নারীর পোশাক পরার স্বাধীনতা ও কিছু প্রশ্ন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

নরসিংদী রেলস্টেশনে নিজ পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধান করার কারণে এক তরুণীকে হেনস্তা করায় মার্জিয়া আক্তার শিলা ওরফে সায়মা নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি পেশায় একজন ঘটক। মার্জিয়াকে আটকের আগে একই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় মুহাম্মদ ইসমাইল মিয়া নামক এক ব্যক্তি। নরসিংদী রেলস্টেশনে ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন হেনেস্তার তরুণী এবং দুই তরুণ। তরুণীর পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট এবং টপস। তরুণীর এ পোশাক দেখে স্টেশনে অবস্থানরত ঘটক মার্জিয়া প্রথমে ওই তরুণীর দিকে তেড়ে যায় এবং পরে আরও কয়েকজন ব্যক্তিসহ তরুণীর ওপর হামলা চালায়। হঠাৎ এমন হামলায় হতভম্ব হয়ে ভুক্তভোগী তরুণী দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেয়। তার সঙ্গে থাকা দুই তরুণকেও মারধর করার অভিযোগ রয়েছে।

উগ্রপন্থিরা যখন ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উত্থাপন করে নিজেরাই ব্লগারদের কতল করছিল তখন সরকার অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করছিল। উগ্রপন্থিদের প্রতি সরকারের এমন নমনীয় মনোভাবের জন্য গণতান্ত্রিক ভোট দায়ী, কারণ সরকার কোন প্রেসার গ্রুপকে ক্ষেপাতে চায় না। সরকারের এমন মনোভাব স্পষ্ট হওয়ার পর থেকে ধর্মের নামে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে কিছু লোক বিভিন্ন উছিলায় উগ্রতা দেখাচ্ছে। কপালে টিপ পরা নিয়ে ব্যঙ্গোক্তি করা হচ্ছে, স্কুলের ছাত্ররা ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে মিছিল করছে, সেøাগান দিচ্ছে, শিক্ষককে নানাবিধ প্রশ্ন করে বেকায়দায় ফেলে হেনস্তা করার চেষ্টা করছে। এই ছাত্রদের অনেকে হয়তো ধর্মের মূল বিষয়গুলোও জানার চেষ্টা করে না, কিন্তু ধর্মীয় ইস্যুতে উগ্রতা প্রদর্শনে তারা একাট্টা। উগ্রতা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শুধু একজনের প্ররোচনাই যথেষ্ট, কারণ এসব অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে ধর্মকে টেনে আনা হয়, কেউ ‘নাস্তিক’ নামে আখ্যায়িত হওয়ার ভয়ে ধর্মের নামে অধর্মের বিরোধিতা করার সাহস করে না।

কোরআনের নির্দেশনা হচ্ছেÑ নারীরা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সম্মুখে তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না, তারা তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ আবৃত করে রাখবে। পাসহ ঢেকে রাখার জন্য মেয়েদের ওড়না বা চাদর সর্বোচ্চ এক হাত ঝুলিয়ে রাখার কথা হাদিসে আছে। কিন্তু মাথা বা কাঁধ থেকে সর্বোচ্চ এক হাত ঝুলিয়ে রাখা চাদর দিয়ে পা কিভাবে ঢেকে রাখা সম্ভব তা বোধগম্য নয়। নারীদের পোশাক নিয়ে কিছু লোক খুব সংবেদনশীল হলেও সর্বজনস্বীকৃত কোন পোশাক আজও ধর্ম মেনে নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। মুখম-ল ঢাকার কথা কোরআনে নেই, বোরকার কথা কোরআনে নেই, হিজাবের কথা কোরআনে নেই, আছে চাদর পরিধানের কথা। কিন্তু কিছু আলেমের ব্যাখ্যায় চাদর পরিধান করার নির্দেশনার অর্থই হচ্ছে মুখম-লসহ পরিপূর্ণ পর্দা। এই পর্দা কিন্তু হজ এবং ওমরার এহরাম অবস্থায় পালন করা হয় না, এ সময় মহিলাদের চেহারা উন্মুক্ত রাখা ওয়াজিব। আবার যারা হিজাব পরেন তাদের অধিকাংশ মুখম-ল উন্মুক্ত রেখে দেন।

সূরা নূরের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘তারা যেন তাদের স্বামী ছাড়া অন্যের সামনে তাদের সাজ-সজ্জা প্রকাশ না করে।’ স্বামী ছাড়া অন্য কারো কাছে যেহেতু সৌন্দর্য প্রদর্শন করা যাবে না সেহেতু মুখ ঢেকে রাখা ব্যতীত গত্যন্তর নেই, কারণ নারীর সৌন্দর্য অনেকটা তাদের চেহারার সৌন্দর্যের উপরে নির্ভর করে। তাই নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া ধর্মসম্মত কিনা তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। অবশ্য ঘরের ভেতরে থাকলেও পর্দা মেনে চলা অপরিহার্য, ধর্ম অনুযায়ী নারীর জন্য দেবরও মৃত্যু সমতুল্য। ঘরের ভেতর পর্দা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরপুরুষের সঙ্গে ফেসবুকে বার্তার আদান-প্রদান করা বা চ্যাটিং সবই তো হারাম। মাওলানা রাজ্জাক নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখার পক্ষে, তার কথা অনুযায়ী স্ত্রীর প্রধান কাজ ধর্ম পালন করা এবং স্বামীর সেবা করা। মাওলানা রাজ্জাকের কথার ভিত্তি আছে, কারণ নারীদের গোপন সৌন্দর্য যাতে প্রকাশ হয়ে না পড়ে সেজন্য সজোরে পদচারণা করা পবিত্র কোরআনে নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নারীদের পদচারণায় রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে উঠে, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত সেøাগানে ধরণী কেঁপে উঠে। তবে ওরাও প্রেসার গ্রুপ, সমাজের উগ্ররা ওদের বিরুদ্ধে লাগতে যায় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র ইসলামে নেই, কিন্তু ইসলামপন্থী দলগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকে। নারীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেও ইসলামপন্থি কিছু রাজনৈতিক দল পরে আপস করেছে; অর্থাৎ স্বার্থের পক্ষে হলে এরা ধর্মের বিরুদ্ধে যেতেও কসুর করে না।

নরসিংদী রেলস্টেশনে যে ঘটক নারী আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেয়েকে নাজেহাল করল তার মুখ কিন্তু ঢাকা ছিল না, হাতের কব্জি ও পায়ের গোড়ালি ঢাকার জন্য মোজা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই ভদ্রমহিলা একজন ঘটক, ঘটককে অপরিচিত পরপুরুষের সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে হয়, পেশার কারণে বেশিরভাগ ঘটককে মিথ্যা কথা বলতে হয়। অন্যদিকে যে কয়েকজন স্থানীয় যুবক তরুণী মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের একজনেরও টাকনুর উপরে পোশাক পরিধান করা ছিল না, অথচ ধর্মের নির্দেশনা হচ্ছে, যে ব্যক্তি অহঙ্কার বশে পায়ের গোড়ালির নিচে কাপড় ঝুলিয়ে চলবে আল্লাহ কিয়ামত দিবসে তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করবেন না। তাহলে ঘটক মার্জিয়াসহ যে পুরুষেরা বিজাতীয় পোশাক পরার দায়ে মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারাও তো ধর্মের নির্দেশনা মেনে পোশাক পরেননি।

ধর্ম অনুযায়ী মানুষের চিরশত্রু হচ্ছে শয়তান। নারী-পুরুষের পারস্পরিক হাসি-ঠাট্টা ও কথা-বার্তার মধ্যে শয়তান প্রবেশ করে পুরুষকে নারীর প্রতি আসক্ত করে তোলে। শয়তানের অপকর্ম স্থান ভেদে কিভাবে পার্থক্য হয় তা পাঠককে জানাতে ইচ্ছে করছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মৃত্যুদ-ে দ-িত, তিনি এখন পলাতক। এক সময় তিনি কোন একটি টিভি চ্যানেলে ধর্মীয় বিষয়ে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। লন্ডন থেকে এক বাঙালি মুসলমানের মাওলানা আজাদের কাছে প্রশ্ন ছিলোÑ ‘লন্ডনে বাস-ট্রামে ভ্রমণকালীন বা রাস্তায় বের হলে মেয়েদের যে পোশাকে দেখি তাতে উত্তেজনা ফিল করি, ওজু ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।’ মাওলানা সাহেব উত্তরে বললেন, ‘খোলামেলা পোশাকে মেয়ে দেখে আপনি যদি এত দুর্বল হয়ে পড়েন তাহলে আপনার নাসারাদের দেশে যাওয়া ঠিক হয়নি, ওই সব দেশে মেয়েরা উলঙ্গ থাকলেও পুরুষেরা কোন আগ্রহ নিয়ে তাকায় না, আপনি এত তাকান কেন? আপনি দেশে ফেরত আসুন।’ মাওলানা সাহেবের কথায় মনে হলো ওই সব দেশে শয়তান পুরুষকে কাবু করতে পারে না।

মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী নারীর প্রতি কামুক দৃষ্টিতে তাকানো হারাম, তাহলে আমাদের দেশে নারীর খোলামেলা পোশাক দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কামাসক্ত হয়ে উঠে কেন? যে পুরুষকে দৃষ্টি অবনত রাখতে বলা হয়েছে সেই পুরুষ নারীর অঙ্গসৌষ্ঠবের সৌন্দর্য অবলোকন করার কথা নয়, নারীর শরীরের দিকে লোলুপদৃষ্টিতে যিনি তাকাবেন তিনি অবশ্যই ধর্মের নির্দেশনা লঙ্ঘনের জন্য দায়ী হবেন। ধর্ম নারীদের পোশাকের ব্যাপারে বেশি কনসার্ন। রাস্তার মাঝখান দিয়ে নারীদের চলার অধিকার ধর্ম দেয়নি, তাদের বলা হয়েছে রাস্তার কিনার দিয়ে চলাচল করতে। নারী যতই পর্দা করুক, যতই রাস্তার কিনার দিয়ে চলাফেরা করুক, তার চোখ কিন্তু খোলা থাকে; এক্ষেত্রে পুরুষের সৌন্দর্য দেখে নারীর কামভাব জাগতে পারে। পুরুষও যদি নারীদের মতো পর্দা করত তাহলে কোন ফ্যাসাদ হতো না।

মানুষ সৃষ্টির পরপরই কিন্তু ধর্মগ্রন্থ আসেনি, ধর্ম এসেছে অনেক পরে। লক্ষ লক্ষ বছর মানুষ উলঙ্গ ছিল। গাছের পাতা বা বাকল দিয়ে দেহের কিয়দংশ ঢাকার প্রচলন হয়েছে খুব বেশি দিন আগে নয়। এখনো অনেক নৃগোষ্ঠী আছে যারা উলঙ্গ থাকে। মেয়েদের উর্ধাংশ অনাবৃত রাখার সংস্কৃতি বহু নৃগোষ্ঠী লালন ও পালন করে। এই উলঙ্গ থাকা বা মেয়েদের বক্ষাদেশ অনাবৃত রাখার মধ্যে তারা কোন লজ্জাবোধ করে না, কারণ তাদের মধ্যে এমন লজ্জাবোধের সৃষ্টিই হয়নি। পশু-পাখির কোন পোশাক নেই, পোষা প্রাণীকে কিছু মানুষ পোশাক পরিয়ে কৃত্রিমভাবে সভ্য করতে চায়।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ২১৫ বছর পূর্বে ভারতের কেরালার পুরুষ রাজা ত্রিভাঙ্কুরের জারি করা আইন নিয়ে একটি কাহিনী পড়েছি। তার জারি করা আইন অনুযায়ী ব্রাহ্মণ ব্যতীত হিন্দুধর্মের অন্য কোনো নারী তার স্তন অনাবৃত রাখতে পারত না, স্তন ঢাকলেই তাকে কর দিতে হতো।

অনেকের ধারণা, পর্দাহীনতার কারণে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, ব্যভিচারের উদ্ভব; কিন্তু তা যদি সত্য হতো তাহলে শিশুরা ধর্ষণ ও বলাৎকারের শিকার হতো না। পোশাক দেখে নারীদের বিচার করা কিছু মানুষের বিকৃত মানসিকতা ও মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ, এ অপরাধ অঙ্কুরে ধ্বংস না হলে লিঙ্গ সমতা কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের কোন জাতীয় পোশাক নেই; আমাদের জাতীয় পোশাক না থাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাপানে গিয়ে রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তালেবান শাসিত আফগানিস্তান নারীদের পোশাক পরিধান নিয়ে কঠোর আইন করলেও আমাদের সংবিধান নারী বা পুরুষের জন্য কোন নির্দিষ্ট পোশাক নির্ধারণ করে দেয়নি; বরং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে, বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে কোন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না এবং একই কারণে কাউকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধও করা যাবে না। প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে শালিনতা বজায় রেখে তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধানের।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ১২ জুন ২০২২ , ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১১ জিলকদ ১৪৪৩

নারীর পোশাক পরার স্বাধীনতা ও কিছু প্রশ্ন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

নরসিংদী রেলস্টেশনে নিজ পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধান করার কারণে এক তরুণীকে হেনস্তা করায় মার্জিয়া আক্তার শিলা ওরফে সায়মা নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি পেশায় একজন ঘটক। মার্জিয়াকে আটকের আগে একই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় মুহাম্মদ ইসমাইল মিয়া নামক এক ব্যক্তি। নরসিংদী রেলস্টেশনে ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন হেনেস্তার তরুণী এবং দুই তরুণ। তরুণীর পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট এবং টপস। তরুণীর এ পোশাক দেখে স্টেশনে অবস্থানরত ঘটক মার্জিয়া প্রথমে ওই তরুণীর দিকে তেড়ে যায় এবং পরে আরও কয়েকজন ব্যক্তিসহ তরুণীর ওপর হামলা চালায়। হঠাৎ এমন হামলায় হতভম্ব হয়ে ভুক্তভোগী তরুণী দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেয়। তার সঙ্গে থাকা দুই তরুণকেও মারধর করার অভিযোগ রয়েছে।

উগ্রপন্থিরা যখন ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উত্থাপন করে নিজেরাই ব্লগারদের কতল করছিল তখন সরকার অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করছিল। উগ্রপন্থিদের প্রতি সরকারের এমন নমনীয় মনোভাবের জন্য গণতান্ত্রিক ভোট দায়ী, কারণ সরকার কোন প্রেসার গ্রুপকে ক্ষেপাতে চায় না। সরকারের এমন মনোভাব স্পষ্ট হওয়ার পর থেকে ধর্মের নামে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে কিছু লোক বিভিন্ন উছিলায় উগ্রতা দেখাচ্ছে। কপালে টিপ পরা নিয়ে ব্যঙ্গোক্তি করা হচ্ছে, স্কুলের ছাত্ররা ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে মিছিল করছে, সেøাগান দিচ্ছে, শিক্ষককে নানাবিধ প্রশ্ন করে বেকায়দায় ফেলে হেনস্তা করার চেষ্টা করছে। এই ছাত্রদের অনেকে হয়তো ধর্মের মূল বিষয়গুলোও জানার চেষ্টা করে না, কিন্তু ধর্মীয় ইস্যুতে উগ্রতা প্রদর্শনে তারা একাট্টা। উগ্রতা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শুধু একজনের প্ররোচনাই যথেষ্ট, কারণ এসব অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে ধর্মকে টেনে আনা হয়, কেউ ‘নাস্তিক’ নামে আখ্যায়িত হওয়ার ভয়ে ধর্মের নামে অধর্মের বিরোধিতা করার সাহস করে না।

কোরআনের নির্দেশনা হচ্ছেÑ নারীরা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সম্মুখে তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না, তারা তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ আবৃত করে রাখবে। পাসহ ঢেকে রাখার জন্য মেয়েদের ওড়না বা চাদর সর্বোচ্চ এক হাত ঝুলিয়ে রাখার কথা হাদিসে আছে। কিন্তু মাথা বা কাঁধ থেকে সর্বোচ্চ এক হাত ঝুলিয়ে রাখা চাদর দিয়ে পা কিভাবে ঢেকে রাখা সম্ভব তা বোধগম্য নয়। নারীদের পোশাক নিয়ে কিছু লোক খুব সংবেদনশীল হলেও সর্বজনস্বীকৃত কোন পোশাক আজও ধর্ম মেনে নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। মুখম-ল ঢাকার কথা কোরআনে নেই, বোরকার কথা কোরআনে নেই, হিজাবের কথা কোরআনে নেই, আছে চাদর পরিধানের কথা। কিন্তু কিছু আলেমের ব্যাখ্যায় চাদর পরিধান করার নির্দেশনার অর্থই হচ্ছে মুখম-লসহ পরিপূর্ণ পর্দা। এই পর্দা কিন্তু হজ এবং ওমরার এহরাম অবস্থায় পালন করা হয় না, এ সময় মহিলাদের চেহারা উন্মুক্ত রাখা ওয়াজিব। আবার যারা হিজাব পরেন তাদের অধিকাংশ মুখম-ল উন্মুক্ত রেখে দেন।

সূরা নূরের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘তারা যেন তাদের স্বামী ছাড়া অন্যের সামনে তাদের সাজ-সজ্জা প্রকাশ না করে।’ স্বামী ছাড়া অন্য কারো কাছে যেহেতু সৌন্দর্য প্রদর্শন করা যাবে না সেহেতু মুখ ঢেকে রাখা ব্যতীত গত্যন্তর নেই, কারণ নারীর সৌন্দর্য অনেকটা তাদের চেহারার সৌন্দর্যের উপরে নির্ভর করে। তাই নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া ধর্মসম্মত কিনা তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। অবশ্য ঘরের ভেতরে থাকলেও পর্দা মেনে চলা অপরিহার্য, ধর্ম অনুযায়ী নারীর জন্য দেবরও মৃত্যু সমতুল্য। ঘরের ভেতর পর্দা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরপুরুষের সঙ্গে ফেসবুকে বার্তার আদান-প্রদান করা বা চ্যাটিং সবই তো হারাম। মাওলানা রাজ্জাক নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখার পক্ষে, তার কথা অনুযায়ী স্ত্রীর প্রধান কাজ ধর্ম পালন করা এবং স্বামীর সেবা করা। মাওলানা রাজ্জাকের কথার ভিত্তি আছে, কারণ নারীদের গোপন সৌন্দর্য যাতে প্রকাশ হয়ে না পড়ে সেজন্য সজোরে পদচারণা করা পবিত্র কোরআনে নিষিদ্ধ। কিন্তু রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নারীদের পদচারণায় রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে উঠে, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত সেøাগানে ধরণী কেঁপে উঠে। তবে ওরাও প্রেসার গ্রুপ, সমাজের উগ্ররা ওদের বিরুদ্ধে লাগতে যায় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র ইসলামে নেই, কিন্তু ইসলামপন্থী দলগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকে। নারীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেও ইসলামপন্থি কিছু রাজনৈতিক দল পরে আপস করেছে; অর্থাৎ স্বার্থের পক্ষে হলে এরা ধর্মের বিরুদ্ধে যেতেও কসুর করে না।

নরসিংদী রেলস্টেশনে যে ঘটক নারী আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেয়েকে নাজেহাল করল তার মুখ কিন্তু ঢাকা ছিল না, হাতের কব্জি ও পায়ের গোড়ালি ঢাকার জন্য মোজা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই ভদ্রমহিলা একজন ঘটক, ঘটককে অপরিচিত পরপুরুষের সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে হয়, পেশার কারণে বেশিরভাগ ঘটককে মিথ্যা কথা বলতে হয়। অন্যদিকে যে কয়েকজন স্থানীয় যুবক তরুণী মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের একজনেরও টাকনুর উপরে পোশাক পরিধান করা ছিল না, অথচ ধর্মের নির্দেশনা হচ্ছে, যে ব্যক্তি অহঙ্কার বশে পায়ের গোড়ালির নিচে কাপড় ঝুলিয়ে চলবে আল্লাহ কিয়ামত দিবসে তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করবেন না। তাহলে ঘটক মার্জিয়াসহ যে পুরুষেরা বিজাতীয় পোশাক পরার দায়ে মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারাও তো ধর্মের নির্দেশনা মেনে পোশাক পরেননি।

ধর্ম অনুযায়ী মানুষের চিরশত্রু হচ্ছে শয়তান। নারী-পুরুষের পারস্পরিক হাসি-ঠাট্টা ও কথা-বার্তার মধ্যে শয়তান প্রবেশ করে পুরুষকে নারীর প্রতি আসক্ত করে তোলে। শয়তানের অপকর্ম স্থান ভেদে কিভাবে পার্থক্য হয় তা পাঠককে জানাতে ইচ্ছে করছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মৃত্যুদ-ে দ-িত, তিনি এখন পলাতক। এক সময় তিনি কোন একটি টিভি চ্যানেলে ধর্মীয় বিষয়ে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। লন্ডন থেকে এক বাঙালি মুসলমানের মাওলানা আজাদের কাছে প্রশ্ন ছিলোÑ ‘লন্ডনে বাস-ট্রামে ভ্রমণকালীন বা রাস্তায় বের হলে মেয়েদের যে পোশাকে দেখি তাতে উত্তেজনা ফিল করি, ওজু ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।’ মাওলানা সাহেব উত্তরে বললেন, ‘খোলামেলা পোশাকে মেয়ে দেখে আপনি যদি এত দুর্বল হয়ে পড়েন তাহলে আপনার নাসারাদের দেশে যাওয়া ঠিক হয়নি, ওই সব দেশে মেয়েরা উলঙ্গ থাকলেও পুরুষেরা কোন আগ্রহ নিয়ে তাকায় না, আপনি এত তাকান কেন? আপনি দেশে ফেরত আসুন।’ মাওলানা সাহেবের কথায় মনে হলো ওই সব দেশে শয়তান পুরুষকে কাবু করতে পারে না।

মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী নারীর প্রতি কামুক দৃষ্টিতে তাকানো হারাম, তাহলে আমাদের দেশে নারীর খোলামেলা পোশাক দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কামাসক্ত হয়ে উঠে কেন? যে পুরুষকে দৃষ্টি অবনত রাখতে বলা হয়েছে সেই পুরুষ নারীর অঙ্গসৌষ্ঠবের সৌন্দর্য অবলোকন করার কথা নয়, নারীর শরীরের দিকে লোলুপদৃষ্টিতে যিনি তাকাবেন তিনি অবশ্যই ধর্মের নির্দেশনা লঙ্ঘনের জন্য দায়ী হবেন। ধর্ম নারীদের পোশাকের ব্যাপারে বেশি কনসার্ন। রাস্তার মাঝখান দিয়ে নারীদের চলার অধিকার ধর্ম দেয়নি, তাদের বলা হয়েছে রাস্তার কিনার দিয়ে চলাচল করতে। নারী যতই পর্দা করুক, যতই রাস্তার কিনার দিয়ে চলাফেরা করুক, তার চোখ কিন্তু খোলা থাকে; এক্ষেত্রে পুরুষের সৌন্দর্য দেখে নারীর কামভাব জাগতে পারে। পুরুষও যদি নারীদের মতো পর্দা করত তাহলে কোন ফ্যাসাদ হতো না।

মানুষ সৃষ্টির পরপরই কিন্তু ধর্মগ্রন্থ আসেনি, ধর্ম এসেছে অনেক পরে। লক্ষ লক্ষ বছর মানুষ উলঙ্গ ছিল। গাছের পাতা বা বাকল দিয়ে দেহের কিয়দংশ ঢাকার প্রচলন হয়েছে খুব বেশি দিন আগে নয়। এখনো অনেক নৃগোষ্ঠী আছে যারা উলঙ্গ থাকে। মেয়েদের উর্ধাংশ অনাবৃত রাখার সংস্কৃতি বহু নৃগোষ্ঠী লালন ও পালন করে। এই উলঙ্গ থাকা বা মেয়েদের বক্ষাদেশ অনাবৃত রাখার মধ্যে তারা কোন লজ্জাবোধ করে না, কারণ তাদের মধ্যে এমন লজ্জাবোধের সৃষ্টিই হয়নি। পশু-পাখির কোন পোশাক নেই, পোষা প্রাণীকে কিছু মানুষ পোশাক পরিয়ে কৃত্রিমভাবে সভ্য করতে চায়।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ২১৫ বছর পূর্বে ভারতের কেরালার পুরুষ রাজা ত্রিভাঙ্কুরের জারি করা আইন নিয়ে একটি কাহিনী পড়েছি। তার জারি করা আইন অনুযায়ী ব্রাহ্মণ ব্যতীত হিন্দুধর্মের অন্য কোনো নারী তার স্তন অনাবৃত রাখতে পারত না, স্তন ঢাকলেই তাকে কর দিতে হতো।

অনেকের ধারণা, পর্দাহীনতার কারণে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, ব্যভিচারের উদ্ভব; কিন্তু তা যদি সত্য হতো তাহলে শিশুরা ধর্ষণ ও বলাৎকারের শিকার হতো না। পোশাক দেখে নারীদের বিচার করা কিছু মানুষের বিকৃত মানসিকতা ও মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ, এ অপরাধ অঙ্কুরে ধ্বংস না হলে লিঙ্গ সমতা কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের কোন জাতীয় পোশাক নেই; আমাদের জাতীয় পোশাক না থাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাপানে গিয়ে রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তালেবান শাসিত আফগানিস্তান নারীদের পোশাক পরিধান নিয়ে কঠোর আইন করলেও আমাদের সংবিধান নারী বা পুরুষের জন্য কোন নির্দিষ্ট পোশাক নির্ধারণ করে দেয়নি; বরং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে, বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে কোন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না এবং একই কারণে কাউকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধও করা যাবে না। প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে শালিনতা বজায় রেখে তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধানের।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]