পিকে হালদারকে ফেরত আনতে উদ্যোগ

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পিকে হালদার) দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি টিমকে ভারতে পাঠানো হতে পারে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দুদক থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এদিকে ভারতে গ্রেপ্তার পিকে হালদারের বিরুদ্ধে নতুন করে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় পিকে হালদার ছাড়াও ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে যারা পিকে সিন্ডিকেটের সদস্য। মামলায় পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণাধীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং লিমিটেডের নামে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ৪৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

পিকে হালদারকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগের কথা জানিয়ে গতকাল দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান বলেন, পিকে হালদারকে ফেরাতে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করি। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ (গতকাল) জরুরি বৈঠক ডাকে। যেখানে আইন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করেছি।

সাঈদ মাহবুব খান বলেন, পিকে হালদারকে ফেরানোর বহিঃসমর্পণ যে আইন বিদ্যমান রয়েছে, তার সব আইন বিধির মাধ্যমে কীভাবে তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি সেই বিষয়ে আলোচনা হয়। তাকে ফেরত আনতে যেসব ডকুমেন্ট প্রয়োজন সেগুলোর একত্রিত করার সিদ্ধান্ত হয়। আমরা খুব দ্রুত সেসব প্রস্তুতি সম্পন্ন করব।

তিনি বলেন, পিকে হালদারকে ভারত থেকে ফেরাতে প্রয়োজনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয়ে কমিটি করে টিম পাঠানো হতে পারে। কূটনীতিক চ্যানেলসহ অন্যান্য যেসব চ্যানেল ব্যবহার করে তাকে দ্রুত আনা যায় আমরা সেই চেষ্টা করব। ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, আমরা যতগুলো ইউনিটের কথা বললাম সবার সহযোগিতা ও সমন্বয়ে তাকে দেশে ফেরাতে সফল হবো।

ভারতে পিকে হালদারের সম্পদের খোঁজ করতে দুদক বিএফআইইউকে যে চিঠি দিয়েছে সে বিষয়ে সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, আমরা যে মামলা করেছি সেখানে ভারতে পিকে হালদারের অল্প পরিমাণ সম্পদের তথ্য আমাদের কাছে ছিল, বাকি তথ্যগুলো যদি আমরা পাই তার বিরুদ্ধে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেয়ার ব্যবস্থা নেব। বিএফআইইউ সেই তথ্যগুলো আমাদের সংগ্রহ করে দেবে।

ইন্টারপোলের তৎপরতার বিষয়ে দুদক সচিব বলেন, ইন্টারপোলকে আমরা চিঠি দিয়েছি। ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের প্রধান শাখা থেকে ভারতীয় ইন্টারপোলের যারা আছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা যেন সেই যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। আর পিকে হালদারের বিষয়ে আমরা যে রেড এলার্ট জারি করেছি সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছি।

দুদক সূত্রে জানা যায়, পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রথম ইন্টারপোলে চিঠি পাঠায় দুদক। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ জানুয়ারি ইন্টারপোল পিকে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল। এরপর গত ১৪ মে পিকে হালদারকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর থেকে গ্রেপ্তারের পরদিন ১৫ মে ইন্টারপোলের ঢাকা ডেস্ক থেকে নয়াদিল্লি ডেস্কে আরও একটি চিঠি পাঠানো হয়।

পিকের বিরুদ্ধে নতুন মামলা

দুদক জানিয়েছে, গতকাল দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদকের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত বাদী হয়ে পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেটের ১২ জনের বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পিকে হালদার ছাড়া যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- দিয়া শিপিং লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিব প্রসাদ ব্যানার্জী, পরিচালক পাপিয়া ব্যানার্জি, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান এমএ হাফিজ, সাবেক চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক অরুণ কুমার কুন্ডু, অঞ্জন কুমার রায়, মো. মোস্তাইন বিল্লাহ, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সত্য গোপাল পোদ্দার ও এফএএস ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহরিয়ার।

মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে অবৈধ উপায়ে ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং লিমিটেডের নামে ঋণ হিসেবে ৪৪ কোটি টাকা গ্রহণ করে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, দিয়া শিপিং লিমিটেডের এমডি শিব প্রসাদ ব্যানার্জী ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অন্য আসামি মো. রাসেল শাহরিয়ার বরাবর ৬ বছরের জন্য ৪৪ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করেন। ওই ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৩২ ডেসিমেল জমি দেখানো হয়। ঋণ প্রস্তাব বোর্ডে অনুমোদনের জন্য ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর উপস্থাপন করেন রাসেল।

‘পরে ১৬৩তম বোর্ড সভায় ঋণ প্রদানের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। বোর্ড সভায় উপস্থিত হয়ে কোন আপত্তি ছাড়াই ঋণ প্রদানের জন্য পরিচালক এমএ হাফিজ, ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, তৎকালীন পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, অঞ্জন কুমার রায়, অরুণ কুমার কুন্ডু, মো. মোস্তাইন বিল্লাহ, সত্য গোপাল পোদ্দার এবং সাবেক এমডি মো. রাসেল শাহরিয়ারকে দায়ী বলে মনে করছে দুদক’।

ঋণ অনুমোদনের পর ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দিয়া শিপিং লিমিটেডের অনুকূলে ঋণ ছাড় করা হয়েছে। পরবর্তীতে তা আত্মসাৎ করে পিকে হালদার সিন্ডিকেট। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান মামলার অন্যতম আসামি এফএএস ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি রাসেল শাহরিয়ারকে ১৫ ফেব্রুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৫টি মামলা করেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। সব মামলায় পিকে হালদারকে প্রধান আসামি করা হয়।

এর আগে, পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী রতন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গত ১৭ মে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে দুদক। রতন কুমার বিশ্বাস আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের পরিচালক ও আরবি এন্টারপ্রাইজের মালিক। মামলায় তার বিরুদ্ধে প্রায় ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।

আলোচিত পিকে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গতকালের মামলা নিয়ে মোট ৪০টি মামলা দায়ের করে দুদক। অনুসন্ধান শুরুর চার মাস পর প্রথম মামলা হয় পিকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন উপপরিচালক মো. মামনুর রশীদ। পরবর্তী সময়ে দুদকের আরেক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম আর্থিক কেলেংকারির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই টিম মোট ৩৮টি মামলা করে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার চার্জশিট ২০২১ সালের নভেম্বরে দাখিল করা হয়। যেখানে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে পিকে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। মামলার তদন্তকালে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকে হালদারের সহযোগী শঙ্খ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। একই ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করা হয়েছে।

গত ১৪ মে শনিবার ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোক নগরের একটি বাড়ি থেকে পিকে হালদারসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে আদালতে হাজির করলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। গত মঙ্গলবার তার বিরুদ্ধে আরও ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন কলকাতার একটি আদালত।

শুক্রবার, ২০ মে ২০২২ , ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৮ শাওয়াল ১৪৪৩

পিকে হালদারকে ফেরত আনতে উদ্যোগ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পিকে হালদার) দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি টিমকে ভারতে পাঠানো হতে পারে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দুদক থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এদিকে ভারতে গ্রেপ্তার পিকে হালদারের বিরুদ্ধে নতুন করে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় পিকে হালদার ছাড়াও ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে যারা পিকে সিন্ডিকেটের সদস্য। মামলায় পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণাধীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং লিমিটেডের নামে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ৪৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

পিকে হালদারকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগের কথা জানিয়ে গতকাল দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান বলেন, পিকে হালদারকে ফেরাতে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করি। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ (গতকাল) জরুরি বৈঠক ডাকে। যেখানে আইন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করেছি।

সাঈদ মাহবুব খান বলেন, পিকে হালদারকে ফেরানোর বহিঃসমর্পণ যে আইন বিদ্যমান রয়েছে, তার সব আইন বিধির মাধ্যমে কীভাবে তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি সেই বিষয়ে আলোচনা হয়। তাকে ফেরত আনতে যেসব ডকুমেন্ট প্রয়োজন সেগুলোর একত্রিত করার সিদ্ধান্ত হয়। আমরা খুব দ্রুত সেসব প্রস্তুতি সম্পন্ন করব।

তিনি বলেন, পিকে হালদারকে ভারত থেকে ফেরাতে প্রয়োজনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয়ে কমিটি করে টিম পাঠানো হতে পারে। কূটনীতিক চ্যানেলসহ অন্যান্য যেসব চ্যানেল ব্যবহার করে তাকে দ্রুত আনা যায় আমরা সেই চেষ্টা করব। ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, আমরা যতগুলো ইউনিটের কথা বললাম সবার সহযোগিতা ও সমন্বয়ে তাকে দেশে ফেরাতে সফল হবো।

ভারতে পিকে হালদারের সম্পদের খোঁজ করতে দুদক বিএফআইইউকে যে চিঠি দিয়েছে সে বিষয়ে সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, আমরা যে মামলা করেছি সেখানে ভারতে পিকে হালদারের অল্প পরিমাণ সম্পদের তথ্য আমাদের কাছে ছিল, বাকি তথ্যগুলো যদি আমরা পাই তার বিরুদ্ধে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেয়ার ব্যবস্থা নেব। বিএফআইইউ সেই তথ্যগুলো আমাদের সংগ্রহ করে দেবে।

ইন্টারপোলের তৎপরতার বিষয়ে দুদক সচিব বলেন, ইন্টারপোলকে আমরা চিঠি দিয়েছি। ইতোমধ্যে ইন্টারপোলের প্রধান শাখা থেকে ভারতীয় ইন্টারপোলের যারা আছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা যেন সেই যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। আর পিকে হালদারের বিষয়ে আমরা যে রেড এলার্ট জারি করেছি সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছি।

দুদক সূত্রে জানা যায়, পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রথম ইন্টারপোলে চিঠি পাঠায় দুদক। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ জানুয়ারি ইন্টারপোল পিকে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল। এরপর গত ১৪ মে পিকে হালদারকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর থেকে গ্রেপ্তারের পরদিন ১৫ মে ইন্টারপোলের ঢাকা ডেস্ক থেকে নয়াদিল্লি ডেস্কে আরও একটি চিঠি পাঠানো হয়।

পিকের বিরুদ্ধে নতুন মামলা

দুদক জানিয়েছে, গতকাল দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ দুদকের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াত বাদী হয়ে পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেটের ১২ জনের বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পিকে হালদার ছাড়া যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- দিয়া শিপিং লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিব প্রসাদ ব্যানার্জী, পরিচালক পাপিয়া ব্যানার্জি, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান এমএ হাফিজ, সাবেক চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক অরুণ কুমার কুন্ডু, অঞ্জন কুমার রায়, মো. মোস্তাইন বিল্লাহ, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সত্য গোপাল পোদ্দার ও এফএএস ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহরিয়ার।

মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে অবৈধ উপায়ে ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং লিমিটেডের নামে ঋণ হিসেবে ৪৪ কোটি টাকা গ্রহণ করে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, দিয়া শিপিং লিমিটেডের এমডি শিব প্রসাদ ব্যানার্জী ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অন্য আসামি মো. রাসেল শাহরিয়ার বরাবর ৬ বছরের জন্য ৪৪ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করেন। ওই ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৩২ ডেসিমেল জমি দেখানো হয়। ঋণ প্রস্তাব বোর্ডে অনুমোদনের জন্য ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর উপস্থাপন করেন রাসেল।

‘পরে ১৬৩তম বোর্ড সভায় ঋণ প্রদানের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। বোর্ড সভায় উপস্থিত হয়ে কোন আপত্তি ছাড়াই ঋণ প্রদানের জন্য পরিচালক এমএ হাফিজ, ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম, তৎকালীন পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, অঞ্জন কুমার রায়, অরুণ কুমার কুন্ডু, মো. মোস্তাইন বিল্লাহ, সত্য গোপাল পোদ্দার এবং সাবেক এমডি মো. রাসেল শাহরিয়ারকে দায়ী বলে মনে করছে দুদক’।

ঋণ অনুমোদনের পর ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দিয়া শিপিং লিমিটেডের অনুকূলে ঋণ ছাড় করা হয়েছে। পরবর্তীতে তা আত্মসাৎ করে পিকে হালদার সিন্ডিকেট। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান মামলার অন্যতম আসামি এফএএস ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি রাসেল শাহরিয়ারকে ১৫ ফেব্রুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৫টি মামলা করেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। সব মামলায় পিকে হালদারকে প্রধান আসামি করা হয়।

এর আগে, পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী রতন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গত ১৭ মে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে দুদক। রতন কুমার বিশ্বাস আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের পরিচালক ও আরবি এন্টারপ্রাইজের মালিক। মামলায় তার বিরুদ্ধে প্রায় ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়।

আলোচিত পিকে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গতকালের মামলা নিয়ে মোট ৪০টি মামলা দায়ের করে দুদক। অনুসন্ধান শুরুর চার মাস পর প্রথম মামলা হয় পিকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন উপপরিচালক মো. মামনুর রশীদ। পরবর্তী সময়ে দুদকের আরেক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম আর্থিক কেলেংকারির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই টিম মোট ৩৮টি মামলা করে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার চার্জশিট ২০২১ সালের নভেম্বরে দাখিল করা হয়। যেখানে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে পিকে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। মামলার তদন্তকালে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকে হালদারের সহযোগী শঙ্খ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। একই ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করা হয়েছে।

গত ১৪ মে শনিবার ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোক নগরের একটি বাড়ি থেকে পিকে হালদারসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে আদালতে হাজির করলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। গত মঙ্গলবার তার বিরুদ্ধে আরও ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন কলকাতার একটি আদালত।