বিএনপিসহ ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না সাবেক সিইসি-ইসিদের মন্তব্য

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিবেরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তারা এ মন্তব্য করেন।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে সভায় গুরুত্ব দেন সাবেক সিইসি, ইসি ও ইসি সচিবেরা।

এক-এগারোর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা (২০০৭-২০১২) সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে সব দল যদি না আসে তাহলে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং কীভাবে আনবেন, তা আপনারা কী অফার করবেন, তার ওপর নির্ভর করবে। আমার সময়ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ওয়াজ প্রবলেমেটিক (সমস্যা ছিল)। তাদের আনতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এখন তারা যেসব কথাবার্তা বলছে, তাতে তো মনে হয়, তারা নির্বাচনে যেতে রাজি নয়।’

সাবেক ইসি মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সবাই মনে করবে, নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ইনভলব (যুক্ত) হতে পারবে না। যদি তারা ইনভলভ হয়ে যায়, তাহলে দেখবে যে কিছুই করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় যারা নির্বাচন বর্জন করেছিল, তাদের আনার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়নি। অনেক সহিংসতা হয়েছে।’ সে সময় নির্বাচন না দিলে সহিংসতা চলতেই থাকতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সব দলের অংশগ্রহণের চেষ্টাটা সরকারি দলের করতে হবে উল্লেখ করে আবু হাফিজ বলেন, ‘তারা চিন্তা করবে দলগুলোকে কীভাবে নির্বাচনে আনা যায়।’

তবে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মনে করেন, যেকোন মূল্যে সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এটা করতে সক্ষম হলে ৮০ ভাগ কাজ হয়ে গেল।’

সর্বশেষ বিদায়ী সিইসি (২০১৭ সাল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) কেএম নূরুল হুদা বলেন, ‘কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময় শত শত লোক নিহত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নষ্ট করা হয়েছে। পরিস্থিতি ব্যাপক সহিংস হয়েছে। সেই অবস্থার মধ্যেও কষ্ট করে নির্বাচন করতে হয়েছে। আবার ড. শামসুল হুদা সাহেবের সময় একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। তখন রাজনৈতিক সরকার ছিল না। সিদ্ধান্ত সহজ ছিল। এখন যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে ছয় মাস সময় লেগে যায়।’ জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সাবেক ইসি মাহবুব তালুকদার বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটাই চ্যালেঞ্জ, তা হলো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা। তিনি বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা সাবেক সিইসি বিচারপতি মো. আবদুর রউফ বলেন, ‘রাজনৈতিকরা মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন।’ তার মতে, এখন ভোটের আগে ২০ কোটি খরচ করে ভোটের পর ২০০ কোটি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচন হয়। তাই প্রার্থীভিত্তিক না হয়ে দলভিত্তিক নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যে দল যতটি আসনে প্রার্থী দেবে এবং যত সংখ্যক ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দলের আসন সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।’

তবে ‘বিদ্যমান আইন’ দিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব বলেও মত আসে সভায়। জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বদলে ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার কথাও বলেন মতবিনিময় সভায় অংশ নেয়া কয়েকজন। তবে সব আসনে ইসি থেকে নিয়োগের আগে যোগ্যতা বিবেচনায় নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন একজন।

নির্বাচনে সেনা মোতায়েন প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন দুই-তিনজন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে, নির্বাচন অধিকতর সুষ্ঠু করা সম্ভব দাবি করে, ইভিএমে নির্বাচন করার পক্ষে করার পক্ষে মত দেন অংশীজনদের অনেকে।

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন। সভায় আরও অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ, সাবেক ইসি সচিব ড. সাদিক, অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ও মোখলেছুর রহমান। গতকাল মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রিত সাবেক ২৮ জন সিইসি-ইসি, ইসি সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে ১০ জন সভায় উপস্থিত ছিলেন।

সোমবার, ১৩ জুন ২০২২ , ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪৩

বিএনপিসহ ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না সাবেক সিইসি-ইসিদের মন্তব্য

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিবেরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তারা এ মন্তব্য করেন।

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে সভায় গুরুত্ব দেন সাবেক সিইসি, ইসি ও ইসি সচিবেরা।

এক-এগারোর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা (২০০৭-২০১২) সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে সব দল যদি না আসে তাহলে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং কীভাবে আনবেন, তা আপনারা কী অফার করবেন, তার ওপর নির্ভর করবে। আমার সময়ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ওয়াজ প্রবলেমেটিক (সমস্যা ছিল)। তাদের আনতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এখন তারা যেসব কথাবার্তা বলছে, তাতে তো মনে হয়, তারা নির্বাচনে যেতে রাজি নয়।’

সাবেক ইসি মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সবাই মনে করবে, নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ইনভলব (যুক্ত) হতে পারবে না। যদি তারা ইনভলভ হয়ে যায়, তাহলে দেখবে যে কিছুই করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় যারা নির্বাচন বর্জন করেছিল, তাদের আনার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়নি। অনেক সহিংসতা হয়েছে।’ সে সময় নির্বাচন না দিলে সহিংসতা চলতেই থাকতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সব দলের অংশগ্রহণের চেষ্টাটা সরকারি দলের করতে হবে উল্লেখ করে আবু হাফিজ বলেন, ‘তারা চিন্তা করবে দলগুলোকে কীভাবে নির্বাচনে আনা যায়।’

তবে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মনে করেন, যেকোন মূল্যে সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এটা করতে সক্ষম হলে ৮০ ভাগ কাজ হয়ে গেল।’

সর্বশেষ বিদায়ী সিইসি (২০১৭ সাল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) কেএম নূরুল হুদা বলেন, ‘কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময় শত শত লোক নিহত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নষ্ট করা হয়েছে। পরিস্থিতি ব্যাপক সহিংস হয়েছে। সেই অবস্থার মধ্যেও কষ্ট করে নির্বাচন করতে হয়েছে। আবার ড. শামসুল হুদা সাহেবের সময় একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। তখন রাজনৈতিক সরকার ছিল না। সিদ্ধান্ত সহজ ছিল। এখন যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে ছয় মাস সময় লেগে যায়।’ জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সাবেক ইসি মাহবুব তালুকদার বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটাই চ্যালেঞ্জ, তা হলো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা। তিনি বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা সাবেক সিইসি বিচারপতি মো. আবদুর রউফ বলেন, ‘রাজনৈতিকরা মাঠ ছেড়ে চলে গেছেন।’ তার মতে, এখন ভোটের আগে ২০ কোটি খরচ করে ভোটের পর ২০০ কোটি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচন হয়। তাই প্রার্থীভিত্তিক না হয়ে দলভিত্তিক নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যে দল যতটি আসনে প্রার্থী দেবে এবং যত সংখ্যক ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দলের আসন সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।’

তবে ‘বিদ্যমান আইন’ দিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব বলেও মত আসে সভায়। জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বদলে ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার করার কথাও বলেন মতবিনিময় সভায় অংশ নেয়া কয়েকজন। তবে সব আসনে ইসি থেকে নিয়োগের আগে যোগ্যতা বিবেচনায় নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন একজন।

নির্বাচনে সেনা মোতায়েন প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন দুই-তিনজন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে, নির্বাচন অধিকতর সুষ্ঠু করা সম্ভব দাবি করে, ইভিএমে নির্বাচন করার পক্ষে করার পক্ষে মত দেন অংশীজনদের অনেকে।

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন। সভায় আরও অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ, সাবেক ইসি সচিব ড. সাদিক, অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ও মোখলেছুর রহমান। গতকাল মতবিনিময় সভায় আমন্ত্রিত সাবেক ২৮ জন সিইসি-ইসি, ইসি সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে ১০ জন সভায় উপস্থিত ছিলেন।