। “হীরালাল” গল্প এদিক থেকে ব্যতিক্রমী। প্রভাতকুমারের কোনো কোনো গল্পে সামাজিক কুপ্রথার সমস্যা ও সমালোচনা দেখা যায়। সেই গল্পগুলি যথাক্রমে “কুড়ানো মেয়ে” ও “অঙ্গহীনা”। তার বেশ কিছু গল্পে সার্থক হিউমার সৃষ্টির নৈপুণ্যে সমুজ্জ্বল। এইরকম একটি মর্মস্পর্শী গল্পের নাম “বাজীকর”। ম্যাজিক দেখিয়ে চিত্তবিনোদনের বিনিময়ে পাওয়া যৎসামান্য আয়ে চলে বাজিকরের দেনা জর্জর সংসার। অভিনবত্ব দেখিয়ে জ্যান্ত মানুষ ভক্ষণ করতে যাওয়ার কৌতুককর পরিণতি গল্পটির পরিচয়। কিন্তু এর আড়ালে হতদরিদ্র ম্যাজিশিয়ানের চরম অভাব অনটনের অশ্রুসজল কারুণ্য মরমি পাঠকের চোখে জল এনে দেবে।

১৯০১ সালে প্রভাতকুমার ব্যারিস্টারি পড?ার জন্য লন্ডন যান। ১৯০৩ এর শেষে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। তিন বছরের বিলেতবাসের অভিজ্ঞতা তাঁকে বিলেতের পটভূমিকায় গল্প লিখতে প্রাণিত করে। সে গল্পগুলি যথাক্রমে দেশী ও বিলিতি, গল্প সংকলনের পর্যায়ভুক্ত মুক্তি, ফুলের মূল্য, পুনর্মুষিক ও প্রবাসিনী এই শ্রেণির গল্প। গল্পাঞ্জলি, মাতৃহীন এবং গল্পবীথি-র কুমুদের বন্ধু, নবকথার ভিখারী সাহেব, বিলাসিনী ও অন্যান্য গল্প সংকলনের সতী প্রভৃতি গল্পও এই পর্যায়ের। এই পর্যায়ের গল্পগুলির মধ্যে ফুলের মূল্য সর্বাধিক মর্মস্পর্শী এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটি জননী অপত্যস্নেহ ও অগ্রজের প্রতি সহোদরার ভালোবাসার এক অনুপম যুগলবন্দি। তেমনি লন্ডনের পটভূমিতে লেখা মাতৃহীন গল্পের মধ্যে এই অপত্যস্নেহও দেখতে পাই।

ইংরেজ সমাজের চিত্র হিসেবে বিলেতফেরতের বিপদ গল্পটিও স্মরণীয়। মুক্তি গল্পে আছে বিলেতে এক বাঙালি যুবকের সস্তা আমোদপ্রিয়তা ও নষ্টামির সমালোচনা। পুনর্মুষিক গল্পে আছে হিন্দুধর্মের আচার বিচারের প্রতি ইংরেজ যুবতী মিস টেম্পলের হাস্যকর আসক্তির বিবরণ। এইসব গল্পে তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে বাঙালির রাজনৈতিক বিরোধ, সংঘর্ষের আগুনে ইংরেজ-বাঙালির পারস্পরিক প্রেমপ্রীতি দেখিয়েছেন।

প্রভাতকুমার জীবনের সহজ সুন্দররূপের দ্রষ্টা ও রূপকার। সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনে দুঃখ-দারিদ্র্য, শোষণ-পীডন আছেই- এ সত্য তার অজানা ছিল না। কিন্তু তিনি সেদিকে যাননি। কারণ, তিনি ছিলেন এসবের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তিনি তাই সবকিছুকেই হাস্যরূপের মাধ্যমেই চালিত করতে চেয়েছেন। তাই প্রভাতকুমারকে মূল্যায়ন করতে হয় একটু অন্যভাবেই। কারণ, তিনি তাঁর গল্পে যে কৌতুকরস ও ঘটনাবৈচিত্র এনেছেন তা খুব কম গল্পকারের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।