আমার সময় ও চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গন

বিমল গুহ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

গ্রামে শিক্ষার হার বাড়ছে। আমাদের ছোটবেলায় আমরা হাতেগোনা চার-পাঁচজন উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলাম। গ্রামের মানুষজন আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল বলে প্রাথমিক পর্যায়ে ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়তো বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। এই ক’বছরে বেশ উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে বাজালিয়া গ্রামে আরও একটি নতুন উচ্চবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। নাম- শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়। প্রবীণ রাজনীতিবিদ শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেরেবাংলা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানেরও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় প্রধান নেতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।

আমাদের সময়ে বাজালিয়া গ্রামে একটিই মাত্র উচ্চ বিদ্যালয় ছিলো- বাজালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৩৯ সালে, আজ থেকে ৮১ বছর আগে। গ্রামের শিক্ষানুরাগী আলহাজ্ব আকামত আলী চৌধুরী এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিরাট দীঘির পাড়ে মনোরম পরিবেশে এটি প্রতিষ্ঠিত। লোকজন বলতো ‘উত্তর দীঘি’। হতে পারে বাজালিয়ার উত্তরপ্রান্ত-সীমায় এর অবস্থান- তাই এই নাম। অন্যপাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাজালিয়া সরকারি প্রাইমারি স্কুল। এই স্কুলের দূরত্ব আমাদের বাড়ি থেকে দুই মাইলের বেশি। এই দীর্ঘপথ হেঁটে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পড়তে আসতো! আমিও আসতাম। আরও দূর থেকেও আসতো কেউ কেউ। পুরানগড় থেকে আসতো, মাহালিয়া থেকেও আসতো।

আমাদের বাবা সবসময় সন্তানদের উচ্চশিক্ষা, এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণের কথা ভাবতেন। আমরা ভাইবোনেরা সবাই- আমি, নির্মল, নিয়তি ও অমল উচ্চশিক্ষা নিয়েছি বাবা বেঁচে থাকতেই। তিনি বেঁচে থাকতেই মুক্তিযুদ্ধের শহিদ আমার জ্যেঠতুতো বড়ভাই ব্রজগোপাল গুহের দুই ছেলে- রতন ও উত্তম, মেয়ে মিনু উচ্চশিক্ষিত হয়েছে। আজ বাবাকে খুব মনে পড়ে। যখন ভাবি, আমাদের সন্তানও লেখাপড়ায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখছে; বন্ধুদেরকে আনন্দের সঙ্গে, গর্বের সঙ্গে বলি- বলতে ইচ্ছে করে। আমাদের মা-বাবার বেলায়ও তাই ছিলো নিশ্চয়! গ্রামের উন্নয়ন, গরীবদের ভালোমন্দ দেখা, আমাদের পরিবারের সকলের ও গ্রামের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তা থাকতো তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয় হল-এ আমাকে চিঠি লিখতেন। একবার লিখলেন, ‘রতন-উত্তম লেখাপড়া করে না; এদেরকে শহরে নিয়ে যাও’। রতন-উত্তম আমার জ্যেঠতুতো ভাই মুক্তিযুদ্ধের শহিদ ব্রজগোপাল গুহের দুইছেলে। বাবার বড় চিন্তা একটাই- সবাই লেখাপড়া শিখে কখন মানুষ হবে! সন্তানেরা, নাতি-নাতনিরা লেখাপড়ায় শিক্ষিত হলে পরিবারের সুনাম যেমন হবে, জীবনক্ষেত্রে নিজেরাও প্রতিষ্ঠিত হবে।

বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৮৬ সালের ১ লা মে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামে কিছু করা দরকার মনে করেছি আমরা। নির্মল বিদেশে থাকাতে ছোটভাই অমলকে নিয়েই আমার যত পরিকল্পনা। শিক্ষানুরাগী পিতার স্মৃতিরক্ষার্থে আমরা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করি ‘বাজালিয়া প্রসন্ন গুহ প্রাইমারি স্কুল’। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো আমার স্ত্রী মীনা। আমার বাবার নাম প্রসন্ন গুহ শোনার পর, তার নাকি তার পৈত্রিক গ্রাম রাউজান থানার সুলতানপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘প্রসন্ন প্রাইমারি’র কথা মনে পড়ে যেতো। আমাকে একবার সেই স্কুলটি দেখাতেও নিয়ে গিয়েছিলো। দেখেছি বেশ বড় স্কুল; নাম- প্রসন্ন প্রাইমারি স্কুল। স্কুলটির পাশে মীনার মামার বাড়ি। সে আরও বলেছিলো, মামার বাড়িতে গেলে তারা প্রসন্ন প্রাইমারি স্কুলের মাঠে খেলতে যেতো। স্কুলটি এলাকার স্মৃতি হয়ে ঠিকে আছে। বলে- তোমরাও তো বাবার নামে স্কুল করতে পারো- প্রসন্ন প্রাইমারি স্কুল। আমরাও গর্ব করে বলতে পারবো!

ভাবছিলাম বাবার নামে একটি স্কুল করা যায় কীভাবে! অবশেষে গ্রামে শিক্ষানুরাগী পিতার স্মৃতিস্মারক একটি স্কুল এবং একটি কলেজ করতে উদ্যোগী হলাম আমি আর ছোটভাই অমল। এলাকাবাসীকে ডেকে সেরকম সিদ্ধান্তও হয়েছিলো। অনেক চেষ্টায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। জমি রেজিস্ট্রি করে দিলাম আমি আর অমল। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯১ সালে। আমরা স্কুলের নাম দিলাম- বাজালিয়া প্রসন্ন গুহ প্রাইমারি স্কুল। পরে একসময় স্কুলটি সরকারি হয়ে যায়। নাম হয়- বাজালিয়া প্রসন্ন গুহ সরকারি প্রাইমারি স্কুল। স্কুলটি

বর্তমানে নি¤œমাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এখন পাঠদান করা হয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছোটভাই অমল গুহ প্রভূত শ্রম দিয়েছে। পিতার স্মৃতিরক্ষাকল্পে নির্মিত স্কুলটি আমাদের পরিবারের গৌরব যেমন বহন করে চলেছে, একই সঙ্গে এলাকায় শিক্ষার আলো বিস্তার করছে। আমাদের ভাবনায় আছে, কীভাবে মাধ্যমিক স্কুলে উন্নীত করা যায়। কলেজটি আমরা আর করতে পারিনি। আমাদের উদ্যোগের সূত্র ধরে বাজালিয়া গ্রামে কর্নেল অলি আহমদ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটাও বাজালিয়া গ্রামের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা সহজে গ্রামে থেকেই উচ্চশিক্ষালাভে সমর্থ হচ্ছে। সেই গ্রামটি এখন আর অজপাড়াগাঁ নেই, এটি চট্টগ্রাম জেলার উন্নত ও শিক্ষিত এক আদর্শ গ্রামে রূপলাভ করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্য অনেক গ্রামের মতো আমাদের গ্রামেরও রয়েছে অনেক বড় অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনার গুলিতে এই গ্রামে আমার বড়ভাই ব্রজগোপাল গুহসহ মোট ১২ জন শহিদ হন। অন্যরা হলেন- কবিরাজ রমণীরঞ্জন নাথ, ধীরেন্দ্রনাথ মল্লিক সাধু, পুলিনচন্দ্র দাশ, কামিনীমোহন নাথ, অশ্বিনীকুমার নাথ সাধু, মদনমোহন নাথ, মোহাম্মদ রশীদ আহমদ, বংশী মালাকার, অনঙ্গমোহন নাথ, মণীন্দ্রলাল শুক্লদাস ও অনিলচন্দ্র শুক্লদাস। গ্রামের এই অবদান ধরে রাখতে আমরা ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ‘স্মৃতিএকাত্তর’। বিষয়টা যখন মাথায় আসলো, ছোটভাই অমলসহ আলোচনা করে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করলাম। অমলকে বলেছিলাম, কাজটা দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে চাই অর্থাৎ আমি বেঁচে থাকতে-থাকতে। এর কারণ হলো, আমাদের পাড়া থেকে- আশুতোষ নাথ, প্রফুল্লরঞ্জন দাশ ও আমি একসঙ্গে বড় হয়েছি। এপাড়ার আমরাই প্রথম শিক্ষিত অগ্রজ। ওরা দুজন ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুজনই আমার বছর তিন/চারেকের বড়। এখন চলে যাবার সিরিয়াল আমার। তাই আমি একাজ সম্পন্ন করে দেখে যেতে চাই। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধে এ পাড়ার তথা বাজালিয়া গ্রামের অবদানের কোনো চিহ্নও হয়তো একদিন থাকবে না, এবং পরে তা আর করাও হবে না। ছোটভাই অমলও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিলো। সে তার সহকর্মী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের স্থপতি শাহিনূল ইসলাম খানকে দিয়ে একটি নকশা করিয়ে নেয়। আমরা দুইভাইয়ের একান্ত চেষ্টায় স্মৃতিসৌধটি অবশেষে নির্মিত হলো। এই স্থাপনা নির্মাণের পেছনে পুরো কৃতিত্ব অমলের। সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তা নির্মাণের যাবতীয় কাজ তদারকি করেছে। সে না-হলে এটি এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হতো না। যে স্থানে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে, প্রসন্ন গুহ প্রাইমারি স্কুলপ্রাঙ্গণে, সেখানে আমাদের বড়ভাইসহ আরও দুজনকে মাটির গর্ত করে সমাধিস্থ করা হয়েছে। সে-অর্থে স্থানটা বধ্যভূমি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পুরোদমে চলছে। আমি তখন প্রথমবর্ষ বাংলা অনার্স শ্রেণির ছাত্র। বেশ ভালো লাগছে নতুন ক্লাস। নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছি। বাংলা বিভাগে কেমন একটা মাদকতা আছে- ক্লাসে না-গিয়ে থাকা যায় না। ছোটো বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করালে সে যেমন নতুন বন্ধু পেয়ে যায়, তখন আর বাড়িতে থাকতে চায় না- তেমনি অবস্থা হয়েছে আমার। শুধু স্কুলই চোখে ভাসে, সহপাঠীদের কথা ভাবি, সাহিত্যের মাদকতা যেন পেয়ে বসেছে। আমি যেদিন প্রথম ক্লাসে যোগদান করি, তখন প্রথমবর্ষের ক্লাস ২/৩ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সহপাঠী বন্ধুরা এত ভালোবাসা দিয়েছে যে, তাদের সাহচর্য খুব ভালো লেগে গেলো। এটার একটা কারণ হতে পারে যে, আমি সাহিত্যের টানে গণিত বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষ থেকে একক্লাস নিচে প্রথমবর্ষে এসে ভর্তি হয়েছি। শিক্ষকগণও অনেক ¯েœহ করতেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমি হয়ে উঠলাম ক্লাসে অনেকের প্রিয়সাথি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের প্রথম অনার্স ব্যাচ এটি। আরও জানলাম, প্রাণের টানে মনের আবেগে ভালো ফলাফল করা অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে বাংলা বিভাগে। ক্লাসে ৭০/৭৫ জন ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে নিয়মিত কবিতা/গল্প লিখতো- কাজী রফিক, নিতাই সেন, মাহমুদ-উল-আলম, সাথী দাশ, আহমদ জাফর, দীপকজ্যোতি আইচ, মীনাকুমারী দাশ, লায়লা জামান, রোকসানা শামীম, আবদুস সামাদ, রওশন আরা, মুকুল সেন, গোলাম ফেরদৌস, ওয়ালী আহসান ধনু, মোজাম্মেল হক, জান্নাত সুলতানা। আমিও ছিলাম তাদের সঙ্গে। পরে কুমিল্লা থেকে এসে এমএ ক্লাসে যোগ দিয়েছিলো আনোয়ারুল হক। একটি শ্রেণিতে একসঙ্গে এতজন নবীন সাহিত্যিক- অভাবনীয় ঘটনা বটে!

স্বাধীনতার পরে-পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে, বাংলাদেশের সেরা বাংলা বিভাগ বললে খুব বাড়িয়ে বলা হয় না? বিভাগে তখন শিক্ষক ছিলেন- সৈয়দ আলী আহসান, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, আবদুল আওয়াল, মাহমুদ শাহ কোরেশী, মনিরুজ্জামান, দেলোয়ার হোসেন, ভুবনমোহন অধিকারী, চৌধুরী জহুরুল হক, হায়াৎ মামুদ, মাহবুব তালুকদার, খালেদা হানুম, খায়রুল বাশার; আমাদের শেষবর্ষে এসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন- শাহজাহান মুনীর, শামসুল আলম, শিপ্রা দস্তিদার, ভূঁইয়া ইকবাল প্রমুখ। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক। তাঁরা এত খ্যাতিমান যে, আলাদা করে তাঁদের সম্পর্কে বলার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলা বিভাগে আমাদের আগে-পরে আরও সাহিত্যচর্চা করতেন- মোহাম্মদ আশরাফ, মায়া দে, ময়ুখ চৌধুরী, দিলীপ মালাকার, নৃপেন দাশ, আলতাফ হোসেন, এবং আমার পরের ক্লাসে- ছায়া দে, জাকির হোসেন বুলবুল, মোহাম্মদ ইসকান্দার, আনন্দমোহন রক্ষিত, প্রণয় মজুমদার, সুখময় চব্রবর্তী, অমিত চৌধুরী, খালিদ আহসান প্রমুখ। এছাড়া অন্য বিভাগের যারা আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যচর্চা করতেন তারা হলেন- কঙ্কন নন্দী, অনীশ বড়–য়া, সুজিত দত্ত, বাবুল পাটোয়ারী, শাহাবুদ্দীন নাগরী, তৌহিদ আহমেদ, শিশির দত্ত প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে আবুল হোসেন কবিতা লিখতেন। তিনি একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন ‘হরিৎ শস্যের গান’ নামে।

প্রথমবর্ষের ক্লাস আমি বেশিদিন পাইনি, কয়েক মাসের মধ্যে উঠে গেছি দ্বিতীয় বর্ষে। আমাদের পড়াশোনা এবং সাহিত্যচর্চা সমানতালে চলছিলো। আমরা তখন রাজনীতি সচেতনও। সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনীতির প্রধান ধারা ছিলো- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ। ১৯৭৩ সালে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা যখন হচ্ছিলো। তখন সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনে হাওয়া বইছে। আমি ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’-এর সঙ্গে যুক্ত। তবে সক্রিয় রাজনীতি করতাম না, সক্রিয় ছিলাম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে। আমি যখন গণিত বিভাগের ছাত্র, তখন শাহজালাল হলের আবাসিক ছাত্র। যখন প্রথমবর্ষ বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম, তখন আমাকে দেয়া হলো শাহ আমানত হল। এ এক বিড়ম্বনার ব্যাপার! আমি থাকি এক হলে, এখন সংযুক্ত করা হলো অন্য হলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিলো নির্বাচনী হাওয়া। আমি নির্বাচনের ব্যাপারেও আগ্রহী না, সাহিত্য নিয়ে থাকতে আগ্রহী। আমি তখন বাড়ি গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। দুইদিন পর হলে ফিরে দেখি পোস্টার ব্যানারে আমার নাম। শাহ আমানত হলের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আমি ‘সাহিত্য সম্পাদক’ পদে প্রার্থী। নেতাদের জিজ্ঞাসা করলাম। বলে- চুপ থাকো তোমাকে এ পদে দাঁড়াতে হবে। আমার জন্য শাখে-করাত অবস্থা। শাহ আমানত হলে একটা সিটও আমার নামে বণ্টন করা হয়েছে। আর এদিকে শাহজালাল হলের যে-কক্ষে থাকতাম, তা অন্যের নামে বরাদ্দ হয়ে গেছে। নির্বাচন হয়ে গেলো। আমি হেরে গেলাম। অবশ্য সামান্য ভোটের ব্যবধানে। এই ‘অবশ্য’ শব্দটিতে আফসোসের গন্ধ পাওয়া গেলেও- হেরে গিয়ে আমার রক্ষা! যদি জিততাম, তা হলে আম-ছালা দুটোই যেতো। এখন আমি আমার আবাসিক হল পরিবর্তন করে আবার শাহজালাল হলে চলে গেলাম। এর মধ্যে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠে গেছি। আবার সিঙ্গেল রুমের জন্য আবেদন করলাম। এবার চাইলাম ৪০২ নং কক্ষ। কারণ আমার আগের গণিত বিভাগের সহপাঠী বাবুল বসাক এমএসসি ফাইনালে; আর আমি অনার্স ফাইনালে। অপেক্ষা করলাম ৪০২ নং কক্ষটি খালি হওয়া পর্যন্ত। ওদিকে ছোটভাই নির্মলও হিসাববিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ফাইনালে- সেও একই হলে থাকে।

আমরা অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী অর্থাৎ শেষবর্ষের। আমাদের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা যারা নিয়মিত লেখালিখি করে তারা ১৭/১৮ জন; আর জুনিয়র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আছে ৪/৫জন। বিভাগে দুটি সাহিত্য সংগঠন তখন- ‘সাহিত্য সংসদ’ ও ‘হিন্দোল সংসদ’। সকলকে নিয়ে ২৩-১১-১৯৭৪ তারিখে এক সভা ডাকা হলো। সভায় সর্বসম্মতভাবে দুটি সংগঠন ভেঙে দিয়ে বৃহত্তর আকারে গঠন করা হলো- ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পরিষদ’। আমাকে মনোনীত করা হলো সংগঠনের সভাপতি, আর দ্বিতীয়বর্ষ থেকে মোহম্মদ ইস্কান্দার হলেন সাধারণ সম্পাদক। কোষাধ্যক্ষ সহপাঠী নিতাই সেন। সদস্য- কাজী রফিক, মাহমুদ-উল-আলম, ওয়ালী আহসান ধনু, দীপকজ্যোতি আইচ, আহমেদ জাফর, লায়লা জামান টুকু, রোকসানা শামীম, ছায়া দে, জাকির হোসেন বুলবুল প্রমুখ। সংগঠনের উপদেষ্টা হলেন বিভাগের শিক্ষক- আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আবুল কামাল মনজুর মোরশেদ, ভূঁইয়া ইকবাল ও এমএ শেষবর্ষের ছাত্র ময়ুখ চৌধুরী। আমরা প্রথম সাহিত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করলাম চট্টগ্রাম শহরের ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট হল’-এ বড় আকারে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের সাহিত্যপিপাসু লোকজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তখন চট্টগ্রামের সাহিত্যের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, কবিতাপাঠ, গান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকা- নিয়মিত হতে থাকে। আমরা তখন ‘কবি’ হয়ে উঠছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হয়েছে তখন- ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’ ও ‘অনেক সূর্যের আশা’। এই দুইটি সংগঠনের আয়োজনে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে আমাদের তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে মাতিয়ে রেখেছিলো। এক্ষেত্রে মাহমুদুল হাসান, আশরাফুল হক ও মহিউদ্দিন শাহআলম নিপুর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। সে সময়ে চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক সাহিত্য সংগঠন ‘স্পার্ক জেনারেশন’ গঠিত হয়েছিলো- ১৯৭৩ সালের ২রা ডিসেম্বর। আয়োজক- হেনা ইসলাম, স্বপন দত্ত, শেখ খুরশীদ আনোয়ার, সৈয়দ ইকবাল, কাজী রফিক ও শিশির দত্ত। তাও বেশ আলোড়ন তুলেছিলো। সে-সময় ময়ুখ চৌধুরীর সম্পাদনায় বের হয়েছিলো কবিতা সংকলন ‘অসভ্য শব্দ’। সে সংকলনটিও বেশ আলোচিত হয়েছিলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম শহর হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম শহরে গঠিত হয় আরও কিছু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন- ‘ছড়া সাহিত্য পরিষদ’; ‘থিয়েটার ৭৩’; ‘অরিন্দম’ ও ‘তীর্থক’ নাট্যগোষ্ঠী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতেও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজমান ছিলো। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্য যা কাম্য হওয়া উচিত, তাই। চট্টগ্রাম শহর সাহিত্যের, বিশেষ করে কবিতা ও নাটকের তীর্থভূমির মতো হয়ে উঠলো। আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় আমরা অতিবাহিত করেছি এক সুন্দর আবহে। বাংলাদেশে ঢাকার পরে চট্টগ্রাম এক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলো। সে-সময় চট্টগ্রামে যাঁরা কবিতাচর্চা করতেন, তাঁদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন- সৈয়দ আলী আহসান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আল মাহমুদ, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনিরুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ, আফজাল চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, জিয়া হায়দার, মুর্তজা বশীর, অরুণ দাশগুপ্ত, ভুবনমোহন অধিকারী, দিলওয়ার হোসেন, আ.ফ.ম. সিরাজউদ্দোলা চৌধুরী, শামসুল আলম সাঈদ, রণজিৎকুমার চক্রবর্তী, তপনজ্যোতি বড়–য়া প্রমুখ। এঁরা কেউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনারত; কেউ চট্টগ্রামে অন্য চাকুরিরত ছিলেন।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গনে দলবেঁধে কবিতা লিখতে এসেছিলেন- মেজবাহ খান, রফিক ভূইয়া, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, আবুল মোমেন, স্বপন দত্ত, ময়ুখ চৌধুরী, মোস্তফা ইকবাল, আশরাফুল হক, কংকন নন্দী, অনীশ বড়–য়া, দিলীপ মালাকার, শেখ খুরশীদ আনোয়ার, হাবীব আহসান কোহিনূর, বিমল গুহ, নিতাই সেন, কাজী রফিক, সাগর চৌধুরী, প্রদীপ খাস্তগীর, সাথী দাশ, দীপংকর চক্রবর্তী, মাহমুদ-উল-আলম, মশউদ-উশ-শহীদ, আহমেদ খালেদ কায়সার, সৈয়দ আহমেদ তারেক, লুৎফুল হাসান, দীপকজ্যোতি আইচ, শিশির দত্ত, সন্তোষ ধর, ত্রিদিব দস্তিদার, ইসতিয়াক সানু, শাহবুদ্দীন নাগরী, ইফতেখার সাদিক, শ্যামল অদুদ, বিপ্লব বিজয়, সুদীপ্ত দেওয়ান, মাহবুবুর রহমান, জিয়া সফদার, মেহবুবা মোখলেস পারুল, নীলা আজম, নাসরীন সুলতানা, ফেরদৌসী বেগম, জিন্নাত আরা নাজমুন নাহার, মিনু পাটোয়ারী, নাইমা শেলী, শামীমা নাজ বাজালিয়া, জোহরা পারুল ইরা, মৃদুল গুহ, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল হোসেন সরকার, মীনাকুমারী দাশ, প্রদীপ খাস্তগীর, মুশফিক হোসেইন, কাসাহো সাকু, খালিদ আহসান, আসাদ মান্নান, মিনার মনসুর, প্রণয় মজুমদার, আবসার হাবীব, নুরুন্নাহার শিরীন, ফাউজুল কবির, অমিত চৌধুরী, কমলেশ দাশগুপ্ত, সুখময় চক্রবর্তী, অভীক ওসমান, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, আইউব সৈয়দ, ওমর কায়সার, রাশেদ রউফ, ইউসুফ মুহম্মদ, অজয় দাশগুপ্ত, আশরাফ আল দীন, আকতার হোসাইন, অরুণ সেন, জিয়া সফদার প্রমুখ।

চট্টগ্রাম শহর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তখন আমার জাগ্রত স্বপ্নের অংশ। মানুষের মন এবং মানুষের জীবন নরম মাটির মতো, যে-রকম আকার দেয়া হবে সেরকম হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে না-পড়ে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়লে একরকম হতো; গণিত বিভাগে পড়লে একরকম হতো- তবে বেশি হেরফের হতো না, কারণ আমি সাহিত্য নিয়েই হয়তো থাকতাম। বাংলা বিভাগে পড়াতে সাহিত্যের বিষয়ে সময় দেয়া যেমন সহজতর হয়েছে, যোগাযোগের ব্যাপারটাও সহজ হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, যাঁরা অতীতে বা সমসাময়িককালে সাহিত্যচর্চা করেছেন, তাঁরা যে সবাই সাহিত্যের ছাত্র তেমনটি নয়, এবং তেমনটি হওয়ার কথাও নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ- তা হলো সাহিত্যের পরিবেশ। সেটা পারিবারিকভাবে থাকলেও হয়।

সাহিত্য বা শিল্পর্চ্চা- পদ্ধতিগত পাঠ নিয়ে শুরু করতে হয়, এমন নয় মোটেই। পাঠ নিতে হয় জীবনের। সাহিত্যের যে-কৌশল তা সাহিত্যপাঠে শিখে নিতে কোনো অসুবিধা নেই, তার জন্য স্কুল কলেজের বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রয়োজন অতি আবশ্যক নয়। আমার বেলায় বিষয়টি সহজতর হয়েছে যে বললাম, তা দোটানার মধ্যে না-থাকা। সাহিত্যজীবনের এত সময় পার করে এসে বুঝলাম- সাহিত্য জিনিসটা কী? সাহিত্য উপলব্ধির বিষয় এবং সেই উপলব্ধির প্রকাশই সৃজন। প্রকাশভঙ্গি নিজের মতো হতে বাধা নেই। বাধা হলো- আমি যদি আমার মতো প্রকাশ করি, আমার সৃষ্টিটা আমার বোধে শতভাগ জারিত হবে। যদি অন্যের কথা ভাবি, পাঠকের কথা- সেক্ষেত্রে সবাই মিলে পাঠকের উপযোগী একটা পদ্ধতি বা কৌশল ঠিক করে নেয়ার দরকার হয়। তবে সাহিত্যের প্রকাশ অবশেষে নিজভঙ্গিতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে বলেছেন, “সেটা অন্তরের উপলব্ধি থেকে; বাইরের অভিজ্ঞতা বা বিশ্লেষণ থেকে নয়। কবিতা জিনিসটা ভিতরের একটা তাগিদ, কিসের তাগিদ সেই কথাটাই নিজেকে প্রশ্ন করেছি। যা উত্তর পেয়েছি সেটাকে সহজ করে বলা সহজ নয়।” এতে পরিষ্কার- সাহিত্য আত্ম-উপলব্ধি ও আত্মগত তাগিদের প্রকাশ। আমাদের সঙ্গে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেছেন, তাদের সবাই তো সাহিত্যে পড়াশোনা করে আসেননি। কিন্তু সাহিত্যে তাঁদের অবদান উল্লেখযোগ্য। তা সবকালেই হয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সারা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক জোয়ার বয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো- ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশালে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করতেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে। তাই সাহিত্যের খবর পেয়ে যেতাম আমরা। ছোটকাগজ- যাকে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলতে আমরা অভ্যস্ত, সব জেলাশহর থেকেই কম-বেশি বের হতো। শহরের বুকস্টলগুলিতে আমরা তা পেয়ে যেতাম। সাহিত্যপত্রিকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রকাশিত হতো- অচিরা, এপিটাফ, কবিতা, কলতান, কিংশুক, নিসর্গ, পদাতিক, বলাকা, বালার্ক, স্পার্ক জেনারেশন, কল্লোল, কালক্রম, কিছুদিন রৌদ্রের মুখোমুখি, তিমির হননের গান, পদাতিক, দ্রৌপদী, লিরিক, যুবরাজ প্রভৃতি। নতুন লেখক সৃষ্টির ক্ষেত্রে এসব পত্রিকার ভূমিকা অপরিসীম। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাঙালির যে আবেগ- তা ধরে রাখে কে? যেন সম্মিলিতভাবে কবিতায় মনোনিবেশ করেছে পুরো জাতি। তাই প্রতি জেলাশহরে অসংখ্য কবির আবির্ভাব লক্ষ্য করা গেছে সে-সময়। এটা স্পষ্ট যে, স্বাধীনতার পরে সারাদেশে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। এতেই কি বাঙালির প্রকৃত মানসিকতা ফুটে ওঠে না? এটা সত্যি যে, কোনোকালেই সবকবি শেষাবধি টিকে থাকে না। কিন্তু কবিতার ইতিহাসে তাঁদের সমবেত প্রয়াসের একটা মূল্য অবশ্যই থাকবে। এঁরা কালের গর্বিত সন্তান, এঁরা বাংলা কবিতায় এনেছিলেন সোনালি রোদ্দুর। (সমাপ্ত)

বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৪ শাওয়াল ১৪৪৩

আমার সময় ও চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গন

বিমল গুহ

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

গ্রামে শিক্ষার হার বাড়ছে। আমাদের ছোটবেলায় আমরা হাতেগোনা চার-পাঁচজন উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলাম। গ্রামের মানুষজন আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল বলে প্রাথমিক পর্যায়ে ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়তো বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। এই ক’বছরে বেশ উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে বাজালিয়া গ্রামে আরও একটি নতুন উচ্চবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। নাম- শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়। প্রবীণ রাজনীতিবিদ শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেরেবাংলা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানেরও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় প্রধান নেতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।

আমাদের সময়ে বাজালিয়া গ্রামে একটিই মাত্র উচ্চ বিদ্যালয় ছিলো- বাজালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৩৯ সালে, আজ থেকে ৮১ বছর আগে। গ্রামের শিক্ষানুরাগী আলহাজ্ব আকামত আলী চৌধুরী এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিরাট দীঘির পাড়ে মনোরম পরিবেশে এটি প্রতিষ্ঠিত। লোকজন বলতো ‘উত্তর দীঘি’। হতে পারে বাজালিয়ার উত্তরপ্রান্ত-সীমায় এর অবস্থান- তাই এই নাম। অন্যপাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাজালিয়া সরকারি প্রাইমারি স্কুল। এই স্কুলের দূরত্ব আমাদের বাড়ি থেকে দুই মাইলের বেশি। এই দীর্ঘপথ হেঁটে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পড়তে আসতো! আমিও আসতাম। আরও দূর থেকেও আসতো কেউ কেউ। পুরানগড় থেকে আসতো, মাহালিয়া থেকেও আসতো।

আমাদের বাবা সবসময় সন্তানদের উচ্চশিক্ষা, এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণের কথা ভাবতেন। আমরা ভাইবোনেরা সবাই- আমি, নির্মল, নিয়তি ও অমল উচ্চশিক্ষা নিয়েছি বাবা বেঁচে থাকতেই। তিনি বেঁচে থাকতেই মুক্তিযুদ্ধের শহিদ আমার জ্যেঠতুতো বড়ভাই ব্রজগোপাল গুহের দুই ছেলে- রতন ও উত্তম, মেয়ে মিনু উচ্চশিক্ষিত হয়েছে। আজ বাবাকে খুব মনে পড়ে। যখন ভাবি, আমাদের সন্তানও লেখাপড়ায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখছে; বন্ধুদেরকে আনন্দের সঙ্গে, গর্বের সঙ্গে বলি- বলতে ইচ্ছে করে। আমাদের মা-বাবার বেলায়ও তাই ছিলো নিশ্চয়! গ্রামের উন্নয়ন, গরীবদের ভালোমন্দ দেখা, আমাদের পরিবারের সকলের ও গ্রামের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তা থাকতো তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয় হল-এ আমাকে চিঠি লিখতেন। একবার লিখলেন, ‘রতন-উত্তম লেখাপড়া করে না; এদেরকে শহরে নিয়ে যাও’। রতন-উত্তম আমার জ্যেঠতুতো ভাই মুক্তিযুদ্ধের শহিদ ব্রজগোপাল গুহের দুইছেলে। বাবার বড় চিন্তা একটাই- সবাই লেখাপড়া শিখে কখন মানুষ হবে! সন্তানেরা, নাতি-নাতনিরা লেখাপড়ায় শিক্ষিত হলে পরিবারের সুনাম যেমন হবে, জীবনক্ষেত্রে নিজেরাও প্রতিষ্ঠিত হবে।

বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৮৬ সালের ১ লা মে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে গ্রামে কিছু করা দরকার মনে করেছি আমরা। নির্মল বিদেশে থাকাতে ছোটভাই অমলকে নিয়েই আমার যত পরিকল্পনা। শিক্ষানুরাগী পিতার স্মৃতিরক্ষার্থে আমরা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করি ‘বাজালিয়া প্রসন্ন গুহ প্রাইমারি স্কুল’। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো আমার স্ত্রী মীনা। আমার বাবার নাম প্রসন্ন গুহ শোনার পর, তার নাকি তার পৈত্রিক গ্রাম রাউজান থানার সুলতানপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘প্রসন্ন প্রাইমারি’র কথা মনে পড়ে যেতো। আমাকে একবার সেই স্কুলটি দেখাতেও নিয়ে গিয়েছিলো। দেখেছি বেশ বড় স্কুল; নাম- প্রসন্ন প্রাইমারি স্কুল। স্কুলটির পাশে মীনার মামার বাড়ি। সে আরও বলেছিলো, মামার বাড়িতে গেলে তারা প্রসন্ন প্রাইমারি স্কুলের মাঠে খেলতে যেতো। স্কুলটি এলাকার স্মৃতি হয়ে ঠিকে আছে। বলে- তোমরাও তো বাবার নামে স্কুল করতে পারো- প্রসন্ন প্রাইমারি স্কুল। আমরাও গর্ব করে বলতে পারবো!

ভাবছিলাম বাবার নামে একটি স্কুল করা যায় কীভাবে! অবশেষে গ্রামে শিক্ষানুরাগী পিতার স্মৃতিস্মারক একটি স্কুল এবং একটি কলেজ করতে উদ্যোগী হলাম আমি আর ছোটভাই অমল। এলাকাবাসীকে ডেকে সেরকম সিদ্ধান্তও হয়েছিলো। অনেক চেষ্টায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। জমি রেজিস্ট্রি করে দিলাম আমি আর অমল। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯১ সালে। আমরা স্কুলের নাম দিলাম- বাজালিয়া প্রসন্ন গুহ প্রাইমারি স্কুল। পরে একসময় স্কুলটি সরকারি হয়ে যায়। নাম হয়- বাজালিয়া প্রসন্ন গুহ সরকারি প্রাইমারি স্কুল। স্কুলটি

বর্তমানে নি¤œমাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এখন পাঠদান করা হয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছোটভাই অমল গুহ প্রভূত শ্রম দিয়েছে। পিতার স্মৃতিরক্ষাকল্পে নির্মিত স্কুলটি আমাদের পরিবারের গৌরব যেমন বহন করে চলেছে, একই সঙ্গে এলাকায় শিক্ষার আলো বিস্তার করছে। আমাদের ভাবনায় আছে, কীভাবে মাধ্যমিক স্কুলে উন্নীত করা যায়। কলেজটি আমরা আর করতে পারিনি। আমাদের উদ্যোগের সূত্র ধরে বাজালিয়া গ্রামে কর্নেল অলি আহমদ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটাও বাজালিয়া গ্রামের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা সহজে গ্রামে থেকেই উচ্চশিক্ষালাভে সমর্থ হচ্ছে। সেই গ্রামটি এখন আর অজপাড়াগাঁ নেই, এটি চট্টগ্রাম জেলার উন্নত ও শিক্ষিত এক আদর্শ গ্রামে রূপলাভ করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্য অনেক গ্রামের মতো আমাদের গ্রামেরও রয়েছে অনেক বড় অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনার গুলিতে এই গ্রামে আমার বড়ভাই ব্রজগোপাল গুহসহ মোট ১২ জন শহিদ হন। অন্যরা হলেন- কবিরাজ রমণীরঞ্জন নাথ, ধীরেন্দ্রনাথ মল্লিক সাধু, পুলিনচন্দ্র দাশ, কামিনীমোহন নাথ, অশ্বিনীকুমার নাথ সাধু, মদনমোহন নাথ, মোহাম্মদ রশীদ আহমদ, বংশী মালাকার, অনঙ্গমোহন নাথ, মণীন্দ্রলাল শুক্লদাস ও অনিলচন্দ্র শুক্লদাস। গ্রামের এই অবদান ধরে রাখতে আমরা ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ‘স্মৃতিএকাত্তর’। বিষয়টা যখন মাথায় আসলো, ছোটভাই অমলসহ আলোচনা করে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করলাম। অমলকে বলেছিলাম, কাজটা দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে চাই অর্থাৎ আমি বেঁচে থাকতে-থাকতে। এর কারণ হলো, আমাদের পাড়া থেকে- আশুতোষ নাথ, প্রফুল্লরঞ্জন দাশ ও আমি একসঙ্গে বড় হয়েছি। এপাড়ার আমরাই প্রথম শিক্ষিত অগ্রজ। ওরা দুজন ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুজনই আমার বছর তিন/চারেকের বড়। এখন চলে যাবার সিরিয়াল আমার। তাই আমি একাজ সম্পন্ন করে দেখে যেতে চাই। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধে এ পাড়ার তথা বাজালিয়া গ্রামের অবদানের কোনো চিহ্নও হয়তো একদিন থাকবে না, এবং পরে তা আর করাও হবে না। ছোটভাই অমলও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিলো। সে তার সহকর্মী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের স্থপতি শাহিনূল ইসলাম খানকে দিয়ে একটি নকশা করিয়ে নেয়। আমরা দুইভাইয়ের একান্ত চেষ্টায় স্মৃতিসৌধটি অবশেষে নির্মিত হলো। এই স্থাপনা নির্মাণের পেছনে পুরো কৃতিত্ব অমলের। সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তা নির্মাণের যাবতীয় কাজ তদারকি করেছে। সে না-হলে এটি এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হতো না। যে স্থানে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে, প্রসন্ন গুহ প্রাইমারি স্কুলপ্রাঙ্গণে, সেখানে আমাদের বড়ভাইসহ আরও দুজনকে মাটির গর্ত করে সমাধিস্থ করা হয়েছে। সে-অর্থে স্থানটা বধ্যভূমি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পুরোদমে চলছে। আমি তখন প্রথমবর্ষ বাংলা অনার্স শ্রেণির ছাত্র। বেশ ভালো লাগছে নতুন ক্লাস। নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছি। বাংলা বিভাগে কেমন একটা মাদকতা আছে- ক্লাসে না-গিয়ে থাকা যায় না। ছোটো বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করালে সে যেমন নতুন বন্ধু পেয়ে যায়, তখন আর বাড়িতে থাকতে চায় না- তেমনি অবস্থা হয়েছে আমার। শুধু স্কুলই চোখে ভাসে, সহপাঠীদের কথা ভাবি, সাহিত্যের মাদকতা যেন পেয়ে বসেছে। আমি যেদিন প্রথম ক্লাসে যোগদান করি, তখন প্রথমবর্ষের ক্লাস ২/৩ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সহপাঠী বন্ধুরা এত ভালোবাসা দিয়েছে যে, তাদের সাহচর্য খুব ভালো লেগে গেলো। এটার একটা কারণ হতে পারে যে, আমি সাহিত্যের টানে গণিত বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষ থেকে একক্লাস নিচে প্রথমবর্ষে এসে ভর্তি হয়েছি। শিক্ষকগণও অনেক ¯েœহ করতেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমি হয়ে উঠলাম ক্লাসে অনেকের প্রিয়সাথি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের প্রথম অনার্স ব্যাচ এটি। আরও জানলাম, প্রাণের টানে মনের আবেগে ভালো ফলাফল করা অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে বাংলা বিভাগে। ক্লাসে ৭০/৭৫ জন ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে নিয়মিত কবিতা/গল্প লিখতো- কাজী রফিক, নিতাই সেন, মাহমুদ-উল-আলম, সাথী দাশ, আহমদ জাফর, দীপকজ্যোতি আইচ, মীনাকুমারী দাশ, লায়লা জামান, রোকসানা শামীম, আবদুস সামাদ, রওশন আরা, মুকুল সেন, গোলাম ফেরদৌস, ওয়ালী আহসান ধনু, মোজাম্মেল হক, জান্নাত সুলতানা। আমিও ছিলাম তাদের সঙ্গে। পরে কুমিল্লা থেকে এসে এমএ ক্লাসে যোগ দিয়েছিলো আনোয়ারুল হক। একটি শ্রেণিতে একসঙ্গে এতজন নবীন সাহিত্যিক- অভাবনীয় ঘটনা বটে!

স্বাধীনতার পরে-পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে, বাংলাদেশের সেরা বাংলা বিভাগ বললে খুব বাড়িয়ে বলা হয় না? বিভাগে তখন শিক্ষক ছিলেন- সৈয়দ আলী আহসান, আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, আবদুল আওয়াল, মাহমুদ শাহ কোরেশী, মনিরুজ্জামান, দেলোয়ার হোসেন, ভুবনমোহন অধিকারী, চৌধুরী জহুরুল হক, হায়াৎ মামুদ, মাহবুব তালুকদার, খালেদা হানুম, খায়রুল বাশার; আমাদের শেষবর্ষে এসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন- শাহজাহান মুনীর, শামসুল আলম, শিপ্রা দস্তিদার, ভূঁইয়া ইকবাল প্রমুখ। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক। তাঁরা এত খ্যাতিমান যে, আলাদা করে তাঁদের সম্পর্কে বলার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলা বিভাগে আমাদের আগে-পরে আরও সাহিত্যচর্চা করতেন- মোহাম্মদ আশরাফ, মায়া দে, ময়ুখ চৌধুরী, দিলীপ মালাকার, নৃপেন দাশ, আলতাফ হোসেন, এবং আমার পরের ক্লাসে- ছায়া দে, জাকির হোসেন বুলবুল, মোহাম্মদ ইসকান্দার, আনন্দমোহন রক্ষিত, প্রণয় মজুমদার, সুখময় চব্রবর্তী, অমিত চৌধুরী, খালিদ আহসান প্রমুখ। এছাড়া অন্য বিভাগের যারা আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যচর্চা করতেন তারা হলেন- কঙ্কন নন্দী, অনীশ বড়–য়া, সুজিত দত্ত, বাবুল পাটোয়ারী, শাহাবুদ্দীন নাগরী, তৌহিদ আহমেদ, শিশির দত্ত প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে আবুল হোসেন কবিতা লিখতেন। তিনি একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন ‘হরিৎ শস্যের গান’ নামে।

প্রথমবর্ষের ক্লাস আমি বেশিদিন পাইনি, কয়েক মাসের মধ্যে উঠে গেছি দ্বিতীয় বর্ষে। আমাদের পড়াশোনা এবং সাহিত্যচর্চা সমানতালে চলছিলো। আমরা তখন রাজনীতি সচেতনও। সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনীতির প্রধান ধারা ছিলো- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ। ১৯৭৩ সালে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা যখন হচ্ছিলো। তখন সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনে হাওয়া বইছে। আমি ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’-এর সঙ্গে যুক্ত। তবে সক্রিয় রাজনীতি করতাম না, সক্রিয় ছিলাম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে। আমি যখন গণিত বিভাগের ছাত্র, তখন শাহজালাল হলের আবাসিক ছাত্র। যখন প্রথমবর্ষ বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম, তখন আমাকে দেয়া হলো শাহ আমানত হল। এ এক বিড়ম্বনার ব্যাপার! আমি থাকি এক হলে, এখন সংযুক্ত করা হলো অন্য হলে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিলো নির্বাচনী হাওয়া। আমি নির্বাচনের ব্যাপারেও আগ্রহী না, সাহিত্য নিয়ে থাকতে আগ্রহী। আমি তখন বাড়ি গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। দুইদিন পর হলে ফিরে দেখি পোস্টার ব্যানারে আমার নাম। শাহ আমানত হলের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আমি ‘সাহিত্য সম্পাদক’ পদে প্রার্থী। নেতাদের জিজ্ঞাসা করলাম। বলে- চুপ থাকো তোমাকে এ পদে দাঁড়াতে হবে। আমার জন্য শাখে-করাত অবস্থা। শাহ আমানত হলে একটা সিটও আমার নামে বণ্টন করা হয়েছে। আর এদিকে শাহজালাল হলের যে-কক্ষে থাকতাম, তা অন্যের নামে বরাদ্দ হয়ে গেছে। নির্বাচন হয়ে গেলো। আমি হেরে গেলাম। অবশ্য সামান্য ভোটের ব্যবধানে। এই ‘অবশ্য’ শব্দটিতে আফসোসের গন্ধ পাওয়া গেলেও- হেরে গিয়ে আমার রক্ষা! যদি জিততাম, তা হলে আম-ছালা দুটোই যেতো। এখন আমি আমার আবাসিক হল পরিবর্তন করে আবার শাহজালাল হলে চলে গেলাম। এর মধ্যে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠে গেছি। আবার সিঙ্গেল রুমের জন্য আবেদন করলাম। এবার চাইলাম ৪০২ নং কক্ষ। কারণ আমার আগের গণিত বিভাগের সহপাঠী বাবুল বসাক এমএসসি ফাইনালে; আর আমি অনার্স ফাইনালে। অপেক্ষা করলাম ৪০২ নং কক্ষটি খালি হওয়া পর্যন্ত। ওদিকে ছোটভাই নির্মলও হিসাববিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ফাইনালে- সেও একই হলে থাকে।

আমরা অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী অর্থাৎ শেষবর্ষের। আমাদের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা যারা নিয়মিত লেখালিখি করে তারা ১৭/১৮ জন; আর জুনিয়র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আছে ৪/৫জন। বিভাগে দুটি সাহিত্য সংগঠন তখন- ‘সাহিত্য সংসদ’ ও ‘হিন্দোল সংসদ’। সকলকে নিয়ে ২৩-১১-১৯৭৪ তারিখে এক সভা ডাকা হলো। সভায় সর্বসম্মতভাবে দুটি সংগঠন ভেঙে দিয়ে বৃহত্তর আকারে গঠন করা হলো- ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পরিষদ’। আমাকে মনোনীত করা হলো সংগঠনের সভাপতি, আর দ্বিতীয়বর্ষ থেকে মোহম্মদ ইস্কান্দার হলেন সাধারণ সম্পাদক। কোষাধ্যক্ষ সহপাঠী নিতাই সেন। সদস্য- কাজী রফিক, মাহমুদ-উল-আলম, ওয়ালী আহসান ধনু, দীপকজ্যোতি আইচ, আহমেদ জাফর, লায়লা জামান টুকু, রোকসানা শামীম, ছায়া দে, জাকির হোসেন বুলবুল প্রমুখ। সংগঠনের উপদেষ্টা হলেন বিভাগের শিক্ষক- আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আবুল কামাল মনজুর মোরশেদ, ভূঁইয়া ইকবাল ও এমএ শেষবর্ষের ছাত্র ময়ুখ চৌধুরী। আমরা প্রথম সাহিত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করলাম চট্টগ্রাম শহরের ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট হল’-এ বড় আকারে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের সাহিত্যপিপাসু লোকজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তখন চট্টগ্রামের সাহিত্যের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, কবিতাপাঠ, গান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকা- নিয়মিত হতে থাকে। আমরা তখন ‘কবি’ হয়ে উঠছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হয়েছে তখন- ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’ ও ‘অনেক সূর্যের আশা’। এই দুইটি সংগঠনের আয়োজনে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে আমাদের তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে মাতিয়ে রেখেছিলো। এক্ষেত্রে মাহমুদুল হাসান, আশরাফুল হক ও মহিউদ্দিন শাহআলম নিপুর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। সে সময়ে চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক সাহিত্য সংগঠন ‘স্পার্ক জেনারেশন’ গঠিত হয়েছিলো- ১৯৭৩ সালের ২রা ডিসেম্বর। আয়োজক- হেনা ইসলাম, স্বপন দত্ত, শেখ খুরশীদ আনোয়ার, সৈয়দ ইকবাল, কাজী রফিক ও শিশির দত্ত। তাও বেশ আলোড়ন তুলেছিলো। সে-সময় ময়ুখ চৌধুরীর সম্পাদনায় বের হয়েছিলো কবিতা সংকলন ‘অসভ্য শব্দ’। সে সংকলনটিও বেশ আলোচিত হয়েছিলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম শহর হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম শহরে গঠিত হয় আরও কিছু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন- ‘ছড়া সাহিত্য পরিষদ’; ‘থিয়েটার ৭৩’; ‘অরিন্দম’ ও ‘তীর্থক’ নাট্যগোষ্ঠী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতেও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজমান ছিলো। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্য যা কাম্য হওয়া উচিত, তাই। চট্টগ্রাম শহর সাহিত্যের, বিশেষ করে কবিতা ও নাটকের তীর্থভূমির মতো হয়ে উঠলো। আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় আমরা অতিবাহিত করেছি এক সুন্দর আবহে। বাংলাদেশে ঢাকার পরে চট্টগ্রাম এক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলো। সে-সময় চট্টগ্রামে যাঁরা কবিতাচর্চা করতেন, তাঁদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন- সৈয়দ আলী আহসান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আল মাহমুদ, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনিরুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ, আফজাল চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, জিয়া হায়দার, মুর্তজা বশীর, অরুণ দাশগুপ্ত, ভুবনমোহন অধিকারী, দিলওয়ার হোসেন, আ.ফ.ম. সিরাজউদ্দোলা চৌধুরী, শামসুল আলম সাঈদ, রণজিৎকুমার চক্রবর্তী, তপনজ্যোতি বড়–য়া প্রমুখ। এঁরা কেউ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনারত; কেউ চট্টগ্রামে অন্য চাকুরিরত ছিলেন।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গনে দলবেঁধে কবিতা লিখতে এসেছিলেন- মেজবাহ খান, রফিক ভূইয়া, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, আবুল মোমেন, স্বপন দত্ত, ময়ুখ চৌধুরী, মোস্তফা ইকবাল, আশরাফুল হক, কংকন নন্দী, অনীশ বড়–য়া, দিলীপ মালাকার, শেখ খুরশীদ আনোয়ার, হাবীব আহসান কোহিনূর, বিমল গুহ, নিতাই সেন, কাজী রফিক, সাগর চৌধুরী, প্রদীপ খাস্তগীর, সাথী দাশ, দীপংকর চক্রবর্তী, মাহমুদ-উল-আলম, মশউদ-উশ-শহীদ, আহমেদ খালেদ কায়সার, সৈয়দ আহমেদ তারেক, লুৎফুল হাসান, দীপকজ্যোতি আইচ, শিশির দত্ত, সন্তোষ ধর, ত্রিদিব দস্তিদার, ইসতিয়াক সানু, শাহবুদ্দীন নাগরী, ইফতেখার সাদিক, শ্যামল অদুদ, বিপ্লব বিজয়, সুদীপ্ত দেওয়ান, মাহবুবুর রহমান, জিয়া সফদার, মেহবুবা মোখলেস পারুল, নীলা আজম, নাসরীন সুলতানা, ফেরদৌসী বেগম, জিন্নাত আরা নাজমুন নাহার, মিনু পাটোয়ারী, নাইমা শেলী, শামীমা নাজ বাজালিয়া, জোহরা পারুল ইরা, মৃদুল গুহ, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল হোসেন সরকার, মীনাকুমারী দাশ, প্রদীপ খাস্তগীর, মুশফিক হোসেইন, কাসাহো সাকু, খালিদ আহসান, আসাদ মান্নান, মিনার মনসুর, প্রণয় মজুমদার, আবসার হাবীব, নুরুন্নাহার শিরীন, ফাউজুল কবির, অমিত চৌধুরী, কমলেশ দাশগুপ্ত, সুখময় চক্রবর্তী, অভীক ওসমান, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, আইউব সৈয়দ, ওমর কায়সার, রাশেদ রউফ, ইউসুফ মুহম্মদ, অজয় দাশগুপ্ত, আশরাফ আল দীন, আকতার হোসাইন, অরুণ সেন, জিয়া সফদার প্রমুখ।

চট্টগ্রাম শহর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তখন আমার জাগ্রত স্বপ্নের অংশ। মানুষের মন এবং মানুষের জীবন নরম মাটির মতো, যে-রকম আকার দেয়া হবে সেরকম হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে না-পড়ে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়লে একরকম হতো; গণিত বিভাগে পড়লে একরকম হতো- তবে বেশি হেরফের হতো না, কারণ আমি সাহিত্য নিয়েই হয়তো থাকতাম। বাংলা বিভাগে পড়াতে সাহিত্যের বিষয়ে সময় দেয়া যেমন সহজতর হয়েছে, যোগাযোগের ব্যাপারটাও সহজ হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, যাঁরা অতীতে বা সমসাময়িককালে সাহিত্যচর্চা করেছেন, তাঁরা যে সবাই সাহিত্যের ছাত্র তেমনটি নয়, এবং তেমনটি হওয়ার কথাও নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ- তা হলো সাহিত্যের পরিবেশ। সেটা পারিবারিকভাবে থাকলেও হয়।

সাহিত্য বা শিল্পর্চ্চা- পদ্ধতিগত পাঠ নিয়ে শুরু করতে হয়, এমন নয় মোটেই। পাঠ নিতে হয় জীবনের। সাহিত্যের যে-কৌশল তা সাহিত্যপাঠে শিখে নিতে কোনো অসুবিধা নেই, তার জন্য স্কুল কলেজের বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রয়োজন অতি আবশ্যক নয়। আমার বেলায় বিষয়টি সহজতর হয়েছে যে বললাম, তা দোটানার মধ্যে না-থাকা। সাহিত্যজীবনের এত সময় পার করে এসে বুঝলাম- সাহিত্য জিনিসটা কী? সাহিত্য উপলব্ধির বিষয় এবং সেই উপলব্ধির প্রকাশই সৃজন। প্রকাশভঙ্গি নিজের মতো হতে বাধা নেই। বাধা হলো- আমি যদি আমার মতো প্রকাশ করি, আমার সৃষ্টিটা আমার বোধে শতভাগ জারিত হবে। যদি অন্যের কথা ভাবি, পাঠকের কথা- সেক্ষেত্রে সবাই মিলে পাঠকের উপযোগী একটা পদ্ধতি বা কৌশল ঠিক করে নেয়ার দরকার হয়। তবে সাহিত্যের প্রকাশ অবশেষে নিজভঙ্গিতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে বলেছেন, “সেটা অন্তরের উপলব্ধি থেকে; বাইরের অভিজ্ঞতা বা বিশ্লেষণ থেকে নয়। কবিতা জিনিসটা ভিতরের একটা তাগিদ, কিসের তাগিদ সেই কথাটাই নিজেকে প্রশ্ন করেছি। যা উত্তর পেয়েছি সেটাকে সহজ করে বলা সহজ নয়।” এতে পরিষ্কার- সাহিত্য আত্ম-উপলব্ধি ও আত্মগত তাগিদের প্রকাশ। আমাদের সঙ্গে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেছেন, তাদের সবাই তো সাহিত্যে পড়াশোনা করে আসেননি। কিন্তু সাহিত্যে তাঁদের অবদান উল্লেখযোগ্য। তা সবকালেই হয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সারা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক জোয়ার বয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো- ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশালে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করতেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে। তাই সাহিত্যের খবর পেয়ে যেতাম আমরা। ছোটকাগজ- যাকে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলতে আমরা অভ্যস্ত, সব জেলাশহর থেকেই কম-বেশি বের হতো। শহরের বুকস্টলগুলিতে আমরা তা পেয়ে যেতাম। সাহিত্যপত্রিকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রকাশিত হতো- অচিরা, এপিটাফ, কবিতা, কলতান, কিংশুক, নিসর্গ, পদাতিক, বলাকা, বালার্ক, স্পার্ক জেনারেশন, কল্লোল, কালক্রম, কিছুদিন রৌদ্রের মুখোমুখি, তিমির হননের গান, পদাতিক, দ্রৌপদী, লিরিক, যুবরাজ প্রভৃতি। নতুন লেখক সৃষ্টির ক্ষেত্রে এসব পত্রিকার ভূমিকা অপরিসীম। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাঙালির যে আবেগ- তা ধরে রাখে কে? যেন সম্মিলিতভাবে কবিতায় মনোনিবেশ করেছে পুরো জাতি। তাই প্রতি জেলাশহরে অসংখ্য কবির আবির্ভাব লক্ষ্য করা গেছে সে-সময়। এটা স্পষ্ট যে, স্বাধীনতার পরে সারাদেশে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। এতেই কি বাঙালির প্রকৃত মানসিকতা ফুটে ওঠে না? এটা সত্যি যে, কোনোকালেই সবকবি শেষাবধি টিকে থাকে না। কিন্তু কবিতার ইতিহাসে তাঁদের সমবেত প্রয়াসের একটা মূল্য অবশ্যই থাকবে। এঁরা কালের গর্বিত সন্তান, এঁরা বাংলা কবিতায় এনেছিলেন সোনালি রোদ্দুর। (সমাপ্ত)