বাজেট ঘাটতি কি আসলেই খারাপ?

এস এম জাহাঙ্গীর আলম

ঘোষণা করা হলো আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট। ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, এবং মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৫ দশকিম ৬ শতাংশ।

প্রথমেই আসা যাক মূল্যস্ফীতির কথায়। মূল্যস্ফীতি হার এখন ৬ শতাংশের বেশি। এই হার কমে আসবে, এটা আশাই করা যায় না, বরং বাড়বেই। যাক সেকথা। বাজেট ঘাটতি যেন একটা মামুলি বিষয়ে পরিনত হয়েছে। বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে। তানাহলে দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা টানতেই হবে। এতে উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হবে। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আসছে বাজেটে ঘাটকি থাকছে ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা প্রায়। চলতি(২০২১-২২) অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক সাহায্য ১ লাখ কোটি টাকার বেশি আর অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সাড়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ ধরা হয়েছে।

যতই দিন যাচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য (ঋণ ও অনুদান) কমছে অপর দিকে অভ্যন্তরীণ ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা বা কোনো দেশ ঋণ দিতে চায় না। কারণ-অনিয়ম, দুর্নীতি, সময় মতো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারাসহ নানাবিধ কারণ আছে। আর ঋণ দিতে গিয়ে কঠিন শর্তও জুড়ে দেয়া হচ্ছে। যাক সে কথা। দাতাদের বক্তব্য হচ্ছে সময় মতো বৈদেশিক সাহায্য যথাযথ ব্যবহার হয় না। এদিকে বৈদেশিক ঋণের স্থিতির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী সরকারের ঋণের স্থিতির ৬৩ শতাংশ অভ্যন্তরীণ আর ৩৭ শতাংশ বৈদেশিক। বৈদেশিক ঋণের ৩৮ শতাংশ হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের, এডিবির ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া জাপানের ১৭, চীনের ৩, ভারতের ১ শতাংশ। সরকার যে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে বা পায়, তার যথাযথভাবে খরচ বা ব্যবহার করতে পারে না। অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

লক্ষণীয় বিষয়, জাতীয় বাজেটে ব্যয় বরাদ্দে সিংহভাগ চলে যায় দেশি-বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে। যেমন চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মকতা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে বেশি খরচ হয় মূলতঃ ৩টি খাতে। এরমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা, অবসরর প্রাপ্তদের পেনশন এর ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেট ঘাটতি নিয়ে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘বাজেট ঘাটতি নতুন কিছু নয়। উন্নয়নশীল দেশে বাজেট ঘাটতি হবেই”। প্রশ্ন হচ্ছে বাজেট ঘাটতি কি আসলেই খারাপ? সাধারণভাবে বাজেট ঘাটতি একটি নেতিবাচক চলক মনে হলেও শর্তসাপেক্ষে সব আয়ের দেশেই জন্যই ঘাটতি বাজেট স্বাভাবিক। ঘাটতি কতটা হতে পারে তা পুরোপুরি নির্ভর করে একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী জিডিপির ৫ শতাংশ রাখতে হয়।

কিন্তু বাংলাদেশ সেই নিয়ম রক্ষা করতে পারছে না। বাজেট ঘাটতি হওয়ার মূল কারণ রাজস্ব ঘাটতি। রাজস্ব ঘাটতি লেগেই আছে। সরকার প্রতিবছর যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন, তা পূর্ণ হয় না। এমনকি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও ঘাটতি থেকে যায়। রাজস্ব ঘাটতি কমাতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সুফলটা তেমন নেই। বাংলাদেশে কর জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের কিছুটা বেশি, যা বিশ্বের সর্বনিম্নœ। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের কিছুটা বেশি আয় কর দেন। ভারতে এই হার ৪ শতাংশ আর নেপালের মতো দেশে ৬ শতাংশ।

প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই বাংলাদেশে আয় কর দেন মাত্র প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর)এর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে রিটার্ন জমা দেন প্রায় সাড়ে ২৫ লাখের কিছুটা বেশি। ৩৭ লাখে বেশি লোক রিটার্ন জমা দেন না। যদিও নিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর) রাজস্ব বাড়াতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং করছে। আয়কর দাখিলের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি চালু করেছে।

এখন ঘরে বসেই আয় কর দেয়ার ব্যবস্থাও চালু করেছে। অনেক ক্ষেত্রে আয় কর জমা দেয়ার পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। কর দাতার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তবে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কর প্রদানে অনীহা আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে কাজ করছে। তাছাড়া কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা তো আছেই। এসব কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। স্বাভাবিক কারণেই রাজস্ব না বাড়লে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। আর সরকারকে ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে দেশ ও জনগণের উন্নয়নে ভাটার টান পড়বে।

বাজেট ঘাটতি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে স্বাভাবিক। এ বিনিয়োগের ফলে বেকারত্ব কমবে, আবার অর্থনৈতিক সক্ষমতাও তৈরি হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বাজেট ঘাটতি হতেই পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময়ে সঙ্গে সঙ্গে যদি অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি গৃহীত ঋণের হারের চেয়ে বেশি হয়, তবে সে ঋণ অর্থনীতির জন্য খারাপ নয়। যে কোনো আয়ের দেশের জন্য একটি সহনীয় মাত্রার ঘাটতি বাজেট দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলবে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এবং এ বিষয়ে তাগিদ থাকতে হবে।

মনে রাখা প্রয়োজন, যদি কোনো দেশ ক্রমবর্ধমান ঋণের জালে আটকে যায়, তবে এর পরিণতি খারাপ হতে পারে। যেমন আফ্রিকান দেশগুলো ঋণের ভারে জর্জরিত। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিসে এ রকম হয়েছে। ঘাটতি বাজেটকে একটি চলমান ও আবশ্যিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে ঘাটতি মেটানোর সবচেয়ে কার্যকর উৎস নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, অর্থনীতির ভিন্নতায় একেক উৎসের জন্য একেক রকমের প্রভাব দেখা দেয়। আমাদের দেশে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার বাজেট ঘাটতি কোন সমস্য নয় বটে, তবে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিবেচনায় যৌক্তিকভাবে তা সমন্বয় করাই চ্যালেঞ্জ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। আর রাজস্ব বাড়াতে হলে জাতীয় বাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরের) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আগেই আমার একাধিক লেখায় বলেছি যে, রাজস্ব বাড়াতে স্বাধীন কর কমিশন গঠন করা জরুরি। কারণ, স্বাধীন কর কমিশন ছাড়া রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব নয়।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার]

সোমবার, ১৩ জুন ২০২২ , ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪৩

বাজেট ঘাটতি কি আসলেই খারাপ?

এস এম জাহাঙ্গীর আলম

ঘোষণা করা হলো আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট। ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, এবং মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৫ দশকিম ৬ শতাংশ।

প্রথমেই আসা যাক মূল্যস্ফীতির কথায়। মূল্যস্ফীতি হার এখন ৬ শতাংশের বেশি। এই হার কমে আসবে, এটা আশাই করা যায় না, বরং বাড়বেই। যাক সেকথা। বাজেট ঘাটতি যেন একটা মামুলি বিষয়ে পরিনত হয়েছে। বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে। তানাহলে দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা টানতেই হবে। এতে উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হবে। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আসছে বাজেটে ঘাটকি থাকছে ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা প্রায়। চলতি(২০২১-২২) অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক সাহায্য ১ লাখ কোটি টাকার বেশি আর অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সাড়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ ধরা হয়েছে।

যতই দিন যাচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য (ঋণ ও অনুদান) কমছে অপর দিকে অভ্যন্তরীণ ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা বা কোনো দেশ ঋণ দিতে চায় না। কারণ-অনিয়ম, দুর্নীতি, সময় মতো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারাসহ নানাবিধ কারণ আছে। আর ঋণ দিতে গিয়ে কঠিন শর্তও জুড়ে দেয়া হচ্ছে। যাক সে কথা। দাতাদের বক্তব্য হচ্ছে সময় মতো বৈদেশিক সাহায্য যথাযথ ব্যবহার হয় না। এদিকে বৈদেশিক ঋণের স্থিতির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী সরকারের ঋণের স্থিতির ৬৩ শতাংশ অভ্যন্তরীণ আর ৩৭ শতাংশ বৈদেশিক। বৈদেশিক ঋণের ৩৮ শতাংশ হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের, এডিবির ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া জাপানের ১৭, চীনের ৩, ভারতের ১ শতাংশ। সরকার যে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে বা পায়, তার যথাযথভাবে খরচ বা ব্যবহার করতে পারে না। অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

লক্ষণীয় বিষয়, জাতীয় বাজেটে ব্যয় বরাদ্দে সিংহভাগ চলে যায় দেশি-বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে। যেমন চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মকতা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে বেশি খরচ হয় মূলতঃ ৩টি খাতে। এরমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা, অবসরর প্রাপ্তদের পেনশন এর ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেট ঘাটতি নিয়ে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘বাজেট ঘাটতি নতুন কিছু নয়। উন্নয়নশীল দেশে বাজেট ঘাটতি হবেই”। প্রশ্ন হচ্ছে বাজেট ঘাটতি কি আসলেই খারাপ? সাধারণভাবে বাজেট ঘাটতি একটি নেতিবাচক চলক মনে হলেও শর্তসাপেক্ষে সব আয়ের দেশেই জন্যই ঘাটতি বাজেট স্বাভাবিক। ঘাটতি কতটা হতে পারে তা পুরোপুরি নির্ভর করে একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী জিডিপির ৫ শতাংশ রাখতে হয়।

কিন্তু বাংলাদেশ সেই নিয়ম রক্ষা করতে পারছে না। বাজেট ঘাটতি হওয়ার মূল কারণ রাজস্ব ঘাটতি। রাজস্ব ঘাটতি লেগেই আছে। সরকার প্রতিবছর যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন, তা পূর্ণ হয় না। এমনকি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও ঘাটতি থেকে যায়। রাজস্ব ঘাটতি কমাতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সুফলটা তেমন নেই। বাংলাদেশে কর জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের কিছুটা বেশি, যা বিশ্বের সর্বনিম্নœ। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের কিছুটা বেশি আয় কর দেন। ভারতে এই হার ৪ শতাংশ আর নেপালের মতো দেশে ৬ শতাংশ।

প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই বাংলাদেশে আয় কর দেন মাত্র প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর)এর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে রিটার্ন জমা দেন প্রায় সাড়ে ২৫ লাখের কিছুটা বেশি। ৩৭ লাখে বেশি লোক রিটার্ন জমা দেন না। যদিও নিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর) রাজস্ব বাড়াতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং করছে। আয়কর দাখিলের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি চালু করেছে।

এখন ঘরে বসেই আয় কর দেয়ার ব্যবস্থাও চালু করেছে। অনেক ক্ষেত্রে আয় কর জমা দেয়ার পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। কর দাতার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তবে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কর প্রদানে অনীহা আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে কাজ করছে। তাছাড়া কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা তো আছেই। এসব কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। স্বাভাবিক কারণেই রাজস্ব না বাড়লে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। আর সরকারকে ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে দেশ ও জনগণের উন্নয়নে ভাটার টান পড়বে।

বাজেট ঘাটতি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে স্বাভাবিক। এ বিনিয়োগের ফলে বেকারত্ব কমবে, আবার অর্থনৈতিক সক্ষমতাও তৈরি হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বাজেট ঘাটতি হতেই পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময়ে সঙ্গে সঙ্গে যদি অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি গৃহীত ঋণের হারের চেয়ে বেশি হয়, তবে সে ঋণ অর্থনীতির জন্য খারাপ নয়। যে কোনো আয়ের দেশের জন্য একটি সহনীয় মাত্রার ঘাটতি বাজেট দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলবে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এবং এ বিষয়ে তাগিদ থাকতে হবে।

মনে রাখা প্রয়োজন, যদি কোনো দেশ ক্রমবর্ধমান ঋণের জালে আটকে যায়, তবে এর পরিণতি খারাপ হতে পারে। যেমন আফ্রিকান দেশগুলো ঋণের ভারে জর্জরিত। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিসে এ রকম হয়েছে। ঘাটতি বাজেটকে একটি চলমান ও আবশ্যিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে ঘাটতি মেটানোর সবচেয়ে কার্যকর উৎস নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, অর্থনীতির ভিন্নতায় একেক উৎসের জন্য একেক রকমের প্রভাব দেখা দেয়। আমাদের দেশে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার বাজেট ঘাটতি কোন সমস্য নয় বটে, তবে দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিবেচনায় যৌক্তিকভাবে তা সমন্বয় করাই চ্যালেঞ্জ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। আর রাজস্ব বাড়াতে হলে জাতীয় বাজস্ব বোর্ডের (এনবিআরের) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আগেই আমার একাধিক লেখায় বলেছি যে, রাজস্ব বাড়াতে স্বাধীন কর কমিশন গঠন করা জরুরি। কারণ, স্বাধীন কর কমিশন ছাড়া রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব নয়।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার]