যে গান তাঁকে অমর করেছে

সোহরাব হাসান

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন কবি, গীতিকার, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক। কিন্তু তাঁর অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে একটি পরিচয়ই বড় হয়ে আছে; একুশের অমর গানের রচয়িতা। যেই গান ঘরে ঘরে জনে জনে গীত হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। একুশের ভাষা শহীদদের নিয়ে অনেকেই গান লিখেছেন। কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরীর গানের মতো আর কোনোটি জনচিত্ত আন্দোলিত করতে পারেনি। হৃদয়কে অনুরণিত করতে পারেনি।

গানটি শুরু হয়েছিল এভাবে:

আমার ভাইয়ের রক্তে রঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আসলেই এ গান ভোলা যায় না। প্রায় সাত দশক ধরে এই গান বাঙালি গেয়ে যাচ্ছে সভায়-শোকে, ঘরে বাইরে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জা্তকি মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করার পর বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে প্রথিবীর বিভিন্ন দেশে এই গান গাওয়া হয়। এই গানে যেমন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার কথা আছে, তেমনি আছে বেদনা ও বিদ্রোহের বাণীও। এ কারণেই গাফ্ফার চৌধুরী লিখতে পারেন:

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা

শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,

দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী

দিনবদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?

না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে গানটি প্রকাশিত হয়। সেটা ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম স্মরণিকা; পঞ্চাশের দশকের সেরা লেখক-কবিরা এতে লিখেছেন। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।

গানটির পটভূমি আমাদের জানা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়; এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয়। সেই সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যালে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিক্যালের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ।

লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে ওঠে। পরে কয়েক দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গণে

শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল। গানটি গাওয়া ও লেখার দায়ে ঢাকা কলেজ থেকে গাফ্ফার চৌধুরীসহ ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।

২.

বর্তমান প্রজন্মের পাঠক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে জানেন একজন কলাম লেখক বা সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। গেল শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ভাষায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, জেল খেটেছেন।

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যখন দেশ সামরিক শাসনে পিষ্ট, চারদিকে ঘাতকের উল্লাস এবং মানবতার লাঞ্ছনা চলছিল, যখন কেউ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিতে সাহস পেতেন না, দূর প্রবাসে বসে তিনি দেশবাসীকে সাহস জুগিয়েছেন; ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে সহযাত্রীদের নিয়ে তিনি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের করে নিহত জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন; তাঁর সেই প্রতিবাদী পঙ্ক্তিমালা সামরিক শাসকের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে সরাসরি প্রবেশাধিকার পায়নি; তখন কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের কাছে বিমানযোগে পৌঁছানো হতো সেই পত্রিকা এবং পরে চোরাইপথে বংলাদেশে আসে। পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রায় অর্ধদশক ধরে যখন দেশে সেই অবরুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন শওকত ওসমান ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর গদ্য, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখের কবিতা আমাদের উজ্জীবিত করত, আশা জাগাত। এখন অনুকূল পরিবেশে অনেকেই বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নাম ব্যবহার করে নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন; কিন্তু সেই প্রতিকূল পরিবেশে তাঁরা ছিলেন নিশ্চুপ। এমনকি কেউ কেউ সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেননি।

গাফ্?ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে তাঁর শাসনামলের সমালোচনা করেছেন, পঁচাত্তরের মার্চে ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো’ শিরোনামে কলাম লিখে সমূহ বিপদের শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনার পর উপলব্ধি করেছেন, এই অভ্যুত্থান ব্যক্তি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও প্রাণসত্তার বিরুদ্ধে। ’৪৭ বছর ধরে গাফ্ফার চৌধুরী সেই অমোঘ সত্যই উচ্চারণ করে গেছেন তাঁর কলামে, বক্তৃতায়, নাটকে এবং অন্যবিধ রচনায়।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনন্য সৃষ্টি। তিনি যদি আর কিছু নাও লিখতেন, এই একটি গান তাঁকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখবে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,

‘আমরা আউটডোরের সামনে গিয়ে দেখি একটি লাশ পড়ে আছে। সাদা প্যান্ট পরা, সাদা শার্ট গায়ে, পায়ে জুতোও আছে, গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে গেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় লাশটি পড়ে আছে। সেই লাশটি দেখার জন্য শত শত লোক ভিড় জমিয়েছে। রফিকুল ইসলাম সম্ভবত তাঁর ছবি নিয়েছিলেন। পরে জানলাম যে এই লাশ হুবহু শহীদ রফিকউদ্দিনের। এই লাশটি দেখার সময়ে আমার মনে কবিতা লেখার জন্য একটি ভাবের উদয় হয়েছিল। ভাবটি এসেছিল কবিতা লেখার জন্য, গান রচনার জন্য নয়। আমি গান লিখতে জানি না, আমি সুরকারও নই, গীতিকারও নই, একটি কবিতা লেখার জন্য আমার মনে যে লাইনটি এসেছিল তা হলো: “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি?”’ (নেপথ্য কাহিনী: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি লুৎফর রহমান রিটন সম্পাদিত আগামী প্রকাশনী।)

গাফ্ফার চৌধুরী আরেকটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর। পাকিস্তানি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান ইতিহাসের বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়কে অগ্রাহ্য করে চীন সফরে গেলেন। চীন থেকে ফিরে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করলেও দক্ষিণাঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের পর ঘূর্ণিদুর্গত মানুষকে দেখতে গেলেন না।

গাফ্ফার চৌধুরী লিখলেনÑ

বাঁচতে চাইলেই বাঁচবে এমন কথা তো নেই

প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতে

আট লাখ শিশু, নারী ও পুরুষ আজকে নেই

মরে গেছে তারা এক রাতে।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটিতে শুধু শহীদের প্রতি শোকগাথা বা আহাজারি নয়। এই গানটিতে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াই-সংগ্রামের কথা আছে, আছে শত্রুর প্রতি প্রবল ঘৃণা প্রকাশ আর নিপীড়িত মানুষের ক্ষুদ্র শক্তিকে জাগানোর উদীপ্ত আহ্বান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এই গানের মাধ্যমে যেই সমাজ ও রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে হয় না।

এই গান কেবল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কিংবা এর সুরকার আলতাফ মাহমুদকেই অমর করেনি, বাঙালির চেতনাকেও করেছে তীক্ষè ও শাণিত। আমরা প্রতিবছর একুশের প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই। আসলে এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবতার চিরন্তন জাগৃতিই গান। এই গান অবিস্মরণীয়।

আলতাফ মাহমুদের জীবন ও সংগীত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সংস্কৃতিকর্মী দিনু বিল্লাহ লিখেছেন: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারিÑ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত কবিতায় কালাতীত ধ্রুপদী সুর সৃষ্টি করে বাঙালির রক্তঝরা ইতিহাসের সঙ্গে শহীদ আলতাফ মাহমুদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’

ওয়াহিদুল হক ও মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘আলতাফ মাহমুদ এক ঝড়ের পাখি’ গ্রন্থের মূল্যায়ন ছিল এরকম: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রথম শুনি, শিখি তা আমরা কজন। কেন ধরতে পারিনি আমাদের মধ্যে মানুষের মুক্তি নির্মাতা এক নব যিশু, যিশুরই মতো চূড়ান্ত হিউমিনিটি আত্মবিশেষের নিমগ্নতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গানটির আরম্ভ পশ্চিম দেশীয় সুরের ধরনে। কিন্তু ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ এবং ললিত নিসর্গ অংশগুলোতে ভারতবর্ষীয় রাগ-রাগিণী একাধারে প্রমত্ত নির্মেঘ ও কিশলয় কোমলতা নিয়ে বিপ্লবের মর্মবাণীকে মেলে ধরে কী আশ্চর্য অমোঘতায়! বাংলা যত দিন থাকবে এই ধরাপৃষ্ঠে, থাকবে আমার সোনার বাংলা, থাকবে বাংলার মাটি, বাংলার জল, আর থাকবে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।

৩.

১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। তিনি লন্ডন প্রবাসী ছিলেন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বরিশালে থাকাকালে তিনি বামপন্থী দল আরএসপি’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়।

১৯৫০ সালে ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফ্ফার চৌধুরী সেখানে সহসম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফ্ফার চৌধুরী। এসময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ’র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি ‘দৈনিক জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক জয়বাংলা’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায়ও লিখতেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন।

স্ত্রী অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপর তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। বিলেত যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন। প্রবাসে বসে গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিয়মিত লিখে গিয়েছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই: ডানপিটে শওকত (১৯৫৩), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), স¤্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭)।

তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থÑ বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭২)। আমরা বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালী (১৯৯৩), ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা, পলাশী থেকে ধানম-ি (২০০৭) তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা। তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্রীয় পদকই পেয়েছেন। এছাড়া পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৩)সহ আরো অসংখ্য পুরস্কার।

৮৮ বছর বয়সে গাফ্ফার চৌধুরী মারা গেছেন। একে পরিণত বয়সই বলতে হবে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও শিল্প-সাহিত্য জগতে তার মৃত্যুতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তিনি তার গানের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, তা বিস্মৃত হওয়ার নয়।

গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে সংবাদ-এর একটি আত্মিক সম্পর্ক ছিল। সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা পর্ব তিনি সংবাদ-এ সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পরে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পুনরায় সংবাদ-এ কলাম লেখা শুরু করেন। বছর দুই তার এই লেখা অব্যাহত ছিল। পরবর্তীকালে সংবাদ-এ না লিখলেও পত্রিকাটির প্রতি তার হার্দিক সম্পর্ক ছিল। মনে আছে, সেই সময়ে গাফ্ফার ভাই সংবাদ-এ একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, যাতে কেবল একুশের গান বা সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলেননি। বলেছিলেন ষাট ও পঞ্চাশের দশকে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামে তার ও সহযাত্রীদের ভূমিকার কথা। ঢাকায় কয়েকবার গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। হাসি মুখে তিনি সহকর্মীদের কুশল জানতে চেয়েছেন। কে কোথায় আছেন, খোঁজ নিয়েছেন।

ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা তার আত্মজীবনীমূলক বই। এই বইয়ে তিনি ঢাকায় তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও চমৎকারভাবে বলেছেন। আমাদের এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠায় মেঘনা ও কীর্তনখোলার পাড়ে, তারপরও কেন ধীরে বয়ে বুড়িহঙ্গা লিখেছেন। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, বুড়িগঙ্গাই গাফ্ফার চৌরীকে গাফ্ফার চৌধুরী বানিয়েছে। সেই বুড়িগঙ্গার তীরে তিনি আসবেন। কিন্তু নিষ্প্রাণ ও নিথর দেহে। গাফ্ফার ভাইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৪ শাওয়াল ১৪৪৩

যে গান তাঁকে অমর করেছে

সোহরাব হাসান

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন কবি, গীতিকার, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক। কিন্তু তাঁর অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে একটি পরিচয়ই বড় হয়ে আছে; একুশের অমর গানের রচয়িতা। যেই গান ঘরে ঘরে জনে জনে গীত হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। একুশের ভাষা শহীদদের নিয়ে অনেকেই গান লিখেছেন। কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরীর গানের মতো আর কোনোটি জনচিত্ত আন্দোলিত করতে পারেনি। হৃদয়কে অনুরণিত করতে পারেনি।

গানটি শুরু হয়েছিল এভাবে:

আমার ভাইয়ের রক্তে রঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আসলেই এ গান ভোলা যায় না। প্রায় সাত দশক ধরে এই গান বাঙালি গেয়ে যাচ্ছে সভায়-শোকে, ঘরে বাইরে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জা্তকি মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করার পর বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে প্রথিবীর বিভিন্ন দেশে এই গান গাওয়া হয়। এই গানে যেমন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার কথা আছে, তেমনি আছে বেদনা ও বিদ্রোহের বাণীও। এ কারণেই গাফ্ফার চৌধুরী লিখতে পারেন:

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা

শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,

দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী

দিনবদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?

না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে গানটি প্রকাশিত হয়। সেটা ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম স্মরণিকা; পঞ্চাশের দশকের সেরা লেখক-কবিরা এতে লিখেছেন। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।

গানটির পটভূমি আমাদের জানা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়; এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয়। সেই সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যালে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিক্যালের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ।

লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে ওঠে। পরে কয়েক দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গণে

শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল। গানটি গাওয়া ও লেখার দায়ে ঢাকা কলেজ থেকে গাফ্ফার চৌধুরীসহ ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।

২.

বর্তমান প্রজন্মের পাঠক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে জানেন একজন কলাম লেখক বা সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। গেল শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ভাষায় আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, জেল খেটেছেন।

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যখন দেশ সামরিক শাসনে পিষ্ট, চারদিকে ঘাতকের উল্লাস এবং মানবতার লাঞ্ছনা চলছিল, যখন কেউ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিতে সাহস পেতেন না, দূর প্রবাসে বসে তিনি দেশবাসীকে সাহস জুগিয়েছেন; ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে সহযাত্রীদের নিয়ে তিনি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের করে নিহত জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন; তাঁর সেই প্রতিবাদী পঙ্ক্তিমালা সামরিক শাসকের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে সরাসরি প্রবেশাধিকার পায়নি; তখন কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের কাছে বিমানযোগে পৌঁছানো হতো সেই পত্রিকা এবং পরে চোরাইপথে বংলাদেশে আসে। পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রায় অর্ধদশক ধরে যখন দেশে সেই অবরুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন শওকত ওসমান ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর গদ্য, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখের কবিতা আমাদের উজ্জীবিত করত, আশা জাগাত। এখন অনুকূল পরিবেশে অনেকেই বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নাম ব্যবহার করে নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন; কিন্তু সেই প্রতিকূল পরিবেশে তাঁরা ছিলেন নিশ্চুপ। এমনকি কেউ কেউ সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেননি।

গাফ্?ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে তাঁর শাসনামলের সমালোচনা করেছেন, পঁচাত্তরের মার্চে ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো’ শিরোনামে কলাম লিখে সমূহ বিপদের শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনার পর উপলব্ধি করেছেন, এই অভ্যুত্থান ব্যক্তি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও প্রাণসত্তার বিরুদ্ধে। ’৪৭ বছর ধরে গাফ্ফার চৌধুরী সেই অমোঘ সত্যই উচ্চারণ করে গেছেন তাঁর কলামে, বক্তৃতায়, নাটকে এবং অন্যবিধ রচনায়।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনন্য সৃষ্টি। তিনি যদি আর কিছু নাও লিখতেন, এই একটি গান তাঁকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখবে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,

‘আমরা আউটডোরের সামনে গিয়ে দেখি একটি লাশ পড়ে আছে। সাদা প্যান্ট পরা, সাদা শার্ট গায়ে, পায়ে জুতোও আছে, গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে গেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় লাশটি পড়ে আছে। সেই লাশটি দেখার জন্য শত শত লোক ভিড় জমিয়েছে। রফিকুল ইসলাম সম্ভবত তাঁর ছবি নিয়েছিলেন। পরে জানলাম যে এই লাশ হুবহু শহীদ রফিকউদ্দিনের। এই লাশটি দেখার সময়ে আমার মনে কবিতা লেখার জন্য একটি ভাবের উদয় হয়েছিল। ভাবটি এসেছিল কবিতা লেখার জন্য, গান রচনার জন্য নয়। আমি গান লিখতে জানি না, আমি সুরকারও নই, গীতিকারও নই, একটি কবিতা লেখার জন্য আমার মনে যে লাইনটি এসেছিল তা হলো: “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি?”’ (নেপথ্য কাহিনী: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি লুৎফর রহমান রিটন সম্পাদিত আগামী প্রকাশনী।)

গাফ্ফার চৌধুরী আরেকটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর। পাকিস্তানি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান ইতিহাসের বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়কে অগ্রাহ্য করে চীন সফরে গেলেন। চীন থেকে ফিরে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করলেও দক্ষিণাঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের পর ঘূর্ণিদুর্গত মানুষকে দেখতে গেলেন না।

গাফ্ফার চৌধুরী লিখলেনÑ

বাঁচতে চাইলেই বাঁচবে এমন কথা তো নেই

প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতে

আট লাখ শিশু, নারী ও পুরুষ আজকে নেই

মরে গেছে তারা এক রাতে।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটিতে শুধু শহীদের প্রতি শোকগাথা বা আহাজারি নয়। এই গানটিতে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াই-সংগ্রামের কথা আছে, আছে শত্রুর প্রতি প্রবল ঘৃণা প্রকাশ আর নিপীড়িত মানুষের ক্ষুদ্র শক্তিকে জাগানোর উদীপ্ত আহ্বান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এই গানের মাধ্যমে যেই সমাজ ও রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে হয় না।

এই গান কেবল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কিংবা এর সুরকার আলতাফ মাহমুদকেই অমর করেনি, বাঙালির চেতনাকেও করেছে তীক্ষè ও শাণিত। আমরা প্রতিবছর একুশের প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই। আসলে এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবতার চিরন্তন জাগৃতিই গান। এই গান অবিস্মরণীয়।

আলতাফ মাহমুদের জীবন ও সংগীত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সংস্কৃতিকর্মী দিনু বিল্লাহ লিখেছেন: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারিÑ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত কবিতায় কালাতীত ধ্রুপদী সুর সৃষ্টি করে বাঙালির রক্তঝরা ইতিহাসের সঙ্গে শহীদ আলতাফ মাহমুদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’

ওয়াহিদুল হক ও মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘আলতাফ মাহমুদ এক ঝড়ের পাখি’ গ্রন্থের মূল্যায়ন ছিল এরকম: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রথম শুনি, শিখি তা আমরা কজন। কেন ধরতে পারিনি আমাদের মধ্যে মানুষের মুক্তি নির্মাতা এক নব যিশু, যিশুরই মতো চূড়ান্ত হিউমিনিটি আত্মবিশেষের নিমগ্নতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গানটির আরম্ভ পশ্চিম দেশীয় সুরের ধরনে। কিন্তু ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ এবং ললিত নিসর্গ অংশগুলোতে ভারতবর্ষীয় রাগ-রাগিণী একাধারে প্রমত্ত নির্মেঘ ও কিশলয় কোমলতা নিয়ে বিপ্লবের মর্মবাণীকে মেলে ধরে কী আশ্চর্য অমোঘতায়! বাংলা যত দিন থাকবে এই ধরাপৃষ্ঠে, থাকবে আমার সোনার বাংলা, থাকবে বাংলার মাটি, বাংলার জল, আর থাকবে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।

৩.

১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। তিনি লন্ডন প্রবাসী ছিলেন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বরিশালে থাকাকালে তিনি বামপন্থী দল আরএসপি’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়।

১৯৫০ সালে ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফ্ফার চৌধুরী সেখানে সহসম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফ্ফার চৌধুরী। এসময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ’র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি ‘দৈনিক জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক জয়বাংলা’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায়ও লিখতেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন।

স্ত্রী অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপর তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। বিলেত যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন। প্রবাসে বসে গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিয়মিত লিখে গিয়েছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই: ডানপিটে শওকত (১৯৫৩), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), স¤্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭)।

তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থÑ বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭২)। আমরা বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালী (১৯৯৩), ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা, পলাশী থেকে ধানম-ি (২০০৭) তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা। তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্রীয় পদকই পেয়েছেন। এছাড়া পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৩)সহ আরো অসংখ্য পুরস্কার।

৮৮ বছর বয়সে গাফ্ফার চৌধুরী মারা গেছেন। একে পরিণত বয়সই বলতে হবে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও শিল্প-সাহিত্য জগতে তার মৃত্যুতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তিনি তার গানের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, তা বিস্মৃত হওয়ার নয়।

গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে সংবাদ-এর একটি আত্মিক সম্পর্ক ছিল। সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা পর্ব তিনি সংবাদ-এ সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পরে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পুনরায় সংবাদ-এ কলাম লেখা শুরু করেন। বছর দুই তার এই লেখা অব্যাহত ছিল। পরবর্তীকালে সংবাদ-এ না লিখলেও পত্রিকাটির প্রতি তার হার্দিক সম্পর্ক ছিল। মনে আছে, সেই সময়ে গাফ্ফার ভাই সংবাদ-এ একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, যাতে কেবল একুশের গান বা সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলেননি। বলেছিলেন ষাট ও পঞ্চাশের দশকে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামে তার ও সহযাত্রীদের ভূমিকার কথা। ঢাকায় কয়েকবার গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। হাসি মুখে তিনি সহকর্মীদের কুশল জানতে চেয়েছেন। কে কোথায় আছেন, খোঁজ নিয়েছেন।

ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা তার আত্মজীবনীমূলক বই। এই বইয়ে তিনি ঢাকায় তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও চমৎকারভাবে বলেছেন। আমাদের এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠায় মেঘনা ও কীর্তনখোলার পাড়ে, তারপরও কেন ধীরে বয়ে বুড়িহঙ্গা লিখেছেন। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, বুড়িগঙ্গাই গাফ্ফার চৌরীকে গাফ্ফার চৌধুরী বানিয়েছে। সেই বুড়িগঙ্গার তীরে তিনি আসবেন। কিন্তু নিষ্প্রাণ ও নিথর দেহে। গাফ্ফার ভাইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।