বিশ্ব রক্তদাতা দিবস

নাজমুল হুদা খান

ভাবুন, একজন মা প্রসবকালীন রক্তক্ষরণে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে; একটি শিশু রক্তশূন্যতাকে জয় করে সুস্থ জীবনের আলো হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে; একজন রোগী রক্ত বা অস্থিমজ্জার রোগের সঙ্গে লড়াই করছে; এক ব্যক্তি আজন্ম হিমোগ্লোবিন স্বল্পতা রোগ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছে কিংবা হাসপাতালের বিছানায় কাতড়াচ্ছে গুরুতর জখম, আগুনে ঝলসানো আমারই মতো একজন মানুষ; অথবা অপারেশনের টেবিলে এক ব্যাগ রক্তের জন্য চিকিৎসক এগুতে পারছে না জীবন বাঁচানোর অপারেশনে। এ সব অসহায় ব্যক্তিবর্গের আপনার আমার কাছে একটাই কাতর আহ্বানÑ এক ব্যাগ রক্ত চাই।

জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে সহজ সহযোগিতার এ হাতটি আমরা ইচ্ছে করলেই বাড়িয়ে দিতে পারি স্বেচ্ছায় এক ব্যাগ রক্তের প্রদানের মাধ্যমে। বিশ্বে সব দেশ, বর্ণ ও জাতির এসব অসহায় মানুষের পাশে সহযোগিতা ও সংহতি প্রদান করতেই - “Donating blood is an act of solidarity. Join the effort and save lives” - এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৪ জুন প্রতি বছরের মতো সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে “বিশ্ব রক্ত দাতা দিবস”। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচাতে যারা স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে নিজের রক্ত দান করছে, তাদের সম্মান ও উৎসাহ প্রদান এবং জনগণকে রক্তদানে উৎসাহ প্রদানই এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য।

রক্ত মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং একমাত্র পরিবহন মাধ্যম। এটি শরীরের রক্তনালী ও শিরার মাধ্যমে দেহের প্রতিটি কোষে খাবার ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিভিন্ন প্রকার কার্যক্রমকে সচল রাখতে বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোন পৌঁছে দেয়ার কাজটি করে থাকে নিরবে। দেহের বর্জ্য পদার্থকে বের করে দেয়া, দেহের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা, রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ, দেহের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষাসহ শত মহাকর্মযজ্ঞ পালন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এ রক্ত। এ রক্ত আমাদের দেহে ২৪ ঘণ্টায় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয় ১২ হাজার মাইল বিস্তৃত রক্তনালী ও শিরার মাধ্যমে। এ সময়ে প্রায় আট হাজার গ্যালন রক্ত সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে আমাদের একমাত্র হৃদ্পিণ্ড। মানবদেহের এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঘাটতি দেখা দিলেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে প্রাননাশের কারন হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন অসুখ বিসুখ ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে রক্তের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। বড় ধরনের অপারেশন, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, নবজাতকের রক্তশূন্যতা বা রক্ত রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা, অগ্নিদগ্ধ রোগীর ব্যবস্থাপনায়, রক্তস্বল্পতা রোগীর চিকিৎসা, থ্যালাসেমিয়া বা হেমোফিলিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় রক্তের ব্যবহার অত্যাবশ্যক।

রক্ত এমন একটি উপাদান, যা এখনো পর্যন্ত কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা যায়নি বা অন্য কোন প্রাণীর রক্ত মানুষের শরীরে ব্যবহার করা যায় না। একজন মানুষের দেহের রক্তই শুধু অন্য একজনের শরীরে ব্যবহার করা যায়। তবে চাইলেই একজন মানুষের রক্ত আরেকজনের শরীরে সঞ্চালন করা যাবে না। তার কারণ মানুষের রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। রক্তের লোহিত কনিকা এবং রক্তরসে রাসায়নিক উপাদানগত কিছু তারতম্য রয়েছে। রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ বিদ্যমান, তবে রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে A, B, AB, O এবং Rh ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। এসব আবিষ্কারে ভূমিকা রাখেন তিনজন বিজ্ঞানী। ১৯৬৮ সালেই ১৪ জুন জন্ম নেয়া অস্ট্রীয় জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার রক্তের মূল গ্রুপ ‘এ’, ‘বি’, এবং ‘ও’ আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন যে, একই গ্রুপ থেকে রক্ত একে অপরের দেহে সঞ্চালনে কোন ক্ষতি নেই। এরপর তারই দুই সহযোগী আলফ্রেড ডন এবং আদ্রিয়ানো ‘এবি’ গ্রুপটি শনাক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪১ সালে বিজ্ঞানী ফিলিপ লেডাইন Rh  ফ্যাক্টরটি আবিষ্কার করেন। যাদের দেহে এ ফ্যাক্টর বিদ্যমান তাদের রক্তকে বলা হয় Rh (+ve) এবং যাদের দেহে এ ফ্যাক্টরটি থাকে না তাদের রক্তে Rh (-ve) গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একজনের দেহ থেকে রক্ত আরেকজনের দেহে সঞ্চালনের পূর্বে অবশ্যই গ্রুপ ম্যাচিং এবং Rh ফ্যাক্টর মিলিয়ে নিতে হবে।

বিশ্ব প্রতি বছর প্রায় ১০-১১ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান করা হয়, তবে এর মাত্র চল্লিশ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশ থেকে যেখানে ৮০ শতাংশের ওপর মানুষের বসবাস। তাই এখনো বিশ্বের অনেক দেশে রক্তের প্রয়োজন হলেই নির্ভর করতে হয় পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা পেশাদার রক্তদাতার ওপর। বিশ্বের স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হার প্রতি হাজারে ৪৫ জন; বাংলাদেশে এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতি হাজারে মাত্র ৪ জন। বাংলাদেশে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বছরে প্রায় ১৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলেও স্বেচ্ছায় রক্তপ্রাপ্তি অর্ধেকের চেয়েও কম। কিন্ত ১৭ কোটি মানুষের মাত্র ৫ শতাংশ লোক বছরে মাত্র দুইবার রক্ত প্রদান করলেই এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব।

১৮-৬০ বছরের যে কোন সুস্থ ব্যক্তির ওজন যদি ৪৫ কেজির ওপর থাকে তাহলে সে প্রতি চার মাস অন্তর নিয়মিত রক্তদান করতে পারে। আমাদের দেহে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে, যা থেকে এক দশমাংশ অর্থাৎ ২৫০-৪৫০ মিলি. রক্তদানে শরীরের কোন ক্ষতি তো হয়ই না বরং নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে এ রক্তদানের। রক্তদানের ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে, রক্তদাতার অস্থিমজ্জার কার্যকারিতা অনেক গুণে বেড়ে যায় এবং রক্ত স্বল্পতা দূরীভূত হয়। রক্তদাতার রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টরেল ও রক্তচাপ কমে হৃদরোগ ও হার্ট এটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে। রক্ত প্রদানের ফলে অস্থিমজ্জার সক্রিয়তার কারণে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। রক্ত প্রদান করলে যে ক্যালরি খরচ হয় তাতে শরীরের ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

তবে রক্ত দেয়ার পূর্বে দাতার জ্বর, সর্দি-কাশি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ আছে কি না, নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক সেবন ও ইন্সুুলিনের মাধ্যমে চিকিৎসা চলমান থাকলে রক্ত প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। ৬ মাসের মধ্যে কোন বড় অপারেশন হলে বা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রক্ত না দেয়াই ভালো। রক্ত দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোন ভ্যাকসিন নেয়া যাবে না কিংবা পূর্বে রক্ত প্রদান করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস থাকলে রক্ত না দেয়াই শ্রেয়। রক্তের জন্য কোন ওষুধ খেলে বা গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অ্যালকোহল সেবন করলে রক্তদান অনুচিত। রক্ত দানের আগের রাতে ভালো ঘুম দেয়া শরীরের জন্য কল্যাণকর। রক্ত প্রদানের পূর্বে সাধারণত আধা লিটার পানি পান করতে পরামর্শ প্রদান করা হয়ে থাকে। রক্ত প্রদানের পর মাথা ঘুরালে বা কোন রকম অস্বস্তি বোধ করলে, সুস্থ বোধ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন অনেক জীবন বাঁচায়। তাই রক্তের চাহিদা নিরন্তর। প্রতিদিন বিশ্বে রক্তের অভাবে বহু মানুষের প্রাণ গেলেও আমাদের অনেকেরই রক্তদান সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কারও ভুল ধারণা রয়েছে। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যেগের কারণে মানুষের মধ্যে রক্ত প্রদানে সচেতনতা দিন দিন বাড়ছে। আসুন, মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে নিজে রক্ত দেই এবং অন্যকে রক্তদানে উৎসাহিত করি।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

মঙ্গলবার, ১৪ জুন ২০২২ , ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৪ জিলকদ ১৪৪৩

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস

নাজমুল হুদা খান

ভাবুন, একজন মা প্রসবকালীন রক্তক্ষরণে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে; একটি শিশু রক্তশূন্যতাকে জয় করে সুস্থ জীবনের আলো হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে; একজন রোগী রক্ত বা অস্থিমজ্জার রোগের সঙ্গে লড়াই করছে; এক ব্যক্তি আজন্ম হিমোগ্লোবিন স্বল্পতা রোগ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছে কিংবা হাসপাতালের বিছানায় কাতড়াচ্ছে গুরুতর জখম, আগুনে ঝলসানো আমারই মতো একজন মানুষ; অথবা অপারেশনের টেবিলে এক ব্যাগ রক্তের জন্য চিকিৎসক এগুতে পারছে না জীবন বাঁচানোর অপারেশনে। এ সব অসহায় ব্যক্তিবর্গের আপনার আমার কাছে একটাই কাতর আহ্বানÑ এক ব্যাগ রক্ত চাই।

জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে সহজ সহযোগিতার এ হাতটি আমরা ইচ্ছে করলেই বাড়িয়ে দিতে পারি স্বেচ্ছায় এক ব্যাগ রক্তের প্রদানের মাধ্যমে। বিশ্বে সব দেশ, বর্ণ ও জাতির এসব অসহায় মানুষের পাশে সহযোগিতা ও সংহতি প্রদান করতেই - “Donating blood is an act of solidarity. Join the effort and save lives” - এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৪ জুন প্রতি বছরের মতো সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে “বিশ্ব রক্ত দাতা দিবস”। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচাতে যারা স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে নিজের রক্ত দান করছে, তাদের সম্মান ও উৎসাহ প্রদান এবং জনগণকে রক্তদানে উৎসাহ প্রদানই এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য।

রক্ত মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং একমাত্র পরিবহন মাধ্যম। এটি শরীরের রক্তনালী ও শিরার মাধ্যমে দেহের প্রতিটি কোষে খাবার ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিভিন্ন প্রকার কার্যক্রমকে সচল রাখতে বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোন পৌঁছে দেয়ার কাজটি করে থাকে নিরবে। দেহের বর্জ্য পদার্থকে বের করে দেয়া, দেহের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা, রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ, দেহের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষাসহ শত মহাকর্মযজ্ঞ পালন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এ রক্ত। এ রক্ত আমাদের দেহে ২৪ ঘণ্টায় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয় ১২ হাজার মাইল বিস্তৃত রক্তনালী ও শিরার মাধ্যমে। এ সময়ে প্রায় আট হাজার গ্যালন রক্ত সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে আমাদের একমাত্র হৃদ্পিণ্ড। মানবদেহের এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের ঘাটতি দেখা দিলেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে প্রাননাশের কারন হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন অসুখ বিসুখ ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে রক্তের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। বড় ধরনের অপারেশন, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, নবজাতকের রক্তশূন্যতা বা রক্ত রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা, অগ্নিদগ্ধ রোগীর ব্যবস্থাপনায়, রক্তস্বল্পতা রোগীর চিকিৎসা, থ্যালাসেমিয়া বা হেমোফিলিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় রক্তের ব্যবহার অত্যাবশ্যক।

রক্ত এমন একটি উপাদান, যা এখনো পর্যন্ত কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা যায়নি বা অন্য কোন প্রাণীর রক্ত মানুষের শরীরে ব্যবহার করা যায় না। একজন মানুষের দেহের রক্তই শুধু অন্য একজনের শরীরে ব্যবহার করা যায়। তবে চাইলেই একজন মানুষের রক্ত আরেকজনের শরীরে সঞ্চালন করা যাবে না। তার কারণ মানুষের রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। রক্তের লোহিত কনিকা এবং রক্তরসে রাসায়নিক উপাদানগত কিছু তারতম্য রয়েছে। রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ বিদ্যমান, তবে রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে A, B, AB, O এবং Rh ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। এসব আবিষ্কারে ভূমিকা রাখেন তিনজন বিজ্ঞানী। ১৯৬৮ সালেই ১৪ জুন জন্ম নেয়া অস্ট্রীয় জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসক কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার রক্তের মূল গ্রুপ ‘এ’, ‘বি’, এবং ‘ও’ আবিষ্কার করেন এবং প্রমাণ করেন যে, একই গ্রুপ থেকে রক্ত একে অপরের দেহে সঞ্চালনে কোন ক্ষতি নেই। এরপর তারই দুই সহযোগী আলফ্রেড ডন এবং আদ্রিয়ানো ‘এবি’ গ্রুপটি শনাক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪১ সালে বিজ্ঞানী ফিলিপ লেডাইন Rh  ফ্যাক্টরটি আবিষ্কার করেন। যাদের দেহে এ ফ্যাক্টর বিদ্যমান তাদের রক্তকে বলা হয় Rh (+ve) এবং যাদের দেহে এ ফ্যাক্টরটি থাকে না তাদের রক্তে Rh (-ve) গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একজনের দেহ থেকে রক্ত আরেকজনের দেহে সঞ্চালনের পূর্বে অবশ্যই গ্রুপ ম্যাচিং এবং Rh ফ্যাক্টর মিলিয়ে নিতে হবে।

বিশ্ব প্রতি বছর প্রায় ১০-১১ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান করা হয়, তবে এর মাত্র চল্লিশ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশ থেকে যেখানে ৮০ শতাংশের ওপর মানুষের বসবাস। তাই এখনো বিশ্বের অনেক দেশে রক্তের প্রয়োজন হলেই নির্ভর করতে হয় পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা পেশাদার রক্তদাতার ওপর। বিশ্বের স্বেচ্ছায় রক্তদাতার হার প্রতি হাজারে ৪৫ জন; বাংলাদেশে এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতি হাজারে মাত্র ৪ জন। বাংলাদেশে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বছরে প্রায় ১৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলেও স্বেচ্ছায় রক্তপ্রাপ্তি অর্ধেকের চেয়েও কম। কিন্ত ১৭ কোটি মানুষের মাত্র ৫ শতাংশ লোক বছরে মাত্র দুইবার রক্ত প্রদান করলেই এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব।

১৮-৬০ বছরের যে কোন সুস্থ ব্যক্তির ওজন যদি ৪৫ কেজির ওপর থাকে তাহলে সে প্রতি চার মাস অন্তর নিয়মিত রক্তদান করতে পারে। আমাদের দেহে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে, যা থেকে এক দশমাংশ অর্থাৎ ২৫০-৪৫০ মিলি. রক্তদানে শরীরের কোন ক্ষতি তো হয়ই না বরং নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে এ রক্তদানের। রক্তদানের ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে, রক্তদাতার অস্থিমজ্জার কার্যকারিতা অনেক গুণে বেড়ে যায় এবং রক্ত স্বল্পতা দূরীভূত হয়। রক্তদাতার রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টরেল ও রক্তচাপ কমে হৃদরোগ ও হার্ট এটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে। রক্ত প্রদানের ফলে অস্থিমজ্জার সক্রিয়তার কারণে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। রক্ত প্রদান করলে যে ক্যালরি খরচ হয় তাতে শরীরের ওজন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

তবে রক্ত দেয়ার পূর্বে দাতার জ্বর, সর্দি-কাশি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ আছে কি না, নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক সেবন ও ইন্সুুলিনের মাধ্যমে চিকিৎসা চলমান থাকলে রক্ত প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। ৬ মাসের মধ্যে কোন বড় অপারেশন হলে বা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রক্ত না দেয়াই ভালো। রক্ত দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোন ভ্যাকসিন নেয়া যাবে না কিংবা পূর্বে রক্ত প্রদান করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস থাকলে রক্ত না দেয়াই শ্রেয়। রক্তের জন্য কোন ওষুধ খেলে বা গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অ্যালকোহল সেবন করলে রক্তদান অনুচিত। রক্ত দানের আগের রাতে ভালো ঘুম দেয়া শরীরের জন্য কল্যাণকর। রক্ত প্রদানের পূর্বে সাধারণত আধা লিটার পানি পান করতে পরামর্শ প্রদান করা হয়ে থাকে। রক্ত প্রদানের পর মাথা ঘুরালে বা কোন রকম অস্বস্তি বোধ করলে, সুস্থ বোধ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন অনেক জীবন বাঁচায়। তাই রক্তের চাহিদা নিরন্তর। প্রতিদিন বিশ্বে রক্তের অভাবে বহু মানুষের প্রাণ গেলেও আমাদের অনেকেরই রক্তদান সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কারও ভুল ধারণা রয়েছে। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যেগের কারণে মানুষের মধ্যে রক্ত প্রদানে সচেতনতা দিন দিন বাড়ছে। আসুন, মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে নিজে রক্ত দেই এবং অন্যকে রক্তদানে উৎসাহিত করি।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]