কুমিল্লা সিটি নির্বাচন

দলের বিভেদ এবং অন্যান্য সমীকরণ

গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা পরাজিত হলেও তৃতীয় দফায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়াতে চায় আওয়ামী লীগ। তবে তাতে প্রধান বাধা দলের বিভেদ।

আর গত ১৭ বছর ধরে কুমিল্লা শহরে ক্ষমতায় আছেন বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু। প্রথম দুই দফা পৌরসভা ও পরে দু’বার সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সাক্কু। তবে এবার পরিস্থিতি তার জন্য একটু ভিন্ন, সে কথা সাক্কু নিজেও স্বীকার করছেন।

কুমিল্লা আওয়ামী লীগে দুই বড় নেতা প্রয়াত আফজল খান ও বাহার উদ্দিন বাহারের বিরোধ দীর্ঘদিনের এবং সর্বজনবিদিত। আর এই বিরোধের সুবিধায় ২০১২ সালের কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আফজল খানকে পরাজিত করে মেয়র পদে জয়লাভ করে মনিরুল হক সাক্কু। পরে ২০১৭ সালের দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনে আফজল খানের মেয়ে আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে পরাজিত করে পুনরায় মেয়র হন সাক্কু। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, দলীয় কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের কারণে বিগত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে।

তবে ক্ষমতাসীন দলের বিভেদে যার বা যেই পক্ষের আশীর্বাদ সাক্কু এতদিন পেয়েছেন বলে প্রচার আছে, এবার আওয়ামী লীগের সেই বড় নেতার আনুসারীই মেয়র প্রার্থী। তাই পরিস্থিতি আগের নির্বাচনগুলোর মতো নেই বলেই বলছেন সাক্কু।

‘এবার পরিস্থিতি অবশ্যই ভিন্ন। তাদের (কুমিল্লা আওয়ামী লীগ) মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ আছে এটার জন্য তো আমি দায়ী না। এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। গত নির্বাচনে আফজল খানের মেয়ে সীমা প্রার্থী ছিলেন। এখন বাহার ভাই আমার পক্ষে না থাকলেও মানুষ বলে তিনি আমার পক্ষে ছিলেন, এটা তো আমি অস্বীকার করতে পারব না। এবারের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বাহার ভাইয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ লোক। তিনি প্রার্থীর জন্য কাজ করছেন। তাই পরিস্থিতির তো কিছুটা পরিবর্তন হয়েছেই’ এক সাক্ষাতকারে বলেছেন সাক্কু।

এবার নির্বাচন করতে গিয়ে সাক্কু তার দল বিএনপি থেকে হয়েছেন আজীবনের জন্য বহিষ্কার। আর তার দলেরই আরেকজন কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার মেয়র প্রার্থী। তবে তাকেও বিএনপি বহিষ্কার করেছে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রচারণায় অংশ না নিতে ‘কঠোর’ নির্দেশনা দিয়েছে। তবে সে নিষেধ অনেকেই শুনছেন না। তারা বিভক্ত হয়েই সাবেক দুই বিএনপি নেতার পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, কুমিল্লায় বিএনপি’র রাজনীতিতে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন-উর রশীদ ইয়াছিনের সঙ্গে সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কুর বিরোধ রয়েছে। আমিন-উর রশীদ ইয়াছিনের শ্যালক নিজাম উদ্দিন কায়সার। তাই সাক্কুকে এবার আওয়ামী লীগের মতোই দলের ভোটের বিভেদ দেখতে হচ্ছে।

এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে ১৪ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। পরে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাতকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয় ক্ষমতাসীন দল। পরবর্তীতে মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিনে এসে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়ন দাখিল করেন প্রয়াত আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন ইমরান।

প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা না করলেও গত ১০ জুন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় মনোনয়ন বঞ্চিতদের কেউই নামেননি। পরে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে গত শনিবার থেকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান কেউ কেউ। তবে তাতে বিরোধ কতটা মিটেছে তা নিয়ে সন্দীহান খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই।

তবে নিজের অনুসারীর জয় অবশ্যই দেখতে চান কুমিল্লা নগরের সংসদ সদস্য বাহার। তা করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। এর প্রেক্ষিতে ওই এমপিকে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করে আচরণ বিধি প্রতিপালনের জন্য পত্রের মাধ্যমে অনুরোধ করে নির্বাচন কমিশন। এরপর সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে এলাকায় অবস্থান প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হলে আদালত নির্বাচন কমিশনের কাছে ব্যাখা চায়। এমন অবস্থায় ওই এমপি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ না করলেও নিজ বাসায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের তুলনায় দ্বিতীয়টিতে সাক্কুর জয়ের ব্যবধান কমেছে। প্রথম নির্বাচনে ভোট হয়েছিল ইভিএমে। আর গত নির্বাচনে ভোট হয়েছিল ব্যালটে। সাক্কুর অভিযোগ গত নির্বাচনে ১২টার পর অনেকগুলো কেন্দ্র প্রতিপক্ষ দখল করে নিয়েছিল। যার কারণে তার ভাষ্য ভোটের ব্যবধান কমেছে।

এবারের নির্বাচনে এসব সমীকরণ এবং দুই দলের এই বিরোধই জয়-পরাজয়ে মূল ভূমিকা রাখবে কিনা তা জানা যাবে আজ রাতে।

বুধবার, ১৫ জুন ২০২২ , ১ আষাড় ১৪২৮ ১৫ জিলকদ ১৪৪৩

কুমিল্লা সিটি নির্বাচন

দলের বিভেদ এবং অন্যান্য সমীকরণ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা পরাজিত হলেও তৃতীয় দফায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়াতে চায় আওয়ামী লীগ। তবে তাতে প্রধান বাধা দলের বিভেদ।

আর গত ১৭ বছর ধরে কুমিল্লা শহরে ক্ষমতায় আছেন বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু। প্রথম দুই দফা পৌরসভা ও পরে দু’বার সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সাক্কু। তবে এবার পরিস্থিতি তার জন্য একটু ভিন্ন, সে কথা সাক্কু নিজেও স্বীকার করছেন।

কুমিল্লা আওয়ামী লীগে দুই বড় নেতা প্রয়াত আফজল খান ও বাহার উদ্দিন বাহারের বিরোধ দীর্ঘদিনের এবং সর্বজনবিদিত। আর এই বিরোধের সুবিধায় ২০১২ সালের কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আফজল খানকে পরাজিত করে মেয়র পদে জয়লাভ করে মনিরুল হক সাক্কু। পরে ২০১৭ সালের দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনে আফজল খানের মেয়ে আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে পরাজিত করে পুনরায় মেয়র হন সাক্কু। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, দলীয় কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের কারণে বিগত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে।

তবে ক্ষমতাসীন দলের বিভেদে যার বা যেই পক্ষের আশীর্বাদ সাক্কু এতদিন পেয়েছেন বলে প্রচার আছে, এবার আওয়ামী লীগের সেই বড় নেতার আনুসারীই মেয়র প্রার্থী। তাই পরিস্থিতি আগের নির্বাচনগুলোর মতো নেই বলেই বলছেন সাক্কু।

‘এবার পরিস্থিতি অবশ্যই ভিন্ন। তাদের (কুমিল্লা আওয়ামী লীগ) মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ আছে এটার জন্য তো আমি দায়ী না। এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। গত নির্বাচনে আফজল খানের মেয়ে সীমা প্রার্থী ছিলেন। এখন বাহার ভাই আমার পক্ষে না থাকলেও মানুষ বলে তিনি আমার পক্ষে ছিলেন, এটা তো আমি অস্বীকার করতে পারব না। এবারের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বাহার ভাইয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ লোক। তিনি প্রার্থীর জন্য কাজ করছেন। তাই পরিস্থিতির তো কিছুটা পরিবর্তন হয়েছেই’ এক সাক্ষাতকারে বলেছেন সাক্কু।

এবার নির্বাচন করতে গিয়ে সাক্কু তার দল বিএনপি থেকে হয়েছেন আজীবনের জন্য বহিষ্কার। আর তার দলেরই আরেকজন কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার মেয়র প্রার্থী। তবে তাকেও বিএনপি বহিষ্কার করেছে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রচারণায় অংশ না নিতে ‘কঠোর’ নির্দেশনা দিয়েছে। তবে সে নিষেধ অনেকেই শুনছেন না। তারা বিভক্ত হয়েই সাবেক দুই বিএনপি নেতার পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, কুমিল্লায় বিএনপি’র রাজনীতিতে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন-উর রশীদ ইয়াছিনের সঙ্গে সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কুর বিরোধ রয়েছে। আমিন-উর রশীদ ইয়াছিনের শ্যালক নিজাম উদ্দিন কায়সার। তাই সাক্কুকে এবার আওয়ামী লীগের মতোই দলের ভোটের বিভেদ দেখতে হচ্ছে।

এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে ১৪ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। পরে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাতকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয় ক্ষমতাসীন দল। পরবর্তীতে মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিনে এসে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়ন দাখিল করেন প্রয়াত আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন ইমরান।

প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা না করলেও গত ১০ জুন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় মনোনয়ন বঞ্চিতদের কেউই নামেননি। পরে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে গত শনিবার থেকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান কেউ কেউ। তবে তাতে বিরোধ কতটা মিটেছে তা নিয়ে সন্দীহান খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই।

তবে নিজের অনুসারীর জয় অবশ্যই দেখতে চান কুমিল্লা নগরের সংসদ সদস্য বাহার। তা করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। এর প্রেক্ষিতে ওই এমপিকে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করে আচরণ বিধি প্রতিপালনের জন্য পত্রের মাধ্যমে অনুরোধ করে নির্বাচন কমিশন। এরপর সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে এলাকায় অবস্থান প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হলে আদালত নির্বাচন কমিশনের কাছে ব্যাখা চায়। এমন অবস্থায় ওই এমপি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ না করলেও নিজ বাসায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের তুলনায় দ্বিতীয়টিতে সাক্কুর জয়ের ব্যবধান কমেছে। প্রথম নির্বাচনে ভোট হয়েছিল ইভিএমে। আর গত নির্বাচনে ভোট হয়েছিল ব্যালটে। সাক্কুর অভিযোগ গত নির্বাচনে ১২টার পর অনেকগুলো কেন্দ্র প্রতিপক্ষ দখল করে নিয়েছিল। যার কারণে তার ভাষ্য ভোটের ব্যবধান কমেছে।

এবারের নির্বাচনে এসব সমীকরণ এবং দুই দলের এই বিরোধই জয়-পরাজয়ে মূল ভূমিকা রাখবে কিনা তা জানা যাবে আজ রাতে।