প্রসঙ্গ নজরুল : সৃজনে-মননে নারী

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

নারী পৃথিবীর বিপুলা এক শক্তির নাম, নারী পৃথিবীর অতুলনীয় সৌন্দর্যের নাম। নারী পৃথিবীর মমতার আধার, আবার নারী সকল জটিলতারও উৎস। নারী পৃথিবীর কল্যাণী, নারী পৃথিবীর জননীও। মা থেকে শুরু করে বোন, কন্যা, বন্ধু, প্রেমিকা, ঘরণি, কর্ত্রী, শিক্ষিকা, সেবিকা ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় নারীই পুরুষকে জন্ম দেয়, লালন-পালন করে, বিকশিত করে, প্রশমিত করে, পুলকিত করে। কাজেই পুরুষের জন্যে নারী অপরিহার্য এক আশীর্বাদ। বাংলা সাহিত্যের পরিম-লে ধূমকেতুরূপে আবির্ভূত হওয়া কাজী নজরুলের জীবনেও নারীর সাহচর্য একেক সময় এক এক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে কবি-সমীপে। কবির মনে-মননে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিলো অতুলনীয়। তিনি নারী স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে লিখেছেন অসাধারণ কবিতা ‘নারী’। তিনিই বলেছেন,

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

...

সেদিন সুদূর নয়

যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।

নজরুল বারাঙ্গনা নারীদের নিয়েও অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি সেইসব সমাজ-অপাংক্তেয় মহীয়সীদের নিয়ে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় লিখেছেন,

কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুথু ও-গায়ে?

হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।

নারীর মান ও মর্যাদার প্রতি সংবেদনশীল এই সাম্য-দ্রোহ-প্রেমের কবিকে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বয়সের নারীর সান্নিধ্যে আসতে দেখি। নারী কখনো মা ও মাতৃসমা, পতœী-সখী, প্রিয়া ও প্রেমিকা, বন্ধু, ছাত্রী ও কন্যাসমা হয়ে তাঁর কাছাকাছি থেকেছে। নজরুলের জীবন-ঘনিষ্ঠ নারী চরিত্রগুলো অধ্যয়ন করে আমরা বুঝতে পারি, তাঁর সৃজনে-মননে নারীর গুরুত্ব।

নজরুলের জীবনে মা ও মাতৃসমা নারীগণ

নজরুলের জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বিত নারীটির নাম জাহেদা খাতুন। বড় অভাগী তিনি। নজরুলের গর্ভধারিণী মা। দেখতে সুন্দর এই মা ছিলেন দরিদ্র ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী। নজরুলের মাত্র আট বছর বয়সে স্বামীহারা হন জাহেদা খাতুন। ফকির আহমদের চাচাতো ভাই তথা নজরুলের লেটো গানের উৎসাহদাতা ছিলেন বজলে করিম। সন্তানদের ভরণ-পোষণের কারণে তার সাথে দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হওয়ায় মায়ের সাথে নজরুলের অভিমান হয়। নজরুল সেই যে মাকে ছাড়লেন, মায়ের মৃত্যুতেও তাঁকে আর দেখতে যাননি। এমনকি হুগলী জেলে রাজবন্দি থাকাকালীন একটানা ঊনচল্লিশ দিন অনশনকারী পুত্রকে দেখতে ১৯২৩ সালের এপ্রিলে হুগলী জেলে এলেও নজরুল তাঁকে দেখা দেননি। নজরুলের বিমাতা বা বড় মা সৈয়দা খাতুন কিংবা তাঁর বৈমাত্রেয় বোন সাজেদা খাতুনের সাথে নজরুলের খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। এমনকি নজরুলের আপন ছোট বোন উম্মে কুলসুমের সাথেও নজরুলের উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই।

নজরুল কিশোর বয়সে দারিদ্র্য জয় করতে গৃহত্যাগী হয়ে ওয়াহেদ বক্সের দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। নজরুলের প্রতি এসময় দারোগা রফিজউল্লাহর বাৎসল্য তৈরি হলেও দারোগা-পতœী তাকে গৃহভৃত্য হিসেবেই নিয়োগ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিজের কর্মক্ষেত্র বদলির আশঙ্কায় নজরুলকে তার বাড়ি তথা কাজীর শিমলায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে নিজের বাড়িতে দারোগা-পতœী তাকে জায়গা দিতে কার্পণ্য করায় নজরুল বিচুতিয়া ব্যাপারি বাড়িতে জায়গীর থেকে জায়গীরদারের মেয়েকে পড়াতেন। কিন্তু নজরুলের বখাটেপনা, দস্যুবৃত্তি দেখে জায়গীরদার তাকে পছন্দ করতেন না। পক্ষান্তরে দারোগা রফিজউল্লাহর বউ মাতৃসমা হয়েও নজরুলকে ঘরে জায়গা না দিয়ে উল্টো তাকে স্নেহের চোখে দেখতেন বলে পরবর্তীকালে প্রচার করেন। নজরুল বিখ্যাত হয়ে গেলে, ১৯৬১ সালের দিকে কাজী রফিজউল্লাহ দারোগার বৃদ্ধা পতœীকে ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা প্রশাসক পি. এ. নাজির নজরুলের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি তখন বানিয়ে বানিয়ে নজরুলের প্রতি তার স্নেহের কথা তুলে ধরেন।

যুদ্ধফেরত কবি ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লায় এসে নজরুল বেশ কয়েকজন মা ও মাতৃসমাদের খুঁজে পান। নজরুলের মা সম্বোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কুমিল্লাস্থ দৌলতপুরের বিশিষ্ট পুস্তক ব্যবসায়ী জনাব আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালাম্মা এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম. রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী উল্লেখযোগ্য। আলী আকবর খানের মেজো বোন বিধবা এখতারুন্নেসা নিঃসন্তান ছিলেন বিধায় নজরুলকে আদর করতেন সন্তান স্নেহে। নজরুল তার স্বল্পকাল দৌলতপুর অবস্থানের সময় এখতারুন্নেসাকে মা সম্বোধনে স্নেহের উৎখনন ঘটান। নজরুল ও নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে আলী আকবর খান এই এখতারুন্নেসার মাধ্যমে সবার ওপরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। সে সময় এখতারুন্নেসা ছাড়া আর কাউকে কবি পাত্তাই দিতেন না। নজরুলকে তিনি এতটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিও নজরুলের নামে

লিখে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। কবি তাঁর ‘মা’ নামের কবিতায় এখ্তারুন্নেসাকে নিয়ে লেখেন-

যেখানেতে দেখি যাহা

মা-এর মতন তাহা

একটি কথায় এত মধু মেশা নাই।

বাংলার বিপ্লবী আরেক অগ্নিকন্যা হেম প্রভাকেও নজরুল ‘মা’ সম্বোধন করেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবী বসন্তকুমার মজুমদারের স্ত্রী এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ফরওয়ার্ড ব্লকের নেত্রী। এই অগ্নিকন্যা হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি ১৯২৬ সালে রচনা করেন ‘হৈমপ্রভা’ কবিতাটি। ইতিহাসমতে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারিপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভাও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কবি মহীয়সী হেমপ্রভাকে নিবেদন করে লেখেন,

কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া

আসিলো আলোক জননী।

প্রভায় তোর উদিল প্রভাত

হেম-প্রভ হল ধরণী।

কবিবন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের মা, ব্যক্তিত্বময়ী বীরজা সুন্দরী দেবীকে কবি প্রমীলার সাথে বিয়ের আগে থেকেই মা বলে ডাকতেন। তাদের কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের বাড়িতে তিনি বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রমীলার জ্যেঠিমা। ১৯২১ সালে প্রথম পরিচয় হওয়ার পর এই বাড়িতে কবি বেশ কিছুদিন ছিলেন। নজরুলের মায়াকাড়া চোখ ও ভুরুতে তার প্রতি বীরজাসুন্দরীর সন্তানবাৎসল্য জেগে ওঠে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনার জন্যে তাঁকে ইংরেজ সরকার আটক করলে তিনিই নজরুলকে হুগলী জেলে নিজ হাতে লেবুর রস পান করিয়ে দীর্ঘ ঊনচল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করান। সেদিন নজরুলের অনশন ভাঙিয়ে জেল থেকে বাইরে এসে অপেক্ষামাণ জনতার উদ্দেশে বিরজা সুন্দরী দেবী বলেছিলেন- ‘খাইয়েছি পাগলকে, কথা কি শোনে! বলে, না, অন্যায় আমি সইব না’ শেষ পর্যন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি ‘মা’। মার আদেশ সব ন্যায়-অন্যায় বোধের ওপরে। লেবুর রস খাইয়ে এসেছি।’

১৯২৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সর্বহারা’ কবি বিরজা সুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ কবিতাটি ছিল এরকম;

“মা (বিরজা সুন্দরী দেবী)র শ্রী চরণারবিন্দে

সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।

তুমি কোন দিন কারো করনি বিচার।

...

শিশু এক এসেছিল, শ্রান্ত কণ্ঠে তাঁর

বলেছিল গলা ধরে “মা” হবে আমার?”

নজরুল বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে পরিবারের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়, সেই নলিনাক্ষ স্যানালের পরিবারের কর্ত্রী সুনীতি বালাকেও কবি মায়ের আসনে রাখেন। এর পাশাপাশি আরেকজন মহিয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহধর্মীনি বাসন্তী দেবী। তিনিও তাঁকে সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে কাছে বসে কবিকে খাওয়াতেন। কবি তাঁর অবিস্মরণীয় ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থটি বাসন্তী দেবীকে উৎসর্গ করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে নজরুল তাৎক্ষণিক ‘ইন্দ্রপতন’ শিরোনামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন তা ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

কবির শাশুড়ি শ্রীমতী গিরিবালা দেবী নজরুলের মাতৃসমা হলেও তাঁকে মা নয়, তিনি মাসীমা ডাকতেন। গিরিবালা দেবী নিজে নজরুলের সংসারে রান্না-বান্না ও নাতিদের দেখভাল করতেন। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে থাকাকালীন নজরুলের ফ্ল্যাটে ছাদের ওপরে তার ঠাকুরঘর ছিল। কিন্তু তার নিজের তাতে ধর্মকর্ম পালন হতো না বললেই চলে। ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে যুবাইদা মির্যার স্মৃতিচারণ হতে জানা যায়, গিরিবালা নিজে ধর্ম চর্চার কারণে মুরগির মাংস না খেলেও নাতিদের ও নজরুলের জন্যে রেঁধে দিতেন।

কবি নজরুলের জীবনে আরেকজন মহীয়সী নারী এসেছিলেন মা হয়ে। তিনি মিসেস এম রহমান তথা মাসুদা রহমান। হুগলীর সরকারি উকিল খান বাহাদুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরীর কন্যা এই মিসেস এম. রহমান যাঁর স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহ্যিতিক মুজিবর রহমান। হিন্দু মেয়ে-মুসলমান ছেলের মধ্যে বিয়ে সে যুগে অতি অস্বাভাবিক চিন্তা হলেও প্রমীলা ও নজরুলের বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন এই মিসেস এম রহমান। তার বিশেষ উদ্যোগেই নজরুল-প্রমীলার মধ্যে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে সম্পন্ন হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বিয়ের পর নব দম্পতির বসবাসের জন্য তিনিই হুগলীতে নজরুলকে বাসা ভাড়া করে দেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন ‘মিসেস্ এম্. রহমান’ নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবি তাকে স্মরণ করে বলেছেন,

বন্দিনীদের বেদনার মাঝে বাঁচিয়া আছ মা তুমি

চিরজীবী মেয়ে, তবু যাই ঐ কবরের ধূলি চুমি।

নজরুলের জীবনে ভগ্নী-নারীরা

আজকের জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল ছিলেন নজরুলের কাছে ভগ্নীতুল্য। সুফিয়া কামালের ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো হাতে পেয়ে নজরুল লাফ দিয়ে ওঠেন বিস্ময়ে, আনন্দে। তিনি ভাবতেই পারেননি, তৎকালে কোনো মুসলিম নারী এরকম কবিতা লিখতে পারে। তিনি নিজে কবি সুফিয়া কামালের ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধ লিখে দেন। নজরুলের আর্থিক দুর্দশা দেখে সওগাত পত্রিকার সম্পাদক নাসিরউদ্দীনকে তিনি আবেগঘন চিঠি লেখেন যাতে নজরুলের জন্যে কিছু করা যায়। সেই চিঠি মোতাবেক নাসিরউদ্দীন মাসিক দেড়শো টাকা সম্মানী দিয়ে নজরুলকে সওগাতের জন্যে সংযুক্ত করে রাখেন। কোনো একদিন নজরুল কবি সুফিয়া কামালের বাড়িতে গিয়ে দেখেন, গানের আসর বসেছে। সেখানে একজন গোয়েন্দাও ছিলেন যাকে কবি চিনতে পেরেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে কবি নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকিই।’ ব্যঙ্গ কবিতা শুনে গোয়েন্দাটি মানে মানে কেটে পড়তেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদু তুমি একে চিনলে কী করে?’ নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’

লেখিকা হিসেবে সুফিয়া কামালের পর কবিবন্ধু হবীবুল্লাহ্ বাহারের ছোটবোন শামসুন্নাহার মাহমুদ কবির স্নেহ অর্জন করেন। তিনি কবিকে নূরুদা বলেই সম্বোধন করতেন। তার নানার বাসা চট্টগ্রামের তামাকুমন্ডি লেইনে বেশ কয়েকদিন ছিলেন নজরুল। তিনি এখানেই রচনা করেন ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতাটি। কলাকাতা হতে প্রকাশিত ও শামসুন্নাহার মাহমুদ সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায় তিনি লেখা পাঠাতেন এবং নাহারের আব্দারে লেখা সংগ্রহ করে দিতেন। ‘নজরুলকে যেমন দেখেছি’ তার বিখ্যাত গ্রন্থ। নজরুল তাঁর ‘সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থ ‘বাহার ও নাহার’ দুই ভাইবোনকে উৎসর্গ করেছেন।

এছাড়াও কবিবন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী সাজেদা খাতুনের সাথেও কবির মধুর সম্পর্ক ছিলো। কবি তাকে সতীন নামে ডাকতেন। তিনি কবিকে গলা ঠিক রাখার জন্যে ডুবো ঘিয়ে ভাজা একটি তিনপোয়া বয়াম পেঁয়াজ কোষে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। বন্ধুপতœীকে উদ্দেশ্য করে কবি বলতেন,

সতীন মিতীন গোলমরিচের ঝাল,

সতীন তুমি বাঁচবে কতকাল?

নজরুলের কন্যাসমা নারীরা

বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায়, নজরুলের ঔরসে প্রমীলার গর্ভে একটা ছোট্ট ফুটফুটে কন্যাশিশুর আগমন ঘটেছিল যে জন্মের পরপরই মারা যায়। নজরুলের পিতৃহৃদয়ে সেই কন্যার মুখটি হয়তোবা জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে। একসময় ১৯২৮ সালে কবিপতœী প্রমীলার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া সুশীলা দেবীর ছয়-সাত বছর বয়সের মেয়ে শান্তিলতা তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখন কবিপুত্র বুলবুলের বয়স ছিল আড়াই বছর। বুভুক্ষু পিতৃস্নেহের কারণে নজরুল সুশীলা দেবীকে অনুরোধ করেন, যাতে মেয়েটাকে তাঁর বাড়িতে রেখে যায়। কবি শান্তিলতাকে নাম দিয়েছিলেন ‘খুকি’ বলে। কবি নজরুলের পালিতা কন্যা শান্তিলতা দেবী, যাঁর আতিথ্যে তাঁর অনেকটা সময় কেটেছে, সেই শান্তিলতার স্মৃতিতর্পণ থেকে জানা যায় যে, কবি ঝিঙে আর শুক্তোর একটা রান্না খুব পছন্দ করতেন। আর পোস্ত দিয়ে রান্না বড় কই মাছও ছিল তাঁর প্রিয়। বাড়িতে মুরগি এবং খাসির মাংস এলেও আগ্রহ করে খেতেন। কিন্তু গরুর মাংস তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল না।

একসময় সওগাত পত্রিকায় কাজের সুবাদে নাসিরউদ্দীনের ছোট্ট মেয়ে নূরজাহান বেগম তথা নূরী কবির সান্নিধ্যে আসে। নূরী সত্যিকার অর্থেই কবির মেয়ের মতো ছিলো। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের পরবর্তী ধারাবাহিক কিস্তি লিখিয়ে নিতে নাসিরউদ্দীন মেয়ে নূরীকে নজরুলের পেছনে পাহারায় লাগিয়ে দিতেন। নূরীও একখিলি পান আর এককাপ চা ধরিয়ে দিয়ে নূরু কাকাকে দিয়ে ঠিকই উপন্যাসটির পরবর্তী কিস্তি লিখিয়ে নিতো।

বর্ধমান হাউজে কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর বাসায় থাকাকালীন নজরুল তার পাঁচ বছরের মেয়ে তথা জ্যেষ্ঠা কন্যা যুবাইদা মির্যার সাথে কাকা-ভাতিজীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি তাকে গান শেখাতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষ্যে কবি খুকুকে ‘এ আঁখিজল মোছো প্রিয়া ভোল আমারে, কে বিদেশি মন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে, কি হবে জানিয়া বল কেন জল নয়নে’ ইত্যাদি গান শিখিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে এসেই তিনি খুকিকে কাঁধে নিয়ে নিতেন। রানু সোমের বাড়ি থেকে ফেরার পথে যেবার তিনি কতিপয় বখাটে যুবক দ্বারা আক্রান্ত হলেন, সেবার বর্ধমান হাউজে ফিরে তিনি ঘটনা বর্ণনা করলে মোতাহার সাহেবের বড় মেয়ে বলে উঠেছিল, ‘আমাকে নেনি বলেই তো।’ হাসির তোড়ে ভাসিয়ে দিয়ে নজরুল জবাবে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস্ নিইনি! নইলে বিপদ আরো বেড়ে যেতো।’ খেতে বসলে ছোট্ট যোবাইদা যখন মাছের ত্বককে মাছের শাড়ি আর ত্বকের সাথে লেগে থাকা মাছকে হরিণের মাংস বলে উঠেছিল, তখন নজরুল হো হো করে হেসে উঠে বলেছিল, শিশুদের সাথে খেতে বসা উচিত। কারণ তারা খুব গুছিয়ে খায়।

(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৪ শাওয়াল ১৪৪৩

প্রসঙ্গ নজরুল : সৃজনে-মননে নারী

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

image

নারী পৃথিবীর বিপুলা এক শক্তির নাম, নারী পৃথিবীর অতুলনীয় সৌন্দর্যের নাম। নারী পৃথিবীর মমতার আধার, আবার নারী সকল জটিলতারও উৎস। নারী পৃথিবীর কল্যাণী, নারী পৃথিবীর জননীও। মা থেকে শুরু করে বোন, কন্যা, বন্ধু, প্রেমিকা, ঘরণি, কর্ত্রী, শিক্ষিকা, সেবিকা ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় নারীই পুরুষকে জন্ম দেয়, লালন-পালন করে, বিকশিত করে, প্রশমিত করে, পুলকিত করে। কাজেই পুরুষের জন্যে নারী অপরিহার্য এক আশীর্বাদ। বাংলা সাহিত্যের পরিম-লে ধূমকেতুরূপে আবির্ভূত হওয়া কাজী নজরুলের জীবনেও নারীর সাহচর্য একেক সময় এক এক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে কবি-সমীপে। কবির মনে-মননে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিলো অতুলনীয়। তিনি নারী স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে লিখেছেন অসাধারণ কবিতা ‘নারী’। তিনিই বলেছেন,

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

...

সেদিন সুদূর নয়

যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।

নজরুল বারাঙ্গনা নারীদের নিয়েও অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি সেইসব সমাজ-অপাংক্তেয় মহীয়সীদের নিয়ে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় লিখেছেন,

কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুথু ও-গায়ে?

হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।

নারীর মান ও মর্যাদার প্রতি সংবেদনশীল এই সাম্য-দ্রোহ-প্রেমের কবিকে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বয়সের নারীর সান্নিধ্যে আসতে দেখি। নারী কখনো মা ও মাতৃসমা, পতœী-সখী, প্রিয়া ও প্রেমিকা, বন্ধু, ছাত্রী ও কন্যাসমা হয়ে তাঁর কাছাকাছি থেকেছে। নজরুলের জীবন-ঘনিষ্ঠ নারী চরিত্রগুলো অধ্যয়ন করে আমরা বুঝতে পারি, তাঁর সৃজনে-মননে নারীর গুরুত্ব।

নজরুলের জীবনে মা ও মাতৃসমা নারীগণ

নজরুলের জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বিত নারীটির নাম জাহেদা খাতুন। বড় অভাগী তিনি। নজরুলের গর্ভধারিণী মা। দেখতে সুন্দর এই মা ছিলেন দরিদ্র ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী। নজরুলের মাত্র আট বছর বয়সে স্বামীহারা হন জাহেদা খাতুন। ফকির আহমদের চাচাতো ভাই তথা নজরুলের লেটো গানের উৎসাহদাতা ছিলেন বজলে করিম। সন্তানদের ভরণ-পোষণের কারণে তার সাথে দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হওয়ায় মায়ের সাথে নজরুলের অভিমান হয়। নজরুল সেই যে মাকে ছাড়লেন, মায়ের মৃত্যুতেও তাঁকে আর দেখতে যাননি। এমনকি হুগলী জেলে রাজবন্দি থাকাকালীন একটানা ঊনচল্লিশ দিন অনশনকারী পুত্রকে দেখতে ১৯২৩ সালের এপ্রিলে হুগলী জেলে এলেও নজরুল তাঁকে দেখা দেননি। নজরুলের বিমাতা বা বড় মা সৈয়দা খাতুন কিংবা তাঁর বৈমাত্রেয় বোন সাজেদা খাতুনের সাথে নজরুলের খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। এমনকি নজরুলের আপন ছোট বোন উম্মে কুলসুমের সাথেও নজরুলের উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই।

নজরুল কিশোর বয়সে দারিদ্র্য জয় করতে গৃহত্যাগী হয়ে ওয়াহেদ বক্সের দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। নজরুলের প্রতি এসময় দারোগা রফিজউল্লাহর বাৎসল্য তৈরি হলেও দারোগা-পতœী তাকে গৃহভৃত্য হিসেবেই নিয়োগ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিজের কর্মক্ষেত্র বদলির আশঙ্কায় নজরুলকে তার বাড়ি তথা কাজীর শিমলায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে নিজের বাড়িতে দারোগা-পতœী তাকে জায়গা দিতে কার্পণ্য করায় নজরুল বিচুতিয়া ব্যাপারি বাড়িতে জায়গীর থেকে জায়গীরদারের মেয়েকে পড়াতেন। কিন্তু নজরুলের বখাটেপনা, দস্যুবৃত্তি দেখে জায়গীরদার তাকে পছন্দ করতেন না। পক্ষান্তরে দারোগা রফিজউল্লাহর বউ মাতৃসমা হয়েও নজরুলকে ঘরে জায়গা না দিয়ে উল্টো তাকে স্নেহের চোখে দেখতেন বলে পরবর্তীকালে প্রচার করেন। নজরুল বিখ্যাত হয়ে গেলে, ১৯৬১ সালের দিকে কাজী রফিজউল্লাহ দারোগার বৃদ্ধা পতœীকে ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা প্রশাসক পি. এ. নাজির নজরুলের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি তখন বানিয়ে বানিয়ে নজরুলের প্রতি তার স্নেহের কথা তুলে ধরেন।

যুদ্ধফেরত কবি ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লায় এসে নজরুল বেশ কয়েকজন মা ও মাতৃসমাদের খুঁজে পান। নজরুলের মা সম্বোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কুমিল্লাস্থ দৌলতপুরের বিশিষ্ট পুস্তক ব্যবসায়ী জনাব আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালাম্মা এখতারুন্নেসা খানম, বিপ্লবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম. রহমান, কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী উল্লেখযোগ্য। আলী আকবর খানের মেজো বোন বিধবা এখতারুন্নেসা নিঃসন্তান ছিলেন বিধায় নজরুলকে আদর করতেন সন্তান স্নেহে। নজরুল তার স্বল্পকাল দৌলতপুর অবস্থানের সময় এখতারুন্নেসাকে মা সম্বোধনে স্নেহের উৎখনন ঘটান। নজরুল ও নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে আলী আকবর খান এই এখতারুন্নেসার মাধ্যমে সবার ওপরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। সে সময় এখতারুন্নেসা ছাড়া আর কাউকে কবি পাত্তাই দিতেন না। নজরুলকে তিনি এতটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিও নজরুলের নামে

লিখে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। কবি তাঁর ‘মা’ নামের কবিতায় এখ্তারুন্নেসাকে নিয়ে লেখেন-

যেখানেতে দেখি যাহা

মা-এর মতন তাহা

একটি কথায় এত মধু মেশা নাই।

বাংলার বিপ্লবী আরেক অগ্নিকন্যা হেম প্রভাকেও নজরুল ‘মা’ সম্বোধন করেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবী বসন্তকুমার মজুমদারের স্ত্রী এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ফরওয়ার্ড ব্লকের নেত্রী। এই অগ্নিকন্যা হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি ১৯২৬ সালে রচনা করেন ‘হৈমপ্রভা’ কবিতাটি। ইতিহাসমতে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারিপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভাও ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কবি মহীয়সী হেমপ্রভাকে নিবেদন করে লেখেন,

কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া

আসিলো আলোক জননী।

প্রভায় তোর উদিল প্রভাত

হেম-প্রভ হল ধরণী।

কবিবন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের মা, ব্যক্তিত্বময়ী বীরজা সুন্দরী দেবীকে কবি প্রমীলার সাথে বিয়ের আগে থেকেই মা বলে ডাকতেন। তাদের কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের বাড়িতে তিনি বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রমীলার জ্যেঠিমা। ১৯২১ সালে প্রথম পরিচয় হওয়ার পর এই বাড়িতে কবি বেশ কিছুদিন ছিলেন। নজরুলের মায়াকাড়া চোখ ও ভুরুতে তার প্রতি বীরজাসুন্দরীর সন্তানবাৎসল্য জেগে ওঠে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনার জন্যে তাঁকে ইংরেজ সরকার আটক করলে তিনিই নজরুলকে হুগলী জেলে নিজ হাতে লেবুর রস পান করিয়ে দীর্ঘ ঊনচল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করান। সেদিন নজরুলের অনশন ভাঙিয়ে জেল থেকে বাইরে এসে অপেক্ষামাণ জনতার উদ্দেশে বিরজা সুন্দরী দেবী বলেছিলেন- ‘খাইয়েছি পাগলকে, কথা কি শোনে! বলে, না, অন্যায় আমি সইব না’ শেষ পর্যন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি ‘মা’। মার আদেশ সব ন্যায়-অন্যায় বোধের ওপরে। লেবুর রস খাইয়ে এসেছি।’

১৯২৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সর্বহারা’ কবি বিরজা সুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ কবিতাটি ছিল এরকম;

“মা (বিরজা সুন্দরী দেবী)র শ্রী চরণারবিন্দে

সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।

তুমি কোন দিন কারো করনি বিচার।

...

শিশু এক এসেছিল, শ্রান্ত কণ্ঠে তাঁর

বলেছিল গলা ধরে “মা” হবে আমার?”

নজরুল বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে পরিবারের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়, সেই নলিনাক্ষ স্যানালের পরিবারের কর্ত্রী সুনীতি বালাকেও কবি মায়ের আসনে রাখেন। এর পাশাপাশি আরেকজন মহিয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহধর্মীনি বাসন্তী দেবী। তিনিও তাঁকে সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে কাছে বসে কবিকে খাওয়াতেন। কবি তাঁর অবিস্মরণীয় ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থটি বাসন্তী দেবীকে উৎসর্গ করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে নজরুল তাৎক্ষণিক ‘ইন্দ্রপতন’ শিরোনামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন তা ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

কবির শাশুড়ি শ্রীমতী গিরিবালা দেবী নজরুলের মাতৃসমা হলেও তাঁকে মা নয়, তিনি মাসীমা ডাকতেন। গিরিবালা দেবী নিজে নজরুলের সংসারে রান্না-বান্না ও নাতিদের দেখভাল করতেন। হিজ মাস্টার্স ভয়েসে থাকাকালীন নজরুলের ফ্ল্যাটে ছাদের ওপরে তার ঠাকুরঘর ছিল। কিন্তু তার নিজের তাতে ধর্মকর্ম পালন হতো না বললেই চলে। ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে যুবাইদা মির্যার স্মৃতিচারণ হতে জানা যায়, গিরিবালা নিজে ধর্ম চর্চার কারণে মুরগির মাংস না খেলেও নাতিদের ও নজরুলের জন্যে রেঁধে দিতেন।

কবি নজরুলের জীবনে আরেকজন মহীয়সী নারী এসেছিলেন মা হয়ে। তিনি মিসেস এম রহমান তথা মাসুদা রহমান। হুগলীর সরকারি উকিল খান বাহাদুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরীর কন্যা এই মিসেস এম. রহমান যাঁর স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহ্যিতিক মুজিবর রহমান। হিন্দু মেয়ে-মুসলমান ছেলের মধ্যে বিয়ে সে যুগে অতি অস্বাভাবিক চিন্তা হলেও প্রমীলা ও নজরুলের বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন এই মিসেস এম রহমান। তার বিশেষ উদ্যোগেই নজরুল-প্রমীলার মধ্যে আন্তঃধর্মীয় বিয়ে সম্পন্ন হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বিয়ের পর নব দম্পতির বসবাসের জন্য তিনিই হুগলীতে নজরুলকে বাসা ভাড়া করে দেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন ‘মিসেস্ এম্. রহমান’ নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবি তাকে স্মরণ করে বলেছেন,

বন্দিনীদের বেদনার মাঝে বাঁচিয়া আছ মা তুমি

চিরজীবী মেয়ে, তবু যাই ঐ কবরের ধূলি চুমি।

নজরুলের জীবনে ভগ্নী-নারীরা

আজকের জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল ছিলেন নজরুলের কাছে ভগ্নীতুল্য। সুফিয়া কামালের ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো হাতে পেয়ে নজরুল লাফ দিয়ে ওঠেন বিস্ময়ে, আনন্দে। তিনি ভাবতেই পারেননি, তৎকালে কোনো মুসলিম নারী এরকম কবিতা লিখতে পারে। তিনি নিজে কবি সুফিয়া কামালের ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধ লিখে দেন। নজরুলের আর্থিক দুর্দশা দেখে সওগাত পত্রিকার সম্পাদক নাসিরউদ্দীনকে তিনি আবেগঘন চিঠি লেখেন যাতে নজরুলের জন্যে কিছু করা যায়। সেই চিঠি মোতাবেক নাসিরউদ্দীন মাসিক দেড়শো টাকা সম্মানী দিয়ে নজরুলকে সওগাতের জন্যে সংযুক্ত করে রাখেন। কোনো একদিন নজরুল কবি সুফিয়া কামালের বাড়িতে গিয়ে দেখেন, গানের আসর বসেছে। সেখানে একজন গোয়েন্দাও ছিলেন যাকে কবি চিনতে পেরেছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে কবি নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকিই।’ ব্যঙ্গ কবিতা শুনে গোয়েন্দাটি মানে মানে কেটে পড়তেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদু তুমি একে চিনলে কী করে?’ নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’

লেখিকা হিসেবে সুফিয়া কামালের পর কবিবন্ধু হবীবুল্লাহ্ বাহারের ছোটবোন শামসুন্নাহার মাহমুদ কবির স্নেহ অর্জন করেন। তিনি কবিকে নূরুদা বলেই সম্বোধন করতেন। তার নানার বাসা চট্টগ্রামের তামাকুমন্ডি লেইনে বেশ কয়েকদিন ছিলেন নজরুল। তিনি এখানেই রচনা করেন ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতাটি। কলাকাতা হতে প্রকাশিত ও শামসুন্নাহার মাহমুদ সম্পাদিত ‘বুলবুল’ পত্রিকায় তিনি লেখা পাঠাতেন এবং নাহারের আব্দারে লেখা সংগ্রহ করে দিতেন। ‘নজরুলকে যেমন দেখেছি’ তার বিখ্যাত গ্রন্থ। নজরুল তাঁর ‘সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থ ‘বাহার ও নাহার’ দুই ভাইবোনকে উৎসর্গ করেছেন।

এছাড়াও কবিবন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী সাজেদা খাতুনের সাথেও কবির মধুর সম্পর্ক ছিলো। কবি তাকে সতীন নামে ডাকতেন। তিনি কবিকে গলা ঠিক রাখার জন্যে ডুবো ঘিয়ে ভাজা একটি তিনপোয়া বয়াম পেঁয়াজ কোষে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। বন্ধুপতœীকে উদ্দেশ্য করে কবি বলতেন,

সতীন মিতীন গোলমরিচের ঝাল,

সতীন তুমি বাঁচবে কতকাল?

নজরুলের কন্যাসমা নারীরা

বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায়, নজরুলের ঔরসে প্রমীলার গর্ভে একটা ছোট্ট ফুটফুটে কন্যাশিশুর আগমন ঘটেছিল যে জন্মের পরপরই মারা যায়। নজরুলের পিতৃহৃদয়ে সেই কন্যার মুখটি হয়তোবা জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে। একসময় ১৯২৮ সালে কবিপতœী প্রমীলার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া সুশীলা দেবীর ছয়-সাত বছর বয়সের মেয়ে শান্তিলতা তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখন কবিপুত্র বুলবুলের বয়স ছিল আড়াই বছর। বুভুক্ষু পিতৃস্নেহের কারণে নজরুল সুশীলা দেবীকে অনুরোধ করেন, যাতে মেয়েটাকে তাঁর বাড়িতে রেখে যায়। কবি শান্তিলতাকে নাম দিয়েছিলেন ‘খুকি’ বলে। কবি নজরুলের পালিতা কন্যা শান্তিলতা দেবী, যাঁর আতিথ্যে তাঁর অনেকটা সময় কেটেছে, সেই শান্তিলতার স্মৃতিতর্পণ থেকে জানা যায় যে, কবি ঝিঙে আর শুক্তোর একটা রান্না খুব পছন্দ করতেন। আর পোস্ত দিয়ে রান্না বড় কই মাছও ছিল তাঁর প্রিয়। বাড়িতে মুরগি এবং খাসির মাংস এলেও আগ্রহ করে খেতেন। কিন্তু গরুর মাংস তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল না।

একসময় সওগাত পত্রিকায় কাজের সুবাদে নাসিরউদ্দীনের ছোট্ট মেয়ে নূরজাহান বেগম তথা নূরী কবির সান্নিধ্যে আসে। নূরী সত্যিকার অর্থেই কবির মেয়ের মতো ছিলো। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের পরবর্তী ধারাবাহিক কিস্তি লিখিয়ে নিতে নাসিরউদ্দীন মেয়ে নূরীকে নজরুলের পেছনে পাহারায় লাগিয়ে দিতেন। নূরীও একখিলি পান আর এককাপ চা ধরিয়ে দিয়ে নূরু কাকাকে দিয়ে ঠিকই উপন্যাসটির পরবর্তী কিস্তি লিখিয়ে নিতো।

বর্ধমান হাউজে কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর বাসায় থাকাকালীন নজরুল তার পাঁচ বছরের মেয়ে তথা জ্যেষ্ঠা কন্যা যুবাইদা মির্যার সাথে কাকা-ভাতিজীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি তাকে গান শেখাতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষ্যে কবি খুকুকে ‘এ আঁখিজল মোছো প্রিয়া ভোল আমারে, কে বিদেশি মন উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে, কি হবে জানিয়া বল কেন জল নয়নে’ ইত্যাদি গান শিখিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে এসেই তিনি খুকিকে কাঁধে নিয়ে নিতেন। রানু সোমের বাড়ি থেকে ফেরার পথে যেবার তিনি কতিপয় বখাটে যুবক দ্বারা আক্রান্ত হলেন, সেবার বর্ধমান হাউজে ফিরে তিনি ঘটনা বর্ণনা করলে মোতাহার সাহেবের বড় মেয়ে বলে উঠেছিল, ‘আমাকে নেনি বলেই তো।’ হাসির তোড়ে ভাসিয়ে দিয়ে নজরুল জবাবে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস্ নিইনি! নইলে বিপদ আরো বেড়ে যেতো।’ খেতে বসলে ছোট্ট যোবাইদা যখন মাছের ত্বককে মাছের শাড়ি আর ত্বকের সাথে লেগে থাকা মাছকে হরিণের মাংস বলে উঠেছিল, তখন নজরুল হো হো করে হেসে উঠে বলেছিল, শিশুদের সাথে খেতে বসা উচিত। কারণ তারা খুব গুছিয়ে খায়।

(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায় পড়ুন)