বাজেট : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ

রেজাউল করিম খোকন

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিতে নতুন চাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে এই সূচক। গত তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের বেশি। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, তেল, মসলাÑ সব নিত্যপণ্যই বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে মানুষকে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে দারিদ্রসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষের একটি অংশ আবার গরিব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে। কয়েক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন তেল, আটা, চাল, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে বাড়লেও বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসেবে তা সঠিকভাবে আসছে না বলে অনেক অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেছেন। বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তবে তা মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না। আবার ২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হচ্ছে। অথচ এতদিনে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হিসাব নতুন করে করা প্রয়োজন।

ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে সম্প্রতি। এতে খরচ বাড়বে বাসার রান্নায়। বাড়বে সার কারখানা ও শিল্পের উৎপাদন খরচ। এমনিতেই মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে নানা সংকটে রয়েছে। তার ওপর গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনে নতুন বোঝা চাপাবে সন্দেহে নেই। হালে মূল্যস্ফীতির চিত্রে কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে দু’চারটি প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি বাড়তো। কিন্তু এবার প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। ফলে পদে পদে মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভব করছেন সাধারণ মানুষ।

গত কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টানা তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে ছিল। বিগত পাঁচ-ছয় বছরে বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায়নি। যদিও আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কম। গত এপ্রিলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ দাঁড়ালেও প্রতিবেশি ভারতে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও নেপালে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছিল। আর গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি উঠেছে সাড়ে ৮ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য। খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রকোপ চলছে। এশিয়ায় চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিফাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াসহ প্রায় অঞ্চলজুড়েই মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত অঞ্চলগুলোতে মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী। কোথাও কোথাও তো মূল্যস্ফীতি পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি বেড়েছে। চলতি বছরে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাষ দিয়ে রেখেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি গণনায় একক পণ্য হিসেবে চালের অবদান সবচেয়ে বেশি। সাধারণ গরিব শ্রেণীর মানুষের আয়ের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ হয় চাল কেনায়। এবার ভরা মৌসুমেও চালে দাম হু হু করে বাড়ছে। চালের দাম বাড়তির কারণে মে ও জুন মাসের হিসাব এলে দেখা যাবে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ধাক্কা সামলে অর্থনীতিতে গতি আসতে শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হতে থাকে। ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল। ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও পরিবহন খরচ যেমন, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে আমদানি খরচ মেটাতে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।

গত একবছরে ভোজ্যতেলের দাম ৫০ শতাংশের মতো বেড়েছে। গমের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১০০ মার্কিন ডলার প্রতি অতিক্রম করেছে। মূলত মূল্যস্ফীতি গত বছরের শেষ দিক থেকে বাড়ছিল। গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে। সর্বশেষ গত দুই মাস ধরে চলমান অস্থির ডলার বাজার আমদানি ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে তুলেছে। দেশে করোনাকালে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে। করোনার প্রকোপ কমে এলে অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল হতে শুরু করলে এ সংখ্যাও কমতে শুরু করেছিল। তবে সাম্প্রতিমক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে ২১ লাখ মানুষ। পাশাপাশি এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ হয় পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে বা নিম্নমানের পণ্য কিনছে কিংবা একেবারেই কিছু পণ্য কেনা বাদ দিয়ে কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্রাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পণ্যের দাম বাড়ার বড় কারণ ছিল বিশ্ববাজার। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়া। এরপর নিজেদের খাদ্যপণ্য সুরক্ষায় বিভিন্ন দেশ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করায় পণ্যের দামে দফায় দফায় উত্থান হয়। গত রোজার ঈদের পর ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে পণ্য আমদানিতে আরেক দফা খরচ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মানুষকে কিছুটা সুবিধা দিতে জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি রাখতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর সাময়িক সময়ের জন্য তুলে দেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া বাজারকে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বাজারকে বাজারের মতো করে চলতে দেওয়া উচিত। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মূল্যস্ফীতি বাড়লেও শ্রমিক চাকরিজীবীদের মজুরি বেতন যদি কিছুটা বাড়ানো যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবেন। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সম্পর্ক রয়েছে। তবে শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে পণ্যের মূল্য বাড়ছে বললে সেটা ঠিক হবে না। দেশের অভ্যন্তরে শুল্ক কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? সয়াবিন তেলের বাজার চড়ে যাওয়ায় শুল্ক কমানোর পর কিছুটা সুফল মিলেছে। এখনও ২৯টি নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্কারোপ রয়ে গেছে। আমদানি ও উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনায় অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা রয়েছে। সেখানে নজরদারি ও খবরদারি করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেও পণ্যের দাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ বাজারে কঠোর তদারকি করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব। প্রয়োজন চালের দাম সহনীয় রাখতে বাজার কৌশল নির্ধারণ করা; পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষদের বাজেটের মাধ্যমে নগদ ও খাদ্যসহায়তা দিয়ে সুরক্ষা দিতে হবে। কেননা, মূল্যস্ফীতি এক ধরনের করের মতো।

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় উপার্জন না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। নতুন অর্থবছরের ২০২২-২৩ বাজেটে গরিব মানুষকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য সহায়তাও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হবে। প্রথমবারের মতো সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ বরাদ্দ থাকছে। কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক কর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের সুফল মিলবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সফল হয় সেটাই দেখার বিষয়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সোমবার, ১৩ জুন ২০২২ , ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪৩

বাজেট : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ

রেজাউল করিম খোকন

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিতে নতুন চাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে এই সূচক। গত তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের বেশি। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, তেল, মসলাÑ সব নিত্যপণ্যই বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে মানুষকে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে দারিদ্রসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষের একটি অংশ আবার গরিব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে। কয়েক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন তেল, আটা, চাল, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে বাড়লেও বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসেবে তা সঠিকভাবে আসছে না বলে অনেক অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেছেন। বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তবে তা মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না। আবার ২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হচ্ছে। অথচ এতদিনে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হিসাব নতুন করে করা প্রয়োজন।

ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে সম্প্রতি। এতে খরচ বাড়বে বাসার রান্নায়। বাড়বে সার কারখানা ও শিল্পের উৎপাদন খরচ। এমনিতেই মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে নানা সংকটে রয়েছে। তার ওপর গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনে নতুন বোঝা চাপাবে সন্দেহে নেই। হালে মূল্যস্ফীতির চিত্রে কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে দু’চারটি প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি বাড়তো। কিন্তু এবার প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। ফলে পদে পদে মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভব করছেন সাধারণ মানুষ।

গত কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টানা তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে ছিল। বিগত পাঁচ-ছয় বছরে বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায়নি। যদিও আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কম। গত এপ্রিলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ দাঁড়ালেও প্রতিবেশি ভারতে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও নেপালে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছিল। আর গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি উঠেছে সাড়ে ৮ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য। খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রকোপ চলছে। এশিয়ায় চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিফাইন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াসহ প্রায় অঞ্চলজুড়েই মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত অঞ্চলগুলোতে মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী। কোথাও কোথাও তো মূল্যস্ফীতি পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি বেড়েছে। চলতি বছরে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাষ দিয়ে রেখেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি গণনায় একক পণ্য হিসেবে চালের অবদান সবচেয়ে বেশি। সাধারণ গরিব শ্রেণীর মানুষের আয়ের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ হয় চাল কেনায়। এবার ভরা মৌসুমেও চালে দাম হু হু করে বাড়ছে। চালের দাম বাড়তির কারণে মে ও জুন মাসের হিসাব এলে দেখা যাবে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ধাক্কা সামলে অর্থনীতিতে গতি আসতে শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হতে থাকে। ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল। ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও পরিবহন খরচ যেমন, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে আমদানি খরচ মেটাতে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।

গত একবছরে ভোজ্যতেলের দাম ৫০ শতাংশের মতো বেড়েছে। গমের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১০০ মার্কিন ডলার প্রতি অতিক্রম করেছে। মূলত মূল্যস্ফীতি গত বছরের শেষ দিক থেকে বাড়ছিল। গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে। সর্বশেষ গত দুই মাস ধরে চলমান অস্থির ডলার বাজার আমদানি ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে তুলেছে। দেশে করোনাকালে তিন কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছিল অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে। করোনার প্রকোপ কমে এলে অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল হতে শুরু করলে এ সংখ্যাও কমতে শুরু করেছিল। তবে সাম্প্রতিমক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে ২১ লাখ মানুষ। পাশাপাশি এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ হয় পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে বা নিম্নমানের পণ্য কিনছে কিংবা একেবারেই কিছু পণ্য কেনা বাদ দিয়ে কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্রাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পণ্যের দাম বাড়ার বড় কারণ ছিল বিশ্ববাজার। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়া। এরপর নিজেদের খাদ্যপণ্য সুরক্ষায় বিভিন্ন দেশ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করায় পণ্যের দামে দফায় দফায় উত্থান হয়। গত রোজার ঈদের পর ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে পণ্য আমদানিতে আরেক দফা খরচ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মানুষকে কিছুটা সুবিধা দিতে জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি রাখতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর সাময়িক সময়ের জন্য তুলে দেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া বাজারকে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বাজারকে বাজারের মতো করে চলতে দেওয়া উচিত। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মূল্যস্ফীতি বাড়লেও শ্রমিক চাকরিজীবীদের মজুরি বেতন যদি কিছুটা বাড়ানো যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবেন। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সম্পর্ক রয়েছে। তবে শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে পণ্যের মূল্য বাড়ছে বললে সেটা ঠিক হবে না। দেশের অভ্যন্তরে শুল্ক কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? সয়াবিন তেলের বাজার চড়ে যাওয়ায় শুল্ক কমানোর পর কিছুটা সুফল মিলেছে। এখনও ২৯টি নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্কারোপ রয়ে গেছে। আমদানি ও উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনায় অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা রয়েছে। সেখানে নজরদারি ও খবরদারি করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেও পণ্যের দাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ বাজারে কঠোর তদারকি করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব। প্রয়োজন চালের দাম সহনীয় রাখতে বাজার কৌশল নির্ধারণ করা; পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষদের বাজেটের মাধ্যমে নগদ ও খাদ্যসহায়তা দিয়ে সুরক্ষা দিতে হবে। কেননা, মূল্যস্ফীতি এক ধরনের করের মতো।

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় উপার্জন না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। নতুন অর্থবছরের ২০২২-২৩ বাজেটে গরিব মানুষকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য সহায়তাও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হবে। প্রথমবারের মতো সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ বরাদ্দ থাকছে। কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক কর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের সুফল মিলবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সফল হয় সেটাই দেখার বিষয়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]