সরকার আবদুল মান্নান
গত ১৯ মে তারিখে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মারা যান। এই বয়সে একজন মানুষের মারা যাওয়া স্বাভাবিক। বলতেই হবে, তিনি দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে ছিলেন এবং একজন অত্যন্ত সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীর, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির অনেক খবরই তিনি রাখতেন। অভিজ্ঞতা ও তাঁর পঠন-বিশে^র সেইসব তথ্যাদি অবলম্বনে দীর্ঘ সত্তর বছর তিনি লিখে গেছেন। সুতরাং বলা যায়, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেকটা সময় জুড়ে ছিল তাঁর অধিষ্ঠান। তাঁর এই সর্বময় অধিষ্ঠানের সবচেয়ে আলকোজ্জ্বল অধ্যায় হলো ৫২-র ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটি। স্বাধীনতাপূর্বকালে এই গানটি ছিল বাঙালি-জীবনে শক্তি ও প্রেরণার উৎস এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতীয় সংগীতের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বমহলে তুলনারহিত নন্দিত গান। একটিমাত্র গান একজন মানুষকে এতটা অমর করে তুলতে পারে তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কি না আমার জানা নেই। সুতরাং বলা যায় যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, যতদিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এই গানটি থাকবে এবং এই গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী থাকবেন। সুতরাং তাঁর লোকান্তর তাঁকে বিন্দুমাত্র বিস্মৃত করার ঘটনা নয়, অধিকন্তু ইহকালে তিনি যে বৈভবে বেঁচে ছিলেন, মৃত্যুর পরেও তিনি অনুরূপ বৈভব ও মর্যাদা নিয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
গত শতকের প্রথমার্ধে ১৯৩৪ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জন্মেছিলেন পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলায়। ১৯২০-এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের বয়সের ব্যবধান ছিল কম-বেশি ১৪ বছর। কিন্তু যে রাজনৈতিক দর্শন ও জীবনাদর্শের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটান, তার সঙ্গে নিরন্তর সহযাত্রার ভেতর দিয়ে গাফ্ফার চৌধুরী ওই ব্যবধান ঘুচিয়ে দেন এবং তিনি হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। আর সেই সান্নিধ্যের শক্তি তিনি রচনা করেন মসিযুদ্ধের আশ্রয়ে। ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমার বন্ধু’ নামক একটি নিবন্ধে মোনায়েম সরকার লিখেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন একজন অগ্রগণ্য কলমযোদ্ধা। তার অগ্নিঝরা কলমে বাংলাদেশের ইতিহাস অবিকৃতভাবে উঠে এসেছে। যখনই তিনি বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কিছু লিখেছেন, তখনই তিনি সত্যকে অবলীলায় স্বীকার করে নিয়েছেন। মিথ্যা ভাষণ কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কখনোই তিনি ইতিহাসকে বিকৃত করেননি। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন, গাফ্ফার ভাই তাদের অন্যতম।”
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। আর ভাবনা ও আদর্শের সেই প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন লেখায়। সত্তর বছরের লেখকজীবন কম কথা নয়। সেই দীর্ঘ লেখক জীবনে তিনি আদর্শ থেকে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শের আনুগত্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। কিন্তু তাঁর সহচর লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদগণ জানেন, তাঁর আদর্শের ওই আনুগত্য কখনোই চাটুকারিতায় পর্যবসিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভুলত্রুটিগুলোকে তিনি পরম শুভাকাক্সক্ষী ও আত্মীয়ের মতো তুলে ধরতেন। আর শেখ মুজিবুর রহমান
এমনই এক মহান ব্যক্তি ছিলেন যিনি দিনের আলোর মতো বুঝতে পারতেন যে শুভাকাক্সক্ষী কে এবং চাটুকারইবা কারা। সুতরাং তিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আত্মীয় জ্ঞান করতেন এবং তাঁর সঙ্গে রসিকতার আশ্রয় নিতেন। আর আত্মীয়কেই তো আদর করে, রসিকতা করে ভিন্ন নামে সংবোধন করা যায়। এবিএম মূসা তাঁর ‘মুজিব ভাই’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ এবং তাঁকে বঙ্গবন্ধু একসঙ্গে দেখলেই বলতেন, ‘এই রে সারছে! আপদ, বিপদ আর মুসিবত একসঙ্গে। কী জানি কী ফ্যাসাদে ফেলবে।’ বঙ্গবন্ধু আদরের এই ‘মুসিবত’ ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যার পরে গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডন থেকে ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিরন্তর লিখে গিয়েছেন। সে সময়ের ‘বাংলার ডাক’, ‘বজ্রকণ্ঠ’, ‘সোনার বাংলা’ (দ্বিভাষিক), ‘সানরাইজ’ প্রভৃতি পত্রিকা তার স্বাক্ষর বহন করছে। এবং একই সঙ্গে তিনি আওয়মী লীগের রাজনীতি ও ক্ষমতা লাভের বিচিত্র বিষয় নিয়ে জনমত গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘ সময় জুড়ে মসিযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। কিন্তু যখনই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তখন থেকেই তিনি আর ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি যখনই কোনো ব্যত্যয় দেখেছেন, তাঁর কাছে কোনো অন্যায় ও অনিয়ম অনুভূত হয়েছে তখনই প্রতিবাদ করেছেন, শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবিতার সুযোগ তিনি কখনো গ্রহণ করেছেন বলে জানা নেই। ফলে বাংলাদেশের পাঠক সমাজ তাঁর কলামগুলো পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন।
শুরুটা তিনি করেছিলেন যৌবনের প্রাক্কালে। পঞ্চাশের দশকের সূচনালগ্নে সাংবাদিকতা দিয়ে জীবনযুদ্ধের যে গোড়াপত্তন রচনা করেছিলেন, ৮৮ বছরের দীর্ঘ এক জীবন অতিবাহিত করেছেন ওই সাংবাদিকতার মধ্যে। মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যবসার উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন একবার। কিন্তু তাঁর মনের গড়নে বণিকবৃত্তির লেশমাত্র উপকরণ ছিল না। সুতরাং নাকে খত্ দিয়ে তাঁর প্রত্যাবর্তন স্বখাতে- সাংবাদিকতায়। কত পত্রপত্রিকার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন? কোন কোন পত্রপত্রিকায় তিনি কাজ করেছেন? কোন সময়ে কোন প্রত্রিকায় তিনি ছিলেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য রীতিমতো একটি গবেষণার প্রয়োজন। কী ধরনের মনোগড়ন লালন করলে সত্তর বছরের এক কর্মজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় একটিমাত্র পেশাকে কেন্দ্র করে! এই নিষ্ঠা, সততা ও স্থিতধী মনোড়গনের জন্য তিনি জীবনের মধু যেমন গ্রহণ করেছেন অকুণ্ঠভাবে, তেমনি গরলও হজম করেছেন অবলীলায়। পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তিনি কত যে ঝঞ্ঝার সম্মুখিন হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তিনি কখনোই ভেঙে পড়েননি। বরং জীবনের সব পরিস্থিতিকে তিনি জীবনযাপনের নিজস্ব দার্ঢ্য ভেবে মোকাবেলা করেছেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী- এই নাম বাঙালি জীবনে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে- হাওড়ে, বাওড়ে, পাহাড়ে, চরে- সর্বত্র একজন শিশু স্কুলের গ-ির ভেতরে যখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল হাতে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শহিদ মিনারের দিকে অগ্রসর হয়, তখন তার মুখে উচ্চারিত হতে থাকে সেই অমোগ বাণী- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”; তখন সে তার কণ্ঠে ধারণ করে ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি জাতির উত্থানকে, মুক্তিযুদ্ধকে, স্বাধীনতাকে। সেই উচ্চারণের বাণীবন্ধের মধ্যে নিশ্চয়ই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। প্রতিটি বাঙালি-জীবনে শৈশব থেকে আমৃত্যু এই অমোঘ বাণী সগৌরবে ধারণ করতে হয় এবং তার পরিধি আজ বিশ^ব্যাপী ব্যাপ্ত। বিষয়টি এমন নয় যে, অপরাপর গানের মতো এই গানটিও তার চেতনার ভেতরগত গ-ির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অধিকন্তু মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে এই গানটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতি ও অর্থনৈতিক এমন কোনো বঞ্চনা নেই যে, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের খড়গ উঁচু না করে। এ হলো প্রমূর্ত এক প্রতিবাদ-বাণী, অমোঘ অস্ত্র। যারা এর ধারক তারা কি এর স্রষ্টাকে ভুলে যেতে পারে? পারে না। এক জীবনে কত সম্মান তিনি পেয়েছেন, কত মানুষের ভালোবাসা তিনি লাভ করেছেন, কত প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার আর সম্মাননা তিনি অর্জন করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কত বই তিরি রচনা করছেন। তারও পরিমাণ কম নয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এই সকল কর্ম, লেখা, সকল কীর্তি মুছে গেলেও একটি অমর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। দেহগত মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তাঁর এই পরম সৌভাগ্যের মৃত্যু হবে কোনো দিন। তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি।
বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৪ শাওয়াল ১৪৪৩
সরকার আবদুল মান্নান
গত ১৯ মে তারিখে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মারা যান। এই বয়সে একজন মানুষের মারা যাওয়া স্বাভাবিক। বলতেই হবে, তিনি দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে ছিলেন এবং একজন অত্যন্ত সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীর, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির অনেক খবরই তিনি রাখতেন। অভিজ্ঞতা ও তাঁর পঠন-বিশে^র সেইসব তথ্যাদি অবলম্বনে দীর্ঘ সত্তর বছর তিনি লিখে গেছেন। সুতরাং বলা যায়, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেকটা সময় জুড়ে ছিল তাঁর অধিষ্ঠান। তাঁর এই সর্বময় অধিষ্ঠানের সবচেয়ে আলকোজ্জ্বল অধ্যায় হলো ৫২-র ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটি। স্বাধীনতাপূর্বকালে এই গানটি ছিল বাঙালি-জীবনে শক্তি ও প্রেরণার উৎস এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতীয় সংগীতের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বমহলে তুলনারহিত নন্দিত গান। একটিমাত্র গান একজন মানুষকে এতটা অমর করে তুলতে পারে তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কি না আমার জানা নেই। সুতরাং বলা যায় যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, যতদিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এই গানটি থাকবে এবং এই গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী থাকবেন। সুতরাং তাঁর লোকান্তর তাঁকে বিন্দুমাত্র বিস্মৃত করার ঘটনা নয়, অধিকন্তু ইহকালে তিনি যে বৈভবে বেঁচে ছিলেন, মৃত্যুর পরেও তিনি অনুরূপ বৈভব ও মর্যাদা নিয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
গত শতকের প্রথমার্ধে ১৯৩৪ সালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জন্মেছিলেন পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলায়। ১৯২০-এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের বয়সের ব্যবধান ছিল কম-বেশি ১৪ বছর। কিন্তু যে রাজনৈতিক দর্শন ও জীবনাদর্শের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটান, তার সঙ্গে নিরন্তর সহযাত্রার ভেতর দিয়ে গাফ্ফার চৌধুরী ওই ব্যবধান ঘুচিয়ে দেন এবং তিনি হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। আর সেই সান্নিধ্যের শক্তি তিনি রচনা করেন মসিযুদ্ধের আশ্রয়ে। ‘আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমার বন্ধু’ নামক একটি নিবন্ধে মোনায়েম সরকার লিখেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন একজন অগ্রগণ্য কলমযোদ্ধা। তার অগ্নিঝরা কলমে বাংলাদেশের ইতিহাস অবিকৃতভাবে উঠে এসেছে। যখনই তিনি বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কিছু লিখেছেন, তখনই তিনি সত্যকে অবলীলায় স্বীকার করে নিয়েছেন। মিথ্যা ভাষণ কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কখনোই তিনি ইতিহাসকে বিকৃত করেননি। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন, গাফ্ফার ভাই তাদের অন্যতম।”
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। আর ভাবনা ও আদর্শের সেই প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন লেখায়। সত্তর বছরের লেখকজীবন কম কথা নয়। সেই দীর্ঘ লেখক জীবনে তিনি আদর্শ থেকে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শের আনুগত্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। কিন্তু তাঁর সহচর লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদগণ জানেন, তাঁর আদর্শের ওই আনুগত্য কখনোই চাটুকারিতায় পর্যবসিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভুলত্রুটিগুলোকে তিনি পরম শুভাকাক্সক্ষী ও আত্মীয়ের মতো তুলে ধরতেন। আর শেখ মুজিবুর রহমান
এমনই এক মহান ব্যক্তি ছিলেন যিনি দিনের আলোর মতো বুঝতে পারতেন যে শুভাকাক্সক্ষী কে এবং চাটুকারইবা কারা। সুতরাং তিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আত্মীয় জ্ঞান করতেন এবং তাঁর সঙ্গে রসিকতার আশ্রয় নিতেন। আর আত্মীয়কেই তো আদর করে, রসিকতা করে ভিন্ন নামে সংবোধন করা যায়। এবিএম মূসা তাঁর ‘মুজিব ভাই’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ এবং তাঁকে বঙ্গবন্ধু একসঙ্গে দেখলেই বলতেন, ‘এই রে সারছে! আপদ, বিপদ আর মুসিবত একসঙ্গে। কী জানি কী ফ্যাসাদে ফেলবে।’ বঙ্গবন্ধু আদরের এই ‘মুসিবত’ ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যার পরে গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডন থেকে ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিরন্তর লিখে গিয়েছেন। সে সময়ের ‘বাংলার ডাক’, ‘বজ্রকণ্ঠ’, ‘সোনার বাংলা’ (দ্বিভাষিক), ‘সানরাইজ’ প্রভৃতি পত্রিকা তার স্বাক্ষর বহন করছে। এবং একই সঙ্গে তিনি আওয়মী লীগের রাজনীতি ও ক্ষমতা লাভের বিচিত্র বিষয় নিয়ে জনমত গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘ সময় জুড়ে মসিযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। কিন্তু যখনই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তখন থেকেই তিনি আর ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি যখনই কোনো ব্যত্যয় দেখেছেন, তাঁর কাছে কোনো অন্যায় ও অনিয়ম অনুভূত হয়েছে তখনই প্রতিবাদ করেছেন, শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবিতার সুযোগ তিনি কখনো গ্রহণ করেছেন বলে জানা নেই। ফলে বাংলাদেশের পাঠক সমাজ তাঁর কলামগুলো পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন।
শুরুটা তিনি করেছিলেন যৌবনের প্রাক্কালে। পঞ্চাশের দশকের সূচনালগ্নে সাংবাদিকতা দিয়ে জীবনযুদ্ধের যে গোড়াপত্তন রচনা করেছিলেন, ৮৮ বছরের দীর্ঘ এক জীবন অতিবাহিত করেছেন ওই সাংবাদিকতার মধ্যে। মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যবসার উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন একবার। কিন্তু তাঁর মনের গড়নে বণিকবৃত্তির লেশমাত্র উপকরণ ছিল না। সুতরাং নাকে খত্ দিয়ে তাঁর প্রত্যাবর্তন স্বখাতে- সাংবাদিকতায়। কত পত্রপত্রিকার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন? কোন কোন পত্রপত্রিকায় তিনি কাজ করেছেন? কোন সময়ে কোন প্রত্রিকায় তিনি ছিলেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য রীতিমতো একটি গবেষণার প্রয়োজন। কী ধরনের মনোগড়ন লালন করলে সত্তর বছরের এক কর্মজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় একটিমাত্র পেশাকে কেন্দ্র করে! এই নিষ্ঠা, সততা ও স্থিতধী মনোড়গনের জন্য তিনি জীবনের মধু যেমন গ্রহণ করেছেন অকুণ্ঠভাবে, তেমনি গরলও হজম করেছেন অবলীলায়। পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তিনি কত যে ঝঞ্ঝার সম্মুখিন হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তিনি কখনোই ভেঙে পড়েননি। বরং জীবনের সব পরিস্থিতিকে তিনি জীবনযাপনের নিজস্ব দার্ঢ্য ভেবে মোকাবেলা করেছেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী- এই নাম বাঙালি জীবনে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে- হাওড়ে, বাওড়ে, পাহাড়ে, চরে- সর্বত্র একজন শিশু স্কুলের গ-ির ভেতরে যখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল হাতে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শহিদ মিনারের দিকে অগ্রসর হয়, তখন তার মুখে উচ্চারিত হতে থাকে সেই অমোগ বাণী- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”; তখন সে তার কণ্ঠে ধারণ করে ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি জাতির উত্থানকে, মুক্তিযুদ্ধকে, স্বাধীনতাকে। সেই উচ্চারণের বাণীবন্ধের মধ্যে নিশ্চয়ই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। প্রতিটি বাঙালি-জীবনে শৈশব থেকে আমৃত্যু এই অমোঘ বাণী সগৌরবে ধারণ করতে হয় এবং তার পরিধি আজ বিশ^ব্যাপী ব্যাপ্ত। বিষয়টি এমন নয় যে, অপরাপর গানের মতো এই গানটিও তার চেতনার ভেতরগত গ-ির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অধিকন্তু মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে এই গানটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতি ও অর্থনৈতিক এমন কোনো বঞ্চনা নেই যে, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের খড়গ উঁচু না করে। এ হলো প্রমূর্ত এক প্রতিবাদ-বাণী, অমোঘ অস্ত্র। যারা এর ধারক তারা কি এর স্রষ্টাকে ভুলে যেতে পারে? পারে না। এক জীবনে কত সম্মান তিনি পেয়েছেন, কত মানুষের ভালোবাসা তিনি লাভ করেছেন, কত প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার আর সম্মাননা তিনি অর্জন করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কত বই তিরি রচনা করছেন। তারও পরিমাণ কম নয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এই সকল কর্ম, লেখা, সকল কীর্তি মুছে গেলেও একটি অমর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। দেহগত মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তাঁর এই পরম সৌভাগ্যের মৃত্যু হবে কোনো দিন। তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি।