বহুমাত্রিক কলমযোদ্ধা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলাম লেখক, একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯ মে বৃহস্পতিবার লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। একজন খ্যাতিমান কলমযোদ্ধার জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে একটি জীবন্ত ইতিহাসেরও পরিসমাপ্তি ঘটল।

তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন; ডাক্তার আগাম মৃত্যু সংবাদ দিয়েছিলেন, ডাক্তারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। স্বাধীনতার পর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বেছে নেন লন্ডনের স্থায়ী প্রবাস জীবন। অজানা এক ভাইরাসের আঘাতে তার স্ত্রীর শরীর অবশ হয়ে যায়, পরিশেষে তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। টানা চল্লিশ বছর তিনি হুইলচেয়ারেই কাটিয়েছেন। দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকার পর ২০১২ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে গাফফার চৌধুরী লন্ডন প্রবাসী। অসুস্থ স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে জীবননির্বাহ করতে গিয়ে তাকে লন্ডনের গ্রোসারি শপেও কাজ করতে হয়েছে। এখন জীবিত এক পুত্র ও তিন কন্যার সবাই উচ্চশিক্ষিত। মাত্র এক মাস আগে তার আরেক মেয়ে বিনীতার অকাল মৃত্যু হয়েছে। তার বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলা কংগ্রেস কমিটি ও খেলাফত কমিটির সভাপতি ছিলেন।

লন্ডনে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুললেও তিনি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। প্রবাসে থেকেও নিজের লেখনীর মাধ্যমে তিনি মুক্তবুদ্ধি এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে লিখেছেন কলাম-গল্প-কবিতা-উপন্যাস। বহুমাত্রিক কলমযোদ্ধা আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় যোগদান করার পর থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। তারপর তিনি কাজ করেছেন খায়রুল কবিরের দৈনিক সংবাদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মাসিক সওগাত, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক, মওলানা আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ, হামিদুল হক চৌধুরীর দৈনিক পূর্বদেশে। তিনি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায়ও এক সময় নিয়মিত লিখতেন। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে তিনি বর্তমান ঘটনার সঙ্গে অতীত ঘটনার সামঞ্জস্য খুঁজে নিতেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ও স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’র প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, এক্ষেত্রে কোন আপোষ করেননি। বিরোধী আদর্শের পাঠক তার লেখাকে পক্ষপাতপূর্ণ বলে গণ্য করলেও লেখার অকাট্য যুক্তি খ-ন করার সামর্থ্য ছিল না তাদের, তাই বিরোধী পক্ষও তার লেখা পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। লেখার ক্ষেত্রে তার মধ্যে কোন ভ-ামি ছিল না, তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা নির্ভয় ও নিঃসংকোচে লিখতেন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য সমাজের একটা শ্রেণী তাকে সহ্য করতে পারত না। শুধু তাই নয়, তিনি পুলিশের কলাবাগানের মাঠ দখলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ক্ষমতা-প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে গিয়ে পরীমনির পাশে দাঁড়িয়েছেন। সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণের জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন হেফাজতের উস্কানি, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িকতাকে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে তার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত আওয়ামী লীগ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার কাছে আত্মসমর্পণকারী একটি রাজনৈতিক দল।

ব্রিটিশ-ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নানা ইতিহাসের সাক্ষী আবদুল গাফফার চৌধুরী। ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি লিখেই বাঙালি জাতির হৃদয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন। গানটিতে ভাষাসৈনিক আব্দুল লতিফ প্রথম সুরারোপ করলেও শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরারোপে এ গানটির যে মাধুর্য ফুটে উঠেছে তা অনবদ্য। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অতি প্রত্যুষে এই গান গাইতে গাইতে প্রভাতফেরি করে বাংলাদেশের মানুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা সবার কণ্ঠে গানটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। ২০০৬ সনে বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এই গানটি তৃতীয় স্থানে নির্বাচিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৫টি ভাষায় অনূদিত এই গানটি এখন বিশ্বের নানা ভাষায় গাওয়া হয়।

তিনি যেমন দেশ ও জাতিকে অকুণ্ঠচিত্তে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অংশীদার করেছেন, দেশ এবং জাতিও তাকে সম্মান-পদক-পুরস্কার সমভাবে ফেরত দিয়েছে; তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, মানিক মিয়া পদক, যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা উপাধি, বঙ্গবন্ধু পুরস্কারসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি পাঠক সমাজের কাছে নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছেন, আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন, নিন্দা-প্রশংসা সবই কুড়িয়েছেন। মতার্দশ বিরোধী পাঠক তার যুক্তি খ-নের অক্ষমতায় তাকে ঈর্ষা ও হিংসা করতেন। যুক্তি খ-নে অসমর্থ শক্তি শুধু উচ্চারণ করতÑ ‘লিখতে হলে দেশে এসে লিখুন, বিদেশে বসে কেন?’ যারা এমন বলতেন তাদের অনেকে এখন বিদেশে অবস্থান করে পাঠক এবং দর্শকদের অহর্নিশ সবক দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে বুঝতে চান না যে, লেখায় সারবস্তুটাই মুখ্য, লেখকের বসতি নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিন দিন অশ্লীল হয়ে উঠছে, যুক্তি দিয়ে খ-ন না করে বিরুদ্ধ মতকে কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ক্ষেত্রেও একই অপপ্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে বারবার, কিন্তু তিনি থামেননি, কোনো অবস্থাতেই দমে যাননি।

আমার সৌভাগ্য যে, আমি বড়মাপের এই মানুষটির দেখা পেয়েছি, কয়েকটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন পেশার বন্ধু-বান্ধব ও ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বিনোদনমূলক আড্ডার আয়োজনে তার সমতুল্য আমি কাউকে দেখিনি। তার উত্তরার বাড়ির আঙিনায় দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের এক সময় নিয়মিত আসর বসত। সাত-আট বছর পূর্বে গাফফার চৌধুরী যতবারই লন্ডন থেকে দেশে এসেছেন ততবারই মেজো ভাই তার সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন। এ আয়োজনে থাকতেন সাংবাদিক বজলুর রহমান, ড. আনিসুজ্জমান, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মতিয়া চৌধুরীসহ দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিরা। আমার দায়িত্ব ছিল তাদের মোয়া, মুড়ি, বরই, বাতাসা এবং চা দিয়ে আপ্যায়ন করা। কয়েকবার গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছি, কিন্তু প্রতিবারই আমাকে বলতে হতোÑ ‘আমি মহিউদ্দিনের ছোটভাই’। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ ওই সব আয়োজনে আমি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলাম না। শেষবার যখন একটি অভিজাত হোটেলে টিভি চ্যানেল বাংলা টিভির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা হয় তখনো চিনতে পারেননি, সাংবাদিক জাকির হোসেন দিদার আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয় পাওয়ার পর তিনি আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘তুমি যে মহিউদ্দিনের ছোটভাই তা অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবও জানেন এবং আমার সঙ্গে তার কথা প্রসঙ্গে তিনি তোমার প্রশংসা করেছেন।’ এত আলাপের মধ্যে আমি কখনো একবারও বলিনি যে ‘আমি আপনার লেখার ভক্ত’।

লেখার প্রতি আমার অনুরাগ-বিরাগ থাকলেও পাঠক হিসেবে আমি সর্বভুক- সময় থাকলে সব লেখাই পড়ি। পত্রিকা হাতে নিয়ে আমি প্রথম পড়তাম উপসম্পাদকীয়- আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’, জহুর হোসেন চৌধুরীর ‘দরবার-ই-জহুর’, সন্তোষ গুপ্তের ‘অনিরুদ্ধের কলাম’, খন্দকার আব্দুল হামিদের ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’, সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘সহজিয়া কড়চা’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সময় বহিয়া যায়’ এবং মহিউদ্দিন আহমদের ‘একাত্তরের ঝর্ণাতলায়’। এছাড়াও ড. আহমেদ শরীফ, ড. হুমায়ূন আজাদ, খন্দকার মনিরুজ্জমান, বিভুরঞ্জন সরকারের লেখাও আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। গাফফার চৌধুরী তার লেখার সমর্থনে মৃত ব্যক্তির রেফারেন্স বেশি দিতেন বলে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার লেখার প্রতি আমি একটু বেশি অনুরক্ত ছিলাম। সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বা টাকশালের নির্বাহী প্রধান থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তার ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ডকু-ড্রামাটি প্রজেক্টর দিয়ে বড়পর্দায় দেখিয়েছিলাম, দর্শক আগ্রহ পায়নি, মনে হয়েছে এই ডকু-ড্রামা তার সফল সৃষ্টি নয়।

আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু আদর করে নাকি ‘মুসিবত’ বলে ডাকতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ এই যুগন্ধর সাংবাদিকের প্রয়াণে গভীর শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করছি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

রবিবার, ২৯ মে ২০২২ , ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৭ শাওয়াল ১৪৪৩

বহুমাত্রিক কলমযোদ্ধা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলাম লেখক, একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯ মে বৃহস্পতিবার লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। একজন খ্যাতিমান কলমযোদ্ধার জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে একটি জীবন্ত ইতিহাসেরও পরিসমাপ্তি ঘটল।

তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন; ডাক্তার আগাম মৃত্যু সংবাদ দিয়েছিলেন, ডাক্তারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। স্বাধীনতার পর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বেছে নেন লন্ডনের স্থায়ী প্রবাস জীবন। অজানা এক ভাইরাসের আঘাতে তার স্ত্রীর শরীর অবশ হয়ে যায়, পরিশেষে তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। টানা চল্লিশ বছর তিনি হুইলচেয়ারেই কাটিয়েছেন। দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকার পর ২০১২ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে গাফফার চৌধুরী লন্ডন প্রবাসী। অসুস্থ স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে জীবননির্বাহ করতে গিয়ে তাকে লন্ডনের গ্রোসারি শপেও কাজ করতে হয়েছে। এখন জীবিত এক পুত্র ও তিন কন্যার সবাই উচ্চশিক্ষিত। মাত্র এক মাস আগে তার আরেক মেয়ে বিনীতার অকাল মৃত্যু হয়েছে। তার বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলা কংগ্রেস কমিটি ও খেলাফত কমিটির সভাপতি ছিলেন।

লন্ডনে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুললেও তিনি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। প্রবাসে থেকেও নিজের লেখনীর মাধ্যমে তিনি মুক্তবুদ্ধি এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে লিখেছেন কলাম-গল্প-কবিতা-উপন্যাস। বহুমাত্রিক কলমযোদ্ধা আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। ১৯৫০ সালে দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় যোগদান করার পর থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। তারপর তিনি কাজ করেছেন খায়রুল কবিরের দৈনিক সংবাদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মাসিক সওগাত, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক, মওলানা আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ, হামিদুল হক চৌধুরীর দৈনিক পূর্বদেশে। তিনি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায়ও এক সময় নিয়মিত লিখতেন। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে তিনি বর্তমান ঘটনার সঙ্গে অতীত ঘটনার সামঞ্জস্য খুঁজে নিতেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ও স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’র প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, এক্ষেত্রে কোন আপোষ করেননি। বিরোধী আদর্শের পাঠক তার লেখাকে পক্ষপাতপূর্ণ বলে গণ্য করলেও লেখার অকাট্য যুক্তি খ-ন করার সামর্থ্য ছিল না তাদের, তাই বিরোধী পক্ষও তার লেখা পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। লেখার ক্ষেত্রে তার মধ্যে কোন ভ-ামি ছিল না, তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা নির্ভয় ও নিঃসংকোচে লিখতেন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য সমাজের একটা শ্রেণী তাকে সহ্য করতে পারত না। শুধু তাই নয়, তিনি পুলিশের কলাবাগানের মাঠ দখলের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ক্ষমতা-প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে গিয়ে পরীমনির পাশে দাঁড়িয়েছেন। সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণের জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন হেফাজতের উস্কানি, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িকতাকে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে তার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত আওয়ামী লীগ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার কাছে আত্মসমর্পণকারী একটি রাজনৈতিক দল।

ব্রিটিশ-ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের নানা ইতিহাসের সাক্ষী আবদুল গাফফার চৌধুরী। ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি লিখেই বাঙালি জাতির হৃদয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন। গানটিতে ভাষাসৈনিক আব্দুল লতিফ প্রথম সুরারোপ করলেও শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরারোপে এ গানটির যে মাধুর্য ফুটে উঠেছে তা অনবদ্য। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অতি প্রত্যুষে এই গান গাইতে গাইতে প্রভাতফেরি করে বাংলাদেশের মানুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা সবার কণ্ঠে গানটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। ২০০৬ সনে বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এই গানটি তৃতীয় স্থানে নির্বাচিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৫টি ভাষায় অনূদিত এই গানটি এখন বিশ্বের নানা ভাষায় গাওয়া হয়।

তিনি যেমন দেশ ও জাতিকে অকুণ্ঠচিত্তে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অংশীদার করেছেন, দেশ এবং জাতিও তাকে সম্মান-পদক-পুরস্কার সমভাবে ফেরত দিয়েছে; তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, মানিক মিয়া পদক, যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা উপাধি, বঙ্গবন্ধু পুরস্কারসহ দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি পাঠক সমাজের কাছে নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছেন, আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন, নিন্দা-প্রশংসা সবই কুড়িয়েছেন। মতার্দশ বিরোধী পাঠক তার যুক্তি খ-নের অক্ষমতায় তাকে ঈর্ষা ও হিংসা করতেন। যুক্তি খ-নে অসমর্থ শক্তি শুধু উচ্চারণ করতÑ ‘লিখতে হলে দেশে এসে লিখুন, বিদেশে বসে কেন?’ যারা এমন বলতেন তাদের অনেকে এখন বিদেশে অবস্থান করে পাঠক এবং দর্শকদের অহর্নিশ সবক দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে বুঝতে চান না যে, লেখায় সারবস্তুটাই মুখ্য, লেখকের বসতি নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিন দিন অশ্লীল হয়ে উঠছে, যুক্তি দিয়ে খ-ন না করে বিরুদ্ধ মতকে কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ক্ষেত্রেও একই অপপ্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে বারবার, কিন্তু তিনি থামেননি, কোনো অবস্থাতেই দমে যাননি।

আমার সৌভাগ্য যে, আমি বড়মাপের এই মানুষটির দেখা পেয়েছি, কয়েকটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন পেশার বন্ধু-বান্ধব ও ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বিনোদনমূলক আড্ডার আয়োজনে তার সমতুল্য আমি কাউকে দেখিনি। তার উত্তরার বাড়ির আঙিনায় দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের এক সময় নিয়মিত আসর বসত। সাত-আট বছর পূর্বে গাফফার চৌধুরী যতবারই লন্ডন থেকে দেশে এসেছেন ততবারই মেজো ভাই তার সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন। এ আয়োজনে থাকতেন সাংবাদিক বজলুর রহমান, ড. আনিসুজ্জমান, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মতিয়া চৌধুরীসহ দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিরা। আমার দায়িত্ব ছিল তাদের মোয়া, মুড়ি, বরই, বাতাসা এবং চা দিয়ে আপ্যায়ন করা। কয়েকবার গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছি, কিন্তু প্রতিবারই আমাকে বলতে হতোÑ ‘আমি মহিউদ্দিনের ছোটভাই’। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ ওই সব আয়োজনে আমি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলাম না। শেষবার যখন একটি অভিজাত হোটেলে টিভি চ্যানেল বাংলা টিভির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা হয় তখনো চিনতে পারেননি, সাংবাদিক জাকির হোসেন দিদার আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয় পাওয়ার পর তিনি আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘তুমি যে মহিউদ্দিনের ছোটভাই তা অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবও জানেন এবং আমার সঙ্গে তার কথা প্রসঙ্গে তিনি তোমার প্রশংসা করেছেন।’ এত আলাপের মধ্যে আমি কখনো একবারও বলিনি যে ‘আমি আপনার লেখার ভক্ত’।

লেখার প্রতি আমার অনুরাগ-বিরাগ থাকলেও পাঠক হিসেবে আমি সর্বভুক- সময় থাকলে সব লেখাই পড়ি। পত্রিকা হাতে নিয়ে আমি প্রথম পড়তাম উপসম্পাদকীয়- আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’, জহুর হোসেন চৌধুরীর ‘দরবার-ই-জহুর’, সন্তোষ গুপ্তের ‘অনিরুদ্ধের কলাম’, খন্দকার আব্দুল হামিদের ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’, সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘সহজিয়া কড়চা’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সময় বহিয়া যায়’ এবং মহিউদ্দিন আহমদের ‘একাত্তরের ঝর্ণাতলায়’। এছাড়াও ড. আহমেদ শরীফ, ড. হুমায়ূন আজাদ, খন্দকার মনিরুজ্জমান, বিভুরঞ্জন সরকারের লেখাও আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। গাফফার চৌধুরী তার লেখার সমর্থনে মৃত ব্যক্তির রেফারেন্স বেশি দিতেন বলে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার লেখার প্রতি আমি একটু বেশি অনুরক্ত ছিলাম। সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বা টাকশালের নির্বাহী প্রধান থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তার ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ডকু-ড্রামাটি প্রজেক্টর দিয়ে বড়পর্দায় দেখিয়েছিলাম, দর্শক আগ্রহ পায়নি, মনে হয়েছে এই ডকু-ড্রামা তার সফল সৃষ্টি নয়।

আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু আদর করে নাকি ‘মুসিবত’ বলে ডাকতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ এই যুগন্ধর সাংবাদিকের প্রয়াণে গভীর শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করছি।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক