পদ্মার লঞ্চ-ট্রলার-স্পিডবোট মালিক ও সংশ্লিষ্টরা পড়েছে মহা দুশ্চিন্তায়। দিন যত গনিয়ে আসছে ততই যেন চোখের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। বিপদে তারা তাদের লঞ্চ-ট্রলার-স্পিডবোট নিয়ে। এর সাথে জড়িত কর্মচারীরা নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। এর সাথে জড়িতরা পড়েছে বিপাকে স্পিড বোড মালিক সালাউদ্দিন জানান, ‘চারমাস আগে সাড়ে তিন লাখ টাকা কিস্তি তুলে এ স্পিডবোটটা কিনেছি। এরপর লাইসেন্স করতে বাকি সঞ্চয়ের টাকাও খরচ হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালুর পরে যদি স্পিডবোট বন্ধ হয়, তাহলে কিস্তি দেবো কীভাবে? সংসার চালাবো কীভাবে? পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।’

মুন্সিগঞ্জের মাওয়া-শিমুলিয়া ঘাটে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন পদ্মার স্পিডবোটচালক আব্দুল মালেক। শুধু তিনি নন, পদ্মা সেতু চালুর পরে নদী পারাপারে নৌপথে যাত্রী কমার শঙ্কায় দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের কাওড়াকান্দি নৌরুটের হাজারো লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোটচালক ও মালিক শ্রমিকসহ ঘাট সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা।

আব্দুল মালেক বলেন, ‘সেতু উদ্বোধন হলে ঘাট থেকে কী হবে। কেউ আসবে না সচরাচর। তখন আমার স্পিডবোট চলবে কি না জানি না। কেউ বলে, নদীশাসনের জন্য স্পিডবোট বন্ধ হয়ে যাবে। কেউ বলে থাকবে। এসব চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না।’ শিমুলিয়া ঘাটের মালেকের মতো অধিকাংশ স্পিডবোটচালক তাদের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার এ নৌপথ পদ্মা সেতু চালুর পরে জনশূন্য হয়ে পড়বে। ঘাট চালু থাকলেও কমে যাবে গুরুত্ব। টান পড়বে তাদের রুটি-রুজিতে। সেতু নেভিগেশন কোং এম এল লঞ্চের মালিক মাসুদ খান বলেন, এখনো জানতে পারিনি এ ঘাটগুলো থাকবে কি না। থাকলেও তখন এত যাত্রী হবে না। এত লঞ্চ দিয়ে কী হবে তখন। যাত্রী না হলে লোকসানে চালাতে হবে। তখন পথে বসতে হবে।

আহনাফ লঞ্চের মাস্টার সফিউল্লা বলেন, একেকটি লঞ্চে পাঁচ-ছয়জন স্টাফ। এ ঘাট থেকে কয়েকটি রুটে ৮৭টি লঞ্চ চলাচল করছে প্রতিদিন। প্রতিটি ঘাটে শত শত মানুষ আছে, যারা লঞ্চ, ফেরিকেন্দ্রিক পেশায় নিযুক্ত। প্রয়োজন কমে গেলে অনেককে ছাঁটাই করবে মালিক, সেটাই স্বাভাবিক।

ঘাটে স্পিড বোটচালক লায়েক হোসেন বলেন, সরকার আমাদের নিয়ে ভাবছে না। শুধু সেতু নিয়ে ব্যস্ত সবাই। আমাদের বিকল্প ব্যবস্থার কথা কেউ বলছে না।

চালক হাকিম বলেন, শিমুলিয়া ঘাট থেকে কয়েকটি রুটে দেড়শোর বেশি স্পিডবোট চলে। সেতু চালু হওয়ার পর এত বোটের যাত্রী পাওয়া যাবে না। যাত্রীর জন্য চাতক পাখির মতো বসে থাকতে হবে।

স্পিডবোট চালকরা জানান, তারা প্রতিটি বোটের জন্য চার থেকে ১০ লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করেছেন। শিমুলিয়া ঘাটে একটি মালিকানাধীন ইয়োটও রয়েছে, যার দাম কোটি টাকার কাছাকাছি। এসব বোট নদীশাসনের কারণে চলাচল বন্ধ হলে তারা ব্যাপক আর্থিক সংকটে পড়বেন।

ঘাটের স্পিডবোটের ইজারাদারের প্রতিনিধি শফিকুল বলেন, সেতু চালু হলে আর ঘাট সেভাবে চলবে না শুধু সেটাই জানি। সবাইকে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। কেউ অন্য রুটে যাবে। এখনো কোনো নিশ্চয়তা পাইনি আমরা। এদিকে মাওয়া ঘাট থেকে প্রায় ৩০টি পর্যটক ট্রলার চলে সেতু এলাকায়। বর্তমানে এগুলো পদ্মা সেতু দেখতে যাওয়া দর্শনাথীদের নিয়ে দারুণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। তবে দুশ্চিন্তা পিছু হাঁটছে তাদেরও।

ট্রলারচালক রিয়াজুল মোল্লা বলেন, এখন সেতু চালু হয়নি বলে পর্যটকরা এসে ট্রলারে ঘুরে সেতু দেখছেন। চালু হওয়ার পরে আর কেউ এখানে আসবে না। সেতুর ওপরই যাবে। তখন আমাদের কি হবে সেটা আল্লাহ জানে।

তবে কয়েকজন ট্রলারচালক জানান, স্থানীয় প্রতিনিধিরা তাদের জানিয়েছেন যে মাওয়া ঘাটে পর্যটনকেন্দ্র চালু থাকবে।

পদ্মার নৌপথে পেশাজীবী এসব মানুষ বলছেন, পানি আর নদীর সঙ্গে আবহমান কাল থেকেই আত্মিক সম্পর্ক তাদের। ফলে ঘাট বন্ধ হলেও দ্রুত পেশা পরিবর্তন সম্ভব নয়। চালু থাকলেও লোকসান দিয়ে তাদের পেশা ধরে রাখতে হবে বাধ্য হয়েই। সেজন্য তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। ঘাটগুলোরই বা পরিণতি কী হবে সেটা পরিষ্কার করা দরকার।

যদিও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শতে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলেই যে নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে তা নয়। নৌপথের প্রয়োজনীয়তা থাকবে। তবে যাত্রী কমার কারণে হয়তো এত পরিবহনের প্রয়োজন থাকবে না। সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি ঘাটে ফেরিও সচল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি নিবন্ধিত যেসব স্পিডবোট ও লঞ্চ আছে সেগুলোও চালু থাকবে। তবে যতদিন মানুষের চাহিদা থাকবে, ততদিন রাখা হবে। কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে পদ্মার লঞ্চ-ট্রলার-স্পিডবোট মালিক পক্ষ ও সংশ্লিষ্টরা সরকারের উর্ধ্বতন কর্তপক্ষসহ প্রধান মন্এর দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।