স্মৃতিকথা

আমার সময় ও চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গন

বিমল গুহ

বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দি-অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। দেশে ফিরে দেশের শাসনভার হাতে তুলে নিয়েছেন। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবছেন। সে হিসেবে প্রধানমন্ত্রীই সরকারপ্রধান, সার্বভৌম ক্ষমতা সংসদের হাতে। দেশে একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন- যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের প্রধান হবেন। একদিন পর ১২ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রপতি মনোনীত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। দেশের জনগণের বড় আস্থার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই তাকিয়ে আছে প্রবাদপ্রতিম এই নেতার দিকে। দেশের অর্থনীতি তখন খুবই দুর্বল।

পাকিস্তানীরা সারাদেশ তছনছ করে রেখে গেছে। আমাদের সাজানো বড় বাড়ি- গ্রামের হিসেবে জমিদারবাড়ির তুল্য, পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরের এপ্রিলে তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে! সেনাদের আক্রমণ থেকে কীভাবে যেন পূজার দোতলা মণ্ডপঘরটা রক্ষা পেয়েছিলো! শরণার্থীজীবন শেষ করে বাহাত্তরের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে সেটাতেই হয়েছিলো আমাদের আশ্রয়। নিচতলা-দোতলা মিলে সবাই গাদাগাদি করে থাকা। তবুও তো মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই থাকলো! অনেকের তাও ছিলো না। পরিবারের লোকসংখ্যা বেশি বলে দ্রুতসময়ে জরুরিভিত্তিতে আর একটা অস্থায়ী ঘর বানাতে হলো আমাদের। পরে বানানো এই ঘরটির দিকে তাকালে মনে হয় গরিবের আস্তানা। সত্যিকার অর্থেই আমাদের নিঃস্ব করে গেছে পাকিস্তানী সেনারা, গরিবের আস্তানাতেই রেখে গেছে আমাদেরকে।

স্বাধীনতার পূর্বে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাবে বলে খবর পাচ্ছিলাম। আমি পড়তাম গণিত বিভাগে প্রথমবর্ষ বিএসসি অনার্স শ্রেণিতে। ছোটভাই নির্মল পড়তো দ্বাদশ শ্রেণিতে, সে এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। নির্মল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শিলিকুড়ি শরণার্থী শিবিরের হাসপাতালে সেচ্ছাসেবকের দায়িত্বপালন করতো, চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে। এই নয়মাসে শরণার্থী শিবিরে সকলের কাছে সে ডাক্তার বাবু বলেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো। রাতের বেলায়ও শরণার্থীর কোনো ব্যারাক থেকে ডাক পড়তো তার, আর সে দৌড়ে চলে যেতো। এভাবে চিকিৎসাকে একটি জনসেবামূলক বিষয় হিসেবে তার মনে গেঁথে যায়। দেশে ফিরে সে ডাক্তারি পড়ার বাসনা পোষণ করলো। কিন্তু তা আর সম্ভব ছিলো না, যেহেতু স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে সে বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলো। তাকে বাণিজ্য শাখাতেই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে হবে। নতুবা যে-পথটি খোলা ছিলো, তা হলো- বায়োলজি বিষয় নিয়ে পুনরায় প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান বিভাগে নতুনভাবে ভর্তি হওয়া। কিন্তু সে আর বছর নষ্ট করতে চাইলো না। অবশেষে ডাক্তারি পড়ার বাসনার সেখানেই ইতি হলো। শেষে বাণিজ্য শাখায় ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা দেবে বলে ঠিক করলো। সে পড়তো বাড়ি থেকে ৮ মাইল দূরে সাতকানিয়া কলেজে। তখন কলেজটি সরকারি ছিলো না। স্বাধীনতার পরে সরকারি হয়েছে। আমার ছোটবোন নিয়তি পড়তো ক্লাস সেভেন বা এইটে, তার কোনো সমস্যা নেই। যথারীতি স্কুলে গেলো। আমাদের সবার ছোটভাই অমল পড়তো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে, তারও ভর্তির ব্যবস্থা হলো।

আমার বেলায় একটু বিপত্তি হয়েছিলো, আসছি সে-কথায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাসে যোগদান করলাম। আমাদের তখন অটোপ্রমোশন হয়ে গেলো। আমরা তখন গণিত বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অটোপ্রমোশনের কথায় অনেকে উৎফুল্ল হয়েছিলো, কিন্তু বেশির-ভাগ ছাত্র তা চায়নি। কারণ এতে জ্ঞানার্জনের বিষয় ছাড়াও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত! মনে পড়ে- আইয়ুবের আমলে (সম্ভবত ১৯৬২ সালে) একবার বি.এ. পরীক্ষা না দিয়ে অটোপ্রমোশন দেয়া হয়েছিলো। এই সুযোগপ্রাপ্তরা আজীবন অটো-বি.এ. নামে আখ্যা পেয়েছিলো। সবক্ষেত্রে এদের গুরুত্ব ছিলো কম। এমনকি চাকুরির ক্ষেত্রেও। এরকম একজন শিক্ষক আমাদের স্কুলে যোগদান করেছিলেন। তাঁকে আড়ালে অনেকে অনেক কথা বলতো। উনি যে অটো-বিএ, শিক্ষার্থীরাও জেনে গিয়েছিলো! আজ সেই ছাপ তো আমাদের পিঠেও পড়লো! ভেবেছিলাম যুদ্ধের আগে আমরা যে যে-ক্লাসে ছিলাম, সে-ক্লাস শুরু করবো- এই ছিলো মানসিক প্রস্তুতি, এবং তা সমীচিন বলেও মনে হয়েছিলো!

এই যে অটোপ্রমোশন- তার মূলে নাকি তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ইউসূফ আলীর অদূরদর্শীতা কাজ করেছে। পরে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। এই কথার সমর্থন মেলে অধ্যাপক

আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা ‘বিপুলা পৃথিবী’তে। তিনি লিখেছেন- “শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসূফ আলী যে-নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে-কথাটা এখানে বলে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার একটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিলো যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে-ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে; এই একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে; এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় এ-প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ-সদস্য ইউসূফ আলী এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলো, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এই ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে-কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম”।

১৯৭১ সালে দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান হলে আমি আকস্মিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস থেকে ১০ কিংবা ১১ই মার্চ চট্টগ্রাম শহরে চলে যাই। পরে যাই গ্রামের বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমি যে-বাড়িতে থাকতাম তাদের সঙ্গে দেখা করে যাবার সুযোগ হয়নি। খবর পাঠিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ঘরও লুটপাট হয়ে যায়। ঘরে কিছুই পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পরে নতুন করে বইপত্তর কিনে নব উদ্যোমে শুরু করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস।

আমাদের গ্রামের বাড়িতে ধীরে ধীরে সবকিছু গোছানোর কাজ চলছে। এই সময়ে বাবার নামে ডাকযোগ ডাকাতির বার্তা নিয়ে এক চিঠি এলো। চিঠিতে লেখা সপ্তাহের অমুকদিন রাতে তারা আসবেন- তাদের জন্য যেন টাকাপয়সা ইত্যাদি সব ব্যবস্থা করে রাখা হয়। সে-আমলে ডাকাতি হতো চিঠি দিয়ে। এটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ কি না এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়। হতে পারে- ডাকাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য গৃহকর্তা টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখবে, না-জানিয়ে গেলে হয়তো বেশিকিছু ঘরে পাবে না! ডাকাতের চিঠি পেয়ে বাবা একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন। এ খবর আমি জেনেছি পরে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে খবরটি জানাতে চাননি বাবা। বাড়িতে তখন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাবা ও মেঝভাই নির্মল, আর দুজন কাজের লোক- চান্দু আর দুলাল। চান্দু আর দুলাল আমাদের কৃষিকাজ দেখাশোনার জন্য বাৎসরিক মজুর। সবাই সে চিঠিকে গুরুত্ব দিলো। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই দোতলার লম্বা ঝুল-বারান্দা টিনের আবরণে আচ্ছাদিত করা হলো। দোতলায় স্থানীয় অস্ত্র- দা, খড়গ, বল্লম, মরিচের গুড়া, পাথরের টুকরা মজুত করা হলো, যাতে ডাকাত এলে সবাই মিলে প্রতিহত করতে পারে। এবং সবাই সাবধান ছিলো। উপরে দোতলায় ছিলো চারজন পুরুষ; আর বেড়ার যে-নতুন ঘর বানানো হয়েছিলো- সেখানে থাকলো পরিবারের বাকি সদস্যরা। সবার মনে শঙ্কা ছিলো- ডাকাত যে-কোনো সময় আসতে পারে। আবার এমনও ভাবনায় ছিলো, এটা নেহাত কারো ফাজলামো!

একদিন পর ঠিক-ঠিক মধ্যরাতে বাড়ির গেটে গুলির শব্দ। জানান দিলো- তারা এসেছেন! গুলির শব্দ শুনেই নিচে বেড়ার ঘরে যারা ছিলো তারা তড়িঘড়ি পুকুরের পাড় ধরে পাশের বাড়িতে চলে যায়। যেতে পারলেন না বৃদ্ধপিসী। ডাকাতদল সদর্পে এসে ৪/৫ রাউন্ড গোলাগুলি করলো, আর চিৎকার করে বলতে লাগলো- দোতলার দরজা খোল। উপর থেকে কেউ তার জবাব দিচ্ছে না। ডাকাতদের একজন গিয়ে বুড়িকে ধরে নিয়ে এলো দোতলার নিচে। এনে বলছে- তোমার ভাইকে বলো দরজা খুলে দিতে; নইলে তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলবো। তারা পরিবারের অন্যদের এদিক-ওদিক খোঁজ করলো। বুড়িপিসীকে জিজ্ঞাসা করলো- অন্যরা কোথায়। বুড়ি পিসী খুব সাহসী। বলে- আমি কি জানি, কে কোথায়। এখানে কেউ ছিলো না; নিচে আমি একা। ডাকাতেরা ভাবলো- সবাই উপরে, দোতলায়। বুড়িপিসীকে মারধরও করলো তারা। তবু তাকে দিয়ে বলাতে পারেনি কিছু। পিসীর নাকি মুখে একটাই কথা- তোরা আমাকে মেরে ফেললেও ওরা আমার কথা শুনবে না। তোরা বরং চলে যা, দোতলায় উঠে লাভ নেই, ওখানে তোদের নেয়ার মতো কোনো কিছু নেই। বুড়িকে ওরা কিলঘুষি মেরেও মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারেনি। পিসী জানতেন, দরজা খুলে দিলে ওরা উপরে গিয়ে টাকাপয়সা না-পেয়ে ভাইকে ও অন্য সবাইকে মেরে ফেলবে। তাই প্রিয়ভাইকে বাঁচাতে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালেও বুড়িপিসীর একই ভূমিকা ছিলো। পাকিস্তানি সেনারাও বুড়িকে অত্যাচার করেছে, প্রাণে মারেনি। আমরা আগেও দেখেছি- বুড়িপিসী এলাকার সবাইকে চিনতো। তিনি কিছুতেই কোনো কাজে ভয় পেতেন না। এমনকি ঝড়ঝঞ্জায় বন্যা-বাদলেও বুড়িপিসী বাবাকে সাহস দিয়ে রাখতেন। ভাইকে ভালোবাসতেন প্রাণের চেয়েও বেশি। বাবাও পিসীকে বড়বোন হলেও মায়ের মতো জ্ঞান করতেন।

ডাকাতদল বাঁশ সংগ্রহ করে নানাভাবে ঝুলবারান্দার আবরণ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিলো। যতবারই চেষ্টা করেছে উপর থেকে খড়গ ও বর্শা দিয়ে তা প্রতিহত করা হয়েছে। কিন্তু নিচে বুড়িপিসীকে যে অত্যাচার করছে সেটা বুঝে কেউ আর উপর থেকে মরিচের গুঁড়া স্প্রে করেনি, তাতে পিসীরও ক্ষতি হতে পারতো। ঘণ্টা-দুই চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে ডাকাতদল শেষরাতের দিকে গুলি চালাতে-চালাতে স্থান ত্যাগ করে। পাড়ার কেউ বন্দুকের সামনে এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি তখন। ওরা ভেবেছিলো প্রসন্ন গুহ পরিবারের সবাইকে এরমধ্যে মেরে ফেলেছে ডাকাতেরা। ভোরের আলো ফুটতেই পাড়ার লোকজন এসে জড়ো হলো। তখন পিসী নিচ-থেকে ডেকে বলেছেন, তোমরা দরজা খোলো- ভোর হয়েছে; এলাকার লোকজন এসেছে। দরজা খুলে সবাই দোতলা থেকে নেমে এলো নিচে। সবার সঙ্গে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির বিষয়ে আলাপ হলো। সকাল হতেই থানায় গেলো ছোটভাই নির্মল। থানার পুলিশ এসে বাড়ি দেখে গেছে। তারা কেস করতে বলে গিয়েছিলো, কিন্তু বাবা কেস করার পক্ষপাতি ছিলেন না। এতে ভোগান্তি আরও বাড়বে এই ভেবে।

ডাকাতির খবর আমি পাই সন্ধ্যার দিকে। ঘটনার বিবরণ শুনে পরদিন বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি সেই ভুতুড়ে বাড়ি! এমনিতে যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাড়িঘর, তার উপর এই দুর্ভোগ। দোতলার ঝুলবারান্দা পরদিন মিস্ত্রি ডেকে আরও মজবুত করা হলো। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ও দরজার সংস্কার করাসহ পুরোমাত্রায় প্রস্তুতি জোরদার করা হলো- এই ভেবে যে, ভবিষ্যতে যে-কোনো সুযোগে ডাকাতদল আবার আসতে পারে। এই ঘটনা আমাদের মনে বড় প্রভাব ফেলে। সেই থেকে গ্রামের বাড়িতে রাতে থাকতে সাহস পেতাম না। তখন একটা বন্দুকের লাইসেন্স নেয়ার কথা হচ্ছিলো। বাবা বললেন, বন্ধুক নিলে আমাদের উপর মানুষের চোখ পড়বে আরও বেশি। সম্পদ তো এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তখন ভাবতে শুরু করবে- অনেক সম্পদ আছে! বাবার ধারণা হয়েছিলো, এটা স্বাধীনতাবিরোধীদের কাজ। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা দেশের কোথাও-কোথাও ঘাপটি মেরে আছে, সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে চায়। এটা আমাদের দেশ, আমাদের বাড়ি; এইসব প্রতিহত করেই আমাদের থাকতে হবে, বাঁচতে হবে। এরপরও আর একরাতে ডাকাতদল পাশ দিয়ে গেছে, বাড়ির গেটে গুলি করতে-করতে। সে রাতে বাড়িতে প্রস্তুতি ছিলো প্রথমরাতের চাইতে দ্বিগুণ। ডাকাতি করা মোটেই সম্ভব হতো না তাদের। ডাকাতকে দোতলায় উঠতে হলে জীবন দিয়ে উঠতে হতো। কারণ কিরিচ ও শানানো খড়গের কাছে সরাসরি কোনো অস্ত্রই বেশি ধারালো নয়! দুপক্ষের যুদ্ধে একপক্ষ খোলা মাঠে, অন্যপক্ষ বাড়ির আড়াল থেকে যুদ্ধ করবে। তাই পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে। এই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, তা থেকে আমরা ভাইবোনেরা মনের দিক থেকে আর মুক্ত হতে পারিনি। সেই থেকে আজ অবধি আমরা বাড়ি গেলে ঘরে রাত কাটাতাম না। সন্ধ্যায়-সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরে ফিরে যেতাম। মাঝে মাঝে থেকেছি- তবে খুব স্বস্তিতে নয়। বলে রাখা ভালো যে, এ শুধু মনের আতঙ্ক। এরপরে আর কোনোদিন চুরি-ডাকাতি হয়নি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পুরোদমে চলছে। নতুন ভর্তির বিজ্ঞপ্তিও হয়েছে। ছোটভাই নির্মল সাতকানিয়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে ভর্তিপরীক্ষা হয়ে গেছে। নির্মল তার অনুষদে ভর্তিপরীক্ষায় প্রথম হলো। সে বাণিজ্য অনুষদের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ১ম বর্ষ অনার্সে ভর্তি হলো। ক্লাস শুরু হলে নবনির্মিত শাহজালাল হলে সিটও বরাদ্দ পায় সে। শাহজালাল হলটি সেসময়ে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমিও ফতেপুর থেকে শাহজালাল হলে চলে আসি দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে। দুভাই হল-এ সিট বরাদ্দ পেয়েছি- আমার কক্ষ নং ৪০১; নির্মলের কক্ষ নং ৪৩৬।

গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস করেছি, ক্লাসের ফাঁকে চলে যেতাম বাংলা বিভাগে। বিজ্ঞান অনুষদ আগে ছিলো কলাভবনে। স্বাধীনতার পর চলে যায় আলাদা বিজ্ঞান ভবনে। ক্লাসের ফাঁকে বিজ্ঞানভবন থেকে এসে যোগ দিতাম কলাভবনের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সাধারণত বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে এসব আয়োজন হতো। এই দুই বিভাগের অনেকের সঙ্গে ইতোমধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছি। হঠাৎ কী মনে হলো- নিজে নিজে ভাবলাম- যদি ইংরেজি বা বাংলা বিভাগে পড়তাম, তখন আর বিজ্ঞানভবন আর কলাভবনের দোটানায় থাকতে হতো না। একদিন ইংরেজি বিভাগে আমার এক বছরের সিনিয়র একজন ছাত্রের সঙ্গে (নাম সম্ভবত- শহিদুল ইসলাম) আলাপ করলাম। তিনি জানতেন আমি কবিতা লিখি, কলাভবনে ২/১টি অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছি। প্রথম বর্ষে যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। সিনিয়র বন্ধুটি বললেন, আপনি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে দেখা করেন, তিনি ইংরেজি বিভাগে আপনার ভর্তির একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। পরদিন গিয়ে দেখা করলাম। বিভাগীয় প্রধান বললেন, তোমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে (কথা হচ্ছিলো ইংরেজিতে)।

-বললাম, ঠিক আছি স্যার।

-ভর্তি পরীক্ষার জন্য পরের দিন আসতে বললেন।

আমি সন্ধ্যায় আবার সেই সিনিয়র বন্ধুর কাছে গেলাম, তার আলাওল হলের কক্ষে। তিনি কিছু পরামর্শ দিলেন, দুটো বই হাতে দিলেন- শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’, আর আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’। বললেন, এ বই দুটো পড়ে রাখেন। আমি বই দুটো নিয়ে রুমে চলে এলাম, এবং রাতের মধ্যেই মোটামুটি পড়ে নিলাম। পরের দিন গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। শুধু মৌখিক পরীক্ষা নিলেন আধাঘণ্টার মতো। ইংরেজিতেই কথপোকথন হলো। স্মরণ করছি যে, হাইস্কুলে জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরী স্যার ক্লাসে ইংরেজিতে কথোপথনের মাধ্যমে আমাদের ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। স্কুলেই তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরকে ইংরেজিতে শিখতে-বলতে শিখিয়েছেন তিনি। মৌখিক পরীক্ষা ভালো হলো, যদিও দুরুদুরু বুকে সারাসময় কেটেছে। আমাকে এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন; আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নাম শুনেছো? তাঁর কোনো বই পড়েছো? বললাম- পড়েছি স্যার, ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সি’। এতে মনে হলো তিনি উত্তর পেয়েছেন। তারপর বললেন, টেল দ্য স্টোরি ইন ব্রিফ? আমি বলতে শুরু করলাম। দুতিন মিনিট বলার পর বললেন, ও কে। ইউ আর সিলেক্টেড ফর এডমিশন। গেট এডমিনেটেড টুমোররো এন্ড সি মি ইন অফিস?

বললাম, স্যার উড ইউ গিভ মি টাইম ফর থ্রি ডেজ টু অ্যারেঞ্জ মানি ফ্রম হোম?

-ওকে, ইউ কাম আফটার থ্রি ডেজ।

আমি সেদিনই দুপুরের বাসে গ্রামের বাড়ি চলে গেলাম এবং বাবার নিকট থেকে টাকা নিয়ে ফিরে এলাম পরদিন। আজকের দিনে তো কী সহজে ‘বিকাশ’-এ মুহূর্তে টাকা লেনদেন করা যায়। বাড়ি থেকে ফিরেই তৃতীয় দিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ভর্তির ফরম নিয়ে। স্যার তখন যা বললেন, তাতে আমি মুহূর্তেই আকাশ থেকে মাটিতে পতিত হলাম। বিকট শব্দে বুকটা ভেঙে গেলো! বললেন, গতকাল অর্থনীতি বিভাগ থেকে একজন ছাত্র (তার নাম সম্ভবত রেজাউল করিম) বিভাগ-বদল করে ইংরেজি বিভাগে আসতে আবেদন করেছে, গতকাল তার আবেদন অনুমোদন করে দিয়েছি। এবছর ভর্তির জন্য আর কোনো আসন খালি নেই। তুমি আগ্রহী হলে পরের বছর চেষ্টা করতে পারো। আমি বিফল মনোরথে বিভাগ থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার চোখে তখন শুধু অন্ধকার! কারণ আমি গণিত বিভাগ থেকে মন তুলে নিয়েছি এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র একবছর গ্যাপ দিয়ে প্রথম বর্ষ ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হতে চেয়েছি। পরের বছর মানে আরও এক বছর গ্যাপ! তারও বা নিশ্চয়তা কি?

এই দুঃসহ স্মৃতিটা আমার হৃদয়ে আঁকা হয়ে গেলো। মানুষের জীবনের কিছু-কিছু ঘটনা থাকে মানুষ মন থেকে সহজে মুছে ফেলতে পারে না! মন খারাপ করে রুমে চলে এলাম। গণিত বিভাগেও আর ক্লাস করতে গেলাম না। রুমে মন খারাপ করে শুয়ে আছি- ভাবছি কী করবো! এর মধ্যে পাশের রুমের সহপাঠী বন্ধু এসে জিজ্ঞাসা করলো, ক্লাসে না যাওয়ার কারণ। জানতে চাইলো- শরীর খারাপ কি না। বললাম, না। শুয়ে-শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম। লেখাপড়া কি এখানেই বন্ধ হয়ে যাবে? ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, এক দুর্ঘটনায় চোখের সামনে সাথির মৃত্যুতে তা বাদ হয়ে গেলো; গণিতে অনার্স পড়তে আসলাম- তা ভালো লাগলো না; ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য টিকেও টাকা জোগাড় করতে সময় লাগলো বলে তাও হলো না! এখন কী করি? তখন মনস্থ করলাম- ঠিক আছে, বাংলা বিভাগে ভর্তির চেষ্টা করবো। তা হলেও সাহিত্য-পড়ার আগ্রহ মিটবে; গণিত থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।

পরদিন গেলাম বাংলা বিভাগে। তখন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্যারের কাছে দরখাস্ত নিয়ে গেলে- স্যার বললেন, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তো বিভাগ বদল করা যায় না, অর্থাৎ ট্রান্সফার হবে না। তিনি আমার দরখাস্তে ইংরেজি হরফে ‘নো’ লিখে তা তৎকালীন বিভাগীয় সহকারী মি. আবদুর রশীদের হাতে দিয়ে বললেন- রেখে দাও। স্যার অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় বেশি কথা বলার সুযোগ হলো না। বাংলা বিভাগের প্রভাষক ভুবনমোহন অধিকারী; থাকতেন ফতেপুরে। তিনি ছিলেন সংস্কৃত বিষয়ের শিক্ষক, বাংলা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত; তখন সংস্কৃত বিভাগ হয়নি। রাতে গেলাম তাঁর বাসায়। ভুবনমোহন অধিকারী স্যার নিজেও কবিতা লিখতেন এবং জানতেন যে, আমিও কবিতা লিখি। তিনি বললেন, তুমি স্যারকে বুঝিয়ে বলতে পারোনি। বলোনি কেনো, যে প্রথমবর্ষে ভর্তি হতে চাও, ট্রান্সফার নয়! -বললাম, তা বলার মতো ফুরসত পাইনি, স্যার খুব ব্যস্ত ছিলেন। দরখাস্তটা নিয়ে না-করে দিলেন। অধিকারী স্যার বললেন, তুমি কাল বিভাগে এসো, আমিও স্যারকে বলবো। পরদিন আমি আবার দেখা করলাম বিভাগীয় প্রধান আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে। আমাকে দেখেই বললেন, তুমি প্রথমবর্ষে ভর্তি হতে চাও? তা তো বলোনি। তবে তোমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে।

বললাম, ঠিক আছে স্যার।

কখন দেবে, বললাম, আজকেও দিতে পারি।

তিনি একটা খাতা আর ভর্তি পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্র দিয়ে পাশের সেমিনার কক্ষে বসিয়ে দিলেন লিখিত পরীক্ষা দিতে। এক ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা দিলাম এবং নির্বাচিত হলাম।

স্যার আমার পুরনো আবেদনপত্রটি বিভাগের সহকারীর কাছ থেকে নিয়ে- যেখানে ইংরেজি হরফে ‘নো’ লিখেছিলেন; তার পাশে আবার বড় হরফে লিখে দিলেন ‘অব্জেকশন’। আবেদনপত্রে চেয়াম্যানের মন্তব্য হয়ে গেলো- ‘নো অবজেকশন’ অর্থাৎ ভর্তি হতে আপত্তি নেই। বিভাগ থেকে ভর্তির যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে পাঠালেন হিসাব দপ্তরে। সেখানে ভর্তির টাকা জমা দিয়ে নতুন করে ভর্তি হয়ে গেলাম ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগে ১ম বর্ষ অনার্স কোর্সে। ততদিনে কিছু ক্লাস হয়ে গেছে। বিভাগে আমার আগমনকে স্বাগত জানালেন সহপাঠী বন্ধুরা। ছোটভাই নির্মলকে তখনো জানাইনি যে আমি তার সাথে একই শিক্ষাবর্ষে বাংলায় অনার্সে পুনরায় ভর্তি হয়েছি। সে বন্ধুদের মুখে পরে শুনেছে। বাড়িতেও তা জানাইনি, নির্মলকেও জানাতে বারণ করেছিলাম। বাবা বাংলা একবছর গ্যাপ দিয়ে পড়াকে কতটা গ্রহণ করতে পারবে- কষ্ট পাবে কি না, তাই ভেবেছিলাম। বাবা জানেন, নির্মল প্রথম বর্ষে ও আমি দ্বিতীয় বর্ষে অনার্স পড়ি। মানুষজনকেও তিনি তা বলে আনন্দ পান। আমাদের গ্রামের তেমন কেউ তখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারেনি। আমাদের আগে আশুতোষ নাথ, আর আমি। এর পরের বছর ছোটভাই নির্মল, বাদল ও বাবুল।

এদিকে নতুন করে পরিবার গোছানো শুরু করে দিয়েছেন বাবা। শুধু কি নিজের পরিবার! তিনি এপাড়ার মুরুব্বি। পুরো এলাকার সবাই তাঁর দিকে চেয়ে থাকে। কারও ঘরবাড়ি নেই, পুরো পাড়া পাকিস্তানিরা জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়ে গেছে। যে-পরিবার শহিদ পরিবার বা আহত সদস্যের পরিবার, তাদের দুর্দশার অন্ত নেই। কারণ যে-সদস্য শহিদ হয়েছে বা আহত হয়েছে- তারাই সে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। বাবা তাদের পুর্নবাসনেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন সরকার ইউনিয়নে-ইউনিয়নে পুনর্বাসন কমিটি গঠন করেছে। বাবা সেই কমিটির সদস্য।

গ্রামে আমরাও কয়েকজন যুবক মিলে ঠিক করলাম- যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামের জন্য কাজ করবো। পাড়ার ছেলেদেরকে নিয়ে গড়ে তুললাম ‘পল্লী মঙ্গল সমিতি’। সমিতির কার্যকরী কমিটিও হলো; সভাপতি- আশুতোষ নাথ, সহসভাপতি- প্রফুল্লরঞ্জন দাশ, সাধারণ সম্পাদক- বিমল গুহ, সদস্য- নারায়ণ মল্লিক, নির্মল গুহ, অনিল বৈদ্য, অনিল মল্লিক, সন্তোষ মহাজন, পরিমল দাস প্রমুখ। সমিতির প্রায় সব কাজ আমাকে করতে হয়। ঠিক করলাম সমিতির পক্ষ থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করবো। সব ঠিকঠাক। লেখা আর পাওয়া যায় না। ম্যাগাজিনের জন্য আশুতোষ নাথের একটি গদ্য রচনা, আর বিভিন্ন নামে ৫টি কবিতা ঠিক করা হলো। বিভিন্নজনের নাম দিয়ে কবিতাগুলি আমিই লিখেছিলাম। ম্যাগাজিনের নাম ঠিক করলাম ‘পল্লীশ্রী’। এখন কাজ ছাপানোর ব্যবস্থা করা। সাতকানিয়া কলেজের পথে একটা প্রেস ঠিক করা হলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- আমাদের এলাকার খ্যাতিমান কথাশিল্পী আবুল ফজলের লেখা নিতে হবে। আবুল ফজল থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। তাঁর আদিবাড়ি আমাদের পাশের গ্রাম কেঁওচিয়ায়। আমি আর আশুতোষ নাথ শহরে গেলাম একদিন। আশুতোষ নাথ তখন হুলাইন ছালেহ নূর কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছেন।

অধ্যাপক আবুল ফজল থাকতেন কাজির দেউরিতে নিজের বাড়ি ‘সাহিত্যসদন’-এ। সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। অবসরে এসেছেন। গ্রামের বাড়িতে তিনি খুব একটা যান না। গিয়ে বললাম- বাজালিয়া গ্রাম থেকে এসেছি। আমরা ‘পল্লীমঙ্গল সমিতি’ করেছি, সেই সমিতি থেকে একটি ম্যাগাজিন বের করবো। নাম- পল্লীশ্রী। তার জন্য আপনার লেখা চাই। আমাদের খবর জানতে চাইলেন, বললাম- আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, আশুতোষ নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেন। বললেন, বসো। তিনি ঘরের ভেতরে গেলেন। প্যাড আর কলম নিয়ে এলেন। আমাদের সামনে বসে লিখে দিলেন- আশীর্বাণী। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। লেখাটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম সন্ধ্যার মধ্যেই। পল্লীশ্রী’র জন্য কভার ডিজাইন দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে নিজেই এঁকে ফেললাম- গোলাকার একটা বৃত্তের মাঝখানে পল্লীশ্রী নামের ডিজাইন। ব্লক বানিয়ে ছাপা হলো সবুজ রঙের কভার। প্রকাশিত হলো- পল্লীশ্রী।

(আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ , ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৭ শাওয়াল ১৪৪৩

স্মৃতিকথা

আমার সময় ও চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গন

বিমল গুহ

image

বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দি-অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। দেশে ফিরে দেশের শাসনভার হাতে তুলে নিয়েছেন। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবছেন। সে হিসেবে প্রধানমন্ত্রীই সরকারপ্রধান, সার্বভৌম ক্ষমতা সংসদের হাতে। দেশে একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন- যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের প্রধান হবেন। একদিন পর ১২ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রপতি মনোনীত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। দেশের জনগণের বড় আস্থার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই তাকিয়ে আছে প্রবাদপ্রতিম এই নেতার দিকে। দেশের অর্থনীতি তখন খুবই দুর্বল।

পাকিস্তানীরা সারাদেশ তছনছ করে রেখে গেছে। আমাদের সাজানো বড় বাড়ি- গ্রামের হিসেবে জমিদারবাড়ির তুল্য, পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরের এপ্রিলে তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে! সেনাদের আক্রমণ থেকে কীভাবে যেন পূজার দোতলা মণ্ডপঘরটা রক্ষা পেয়েছিলো! শরণার্থীজীবন শেষ করে বাহাত্তরের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে সেটাতেই হয়েছিলো আমাদের আশ্রয়। নিচতলা-দোতলা মিলে সবাই গাদাগাদি করে থাকা। তবুও তো মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই থাকলো! অনেকের তাও ছিলো না। পরিবারের লোকসংখ্যা বেশি বলে দ্রুতসময়ে জরুরিভিত্তিতে আর একটা অস্থায়ী ঘর বানাতে হলো আমাদের। পরে বানানো এই ঘরটির দিকে তাকালে মনে হয় গরিবের আস্তানা। সত্যিকার অর্থেই আমাদের নিঃস্ব করে গেছে পাকিস্তানী সেনারা, গরিবের আস্তানাতেই রেখে গেছে আমাদেরকে।

স্বাধীনতার পূর্বে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাবে বলে খবর পাচ্ছিলাম। আমি পড়তাম গণিত বিভাগে প্রথমবর্ষ বিএসসি অনার্স শ্রেণিতে। ছোটভাই নির্মল পড়তো দ্বাদশ শ্রেণিতে, সে এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। নির্মল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শিলিকুড়ি শরণার্থী শিবিরের হাসপাতালে সেচ্ছাসেবকের দায়িত্বপালন করতো, চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে। এই নয়মাসে শরণার্থী শিবিরে সকলের কাছে সে ডাক্তার বাবু বলেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো। রাতের বেলায়ও শরণার্থীর কোনো ব্যারাক থেকে ডাক পড়তো তার, আর সে দৌড়ে চলে যেতো। এভাবে চিকিৎসাকে একটি জনসেবামূলক বিষয় হিসেবে তার মনে গেঁথে যায়। দেশে ফিরে সে ডাক্তারি পড়ার বাসনা পোষণ করলো। কিন্তু তা আর সম্ভব ছিলো না, যেহেতু স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে সে বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলো। তাকে বাণিজ্য শাখাতেই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে হবে। নতুবা যে-পথটি খোলা ছিলো, তা হলো- বায়োলজি বিষয় নিয়ে পুনরায় প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান বিভাগে নতুনভাবে ভর্তি হওয়া। কিন্তু সে আর বছর নষ্ট করতে চাইলো না। অবশেষে ডাক্তারি পড়ার বাসনার সেখানেই ইতি হলো। শেষে বাণিজ্য শাখায় ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা দেবে বলে ঠিক করলো। সে পড়তো বাড়ি থেকে ৮ মাইল দূরে সাতকানিয়া কলেজে। তখন কলেজটি সরকারি ছিলো না। স্বাধীনতার পরে সরকারি হয়েছে। আমার ছোটবোন নিয়তি পড়তো ক্লাস সেভেন বা এইটে, তার কোনো সমস্যা নেই। যথারীতি স্কুলে গেলো। আমাদের সবার ছোটভাই অমল পড়তো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে, তারও ভর্তির ব্যবস্থা হলো।

আমার বেলায় একটু বিপত্তি হয়েছিলো, আসছি সে-কথায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাসে যোগদান করলাম। আমাদের তখন অটোপ্রমোশন হয়ে গেলো। আমরা তখন গণিত বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অটোপ্রমোশনের কথায় অনেকে উৎফুল্ল হয়েছিলো, কিন্তু বেশির-ভাগ ছাত্র তা চায়নি। কারণ এতে জ্ঞানার্জনের বিষয় ছাড়াও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত! মনে পড়ে- আইয়ুবের আমলে (সম্ভবত ১৯৬২ সালে) একবার বি.এ. পরীক্ষা না দিয়ে অটোপ্রমোশন দেয়া হয়েছিলো। এই সুযোগপ্রাপ্তরা আজীবন অটো-বি.এ. নামে আখ্যা পেয়েছিলো। সবক্ষেত্রে এদের গুরুত্ব ছিলো কম। এমনকি চাকুরির ক্ষেত্রেও। এরকম একজন শিক্ষক আমাদের স্কুলে যোগদান করেছিলেন। তাঁকে আড়ালে অনেকে অনেক কথা বলতো। উনি যে অটো-বিএ, শিক্ষার্থীরাও জেনে গিয়েছিলো! আজ সেই ছাপ তো আমাদের পিঠেও পড়লো! ভেবেছিলাম যুদ্ধের আগে আমরা যে যে-ক্লাসে ছিলাম, সে-ক্লাস শুরু করবো- এই ছিলো মানসিক প্রস্তুতি, এবং তা সমীচিন বলেও মনে হয়েছিলো!

এই যে অটোপ্রমোশন- তার মূলে নাকি তৎকালীন জাতীয় পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ইউসূফ আলীর অদূরদর্শীতা কাজ করেছে। পরে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। এই কথার সমর্থন মেলে অধ্যাপক

আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা ‘বিপুলা পৃথিবী’তে। তিনি লিখেছেন- “শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসূফ আলী যে-নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে-কথাটা এখানে বলে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার একটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিলো যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে-ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে; এই একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে; এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় এ-প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ-সদস্য ইউসূফ আলী এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলো, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এই ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে-কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম”।

১৯৭১ সালে দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান হলে আমি আকস্মিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস থেকে ১০ কিংবা ১১ই মার্চ চট্টগ্রাম শহরে চলে যাই। পরে যাই গ্রামের বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমি যে-বাড়িতে থাকতাম তাদের সঙ্গে দেখা করে যাবার সুযোগ হয়নি। খবর পাঠিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ঘরও লুটপাট হয়ে যায়। ঘরে কিছুই পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পরে নতুন করে বইপত্তর কিনে নব উদ্যোমে শুরু করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস।

আমাদের গ্রামের বাড়িতে ধীরে ধীরে সবকিছু গোছানোর কাজ চলছে। এই সময়ে বাবার নামে ডাকযোগ ডাকাতির বার্তা নিয়ে এক চিঠি এলো। চিঠিতে লেখা সপ্তাহের অমুকদিন রাতে তারা আসবেন- তাদের জন্য যেন টাকাপয়সা ইত্যাদি সব ব্যবস্থা করে রাখা হয়। সে-আমলে ডাকাতি হতো চিঠি দিয়ে। এটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ কি না এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়। হতে পারে- ডাকাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য গৃহকর্তা টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখবে, না-জানিয়ে গেলে হয়তো বেশিকিছু ঘরে পাবে না! ডাকাতের চিঠি পেয়ে বাবা একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন। এ খবর আমি জেনেছি পরে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে খবরটি জানাতে চাননি বাবা। বাড়িতে তখন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাবা ও মেঝভাই নির্মল, আর দুজন কাজের লোক- চান্দু আর দুলাল। চান্দু আর দুলাল আমাদের কৃষিকাজ দেখাশোনার জন্য বাৎসরিক মজুর। সবাই সে চিঠিকে গুরুত্ব দিলো। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই দোতলার লম্বা ঝুল-বারান্দা টিনের আবরণে আচ্ছাদিত করা হলো। দোতলায় স্থানীয় অস্ত্র- দা, খড়গ, বল্লম, মরিচের গুড়া, পাথরের টুকরা মজুত করা হলো, যাতে ডাকাত এলে সবাই মিলে প্রতিহত করতে পারে। এবং সবাই সাবধান ছিলো। উপরে দোতলায় ছিলো চারজন পুরুষ; আর বেড়ার যে-নতুন ঘর বানানো হয়েছিলো- সেখানে থাকলো পরিবারের বাকি সদস্যরা। সবার মনে শঙ্কা ছিলো- ডাকাত যে-কোনো সময় আসতে পারে। আবার এমনও ভাবনায় ছিলো, এটা নেহাত কারো ফাজলামো!

একদিন পর ঠিক-ঠিক মধ্যরাতে বাড়ির গেটে গুলির শব্দ। জানান দিলো- তারা এসেছেন! গুলির শব্দ শুনেই নিচে বেড়ার ঘরে যারা ছিলো তারা তড়িঘড়ি পুকুরের পাড় ধরে পাশের বাড়িতে চলে যায়। যেতে পারলেন না বৃদ্ধপিসী। ডাকাতদল সদর্পে এসে ৪/৫ রাউন্ড গোলাগুলি করলো, আর চিৎকার করে বলতে লাগলো- দোতলার দরজা খোল। উপর থেকে কেউ তার জবাব দিচ্ছে না। ডাকাতদের একজন গিয়ে বুড়িকে ধরে নিয়ে এলো দোতলার নিচে। এনে বলছে- তোমার ভাইকে বলো দরজা খুলে দিতে; নইলে তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলবো। তারা পরিবারের অন্যদের এদিক-ওদিক খোঁজ করলো। বুড়িপিসীকে জিজ্ঞাসা করলো- অন্যরা কোথায়। বুড়ি পিসী খুব সাহসী। বলে- আমি কি জানি, কে কোথায়। এখানে কেউ ছিলো না; নিচে আমি একা। ডাকাতেরা ভাবলো- সবাই উপরে, দোতলায়। বুড়িপিসীকে মারধরও করলো তারা। তবু তাকে দিয়ে বলাতে পারেনি কিছু। পিসীর নাকি মুখে একটাই কথা- তোরা আমাকে মেরে ফেললেও ওরা আমার কথা শুনবে না। তোরা বরং চলে যা, দোতলায় উঠে লাভ নেই, ওখানে তোদের নেয়ার মতো কোনো কিছু নেই। বুড়িকে ওরা কিলঘুষি মেরেও মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারেনি। পিসী জানতেন, দরজা খুলে দিলে ওরা উপরে গিয়ে টাকাপয়সা না-পেয়ে ভাইকে ও অন্য সবাইকে মেরে ফেলবে। তাই প্রিয়ভাইকে বাঁচাতে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালেও বুড়িপিসীর একই ভূমিকা ছিলো। পাকিস্তানি সেনারাও বুড়িকে অত্যাচার করেছে, প্রাণে মারেনি। আমরা আগেও দেখেছি- বুড়িপিসী এলাকার সবাইকে চিনতো। তিনি কিছুতেই কোনো কাজে ভয় পেতেন না। এমনকি ঝড়ঝঞ্জায় বন্যা-বাদলেও বুড়িপিসী বাবাকে সাহস দিয়ে রাখতেন। ভাইকে ভালোবাসতেন প্রাণের চেয়েও বেশি। বাবাও পিসীকে বড়বোন হলেও মায়ের মতো জ্ঞান করতেন।

ডাকাতদল বাঁশ সংগ্রহ করে নানাভাবে ঝুলবারান্দার আবরণ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিলো। যতবারই চেষ্টা করেছে উপর থেকে খড়গ ও বর্শা দিয়ে তা প্রতিহত করা হয়েছে। কিন্তু নিচে বুড়িপিসীকে যে অত্যাচার করছে সেটা বুঝে কেউ আর উপর থেকে মরিচের গুঁড়া স্প্রে করেনি, তাতে পিসীরও ক্ষতি হতে পারতো। ঘণ্টা-দুই চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে ডাকাতদল শেষরাতের দিকে গুলি চালাতে-চালাতে স্থান ত্যাগ করে। পাড়ার কেউ বন্দুকের সামনে এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি তখন। ওরা ভেবেছিলো প্রসন্ন গুহ পরিবারের সবাইকে এরমধ্যে মেরে ফেলেছে ডাকাতেরা। ভোরের আলো ফুটতেই পাড়ার লোকজন এসে জড়ো হলো। তখন পিসী নিচ-থেকে ডেকে বলেছেন, তোমরা দরজা খোলো- ভোর হয়েছে; এলাকার লোকজন এসেছে। দরজা খুলে সবাই দোতলা থেকে নেমে এলো নিচে। সবার সঙ্গে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির বিষয়ে আলাপ হলো। সকাল হতেই থানায় গেলো ছোটভাই নির্মল। থানার পুলিশ এসে বাড়ি দেখে গেছে। তারা কেস করতে বলে গিয়েছিলো, কিন্তু বাবা কেস করার পক্ষপাতি ছিলেন না। এতে ভোগান্তি আরও বাড়বে এই ভেবে।

ডাকাতির খবর আমি পাই সন্ধ্যার দিকে। ঘটনার বিবরণ শুনে পরদিন বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি সেই ভুতুড়ে বাড়ি! এমনিতে যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাড়িঘর, তার উপর এই দুর্ভোগ। দোতলার ঝুলবারান্দা পরদিন মিস্ত্রি ডেকে আরও মজবুত করা হলো। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ও দরজার সংস্কার করাসহ পুরোমাত্রায় প্রস্তুতি জোরদার করা হলো- এই ভেবে যে, ভবিষ্যতে যে-কোনো সুযোগে ডাকাতদল আবার আসতে পারে। এই ঘটনা আমাদের মনে বড় প্রভাব ফেলে। সেই থেকে গ্রামের বাড়িতে রাতে থাকতে সাহস পেতাম না। তখন একটা বন্দুকের লাইসেন্স নেয়ার কথা হচ্ছিলো। বাবা বললেন, বন্ধুক নিলে আমাদের উপর মানুষের চোখ পড়বে আরও বেশি। সম্পদ তো এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তখন ভাবতে শুরু করবে- অনেক সম্পদ আছে! বাবার ধারণা হয়েছিলো, এটা স্বাধীনতাবিরোধীদের কাজ। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা দেশের কোথাও-কোথাও ঘাপটি মেরে আছে, সুযোগ পেলেই ছোবল মারতে চায়। এটা আমাদের দেশ, আমাদের বাড়ি; এইসব প্রতিহত করেই আমাদের থাকতে হবে, বাঁচতে হবে। এরপরও আর একরাতে ডাকাতদল পাশ দিয়ে গেছে, বাড়ির গেটে গুলি করতে-করতে। সে রাতে বাড়িতে প্রস্তুতি ছিলো প্রথমরাতের চাইতে দ্বিগুণ। ডাকাতি করা মোটেই সম্ভব হতো না তাদের। ডাকাতকে দোতলায় উঠতে হলে জীবন দিয়ে উঠতে হতো। কারণ কিরিচ ও শানানো খড়গের কাছে সরাসরি কোনো অস্ত্রই বেশি ধারালো নয়! দুপক্ষের যুদ্ধে একপক্ষ খোলা মাঠে, অন্যপক্ষ বাড়ির আড়াল থেকে যুদ্ধ করবে। তাই পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে। এই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, তা থেকে আমরা ভাইবোনেরা মনের দিক থেকে আর মুক্ত হতে পারিনি। সেই থেকে আজ অবধি আমরা বাড়ি গেলে ঘরে রাত কাটাতাম না। সন্ধ্যায়-সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরে ফিরে যেতাম। মাঝে মাঝে থেকেছি- তবে খুব স্বস্তিতে নয়। বলে রাখা ভালো যে, এ শুধু মনের আতঙ্ক। এরপরে আর কোনোদিন চুরি-ডাকাতি হয়নি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পুরোদমে চলছে। নতুন ভর্তির বিজ্ঞপ্তিও হয়েছে। ছোটভাই নির্মল সাতকানিয়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে ভর্তিপরীক্ষা হয়ে গেছে। নির্মল তার অনুষদে ভর্তিপরীক্ষায় প্রথম হলো। সে বাণিজ্য অনুষদের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ১ম বর্ষ অনার্সে ভর্তি হলো। ক্লাস শুরু হলে নবনির্মিত শাহজালাল হলে সিটও বরাদ্দ পায় সে। শাহজালাল হলটি সেসময়ে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমিও ফতেপুর থেকে শাহজালাল হলে চলে আসি দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে। দুভাই হল-এ সিট বরাদ্দ পেয়েছি- আমার কক্ষ নং ৪০১; নির্মলের কক্ষ নং ৪৩৬।

গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস করেছি, ক্লাসের ফাঁকে চলে যেতাম বাংলা বিভাগে। বিজ্ঞান অনুষদ আগে ছিলো কলাভবনে। স্বাধীনতার পর চলে যায় আলাদা বিজ্ঞান ভবনে। ক্লাসের ফাঁকে বিজ্ঞানভবন থেকে এসে যোগ দিতাম কলাভবনের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সাধারণত বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে এসব আয়োজন হতো। এই দুই বিভাগের অনেকের সঙ্গে ইতোমধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছি। হঠাৎ কী মনে হলো- নিজে নিজে ভাবলাম- যদি ইংরেজি বা বাংলা বিভাগে পড়তাম, তখন আর বিজ্ঞানভবন আর কলাভবনের দোটানায় থাকতে হতো না। একদিন ইংরেজি বিভাগে আমার এক বছরের সিনিয়র একজন ছাত্রের সঙ্গে (নাম সম্ভবত- শহিদুল ইসলাম) আলাপ করলাম। তিনি জানতেন আমি কবিতা লিখি, কলাভবনে ২/১টি অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছি। প্রথম বর্ষে যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। সিনিয়র বন্ধুটি বললেন, আপনি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে দেখা করেন, তিনি ইংরেজি বিভাগে আপনার ভর্তির একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। পরদিন গিয়ে দেখা করলাম। বিভাগীয় প্রধান বললেন, তোমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে (কথা হচ্ছিলো ইংরেজিতে)।

-বললাম, ঠিক আছি স্যার।

-ভর্তি পরীক্ষার জন্য পরের দিন আসতে বললেন।

আমি সন্ধ্যায় আবার সেই সিনিয়র বন্ধুর কাছে গেলাম, তার আলাওল হলের কক্ষে। তিনি কিছু পরামর্শ দিলেন, দুটো বই হাতে দিলেন- শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’, আর আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’। বললেন, এ বই দুটো পড়ে রাখেন। আমি বই দুটো নিয়ে রুমে চলে এলাম, এবং রাতের মধ্যেই মোটামুটি পড়ে নিলাম। পরের দিন গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। শুধু মৌখিক পরীক্ষা নিলেন আধাঘণ্টার মতো। ইংরেজিতেই কথপোকথন হলো। স্মরণ করছি যে, হাইস্কুলে জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরী স্যার ক্লাসে ইংরেজিতে কথোপথনের মাধ্যমে আমাদের ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। স্কুলেই তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরকে ইংরেজিতে শিখতে-বলতে শিখিয়েছেন তিনি। মৌখিক পরীক্ষা ভালো হলো, যদিও দুরুদুরু বুকে সারাসময় কেটেছে। আমাকে এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন; আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নাম শুনেছো? তাঁর কোনো বই পড়েছো? বললাম- পড়েছি স্যার, ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সি’। এতে মনে হলো তিনি উত্তর পেয়েছেন। তারপর বললেন, টেল দ্য স্টোরি ইন ব্রিফ? আমি বলতে শুরু করলাম। দুতিন মিনিট বলার পর বললেন, ও কে। ইউ আর সিলেক্টেড ফর এডমিশন। গেট এডমিনেটেড টুমোররো এন্ড সি মি ইন অফিস?

বললাম, স্যার উড ইউ গিভ মি টাইম ফর থ্রি ডেজ টু অ্যারেঞ্জ মানি ফ্রম হোম?

-ওকে, ইউ কাম আফটার থ্রি ডেজ।

আমি সেদিনই দুপুরের বাসে গ্রামের বাড়ি চলে গেলাম এবং বাবার নিকট থেকে টাকা নিয়ে ফিরে এলাম পরদিন। আজকের দিনে তো কী সহজে ‘বিকাশ’-এ মুহূর্তে টাকা লেনদেন করা যায়। বাড়ি থেকে ফিরেই তৃতীয় দিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ভর্তির ফরম নিয়ে। স্যার তখন যা বললেন, তাতে আমি মুহূর্তেই আকাশ থেকে মাটিতে পতিত হলাম। বিকট শব্দে বুকটা ভেঙে গেলো! বললেন, গতকাল অর্থনীতি বিভাগ থেকে একজন ছাত্র (তার নাম সম্ভবত রেজাউল করিম) বিভাগ-বদল করে ইংরেজি বিভাগে আসতে আবেদন করেছে, গতকাল তার আবেদন অনুমোদন করে দিয়েছি। এবছর ভর্তির জন্য আর কোনো আসন খালি নেই। তুমি আগ্রহী হলে পরের বছর চেষ্টা করতে পারো। আমি বিফল মনোরথে বিভাগ থেকে বের হয়ে গেলাম। আমার চোখে তখন শুধু অন্ধকার! কারণ আমি গণিত বিভাগ থেকে মন তুলে নিয়েছি এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র একবছর গ্যাপ দিয়ে প্রথম বর্ষ ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হতে চেয়েছি। পরের বছর মানে আরও এক বছর গ্যাপ! তারও বা নিশ্চয়তা কি?

এই দুঃসহ স্মৃতিটা আমার হৃদয়ে আঁকা হয়ে গেলো। মানুষের জীবনের কিছু-কিছু ঘটনা থাকে মানুষ মন থেকে সহজে মুছে ফেলতে পারে না! মন খারাপ করে রুমে চলে এলাম। গণিত বিভাগেও আর ক্লাস করতে গেলাম না। রুমে মন খারাপ করে শুয়ে আছি- ভাবছি কী করবো! এর মধ্যে পাশের রুমের সহপাঠী বন্ধু এসে জিজ্ঞাসা করলো, ক্লাসে না যাওয়ার কারণ। জানতে চাইলো- শরীর খারাপ কি না। বললাম, না। শুয়ে-শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম। লেখাপড়া কি এখানেই বন্ধ হয়ে যাবে? ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, এক দুর্ঘটনায় চোখের সামনে সাথির মৃত্যুতে তা বাদ হয়ে গেলো; গণিতে অনার্স পড়তে আসলাম- তা ভালো লাগলো না; ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য টিকেও টাকা জোগাড় করতে সময় লাগলো বলে তাও হলো না! এখন কী করি? তখন মনস্থ করলাম- ঠিক আছে, বাংলা বিভাগে ভর্তির চেষ্টা করবো। তা হলেও সাহিত্য-পড়ার আগ্রহ মিটবে; গণিত থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।

পরদিন গেলাম বাংলা বিভাগে। তখন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্যারের কাছে দরখাস্ত নিয়ে গেলে- স্যার বললেন, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তো বিভাগ বদল করা যায় না, অর্থাৎ ট্রান্সফার হবে না। তিনি আমার দরখাস্তে ইংরেজি হরফে ‘নো’ লিখে তা তৎকালীন বিভাগীয় সহকারী মি. আবদুর রশীদের হাতে দিয়ে বললেন- রেখে দাও। স্যার অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় বেশি কথা বলার সুযোগ হলো না। বাংলা বিভাগের প্রভাষক ভুবনমোহন অধিকারী; থাকতেন ফতেপুরে। তিনি ছিলেন সংস্কৃত বিষয়ের শিক্ষক, বাংলা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত; তখন সংস্কৃত বিভাগ হয়নি। রাতে গেলাম তাঁর বাসায়। ভুবনমোহন অধিকারী স্যার নিজেও কবিতা লিখতেন এবং জানতেন যে, আমিও কবিতা লিখি। তিনি বললেন, তুমি স্যারকে বুঝিয়ে বলতে পারোনি। বলোনি কেনো, যে প্রথমবর্ষে ভর্তি হতে চাও, ট্রান্সফার নয়! -বললাম, তা বলার মতো ফুরসত পাইনি, স্যার খুব ব্যস্ত ছিলেন। দরখাস্তটা নিয়ে না-করে দিলেন। অধিকারী স্যার বললেন, তুমি কাল বিভাগে এসো, আমিও স্যারকে বলবো। পরদিন আমি আবার দেখা করলাম বিভাগীয় প্রধান আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে। আমাকে দেখেই বললেন, তুমি প্রথমবর্ষে ভর্তি হতে চাও? তা তো বলোনি। তবে তোমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে।

বললাম, ঠিক আছে স্যার।

কখন দেবে, বললাম, আজকেও দিতে পারি।

তিনি একটা খাতা আর ভর্তি পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্র দিয়ে পাশের সেমিনার কক্ষে বসিয়ে দিলেন লিখিত পরীক্ষা দিতে। এক ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা দিলাম এবং নির্বাচিত হলাম।

স্যার আমার পুরনো আবেদনপত্রটি বিভাগের সহকারীর কাছ থেকে নিয়ে- যেখানে ইংরেজি হরফে ‘নো’ লিখেছিলেন; তার পাশে আবার বড় হরফে লিখে দিলেন ‘অব্জেকশন’। আবেদনপত্রে চেয়াম্যানের মন্তব্য হয়ে গেলো- ‘নো অবজেকশন’ অর্থাৎ ভর্তি হতে আপত্তি নেই। বিভাগ থেকে ভর্তির যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে পাঠালেন হিসাব দপ্তরে। সেখানে ভর্তির টাকা জমা দিয়ে নতুন করে ভর্তি হয়ে গেলাম ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগে ১ম বর্ষ অনার্স কোর্সে। ততদিনে কিছু ক্লাস হয়ে গেছে। বিভাগে আমার আগমনকে স্বাগত জানালেন সহপাঠী বন্ধুরা। ছোটভাই নির্মলকে তখনো জানাইনি যে আমি তার সাথে একই শিক্ষাবর্ষে বাংলায় অনার্সে পুনরায় ভর্তি হয়েছি। সে বন্ধুদের মুখে পরে শুনেছে। বাড়িতেও তা জানাইনি, নির্মলকেও জানাতে বারণ করেছিলাম। বাবা বাংলা একবছর গ্যাপ দিয়ে পড়াকে কতটা গ্রহণ করতে পারবে- কষ্ট পাবে কি না, তাই ভেবেছিলাম। বাবা জানেন, নির্মল প্রথম বর্ষে ও আমি দ্বিতীয় বর্ষে অনার্স পড়ি। মানুষজনকেও তিনি তা বলে আনন্দ পান। আমাদের গ্রামের তেমন কেউ তখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারেনি। আমাদের আগে আশুতোষ নাথ, আর আমি। এর পরের বছর ছোটভাই নির্মল, বাদল ও বাবুল।

এদিকে নতুন করে পরিবার গোছানো শুরু করে দিয়েছেন বাবা। শুধু কি নিজের পরিবার! তিনি এপাড়ার মুরুব্বি। পুরো এলাকার সবাই তাঁর দিকে চেয়ে থাকে। কারও ঘরবাড়ি নেই, পুরো পাড়া পাকিস্তানিরা জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়ে গেছে। যে-পরিবার শহিদ পরিবার বা আহত সদস্যের পরিবার, তাদের দুর্দশার অন্ত নেই। কারণ যে-সদস্য শহিদ হয়েছে বা আহত হয়েছে- তারাই সে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। বাবা তাদের পুর্নবাসনেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন সরকার ইউনিয়নে-ইউনিয়নে পুনর্বাসন কমিটি গঠন করেছে। বাবা সেই কমিটির সদস্য।

গ্রামে আমরাও কয়েকজন যুবক মিলে ঠিক করলাম- যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামের জন্য কাজ করবো। পাড়ার ছেলেদেরকে নিয়ে গড়ে তুললাম ‘পল্লী মঙ্গল সমিতি’। সমিতির কার্যকরী কমিটিও হলো; সভাপতি- আশুতোষ নাথ, সহসভাপতি- প্রফুল্লরঞ্জন দাশ, সাধারণ সম্পাদক- বিমল গুহ, সদস্য- নারায়ণ মল্লিক, নির্মল গুহ, অনিল বৈদ্য, অনিল মল্লিক, সন্তোষ মহাজন, পরিমল দাস প্রমুখ। সমিতির প্রায় সব কাজ আমাকে করতে হয়। ঠিক করলাম সমিতির পক্ষ থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করবো। সব ঠিকঠাক। লেখা আর পাওয়া যায় না। ম্যাগাজিনের জন্য আশুতোষ নাথের একটি গদ্য রচনা, আর বিভিন্ন নামে ৫টি কবিতা ঠিক করা হলো। বিভিন্নজনের নাম দিয়ে কবিতাগুলি আমিই লিখেছিলাম। ম্যাগাজিনের নাম ঠিক করলাম ‘পল্লীশ্রী’। এখন কাজ ছাপানোর ব্যবস্থা করা। সাতকানিয়া কলেজের পথে একটা প্রেস ঠিক করা হলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- আমাদের এলাকার খ্যাতিমান কথাশিল্পী আবুল ফজলের লেখা নিতে হবে। আবুল ফজল থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। তাঁর আদিবাড়ি আমাদের পাশের গ্রাম কেঁওচিয়ায়। আমি আর আশুতোষ নাথ শহরে গেলাম একদিন। আশুতোষ নাথ তখন হুলাইন ছালেহ নূর কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছেন।

অধ্যাপক আবুল ফজল থাকতেন কাজির দেউরিতে নিজের বাড়ি ‘সাহিত্যসদন’-এ। সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। অবসরে এসেছেন। গ্রামের বাড়িতে তিনি খুব একটা যান না। গিয়ে বললাম- বাজালিয়া গ্রাম থেকে এসেছি। আমরা ‘পল্লীমঙ্গল সমিতি’ করেছি, সেই সমিতি থেকে একটি ম্যাগাজিন বের করবো। নাম- পল্লীশ্রী। তার জন্য আপনার লেখা চাই। আমাদের খবর জানতে চাইলেন, বললাম- আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, আশুতোষ নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেন। বললেন, বসো। তিনি ঘরের ভেতরে গেলেন। প্যাড আর কলম নিয়ে এলেন। আমাদের সামনে বসে লিখে দিলেন- আশীর্বাণী। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। লেখাটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম সন্ধ্যার মধ্যেই। পল্লীশ্রী’র জন্য কভার ডিজাইন দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে নিজেই এঁকে ফেললাম- গোলাকার একটা বৃত্তের মাঝখানে পল্লীশ্রী নামের ডিজাইন। ব্লক বানিয়ে ছাপা হলো সবুজ রঙের কভার। প্রকাশিত হলো- পল্লীশ্রী।

(আগামী সংখ্যায় পড়ুন)