প্রসঙ্গ : উন্নয়ন

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

উন্নয়নের আভিধানিক অর্থ হলো, “কোন কিছু কাক্সিক্ষত পরির্বতন বা উত্তরণ”। বিশেষজ্ঞদের মতে উন্নয়নের অর্থ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশ তথা জাতিকে আধুনিকায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে দেশের সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা। অ্যাডাম স্মিথ জাতীয় উন্নয়ন বলতে সামগ্রিকভাবে পুঁজির সঞ্চায়নকে বুঝিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সামগ্রিক পুঁজির বিকাশ ঘটছে, তবে রাষ্ট্রীয় পুঁজি সংকোচিত হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তির (মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের) পুঁজি বা মূলধন বেড়ে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে, ফলে জিডিপির কলেবর হয়েছে বড়, আর এই কলেবরের গড়টা সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় হিসাবে এখন করা হয় গণ্য।

কেউ কেউ মনে করেন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই হলো জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাওয়া। মাথাপিছু আয়কে জাতীয় আয়ের উন্নয়ন হিসেবে গ্রহণ করাটা কতটা য়ৌক্তিক, তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ, জাতীয় মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে যে ফলটা বের হয়, তা হলো মাথাপিছু আয়। এর ফলে যে অঙ্কটা বের হয়ে আসে তার সুফলটা কি সব মানুষ সমানভাবে ভোগ করতে পারে? বর্তমানে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের প্রবৃদ্ধির পুনর্বণ্টনকে সূত্র ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যা দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশের সব শিল্প কারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন ছিল। সেই সময় শিল্প থেকে প্রাপ্ত আয়টা হত রাষ্ট্রের সুতরাং রাষ্ট্র যে আয়টা করত তা হতো জনগণের আয়। তাই ওই সূত্রানুসারে মাথাপিছু আয় হিসাব করাটা বর্তমানে কতটা যুক্তিযুক্ত হবে? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন সব শিল্পকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। তাই শিল্পকারখানার আয়টা কতিপয় মানুষ ভোগ করছে। তাই বাংলাদেশে আয় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে, কিছু মানুষ গড়ে তুলছেন সম্পদের পাহাড় আর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী দরিদ্রতার দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তাই গড় আয়কে উন্নয়নের সূচক হিসেবে গণ্য করাটা সমীচীন হবে না।

কারন শ্রীলঙ্কার সাবেক জিডিপির দিকে নজর দিলেই তা বোঝা যায়। শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ছিল ৩৮১৮ ডলার। বিশাল আকারের জাতীয় আয় অর্জন করেছিল শ্রীলঙ্কা। তাহলে হঠাৎ করে কেন তাদের অর্থনৈতিক ধস? কারণ, সামগ্রিকভাবে দেশটির সব মানুষের আয় সমানভাবে বাড়েনি। যাদের বেড়েছিল তারা অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয়। ফলে অভ্যান্তরীণ অর্থ প্রবাহটা কমে যায়।

উন্নয়নের সঙ্গানুসারে বাংলাদেশের সঞ্চয় বা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকসমূহের মূলধন কতটা বেড়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করা দরকার। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ২১ সাল শেষে মূলধন ঘাটতি ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। গত বছর ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৫০ গুণ বা ১৩৫ শতাংশ বেশি ঘাটতি। বিভিন্ন তথ্য থেকে এটাও জানা যায় য়ে, দেশে রেমিট্যান্স আসার গতিটা অনেক কমে গেছে। করোনাকালীন সময়ে (গত অর্থবছরে) রেমিট্যান্স বেড়েছিল ৩৪ শতাংশ এই অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে ২০ শতাংশ। অনেকেই বলছেন রেমিট্যান্স কমাই আমানত কমে যাওয়ার কারণ। তবে আগের ব্যাংকের আমানতের বিপুল অঙ্কের টাকা গেল কোথায়? যতই রেমিট্যান্স কমে যাক তারপর যেটুকু এসেছে, তা দিয়ে তো আমানত বাড়ার কথা।

চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমানত প্রবৃদ্ধি হার ছিল প্রায় ৪৬ শতাংশ। অপর দিকে গত অর্থবছরে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৫১ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মূলধন আসে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। তাই এই মূলধনের মালিক জনগণ। সুতরাং এই ঘাটতিটা জনগণের হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ২০২১ সালের ৩০ জুন বলেছেন, রাষ্ট্রের বর্তমানে বিদেশি ঋণের স্থিতির পরিমাণ ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় , দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ। এই হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ মাকির্ন ডলার। একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৮৩০ টাকা। অন্যদিকে প্রতি বছর বাংরাদেশে থেকে অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যার গড় পরিমাণ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। তাহলে উন্নয়নের সঙ্গানুসারে বাংলাদেশের সঞ্চয়ের বা আমনতের ক্ষেত্রে কতটা উন্নতি হলো?

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে তার মূল কারণ হলো এ দেশের শ্রম সস্তা তাই বিদেশিরা এখানে শিল্পকারখানা স্থাপন করে এদেশের শ্রম সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মুনাফাটা নিজ দেশে পাঠায়। দেশেজ বিনিয়োগ আসলে বাড়েনি কারণ প্রতি বছর ঋণ খেলাপি বাড়ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণের আশঙ্কাজনকভাবে খেলাপি হার বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর ঋণখেলাপি টাকার পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। খেলাপি বাড়ছে কিন্তু আদায় কমছে অস্বাভাবিক হারে। ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা এই বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের ১০ শতাংশই খেলাপি। তারপর অবলোপণ সংস্কৃতির কারণে মোট অনাদায়ী ঋণের প্রকৃত পরিমাণটাও জানা যায় না।

বিভিন্ন সেক্টরে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এই বাড়ার সুফল জনগণের ভাগ্যে জুটছে না কারণ এই উৎপাদনটার হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিজেএমসি (বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন) প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির আওতায় দেশের সব পাটকল গুলিকে জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭২ সালে বিজেএমসির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এ সংস্থাটির অন্তর্ভুক্ত পাটকলের সংখ্যা ছিল ৭০টি। ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়ায় মাত্র ২৫টি। বাকি ৪৫টি পাটকল ১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০২০ সারে বিজেএমসির ২৫টি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৫১৯ জন। বদলি তালিকাভুক্ত শ্রমিক ২২ হাজার ৯৯৮ জন, দৈনিক তালিকাভুক্ত শ্রমিক ৪ হাজার ৯১০ জন সব মিলিয়ে এই বন্ধ করা ২৫টি পাটকলে কাজ করেন দৈনিক গড়ে ২৭ হাজার ৯৫৭ জন শ্রমিক।

বিজেএমসির পাটকলগুলো বন্ধ করার ফলে কাজ হারালো প্রায় ২৮ হাজার মানুষ। মোট ৭০টি মিলের হিসাব করলে দেখা যাবে প্রায় দুই লাখ মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলোতে প্রায় দুই লাখের অধিক পদ বন্ধ হয়ে গেল। (১৯৭২ সালের শিল্পকারখানার হিসাব অনুযায়ী)। ২০২০ সালে বিজেএমসির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকার আর রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভুর্তকী দিবে না তাই বিজেএমসির অন্তর্ভুক্ত জুটমিলগুলো বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। উন্নয়ন হলে লোকসান বাড়ল কেন? উন্নয়নের সঙ্গানুসারে উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নয়ন আসলে কিছুই হয়নি? যোগাযোগ ব্যবস্থা রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্টের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তাছাড়া ইন্টারনেট সেবাসহ অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ বেড়েছে। কোন রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে সে দেশের প্রান্তিক মানুষেরা তার উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা বিশ্লেষণ করলে কি পাওয়া যায়।

বগুড়ার মহাস্থানগরে প্রতি কেজি যে পণ্য একজন কৃষক বিক্রি করেন দুই থেকে তিন টাকা দামে আর ওই পণ্য ঢাকার কারওয়ান বাজারে এসে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকা দামে। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গুলখালী ইউনিয়ন থেকে ঢাকা আসতে এখন আর তেমন সময় লাগে না, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হওয়ায় ফেরী পার হতে হয় না যেখানে ফেরি ছিল সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় সেতু। গুলখালীতে প্রান্তিক কৃষকরা এক কেজি তরমুজের দাম পায় ৪-৬ টাকা করে অথচ এই তরমুজ দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকা দামে। যোগাযোগের অভাবনীয় উন্নয়নে সাধারণ মানুষের বা প্রািন্তক জনগোষ্ঠীর কি লাভ হলো?

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

রবিবার, ২৯ মে ২০২২ , ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৭ শাওয়াল ১৪৪৩

প্রসঙ্গ : উন্নয়ন

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

উন্নয়নের আভিধানিক অর্থ হলো, “কোন কিছু কাক্সিক্ষত পরির্বতন বা উত্তরণ”। বিশেষজ্ঞদের মতে উন্নয়নের অর্থ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশ তথা জাতিকে আধুনিকায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে দেশের সঞ্চয়, বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা। অ্যাডাম স্মিথ জাতীয় উন্নয়ন বলতে সামগ্রিকভাবে পুঁজির সঞ্চায়নকে বুঝিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সামগ্রিক পুঁজির বিকাশ ঘটছে, তবে রাষ্ট্রীয় পুঁজি সংকোচিত হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তির (মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের) পুঁজি বা মূলধন বেড়ে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে, ফলে জিডিপির কলেবর হয়েছে বড়, আর এই কলেবরের গড়টা সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় হিসাবে এখন করা হয় গণ্য।

কেউ কেউ মনে করেন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই হলো জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাওয়া। মাথাপিছু আয়কে জাতীয় আয়ের উন্নয়ন হিসেবে গ্রহণ করাটা কতটা য়ৌক্তিক, তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ, জাতীয় মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে যে ফলটা বের হয়, তা হলো মাথাপিছু আয়। এর ফলে যে অঙ্কটা বের হয়ে আসে তার সুফলটা কি সব মানুষ সমানভাবে ভোগ করতে পারে? বর্তমানে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের প্রবৃদ্ধির পুনর্বণ্টনকে সূত্র ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যা দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশের সব শিল্প কারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন ছিল। সেই সময় শিল্প থেকে প্রাপ্ত আয়টা হত রাষ্ট্রের সুতরাং রাষ্ট্র যে আয়টা করত তা হতো জনগণের আয়। তাই ওই সূত্রানুসারে মাথাপিছু আয় হিসাব করাটা বর্তমানে কতটা যুক্তিযুক্ত হবে? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন সব শিল্পকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। তাই শিল্পকারখানার আয়টা কতিপয় মানুষ ভোগ করছে। তাই বাংলাদেশে আয় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে, কিছু মানুষ গড়ে তুলছেন সম্পদের পাহাড় আর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী দরিদ্রতার দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তাই গড় আয়কে উন্নয়নের সূচক হিসেবে গণ্য করাটা সমীচীন হবে না।

কারন শ্রীলঙ্কার সাবেক জিডিপির দিকে নজর দিলেই তা বোঝা যায়। শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ছিল ৩৮১৮ ডলার। বিশাল আকারের জাতীয় আয় অর্জন করেছিল শ্রীলঙ্কা। তাহলে হঠাৎ করে কেন তাদের অর্থনৈতিক ধস? কারণ, সামগ্রিকভাবে দেশটির সব মানুষের আয় সমানভাবে বাড়েনি। যাদের বেড়েছিল তারা অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয়। ফলে অভ্যান্তরীণ অর্থ প্রবাহটা কমে যায়।

উন্নয়নের সঙ্গানুসারে বাংলাদেশের সঞ্চয় বা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকসমূহের মূলধন কতটা বেড়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করা দরকার। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ২১ সাল শেষে মূলধন ঘাটতি ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। গত বছর ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৫০ গুণ বা ১৩৫ শতাংশ বেশি ঘাটতি। বিভিন্ন তথ্য থেকে এটাও জানা যায় য়ে, দেশে রেমিট্যান্স আসার গতিটা অনেক কমে গেছে। করোনাকালীন সময়ে (গত অর্থবছরে) রেমিট্যান্স বেড়েছিল ৩৪ শতাংশ এই অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে ২০ শতাংশ। অনেকেই বলছেন রেমিট্যান্স কমাই আমানত কমে যাওয়ার কারণ। তবে আগের ব্যাংকের আমানতের বিপুল অঙ্কের টাকা গেল কোথায়? যতই রেমিট্যান্স কমে যাক তারপর যেটুকু এসেছে, তা দিয়ে তো আমানত বাড়ার কথা।

চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমানত প্রবৃদ্ধি হার ছিল প্রায় ৪৬ শতাংশ। অপর দিকে গত অর্থবছরে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৫১ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মূলধন আসে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। তাই এই মূলধনের মালিক জনগণ। সুতরাং এই ঘাটতিটা জনগণের হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ২০২১ সালের ৩০ জুন বলেছেন, রাষ্ট্রের বর্তমানে বিদেশি ঋণের স্থিতির পরিমাণ ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় , দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ। এই হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ মাকির্ন ডলার। একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৮৩০ টাকা। অন্যদিকে প্রতি বছর বাংরাদেশে থেকে অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যার গড় পরিমাণ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। তাহলে উন্নয়নের সঙ্গানুসারে বাংলাদেশের সঞ্চয়ের বা আমনতের ক্ষেত্রে কতটা উন্নতি হলো?

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে তার মূল কারণ হলো এ দেশের শ্রম সস্তা তাই বিদেশিরা এখানে শিল্পকারখানা স্থাপন করে এদেশের শ্রম সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মুনাফাটা নিজ দেশে পাঠায়। দেশেজ বিনিয়োগ আসলে বাড়েনি কারণ প্রতি বছর ঋণ খেলাপি বাড়ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণের আশঙ্কাজনকভাবে খেলাপি হার বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর ঋণখেলাপি টাকার পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। খেলাপি বাড়ছে কিন্তু আদায় কমছে অস্বাভাবিক হারে। ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা এই বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা। মোট ঋণের ১০ শতাংশই খেলাপি। তারপর অবলোপণ সংস্কৃতির কারণে মোট অনাদায়ী ঋণের প্রকৃত পরিমাণটাও জানা যায় না।

বিভিন্ন সেক্টরে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু এই বাড়ার সুফল জনগণের ভাগ্যে জুটছে না কারণ এই উৎপাদনটার হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিজেএমসি (বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন) প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির আওতায় দেশের সব পাটকল গুলিকে জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭২ সালে বিজেএমসির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এ সংস্থাটির অন্তর্ভুক্ত পাটকলের সংখ্যা ছিল ৭০টি। ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়ায় মাত্র ২৫টি। বাকি ৪৫টি পাটকল ১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০২০ সারে বিজেএমসির ২৫টি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৫১৯ জন। বদলি তালিকাভুক্ত শ্রমিক ২২ হাজার ৯৯৮ জন, দৈনিক তালিকাভুক্ত শ্রমিক ৪ হাজার ৯১০ জন সব মিলিয়ে এই বন্ধ করা ২৫টি পাটকলে কাজ করেন দৈনিক গড়ে ২৭ হাজার ৯৫৭ জন শ্রমিক।

বিজেএমসির পাটকলগুলো বন্ধ করার ফলে কাজ হারালো প্রায় ২৮ হাজার মানুষ। মোট ৭০টি মিলের হিসাব করলে দেখা যাবে প্রায় দুই লাখ মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলোতে প্রায় দুই লাখের অধিক পদ বন্ধ হয়ে গেল। (১৯৭২ সালের শিল্পকারখানার হিসাব অনুযায়ী)। ২০২০ সালে বিজেএমসির পুঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকার আর রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভুর্তকী দিবে না তাই বিজেএমসির অন্তর্ভুক্ত জুটমিলগুলো বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। উন্নয়ন হলে লোকসান বাড়ল কেন? উন্নয়নের সঙ্গানুসারে উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নয়ন আসলে কিছুই হয়নি? যোগাযোগ ব্যবস্থা রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্টের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তাছাড়া ইন্টারনেট সেবাসহ অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ বেড়েছে। কোন রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে সে দেশের প্রান্তিক মানুষেরা তার উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা বিশ্লেষণ করলে কি পাওয়া যায়।

বগুড়ার মহাস্থানগরে প্রতি কেজি যে পণ্য একজন কৃষক বিক্রি করেন দুই থেকে তিন টাকা দামে আর ওই পণ্য ঢাকার কারওয়ান বাজারে এসে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকা দামে। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গুলখালী ইউনিয়ন থেকে ঢাকা আসতে এখন আর তেমন সময় লাগে না, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হওয়ায় ফেরী পার হতে হয় না যেখানে ফেরি ছিল সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় সেতু। গুলখালীতে প্রান্তিক কৃষকরা এক কেজি তরমুজের দাম পায় ৪-৬ টাকা করে অথচ এই তরমুজ দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকা দামে। যোগাযোগের অভাবনীয় উন্নয়নে সাধারণ মানুষের বা প্রািন্তক জনগোষ্ঠীর কি লাভ হলো?

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]