হরপ্রাসাদের ‘তৈল’ এবং উন্নয়নের পথরেখা

শেখর ভট্টাচার্য

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আমার প্রিয় লেখকদের অন্যতম। শাস্ত্রী মহোদয় সারা জীবন ব্যয় করে যদি তৈল প্রবন্ধটি রচনা করে ধরাধাম ত্যাগ করতেন, আমি নিশ্চিত শুধু ‘তৈল’ দিয়েই তিনি বিশ্ব চরাচরে অমর হয়ে থাকতেন। তার ‘তৈল’ সমতুল্য সর্বকালের উপযোগী প্রবন্ধ বিশ্ব সাহিত্যে খুব বেশি যে নেই এ কথাটি গবেষণা না করে বলতে আমার দ্বিধা নেই। বিশ্ব সাহিত্যে যতটুকু ঘোরাফেরা করেছি এ রকম উচ্চরসের, চাবুক লাগানো প্রবন্ধ পড়া হয়ে ওঠেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে লন্ডনে জন্ম নেয়া ব্রিটিশ দার্শনিক, আইনজ্ঞ, বিজ্ঞান গবেষণার পথিকৃত স্যার ফ্রান্সিস বেকন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এমন কোন বিষয় নেই যে বিষয় নিয়ে তিনি প্রবন্ধ রচনা করেননি। তিনিও তৈলের মর্ম ও গুরুত্ব ঠিক ততটুকু বুঝতে পারেননি। “বন্ধুত্ব”, “বিয়ে”, “ঈর্ষা”, “সাহসিকতা”, “ভালোবাসা”র মতো বিষয় নিয়ে রচনা লিখে বেকন সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়ে আছেন। স্যার বেকনও তৈলের মতো বিষয় নিয়ে এতো উচ্চ মানের সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক রচনা লেখার কোন উৎসাহ বোধ করেননি। কেউ যদি এ কথা বলেন ইউরোপে সে সময়ে অভিবক্ত ভারত বা বাংলার মতো হরপ্রসাদ বর্ণিত তৈলের ব্যবহার ছিলোনা, তার কথাটি কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির ধারণা আছে বলে আমি মনে করি। যাদের ধারণা নাই তারা বড়ই হতভাগা। এই অসাধারণ মানুষটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৬ নভেম্বর ১৮৫৩ সালে আর তিনি ১৭ নভেম্বর ১৯৩১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমার কথা শুনুন। কোলকাতা সংস্কৃত কলেজ থেকে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে স্নাত্তকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে তিনি শাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন। হরপ্রসাদ কী ছিলেন না? তিনি শিক্ষাবিদ, গবেষক, বহু ভাষাবিদ, পুথি-সংগ্রাহক-বিশ্লেষক, সম্পাদক, অনুবাদক। শিলা লেখ, তাম্রলিপি পাঠোদ্ধারকারী এবং ঐতিহাসিক। তার সম্পাদিত গ্রন্থাবলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ‘হাজার বছরের বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’ (প্রকাশকাল : ১৯১৬)। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পরিচিত এই ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাপদ’ ১৯০৭ সালে নেপাল থেকে হরপ্রসাদই আবিষ্কার করেন। বাংলাসাহিত্য যে হাজার বছরের পুরোনো, তা হরপ্রসাদের এই আবিষ্কারের পথ ধরেই প্রমাণিত হয়। গবেষণা এবং পুঁথি-আবিষ্কার ও সম্পাদনা ছাড়াও তিনি উপন্যাস লিখেছেন (‘কাঞ্চনমালা’, ১৯১৬; ‘বেনের মেয়ে’, ১৯২০); কয়েকজন প্রাচীন মনীষীর জীবন ও কর্মের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন; মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর নাট্যরূপ দিয়েছেন।

শাস্ত্রী মহাশয় তার সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মানচিত্র তুলে ধরেছেন তৈল প্রবন্ধটিতে। রচনাটির আরম্ভ হয় এরকম-

“তৈল যে কী পদার্থ তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠা-া করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠা-া করিতে আর কিসে পারে!”

এতো বড় মনীষী, এত বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করে তৈলের মহিমা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আধুনিক বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা থেকে গ্রামগঞ্জের অতি সাধারণ ব্যসায়ীরা সামান্য শিক্ষায় কিংবা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেয়েই তৈলের মর্ম গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই মূল্যবান তরল পদার্থটিকে তারা মাঝেমধ্যে অমূল্য করে তোলার জন্য বাংলাদেশের বাজার থেকে উধাও করে দেন। কোন দ্রব্য নিখোঁজ বা উধাও নাহলে দ্রব্যেটির মূল্য বুঝা যায় না। যেমন বাংলা ভাষায় একটি কথা আছে দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বাঙালি বুঝতে পারে না। হারিয়ে না ফেললে কিগবা পাওয়া না গেলেই তার মূল্য বোঝা সহজ হয়। তৈলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে সব শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের অভূতপূর্ব ঐক্য দেখে অনেকেই স্তম্ভিত হন। অন্য অনেক ব্যাপারে তারা ঐক্যবদ্ধ না হলেও স্নেহ জাতীয় পদার্থের মূল্য বৃদ্ধিতে তাদের ইস্পাত সম ঐক্য এবং সংহতি। কৌশলটি বড়ই রসময়। তৈলের বা তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে জাতিকে শিক্ষা দেয়ার মহান উদ্দেশ্যে খাটের নীচে, বাথরুমে, পরিত্যক্ত দালানের মেঝের নিচে, খোলা আঙিনার মাটি খুঁড়ে তার নিচে সযতনে তৈলের খনি তৈরি করে বঙ্গ ও বিশ্ববাসীকে তাদের অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছেন। সংবাদপত্রের পাতাময় তেলের খনির ছবি দর্শন করে জাতি যুগপৎ মুগ্ধ ও বাক শক্তি হীন হয়ে পড়েছে।

শাস্ত্রী মহাশয়ের একটি আগ্রহ ছিল, তৈল বিদ্যাকে প্রসারিত করার জন্য স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে কতকিছু উদ্ভাবন করছে। আমরা তেল প্রদানের যে অপ্রতিষ্ঠানিক জ্ঞান রয়েছে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক করে সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করতেও ব্যর্থ হয়েছি। এই ‘বিশেষ সামাজিক শিক্ষা’ সম্পর্কে সত্যান্বেষী হরপ্রসাদ বলেছেন : ‘তেলদানের একটি স্কুলের নিতান্ত প্রয়োজন। অতএব আমরা প্রস্তাব করি বাছিয়া বাছিয়া কোনো রায়বাহাদুর অথবা খাঁ বাহাদুরকে প্রিন্সিপাল করিয়া শিগগির একটি স্নেহনিষেকের কালেজ খোলা হয়। ... কিন্তু এরূপ কালেজ খুলিতে হইলে প্রথমতই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তেল সবাই দিয়া থাকেন- কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দিই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার, এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমতো লেকচার পাওয়া যায় না।’ বল-বিক্রম-বিদ্যা-বুদ্ধিবিহীন বাঙালির একমাত্র ভরসা যে ‘তৈলমর্দন’, সে-বিষয়ে হরপ্রসাদ কোনো সন্দেহ পোষণ করেননি। আবার তেল-প্রয়োগ পদ্ধতিও যেসব বাঙালি সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি, তাও তিনি তার পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছেন। যশ-খ্যাতি যাই বলি না কেন, বাঙালির সমূহ সাফল্যের মূলে যে ওই ‘তৈল’ তা যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, প্রতিদিনের প্রতিবেশ থেকে জেনেছেন সমাজ-বিশ্লেষক হরপ্রসাদ।

মহামহীম হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বেঁচে থাকলে বাঙালির তেল ব্যবহার দেখে অত্যন্ত প্রীত হতেন। সমগ্র বাংলাদেশ আজ তেলের ওপর সাঁতার কাটছে। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব বিষয়ে আত্মস্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের আজ জয় জয়কার। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী থেকে রাজনৈতিক দলের যে কোন পদ প্রার্থী হতে হলে আজ উচ্চমানের তেল অত্যন্ত জরুরি। তবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তেলের ভ্যলু-চেইনের সঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত হয়েছে সেটি হলো মূল্যবান কাগজ। তৈল এবং কাগজ দুটি দ্রব্যকে জন-সমাজে খালি চোখে দেখা যায় না। অদৃশ্য অমূল্য বস্তুদের প্রয়োগের সময় পাবলিক ডেমোনেস্ট্রেশন না করার কথা বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। তাই নিতান্ত “গঙ্গারাম”দের তেল মর্দনের দৃশ্যটি গোচরে আসে না। যিনি তেল দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করেন এবং যিনি তেল গ্রহণ করেম তারা দুজনই শুধু তৈল মর্দনের সুখ অনুভব ও উপভোগ করে থাকেন।

শাস্ত্রী মহাশয় বেঁচে থাকলে অধম একটি অনুরোধ নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে অনুরোধ করত, প্রাতিষ্ঠানিক তৈল প্রদান শিক্ষায় তার অগ্রহ থেকে সরে আসার জন্য। তার ইচ্ছা অনুযায়ী যদি “তৈল প্রদান কৌশল শিক্ষার স্কুল” গ্রামে গ্রামে স্থাপন করা হয় তাহলে এ পোড়া দেশের অবস্থা যে কী হবে তা স্বয়ং বিধাতা ছাড়া কেউ অনুমান করতে পারেন না। অপ্রতিষ্ঠানিক বিদ্যায় বাঙালি তৈল প্রদানে যতটুকু দক্ষতা অর্জন করেছে তার ফলাফলে আমাদের অন্তরাত্মা প্রায় শুকনো কাঠে রুপান্তরির হয়ে পড়ছে। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজ আজ এ বিষয়ে এতই দক্ষতা অর্জন করেছে, তাদের জ্ঞানকে সারা বিশ্বে বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তাদের সীমিত তৈল ব্যবহারকারী দেশে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। এতে বিশ্বে তৈল বিদ্যার প্রসারতা ঘটবে এবং তৈল ব্যবহার রকেটের গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের মডেলে পরিণত হওয়াও অসম্ভব কোন অর্জন হবে না।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির পর আমাদের এখন ভাবতে হবে আমরা কী মিথ্যা প্রশংসা বা লোক দেখানো স্তুতির বিদ্যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাবো নাকি আমরা পরিশ্রম মেধা দিয়ে একটি নৈতিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ সমাজ কাঠামো গড়ে তুলবো। প্রথমটি খুব সহজ কিন্তু অনৈতিক। এর মাধ্যমে অর্জিত যে কোন উন্নয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো টেকসই এবং আমাদের উচ্চমূল্যবোধ গড়ার উপযোগী। সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করা বাংলাদেশেকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এগোনোর পথ কোনটি হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ , ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৭ শাওয়াল ১৪৪৩

হরপ্রাসাদের ‘তৈল’ এবং উন্নয়নের পথরেখা

শেখর ভট্টাচার্য

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আমার প্রিয় লেখকদের অন্যতম। শাস্ত্রী মহোদয় সারা জীবন ব্যয় করে যদি তৈল প্রবন্ধটি রচনা করে ধরাধাম ত্যাগ করতেন, আমি নিশ্চিত শুধু ‘তৈল’ দিয়েই তিনি বিশ্ব চরাচরে অমর হয়ে থাকতেন। তার ‘তৈল’ সমতুল্য সর্বকালের উপযোগী প্রবন্ধ বিশ্ব সাহিত্যে খুব বেশি যে নেই এ কথাটি গবেষণা না করে বলতে আমার দ্বিধা নেই। বিশ্ব সাহিত্যে যতটুকু ঘোরাফেরা করেছি এ রকম উচ্চরসের, চাবুক লাগানো প্রবন্ধ পড়া হয়ে ওঠেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে লন্ডনে জন্ম নেয়া ব্রিটিশ দার্শনিক, আইনজ্ঞ, বিজ্ঞান গবেষণার পথিকৃত স্যার ফ্রান্সিস বেকন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এমন কোন বিষয় নেই যে বিষয় নিয়ে তিনি প্রবন্ধ রচনা করেননি। তিনিও তৈলের মর্ম ও গুরুত্ব ঠিক ততটুকু বুঝতে পারেননি। “বন্ধুত্ব”, “বিয়ে”, “ঈর্ষা”, “সাহসিকতা”, “ভালোবাসা”র মতো বিষয় নিয়ে রচনা লিখে বেকন সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়ে আছেন। স্যার বেকনও তৈলের মতো বিষয় নিয়ে এতো উচ্চ মানের সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক রচনা লেখার কোন উৎসাহ বোধ করেননি। কেউ যদি এ কথা বলেন ইউরোপে সে সময়ে অভিবক্ত ভারত বা বাংলার মতো হরপ্রসাদ বর্ণিত তৈলের ব্যবহার ছিলোনা, তার কথাটি কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির ধারণা আছে বলে আমি মনে করি। যাদের ধারণা নাই তারা বড়ই হতভাগা। এই অসাধারণ মানুষটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৬ নভেম্বর ১৮৫৩ সালে আর তিনি ১৭ নভেম্বর ১৯৩১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমার কথা শুনুন। কোলকাতা সংস্কৃত কলেজ থেকে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে স্নাত্তকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে তিনি শাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন। হরপ্রসাদ কী ছিলেন না? তিনি শিক্ষাবিদ, গবেষক, বহু ভাষাবিদ, পুথি-সংগ্রাহক-বিশ্লেষক, সম্পাদক, অনুবাদক। শিলা লেখ, তাম্রলিপি পাঠোদ্ধারকারী এবং ঐতিহাসিক। তার সম্পাদিত গ্রন্থাবলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ‘হাজার বছরের বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’ (প্রকাশকাল : ১৯১৬)। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পরিচিত এই ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাপদ’ ১৯০৭ সালে নেপাল থেকে হরপ্রসাদই আবিষ্কার করেন। বাংলাসাহিত্য যে হাজার বছরের পুরোনো, তা হরপ্রসাদের এই আবিষ্কারের পথ ধরেই প্রমাণিত হয়। গবেষণা এবং পুঁথি-আবিষ্কার ও সম্পাদনা ছাড়াও তিনি উপন্যাস লিখেছেন (‘কাঞ্চনমালা’, ১৯১৬; ‘বেনের মেয়ে’, ১৯২০); কয়েকজন প্রাচীন মনীষীর জীবন ও কর্মের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন; মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর নাট্যরূপ দিয়েছেন।

শাস্ত্রী মহাশয় তার সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মানচিত্র তুলে ধরেছেন তৈল প্রবন্ধটিতে। রচনাটির আরম্ভ হয় এরকম-

“তৈল যে কী পদার্থ তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠা-া করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠা-া করিতে আর কিসে পারে!”

এতো বড় মনীষী, এত বিদ্যা শিক্ষা অর্জন করে তৈলের মহিমা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আধুনিক বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা থেকে গ্রামগঞ্জের অতি সাধারণ ব্যসায়ীরা সামান্য শিক্ষায় কিংবা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেয়েই তৈলের মর্ম গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই মূল্যবান তরল পদার্থটিকে তারা মাঝেমধ্যে অমূল্য করে তোলার জন্য বাংলাদেশের বাজার থেকে উধাও করে দেন। কোন দ্রব্য নিখোঁজ বা উধাও নাহলে দ্রব্যেটির মূল্য বুঝা যায় না। যেমন বাংলা ভাষায় একটি কথা আছে দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বাঙালি বুঝতে পারে না। হারিয়ে না ফেললে কিগবা পাওয়া না গেলেই তার মূল্য বোঝা সহজ হয়। তৈলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে সব শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের অভূতপূর্ব ঐক্য দেখে অনেকেই স্তম্ভিত হন। অন্য অনেক ব্যাপারে তারা ঐক্যবদ্ধ না হলেও স্নেহ জাতীয় পদার্থের মূল্য বৃদ্ধিতে তাদের ইস্পাত সম ঐক্য এবং সংহতি। কৌশলটি বড়ই রসময়। তৈলের বা তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে জাতিকে শিক্ষা দেয়ার মহান উদ্দেশ্যে খাটের নীচে, বাথরুমে, পরিত্যক্ত দালানের মেঝের নিচে, খোলা আঙিনার মাটি খুঁড়ে তার নিচে সযতনে তৈলের খনি তৈরি করে বঙ্গ ও বিশ্ববাসীকে তাদের অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছেন। সংবাদপত্রের পাতাময় তেলের খনির ছবি দর্শন করে জাতি যুগপৎ মুগ্ধ ও বাক শক্তি হীন হয়ে পড়েছে।

শাস্ত্রী মহাশয়ের একটি আগ্রহ ছিল, তৈল বিদ্যাকে প্রসারিত করার জন্য স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। সারা বিশ্বজুড়ে মানুষ বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে কতকিছু উদ্ভাবন করছে। আমরা তেল প্রদানের যে অপ্রতিষ্ঠানিক জ্ঞান রয়েছে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক করে সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করতেও ব্যর্থ হয়েছি। এই ‘বিশেষ সামাজিক শিক্ষা’ সম্পর্কে সত্যান্বেষী হরপ্রসাদ বলেছেন : ‘তেলদানের একটি স্কুলের নিতান্ত প্রয়োজন। অতএব আমরা প্রস্তাব করি বাছিয়া বাছিয়া কোনো রায়বাহাদুর অথবা খাঁ বাহাদুরকে প্রিন্সিপাল করিয়া শিগগির একটি স্নেহনিষেকের কালেজ খোলা হয়। ... কিন্তু এরূপ কালেজ খুলিতে হইলে প্রথমতই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তেল সবাই দিয়া থাকেন- কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দিই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার, এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমতো লেকচার পাওয়া যায় না।’ বল-বিক্রম-বিদ্যা-বুদ্ধিবিহীন বাঙালির একমাত্র ভরসা যে ‘তৈলমর্দন’, সে-বিষয়ে হরপ্রসাদ কোনো সন্দেহ পোষণ করেননি। আবার তেল-প্রয়োগ পদ্ধতিও যেসব বাঙালি সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি, তাও তিনি তার পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছেন। যশ-খ্যাতি যাই বলি না কেন, বাঙালির সমূহ সাফল্যের মূলে যে ওই ‘তৈল’ তা যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, প্রতিদিনের প্রতিবেশ থেকে জেনেছেন সমাজ-বিশ্লেষক হরপ্রসাদ।

মহামহীম হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বেঁচে থাকলে বাঙালির তেল ব্যবহার দেখে অত্যন্ত প্রীত হতেন। সমগ্র বাংলাদেশ আজ তেলের ওপর সাঁতার কাটছে। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব বিষয়ে আত্মস্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের আজ জয় জয়কার। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী থেকে রাজনৈতিক দলের যে কোন পদ প্রার্থী হতে হলে আজ উচ্চমানের তেল অত্যন্ত জরুরি। তবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তেলের ভ্যলু-চেইনের সঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত হয়েছে সেটি হলো মূল্যবান কাগজ। তৈল এবং কাগজ দুটি দ্রব্যকে জন-সমাজে খালি চোখে দেখা যায় না। অদৃশ্য অমূল্য বস্তুদের প্রয়োগের সময় পাবলিক ডেমোনেস্ট্রেশন না করার কথা বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। তাই নিতান্ত “গঙ্গারাম”দের তেল মর্দনের দৃশ্যটি গোচরে আসে না। যিনি তেল দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করেন এবং যিনি তেল গ্রহণ করেম তারা দুজনই শুধু তৈল মর্দনের সুখ অনুভব ও উপভোগ করে থাকেন।

শাস্ত্রী মহাশয় বেঁচে থাকলে অধম একটি অনুরোধ নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে অনুরোধ করত, প্রাতিষ্ঠানিক তৈল প্রদান শিক্ষায় তার অগ্রহ থেকে সরে আসার জন্য। তার ইচ্ছা অনুযায়ী যদি “তৈল প্রদান কৌশল শিক্ষার স্কুল” গ্রামে গ্রামে স্থাপন করা হয় তাহলে এ পোড়া দেশের অবস্থা যে কী হবে তা স্বয়ং বিধাতা ছাড়া কেউ অনুমান করতে পারেন না। অপ্রতিষ্ঠানিক বিদ্যায় বাঙালি তৈল প্রদানে যতটুকু দক্ষতা অর্জন করেছে তার ফলাফলে আমাদের অন্তরাত্মা প্রায় শুকনো কাঠে রুপান্তরির হয়ে পড়ছে। বাঙালি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজ আজ এ বিষয়ে এতই দক্ষতা অর্জন করেছে, তাদের জ্ঞানকে সারা বিশ্বে বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তাদের সীমিত তৈল ব্যবহারকারী দেশে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। এতে বিশ্বে তৈল বিদ্যার প্রসারতা ঘটবে এবং তৈল ব্যবহার রকেটের গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের মডেলে পরিণত হওয়াও অসম্ভব কোন অর্জন হবে না।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির পর আমাদের এখন ভাবতে হবে আমরা কী মিথ্যা প্রশংসা বা লোক দেখানো স্তুতির বিদ্যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাবো নাকি আমরা পরিশ্রম মেধা দিয়ে একটি নৈতিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ সমাজ কাঠামো গড়ে তুলবো। প্রথমটি খুব সহজ কিন্তু অনৈতিক। এর মাধ্যমে অর্জিত যে কোন উন্নয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো টেকসই এবং আমাদের উচ্চমূল্যবোধ গড়ার উপযোগী। সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করা বাংলাদেশেকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এগোনোর পথ কোনটি হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]