শামীম আজাদ
বিলেতে এলেই মানুষ যে কয়েকটা জিনিস দেখতে চায় তার মধ্যে বাকিংহাম প্যালেস বা উইন্ডসোর প্রাসাদ তার একটি। সামর্থ্য নিয়ে ভাবনা না থাকলে যায় হ্যারডেসও। ডায়না ও দোদীর প্রেম কাহিনীর জন্য এর মালিক দোদীর বাবা আল ফায়াদের এ বিশাল মেগাস্টোর একটা দর্শনীয় জায়গা হয়ে গেছে। আর মানুষ স্ট্রাটফোর্ড আপঅন এ্যাভনে দেখে আসে ৪০০ বছর আগে জন্ম নেয়া এদেশের অন্যতম কবি উইলিয়াম শেক্সপীয়র এর জন্মবাড়ি। কিন্তু ভ্রামণিক যদি বাংলাদেশী হন তাহলে দেখা করতে চান আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে। তিনিও এক দর্শনীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁকে দেখার ইচ্ছার সঙ্গে অনেকে তাঁর নাম উচ্চারণের পরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র এক লাইন গেয়েও দেন। এ যেন গাফ্ফার ভাইয়ের পদবী!
তিন দশক আগে আমিও তাঁকেই দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি উইকাম হাউসে বসতেন আর ‘পূর্বদেশ’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা চালাতে শুরু করেছেন। সে ছিলো ১৯৯০ সাল। ব্রিটিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিলেতের মূলধারার স্কুলগুলোয় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বিদেশ থেকে প্রায় আড়াইশ’ শিক্ষক নিয়োগ করেছিলো। বাংলাদেশ থেকে আমরা ন’জন এসেছিলাম কিন্তু বাদবাকি সবাই ছিলো ইউরোপ ও আমেরিকার। প্রথম বিশ্বের স্কুলে এই তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষকরা কি শেখাবে! আমরা পড়ে গেলাম বর্ণবাদী মিডিয়া সমালোচনার মুখে। রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্র সব জায়গায় আমাদের ন’জনের কথা। একে নতুন দেশ, তার উপর কারিকুলমের বিষয় ইংলিশ, বিজ্ঞান ও অংক- সবই পড়াতে হবে। ট্রেনিং চলবে, পাশাপাশি। এদিকে মিডিয়ার কামড়। এত নার্ভাস লাগছিলো! কার কাছে যাই, কোথায় গেলে একটু ভরসা পাই! তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও আমি তো চিনি। তিনি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানোর গাফ্ফার ভাই।
সেপ্টেম্বরের শীত ও সন্ধ্যা ভেদ করে স্কুল শেষে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটি কক্ষে স্তূপাকার কাগজ আর আর কাগজের মধ্যে বসে আছেন তিনি। উঁচু সিলিং থেকে বাতি জ্বলছে, এক সহকারীকে কাগজের বিলিব্যবস্থা নিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। আমাকে কে নিয়ে গেছিলেন আজ তা আর মনে নেই। তিনি আমার নামটি বলতেই গাফ্ফার ভাইর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। কিন্তু কথা শুনে অবাক।
- আরে জানি জানি। সব জায়গায় তোমাদের কথা। তোমরা হইলা আমাদের নবরতœ।
আমাদের দেশ থেকে তিনশ’জন থেকে বেছে মাত্র এই নয়জন!
- তো কোথায় উঠছো? একাই আসছো না পরিবার নিয়া?
এই সেই আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী? খাইছো গেছো টাইপের কথা বলেন! এতো সাধারণ! আর গলার স্বরও তো যেমন ভেবেছিলাম তেমন গুরুগম্ভীর না। বসার পর কণ্ঠ নামিয়ে বহু পরিচিত এক অতি আপনজনের মতো জিজ্ঞাসা করেন, শামীম চা খাইবা? আর আমি গলে গেলাম। বুঝলাম ঠিক মানুষের কাছে এসেছি।
বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির উদারপন্থী অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা তাঁকে পুরোহিতের সম্মান দিতেন। কথিত আছে শৈশবে মাদ্রাসায় গমনকারী তিনি এখানে জানাজাও পড়িয়েছেন। তাঁর পৌরহিত্য ছাড়া সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক উৎসব রূপহীন তাৎপর্যহীন হয়ে উঠতো। তিনি ছিলেন আশ্চর্য এক স্মৃতিধর ব্যক্তি। ভেবে অবাক হই, প্রতিনিয়তই তাঁর লেখা, কথা ও বক্তব্যে কী এক অভিনব
পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিগত সময়কে বর্তমানের মুখামুখি দাঁড় করিয়ে দিতেন! দীর্ঘদিন আয়ুপ্রাপ্ত মানুষ তার সজাগ সময়ের সার্বক্ষণিক ব্যবহার করে গেছেন এমন উদাহরণ কেবল আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীই। আমরা তাঁকে বলতাম ত্রিকালদর্শী। বৃটিশ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী আমলের নানান ব্যক্তি ও ঘটনার কথা লেখার মতোই অনায়াসে বলে আড্ডা জমিয়ে ফেলতেন।
সেই নব্বই সাল থেকে গাফ্ফার ভাইর সঙ্গে আমার হাঁটা শুরু। দেখেছি, তিনি বিলেতী ও দেশি বাঙালিদের কাছে কখনো আদৃত কখনো সমালোচিত হলেও তাঁকে পরিহার করার কোনো উপায় ছিলো না। তিনি ছিলেন আমাদের এক আশ্চর্য ও অত্যাবশ্যকীয় অনুপান। কোনো অনুষ্ঠানই শুরু হয়নি তিনি এসে না পড়া পর্যন্ত। আর অনুষ্ঠানের শেষ হতো না গাফ্ফার ভাইর সঙ্গে ব্রিকলেনে আহার ও আড্ডা না হওয়া অবধি। আর পুরো সময়টাকেই ভরে রাখতেন মিন্ট ফ্লেভারে ঐতিহাসিক নানান গালগল্পে। তাঁর টিমটিও অসাধারণ। লেখা, আবৃত্তি, অভিনয়, সাংবাদিকতার সঙ্গে এরা রাঁধা থেকে মঞ্চ বাঁধা, প্লেট বাসন ধোয়া থেকে পেটপুরে খাওয়া শেষে গাড়ি দিয়ে অভ্যাগতদের যার যার বাড়ি পৌঁছানোর কাজটি পযর্ন্ত করে তবে ছুটি।
সম্ভবত ১৯৯৬ সালের সামারের দীর্ঘ ও আলোকিত দিনের কথা। চল্লিশের দশকের দুই কবি আবুল হোসেন ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লন্ডনে বেড়াতে এসেছেন। আমি স্কুল ট্রিপে গিয়ে পায়ের গোড়ালী ভেঙে বেশ ভারি প্লাস্টার পরে খোড়া হয়ে আছি। আমাকে দেখতে এসে বললেন, তোমার মুখে তো আর প্লাস্টার নাই! তাঁদের কবিতা পাঠের পর বিলেতের কবিদের সঙ্গে কবিতা পড়বে আর তোমার বাসাতেই আয়োজন হবে। আমি তো হতবাক! বলেন কী? ঈশিতার সঙ্গে কথা হইছে। সে সব্জি করবে আর দিলু নাসের করবে কাজু বাদাম দিয়ে চিকেন বিরিয়ানী, আমি আনবো টিট বিটস, ডলি কেটে আনবে গাজর শশা। সেবার সত্যি আমাদের পার্থ রোডের বাড়িতে চঞ্চলের আনা মিষ্টান্ন সহযোগে দারুণ উপভোগ্য এক অনুষ্ঠান হলো। কিন্তু মিষ্টান্নলোভীও তা খেতে বারণ এই মানুষটির প্রতি নজর রাখতে হলো আগাগোড়া। আমরা জানতাম শেলী ভাবীর চোখ এড়িয়ে প্রায় শিশুর মতোই কী করে টুপ করে মুখে মিষ্টি পুরে নেন।
ফোন করলে গাফ্ফার ভাই বাসায় না থাকলে ভাবী ফোন ধরতেন। আমার কণ্ঠ শুনেই হ্যালো করার আগেই বলতেন, আপনার গাফ্ফার ভাই তো বাসায় নেই ভাই। আমি বলতাম, জানি তো, আপনার জন্যই করেছি। সত্যি তাই করতাম। হুইলচেয়ার বাসিনী শেলী ভাবী নাতি জ্যাকবের গল্প করতেন, কথায় কথায় খনার বচন বলতেন, ?বাপের বাড়ির কাহিনী বলতেন। একসময় কি মনে করে তার নোটও রাখছিলাম! তাঁর হাতের অপূর্ব ট্রাউট মাছ রান্না খেয়ে আসার পর প্রায়ই ফোনে আমরা রান্নার গল্প করতাম। ১৯৭৪ সালে এদেশে এলে গাফ্ফার ভাই পূর্ব লন্ডনের তাজ স্টোরে টিলে কাজ করেছেন। বিলেতের বাঙালিদের অধিকাংশ মানুষ সিলেটি বলে সেখান থেকে হাতকড়া কারি খেতে শিখেছিলেন। এর যাদুকরী সুগন্ধের কারণে ভাবী তা শুধু কষা মাংস না- প্রায় সব কিছুতেই দিতেন। এমন কি মাঝে মাঝে ডালেও দু’এক ফালি ফেলে দিতেন। ভাবী পছন্দ করতেন ডালের বড়ি। আমি তা পূর্ব লন্ডনের ভারতীয় দোকান থেকে কিনে একবার ডাকে পাঠিয়ে দিলে তিনি তা রান্নার যা বিবরণ দিয়েছিলেন যে আমার মুখে জল এসে গিয়েছিলো!
গাফ্ফার ভাই সবার সঙ্গেই ফোনে কথা বলতেন। ফোন না পেলে নিজেই করতেন। এই কয়েক দিন আগে পর্যন্তও। আগে আমি টেলিফোনে না হলে তাঁর প্রকাশিত লেখায় ঠিক জেনে যেতাম তিনি কি নিয়ে কাকে নিয়ে ব্যস্ত এখন। কোন রাজনৈতিক ঘটনা তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে বা কাকে তিনি নিজেই ক্ষুব্ধ করে তুলছেন। নিজেই বিস্মিত হতেন কী করে একজন সাহিত্যিক থেকে একজন রাজনৈতিক কলামিস্ট হয়ে গেলেন।
কিন্তু সাহিত্য বা সৃষ্টিশীলতার স্পৃহা ও তার উদ্যম মরেনি কখনো। একটা শেষ হতেই ফোন করে বলতেন আরেকটির পরিকল্পনা। একবার তাঁর নাটক “পলাশী থেকে ধানমন্ডি”করে ফিরেছেন। আমি সে গল্প শোনার জন্য ফোন করতেই বললেন, ভালোই হইছে। শোনো শামীম একটা কবিতা পত্রিকা বার করতে চাই। পৃথিবীর তিন শহর ঢাকা, কলকাতা ও লন্ডন থাইকা তিন সম্পাদক কাজ করবেন। সুনীলের সঙ্গে কথা হইছে। তুমি হবে লন্ডনের। ভাবছি ঢাকায় কারে দেয়া যায়! এরকম শত উদযোগের ভাবনা তাঁর মাথায় প্রতিনিয়ত আসতো এবং আমাদের নিয়েই তা বাস্তব করে তুলেছেনও। প্রচুর কৃতী শিল্পী সাহিত্যিক গাফ্ফার ভাইর বন্ধু ছিলেন। তিনি কখনো একা হাঁটেননি।
আমার মনে হতো তিনি এরকম সাহিত্য সংগঠকও হতে চান নি। হতে চেয়েছিলেন কবি কিংবা গল্পকার অথবা নাট্যকার। বলতেন, আমি সাংবাদিক-কলামিস্ট হয়ে গেলাম পেটের দায়ে। যদি আজকের এই হুমায়ুন, মিলন- এদের মতো আমার তুঙ্গ সময়ে গল্প উপন্যাস লিখে আয় করতে পারতাম আমি তাহলে হয়তো শুধু সাহিত্যিকই হতাম!
কিন্তু আমার তা মনে হয় না। সেই অমোঘ গানের লিরিকের মাধ্যমে তাঁর মনে যে বিপ্লবী চেতনার বীজ বপন করেছিলো, মাত্র উনিশ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলন তাঁর মানস জগতকে কর্ষণ করে- তা থেকে নিষ্কৃতি এতো সহজ ছিলো না। তাই নিয়েই তিনি কাটিয়ে দিলেন প্রায় অর্ধেক শতাব্দী। তিনি ছিলেন এক ফুলটাইম লেখক। হেনো বিষয় নেই যে তিনি লিখেছেন। মনে হতো, একটা কুটো ধরিয়ে দিলে সেটিকে তিনি বাঁশ করে ফেলতে পারেন। ইতিহাসের এক বিন্দু পেলে তা দিয়ে সিন্ধু এনে দিতে পারেন। আর সুবাসের সূত্র পেলে মৃগনাভির মায়া ছড়িয়ে দিতে জানেন- এমনই তাঁর কলাম। যখন সুস্থ ছিলেন, প্রতিদিন সকালে তিন ঘণ্টা ধরে লিখতেন। এর মধ্যে চিঠি, কবিতা, নাটক ও কলাম সবই হতো।
বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াশীল অংশেরও তাঁকে ছাড়া চলতো না। তিনি তাদের ছদ্ম অনুরাগ ঠিকই লক্ষ্য করতেন এবং সুযোগের অন্যথা করতেন না। চোখের দিকে তাকিয়ে সব বলে দিতেন। সীমাহীন ধৈর্য্য ছিলো তার। তারা তাকে ভয় করতো। কারণ তিনি কখনো আপোস করেননি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত অভিধান, এক কিংবদন্তি পুরুষ। প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল বাংলাদেশের দেহের বাইরে থাকার পরও দেশের অন্তরটুকু বুকে করেই বেঁচেছিলেন। দেশের অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ বিষয় থেকে বড় বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে সমান মনোযোগে নিজের মতবাদ ও ভিন্নমত ঘোষণা করতে কখনো পিছ পা হননি।
তাঁর মৃত্যুতে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটি হারালো তাঁদের বাতিঘর ও অভিভাবককে। সকলের মতো এভাবেই আমার অতি কাছের মানুষ প্রিয় গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে বলতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছে, এই বিয়োগ ব্যথার মধ্যেও একটা অপরিমেয় প্রাপ্তির কথাও বার বার হৃদয়ে বাজছে। এবং তাঁকে যে আমরা এত দীর্ঘ সময় ধরে পাওয়ার চাইতেও বেশি করে পেয়েছিলাম, সেটাও এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর গাফ্ফার ভাইই একমাত্র মানুষ যিনি সুদীর্ঘ ও সম্পূর্ণ জীবন যাপনের পুরোটাই কর্মমুখর ছিলেন। বলা যায়, তাঁর উপস্থিতি আমাদের জাতীয়, সামাজিক ও বিশেষ করে আমার মতো অনেকের ব্যক্তিজীবনের এতটাই ছিলো যে এই বিয়োগ ব্যথার মধ্যেও সে অপরিমেয় প্রাপ্তির কথাও বার বার মনে হচছে। বিশ্বের নানান দেশে ছড়িয়ে থাকা নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতগণের কাজের চেয়ে সদ্য প্রয়াত আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের জন্য কোনো কম করেননি। বরং বেশিই করেছেন।
এদেশে থেকেও বহুদূর বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর এই সম্পৃক্ততাকে টাওয়ার হ্যাম্লেটস অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখেছে বলেই পিটার শোর ও মিলরেড গর্ডনের মতো প্রভাবশালী এবং সমাজপ্রেমী এমপির সঙ্গেই প্রবাস পিতা তসাদ্দুক আহমদ ও গাফ্ফার ভাইকে ব্রিটিশ সরকার প্রদান করে ‘ফ্রিডম অব দ্য বারা’ উপাধি। ব্রিটিশ স¤্রাজ্যে বাংলাদেশীদের এমন প্রাপ্তি শুনিনি। এ অনেকটা নগরীর চাবি প্রদান করার মতো, পুরো বারাতে তার অবারিত যাতায়াতের মতো।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সাত দশকের বেশি সময় ধরে তিনি যেনো দুই হাতে লিখে গেছেন। তাঁর এই লেখালেখির বেশিরভাগই ছিল রাজনৈতিক ভাষ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি যেটির জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হলো একেবারে তরুণ বয়সে ঢাকা কলেজে মাত্র উনিশ বছর বয়সে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে লেখা তাঁর সেই দীর্ঘ ও সর্বগ্রাহ্য কবিতাখানা। যে কবিতাকে বাংলাদেশের এক কীর্তিমান সুরকার আব্দুল লতিফ তাৎক্ষণিকভাবে সুর দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিলেন। আর পরে তা পূনরায় বর্তমান বহুশ্রুত সুরে পরিচিতি দেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে যে সর্বকালের সেরা বাংলা গান বলে যে ২০টি গানকে নির্বাচিত করেছিলো, তার তিন নম্বরে ছিল এটি। ১৯৫২ সাল থেকে দেশে বিদেশে ঘরে ঘরে একুশের প্রথম প্রভাতে তা গীত হতে থাকে এক অপ্রতিরোধ্য বাণী হিসেবে, এক গভীর আত্মপ্রত্যয়ে, এক অমোঘ শক্তির আকর হিসেবে। যেন তা একটি জাতির জেগে ওঠার সোনার কাঠি-রূপার কাঠি এবং এ গান পরিণত হয়েছে জাতীয় সঙ্গীতের পর বহুল গীত গান।
তবে এটিই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিৎ নয়, এই বহুমুখী মানুষটিকে মনে রাখার বহুবিধ কারণ আছে। আমার কাছে যেটা উল্লেখযোগ্য মনে হয়, তা হলো প্রায় অর্ধ শতাব্দী সময় ধরে দেশের বাইরে থেকেও বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, দুর্নীতি, বাংলাদেশের সব ধরনের উত্থান-পতনকে নিয়ে তাঁর সমালোচনা, আলোচনা এবং নির্ভীক পরামর্শ দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা। লোকে তাকে কী বলবে, বা তিনি যা বলছেন তা কি তার মনগড়া ব্যাখা? এসব নিয়ে তিনি ভাবেননি। ভাবেন একবারও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে লিখতে, “প্রধানমন্ত্রী এখন রাজাকার পরিবেষ্ঠিত।” বলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিপন্থী কর্মকা- দমাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
মাতৃভূমি থেকে থেকে বহু দূরের দেশে বাস করেও বাংলাদেশটাকে তিনি দেখতে পেতেন আদ্যোপান্ত। বাংলাদেশে বসবাস করেও লেখক-সাংবাদিকরা রাজনৈতিক ঘনঘটার বহু জরুরি অনুষঙ্গ কিংবা টার্নিং পয়েন্টকে মিস করলেও তাঁর অনুসন্ধানী চোখে সব কিছুই ধরা পড়তো। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাংলাদেশবিরোধীদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন কলমসৈনিক। এখানে বিলেতে গণজাগরণ মঞ্চের পাশে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে এবং বিজয়ফুল কার্যক্রমে তিনি দিতেন শক্তি সাহস ও প্রেরণা। আপনি ছিলেন ইউরোপে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের শক্তি ও আশার প্রদীপ।
স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদকও ছিলেন তিনি। সেইসাথে রেখে গেছেন তাঁর অমূল্য কলামগুলো। যেখানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের লালসবুজ পতাকা অম্লান হয়ে আছে। তিনি সেখানেই চির জাগ্রত থাকবেন। তাঁকে প্রতিমুহূর্তে চেতনায় লালন করে যাবে আগামীর বাংলাদেশ।
বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ আপনাকে ভুলবে না প্রিয় গাফ্ফার ভাই। তিন দশকের কতো স্মৃতি আপনার সঙ্গে! সেইসব স্মৃতি চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে উপস্থিত হচ্ছে বারবার। বিশেষ করে যখন আর কোনো ওষুধ আপনার জন্য অবশিষ্ট নেই। কোনো চিকিৎসাও বাকি নেই তখনো লিখে যাচ্ছেন। ফোন ধরছেন এবং তখনো নিরাশার কথা আপনার ঠোঁট থেকে অনবধানেও বেরিয়ে আসছে না।
আপনার সাথে আমার, আমার সন্তান ও আমার প্রয়াত স্বামী আবুল কালাম আজাদের স্মৃতির শেষ নেই। আপনার সাথে আমাদের বাসায় আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথা, দেশ নিয়ে আশানিরাশা ও সম্ভবনার গল্পকথাও আপনাকে ঘিরে চা’য়ের শূন্য কাপের স্তূপ, গাজরের প্লেট সব মনে পড়ছে। আসলে আপনি থাকলে আসরে বা ঘরে আর কারো প্রতি নজর যেতো না।
লন্ডনে থাকি বলে মনে হতো কাছেই তো আছেন। দেশ নিয়ে রাগে, দুঃখে, আনন্দে, অর্জনে ফোনটা নিয়ে দীর্ঘ কথা বলেছি। আপনার চলে যাওয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে আর তো পাবো না তারে। শুধু আমি নই আমার প্রিয় মাতৃভূমির এক নির্ভীক সেনিক আজ কত দূর চলে গেলেন !!
আহ গাফ্ফার ভাই, আপনার বিকল্প শুধু আপনিই। শান্তিময় হোক আপনার এই অনন্তযাত্রা।
পরম শান্তিতে থাকুন অমৃতলোকে।
বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৪ শাওয়াল ১৪৪৩
শামীম আজাদ
বিলেতে এলেই মানুষ যে কয়েকটা জিনিস দেখতে চায় তার মধ্যে বাকিংহাম প্যালেস বা উইন্ডসোর প্রাসাদ তার একটি। সামর্থ্য নিয়ে ভাবনা না থাকলে যায় হ্যারডেসও। ডায়না ও দোদীর প্রেম কাহিনীর জন্য এর মালিক দোদীর বাবা আল ফায়াদের এ বিশাল মেগাস্টোর একটা দর্শনীয় জায়গা হয়ে গেছে। আর মানুষ স্ট্রাটফোর্ড আপঅন এ্যাভনে দেখে আসে ৪০০ বছর আগে জন্ম নেয়া এদেশের অন্যতম কবি উইলিয়াম শেক্সপীয়র এর জন্মবাড়ি। কিন্তু ভ্রামণিক যদি বাংলাদেশী হন তাহলে দেখা করতে চান আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে। তিনিও এক দর্শনীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁকে দেখার ইচ্ছার সঙ্গে অনেকে তাঁর নাম উচ্চারণের পরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র এক লাইন গেয়েও দেন। এ যেন গাফ্ফার ভাইয়ের পদবী!
তিন দশক আগে আমিও তাঁকেই দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি উইকাম হাউসে বসতেন আর ‘পূর্বদেশ’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা চালাতে শুরু করেছেন। সে ছিলো ১৯৯০ সাল। ব্রিটিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিলেতের মূলধারার স্কুলগুলোয় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বিদেশ থেকে প্রায় আড়াইশ’ শিক্ষক নিয়োগ করেছিলো। বাংলাদেশ থেকে আমরা ন’জন এসেছিলাম কিন্তু বাদবাকি সবাই ছিলো ইউরোপ ও আমেরিকার। প্রথম বিশ্বের স্কুলে এই তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষকরা কি শেখাবে! আমরা পড়ে গেলাম বর্ণবাদী মিডিয়া সমালোচনার মুখে। রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্র সব জায়গায় আমাদের ন’জনের কথা। একে নতুন দেশ, তার উপর কারিকুলমের বিষয় ইংলিশ, বিজ্ঞান ও অংক- সবই পড়াতে হবে। ট্রেনিং চলবে, পাশাপাশি। এদিকে মিডিয়ার কামড়। এত নার্ভাস লাগছিলো! কার কাছে যাই, কোথায় গেলে একটু ভরসা পাই! তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও আমি তো চিনি। তিনি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানোর গাফ্ফার ভাই।
সেপ্টেম্বরের শীত ও সন্ধ্যা ভেদ করে স্কুল শেষে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটি কক্ষে স্তূপাকার কাগজ আর আর কাগজের মধ্যে বসে আছেন তিনি। উঁচু সিলিং থেকে বাতি জ্বলছে, এক সহকারীকে কাগজের বিলিব্যবস্থা নিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। আমাকে কে নিয়ে গেছিলেন আজ তা আর মনে নেই। তিনি আমার নামটি বলতেই গাফ্ফার ভাইর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। কিন্তু কথা শুনে অবাক।
- আরে জানি জানি। সব জায়গায় তোমাদের কথা। তোমরা হইলা আমাদের নবরতœ।
আমাদের দেশ থেকে তিনশ’জন থেকে বেছে মাত্র এই নয়জন!
- তো কোথায় উঠছো? একাই আসছো না পরিবার নিয়া?
এই সেই আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী? খাইছো গেছো টাইপের কথা বলেন! এতো সাধারণ! আর গলার স্বরও তো যেমন ভেবেছিলাম তেমন গুরুগম্ভীর না। বসার পর কণ্ঠ নামিয়ে বহু পরিচিত এক অতি আপনজনের মতো জিজ্ঞাসা করেন, শামীম চা খাইবা? আর আমি গলে গেলাম। বুঝলাম ঠিক মানুষের কাছে এসেছি।
বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির উদারপন্থী অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা তাঁকে পুরোহিতের সম্মান দিতেন। কথিত আছে শৈশবে মাদ্রাসায় গমনকারী তিনি এখানে জানাজাও পড়িয়েছেন। তাঁর পৌরহিত্য ছাড়া সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক উৎসব রূপহীন তাৎপর্যহীন হয়ে উঠতো। তিনি ছিলেন আশ্চর্য এক স্মৃতিধর ব্যক্তি। ভেবে অবাক হই, প্রতিনিয়তই তাঁর লেখা, কথা ও বক্তব্যে কী এক অভিনব
পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিগত সময়কে বর্তমানের মুখামুখি দাঁড় করিয়ে দিতেন! দীর্ঘদিন আয়ুপ্রাপ্ত মানুষ তার সজাগ সময়ের সার্বক্ষণিক ব্যবহার করে গেছেন এমন উদাহরণ কেবল আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীই। আমরা তাঁকে বলতাম ত্রিকালদর্শী। বৃটিশ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী আমলের নানান ব্যক্তি ও ঘটনার কথা লেখার মতোই অনায়াসে বলে আড্ডা জমিয়ে ফেলতেন।
সেই নব্বই সাল থেকে গাফ্ফার ভাইর সঙ্গে আমার হাঁটা শুরু। দেখেছি, তিনি বিলেতী ও দেশি বাঙালিদের কাছে কখনো আদৃত কখনো সমালোচিত হলেও তাঁকে পরিহার করার কোনো উপায় ছিলো না। তিনি ছিলেন আমাদের এক আশ্চর্য ও অত্যাবশ্যকীয় অনুপান। কোনো অনুষ্ঠানই শুরু হয়নি তিনি এসে না পড়া পর্যন্ত। আর অনুষ্ঠানের শেষ হতো না গাফ্ফার ভাইর সঙ্গে ব্রিকলেনে আহার ও আড্ডা না হওয়া অবধি। আর পুরো সময়টাকেই ভরে রাখতেন মিন্ট ফ্লেভারে ঐতিহাসিক নানান গালগল্পে। তাঁর টিমটিও অসাধারণ। লেখা, আবৃত্তি, অভিনয়, সাংবাদিকতার সঙ্গে এরা রাঁধা থেকে মঞ্চ বাঁধা, প্লেট বাসন ধোয়া থেকে পেটপুরে খাওয়া শেষে গাড়ি দিয়ে অভ্যাগতদের যার যার বাড়ি পৌঁছানোর কাজটি পযর্ন্ত করে তবে ছুটি।
সম্ভবত ১৯৯৬ সালের সামারের দীর্ঘ ও আলোকিত দিনের কথা। চল্লিশের দশকের দুই কবি আবুল হোসেন ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লন্ডনে বেড়াতে এসেছেন। আমি স্কুল ট্রিপে গিয়ে পায়ের গোড়ালী ভেঙে বেশ ভারি প্লাস্টার পরে খোড়া হয়ে আছি। আমাকে দেখতে এসে বললেন, তোমার মুখে তো আর প্লাস্টার নাই! তাঁদের কবিতা পাঠের পর বিলেতের কবিদের সঙ্গে কবিতা পড়বে আর তোমার বাসাতেই আয়োজন হবে। আমি তো হতবাক! বলেন কী? ঈশিতার সঙ্গে কথা হইছে। সে সব্জি করবে আর দিলু নাসের করবে কাজু বাদাম দিয়ে চিকেন বিরিয়ানী, আমি আনবো টিট বিটস, ডলি কেটে আনবে গাজর শশা। সেবার সত্যি আমাদের পার্থ রোডের বাড়িতে চঞ্চলের আনা মিষ্টান্ন সহযোগে দারুণ উপভোগ্য এক অনুষ্ঠান হলো। কিন্তু মিষ্টান্নলোভীও তা খেতে বারণ এই মানুষটির প্রতি নজর রাখতে হলো আগাগোড়া। আমরা জানতাম শেলী ভাবীর চোখ এড়িয়ে প্রায় শিশুর মতোই কী করে টুপ করে মুখে মিষ্টি পুরে নেন।
ফোন করলে গাফ্ফার ভাই বাসায় না থাকলে ভাবী ফোন ধরতেন। আমার কণ্ঠ শুনেই হ্যালো করার আগেই বলতেন, আপনার গাফ্ফার ভাই তো বাসায় নেই ভাই। আমি বলতাম, জানি তো, আপনার জন্যই করেছি। সত্যি তাই করতাম। হুইলচেয়ার বাসিনী শেলী ভাবী নাতি জ্যাকবের গল্প করতেন, কথায় কথায় খনার বচন বলতেন, ?বাপের বাড়ির কাহিনী বলতেন। একসময় কি মনে করে তার নোটও রাখছিলাম! তাঁর হাতের অপূর্ব ট্রাউট মাছ রান্না খেয়ে আসার পর প্রায়ই ফোনে আমরা রান্নার গল্প করতাম। ১৯৭৪ সালে এদেশে এলে গাফ্ফার ভাই পূর্ব লন্ডনের তাজ স্টোরে টিলে কাজ করেছেন। বিলেতের বাঙালিদের অধিকাংশ মানুষ সিলেটি বলে সেখান থেকে হাতকড়া কারি খেতে শিখেছিলেন। এর যাদুকরী সুগন্ধের কারণে ভাবী তা শুধু কষা মাংস না- প্রায় সব কিছুতেই দিতেন। এমন কি মাঝে মাঝে ডালেও দু’এক ফালি ফেলে দিতেন। ভাবী পছন্দ করতেন ডালের বড়ি। আমি তা পূর্ব লন্ডনের ভারতীয় দোকান থেকে কিনে একবার ডাকে পাঠিয়ে দিলে তিনি তা রান্নার যা বিবরণ দিয়েছিলেন যে আমার মুখে জল এসে গিয়েছিলো!
গাফ্ফার ভাই সবার সঙ্গেই ফোনে কথা বলতেন। ফোন না পেলে নিজেই করতেন। এই কয়েক দিন আগে পর্যন্তও। আগে আমি টেলিফোনে না হলে তাঁর প্রকাশিত লেখায় ঠিক জেনে যেতাম তিনি কি নিয়ে কাকে নিয়ে ব্যস্ত এখন। কোন রাজনৈতিক ঘটনা তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে বা কাকে তিনি নিজেই ক্ষুব্ধ করে তুলছেন। নিজেই বিস্মিত হতেন কী করে একজন সাহিত্যিক থেকে একজন রাজনৈতিক কলামিস্ট হয়ে গেলেন।
কিন্তু সাহিত্য বা সৃষ্টিশীলতার স্পৃহা ও তার উদ্যম মরেনি কখনো। একটা শেষ হতেই ফোন করে বলতেন আরেকটির পরিকল্পনা। একবার তাঁর নাটক “পলাশী থেকে ধানমন্ডি”করে ফিরেছেন। আমি সে গল্প শোনার জন্য ফোন করতেই বললেন, ভালোই হইছে। শোনো শামীম একটা কবিতা পত্রিকা বার করতে চাই। পৃথিবীর তিন শহর ঢাকা, কলকাতা ও লন্ডন থাইকা তিন সম্পাদক কাজ করবেন। সুনীলের সঙ্গে কথা হইছে। তুমি হবে লন্ডনের। ভাবছি ঢাকায় কারে দেয়া যায়! এরকম শত উদযোগের ভাবনা তাঁর মাথায় প্রতিনিয়ত আসতো এবং আমাদের নিয়েই তা বাস্তব করে তুলেছেনও। প্রচুর কৃতী শিল্পী সাহিত্যিক গাফ্ফার ভাইর বন্ধু ছিলেন। তিনি কখনো একা হাঁটেননি।
আমার মনে হতো তিনি এরকম সাহিত্য সংগঠকও হতে চান নি। হতে চেয়েছিলেন কবি কিংবা গল্পকার অথবা নাট্যকার। বলতেন, আমি সাংবাদিক-কলামিস্ট হয়ে গেলাম পেটের দায়ে। যদি আজকের এই হুমায়ুন, মিলন- এদের মতো আমার তুঙ্গ সময়ে গল্প উপন্যাস লিখে আয় করতে পারতাম আমি তাহলে হয়তো শুধু সাহিত্যিকই হতাম!
কিন্তু আমার তা মনে হয় না। সেই অমোঘ গানের লিরিকের মাধ্যমে তাঁর মনে যে বিপ্লবী চেতনার বীজ বপন করেছিলো, মাত্র উনিশ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলন তাঁর মানস জগতকে কর্ষণ করে- তা থেকে নিষ্কৃতি এতো সহজ ছিলো না। তাই নিয়েই তিনি কাটিয়ে দিলেন প্রায় অর্ধেক শতাব্দী। তিনি ছিলেন এক ফুলটাইম লেখক। হেনো বিষয় নেই যে তিনি লিখেছেন। মনে হতো, একটা কুটো ধরিয়ে দিলে সেটিকে তিনি বাঁশ করে ফেলতে পারেন। ইতিহাসের এক বিন্দু পেলে তা দিয়ে সিন্ধু এনে দিতে পারেন। আর সুবাসের সূত্র পেলে মৃগনাভির মায়া ছড়িয়ে দিতে জানেন- এমনই তাঁর কলাম। যখন সুস্থ ছিলেন, প্রতিদিন সকালে তিন ঘণ্টা ধরে লিখতেন। এর মধ্যে চিঠি, কবিতা, নাটক ও কলাম সবই হতো।
বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াশীল অংশেরও তাঁকে ছাড়া চলতো না। তিনি তাদের ছদ্ম অনুরাগ ঠিকই লক্ষ্য করতেন এবং সুযোগের অন্যথা করতেন না। চোখের দিকে তাকিয়ে সব বলে দিতেন। সীমাহীন ধৈর্য্য ছিলো তার। তারা তাকে ভয় করতো। কারণ তিনি কখনো আপোস করেননি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত অভিধান, এক কিংবদন্তি পুরুষ। প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল বাংলাদেশের দেহের বাইরে থাকার পরও দেশের অন্তরটুকু বুকে করেই বেঁচেছিলেন। দেশের অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ বিষয় থেকে বড় বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে সমান মনোযোগে নিজের মতবাদ ও ভিন্নমত ঘোষণা করতে কখনো পিছ পা হননি।
তাঁর মৃত্যুতে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটি হারালো তাঁদের বাতিঘর ও অভিভাবককে। সকলের মতো এভাবেই আমার অতি কাছের মানুষ প্রিয় গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে বলতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছে, এই বিয়োগ ব্যথার মধ্যেও একটা অপরিমেয় প্রাপ্তির কথাও বার বার হৃদয়ে বাজছে। এবং তাঁকে যে আমরা এত দীর্ঘ সময় ধরে পাওয়ার চাইতেও বেশি করে পেয়েছিলাম, সেটাও এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর গাফ্ফার ভাইই একমাত্র মানুষ যিনি সুদীর্ঘ ও সম্পূর্ণ জীবন যাপনের পুরোটাই কর্মমুখর ছিলেন। বলা যায়, তাঁর উপস্থিতি আমাদের জাতীয়, সামাজিক ও বিশেষ করে আমার মতো অনেকের ব্যক্তিজীবনের এতটাই ছিলো যে এই বিয়োগ ব্যথার মধ্যেও সে অপরিমেয় প্রাপ্তির কথাও বার বার মনে হচছে। বিশ্বের নানান দেশে ছড়িয়ে থাকা নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতগণের কাজের চেয়ে সদ্য প্রয়াত আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের জন্য কোনো কম করেননি। বরং বেশিই করেছেন।
এদেশে থেকেও বহুদূর বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর এই সম্পৃক্ততাকে টাওয়ার হ্যাম্লেটস অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখেছে বলেই পিটার শোর ও মিলরেড গর্ডনের মতো প্রভাবশালী এবং সমাজপ্রেমী এমপির সঙ্গেই প্রবাস পিতা তসাদ্দুক আহমদ ও গাফ্ফার ভাইকে ব্রিটিশ সরকার প্রদান করে ‘ফ্রিডম অব দ্য বারা’ উপাধি। ব্রিটিশ স¤্রাজ্যে বাংলাদেশীদের এমন প্রাপ্তি শুনিনি। এ অনেকটা নগরীর চাবি প্রদান করার মতো, পুরো বারাতে তার অবারিত যাতায়াতের মতো।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সাত দশকের বেশি সময় ধরে তিনি যেনো দুই হাতে লিখে গেছেন। তাঁর এই লেখালেখির বেশিরভাগই ছিল রাজনৈতিক ভাষ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি যেটির জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হলো একেবারে তরুণ বয়সে ঢাকা কলেজে মাত্র উনিশ বছর বয়সে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে লেখা তাঁর সেই দীর্ঘ ও সর্বগ্রাহ্য কবিতাখানা। যে কবিতাকে বাংলাদেশের এক কীর্তিমান সুরকার আব্দুল লতিফ তাৎক্ষণিকভাবে সুর দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিলেন। আর পরে তা পূনরায় বর্তমান বহুশ্রুত সুরে পরিচিতি দেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে যে সর্বকালের সেরা বাংলা গান বলে যে ২০টি গানকে নির্বাচিত করেছিলো, তার তিন নম্বরে ছিল এটি। ১৯৫২ সাল থেকে দেশে বিদেশে ঘরে ঘরে একুশের প্রথম প্রভাতে তা গীত হতে থাকে এক অপ্রতিরোধ্য বাণী হিসেবে, এক গভীর আত্মপ্রত্যয়ে, এক অমোঘ শক্তির আকর হিসেবে। যেন তা একটি জাতির জেগে ওঠার সোনার কাঠি-রূপার কাঠি এবং এ গান পরিণত হয়েছে জাতীয় সঙ্গীতের পর বহুল গীত গান।
তবে এটিই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিৎ নয়, এই বহুমুখী মানুষটিকে মনে রাখার বহুবিধ কারণ আছে। আমার কাছে যেটা উল্লেখযোগ্য মনে হয়, তা হলো প্রায় অর্ধ শতাব্দী সময় ধরে দেশের বাইরে থেকেও বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, দুর্নীতি, বাংলাদেশের সব ধরনের উত্থান-পতনকে নিয়ে তাঁর সমালোচনা, আলোচনা এবং নির্ভীক পরামর্শ দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা। লোকে তাকে কী বলবে, বা তিনি যা বলছেন তা কি তার মনগড়া ব্যাখা? এসব নিয়ে তিনি ভাবেননি। ভাবেন একবারও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে লিখতে, “প্রধানমন্ত্রী এখন রাজাকার পরিবেষ্ঠিত।” বলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিপন্থী কর্মকা- দমাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
মাতৃভূমি থেকে থেকে বহু দূরের দেশে বাস করেও বাংলাদেশটাকে তিনি দেখতে পেতেন আদ্যোপান্ত। বাংলাদেশে বসবাস করেও লেখক-সাংবাদিকরা রাজনৈতিক ঘনঘটার বহু জরুরি অনুষঙ্গ কিংবা টার্নিং পয়েন্টকে মিস করলেও তাঁর অনুসন্ধানী চোখে সব কিছুই ধরা পড়তো। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাংলাদেশবিরোধীদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন কলমসৈনিক। এখানে বিলেতে গণজাগরণ মঞ্চের পাশে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে এবং বিজয়ফুল কার্যক্রমে তিনি দিতেন শক্তি সাহস ও প্রেরণা। আপনি ছিলেন ইউরোপে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের শক্তি ও আশার প্রদীপ।
স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদকও ছিলেন তিনি। সেইসাথে রেখে গেছেন তাঁর অমূল্য কলামগুলো। যেখানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের লালসবুজ পতাকা অম্লান হয়ে আছে। তিনি সেখানেই চির জাগ্রত থাকবেন। তাঁকে প্রতিমুহূর্তে চেতনায় লালন করে যাবে আগামীর বাংলাদেশ।
বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ আপনাকে ভুলবে না প্রিয় গাফ্ফার ভাই। তিন দশকের কতো স্মৃতি আপনার সঙ্গে! সেইসব স্মৃতি চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে উপস্থিত হচ্ছে বারবার। বিশেষ করে যখন আর কোনো ওষুধ আপনার জন্য অবশিষ্ট নেই। কোনো চিকিৎসাও বাকি নেই তখনো লিখে যাচ্ছেন। ফোন ধরছেন এবং তখনো নিরাশার কথা আপনার ঠোঁট থেকে অনবধানেও বেরিয়ে আসছে না।
আপনার সাথে আমার, আমার সন্তান ও আমার প্রয়াত স্বামী আবুল কালাম আজাদের স্মৃতির শেষ নেই। আপনার সাথে আমাদের বাসায় আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথা, দেশ নিয়ে আশানিরাশা ও সম্ভবনার গল্পকথাও আপনাকে ঘিরে চা’য়ের শূন্য কাপের স্তূপ, গাজরের প্লেট সব মনে পড়ছে। আসলে আপনি থাকলে আসরে বা ঘরে আর কারো প্রতি নজর যেতো না।
লন্ডনে থাকি বলে মনে হতো কাছেই তো আছেন। দেশ নিয়ে রাগে, দুঃখে, আনন্দে, অর্জনে ফোনটা নিয়ে দীর্ঘ কথা বলেছি। আপনার চলে যাওয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে আর তো পাবো না তারে। শুধু আমি নই আমার প্রিয় মাতৃভূমির এক নির্ভীক সেনিক আজ কত দূর চলে গেলেন !!
আহ গাফ্ফার ভাই, আপনার বিকল্প শুধু আপনিই। শান্তিময় হোক আপনার এই অনন্তযাত্রা।
পরম শান্তিতে থাকুন অমৃতলোকে।